তুমি অতঃপর তুমিই
৩৬
অন্তিম পর্ব( শেষ অংশ)
Taniya Sheikh
সামিরা প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছে হাসপাতালে। দু-চোখে অসহায়ত্ব। তৃষ্ণায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হলেও সহজে পানি মেলে না। আপনজন আসে না তাকে দেখতে। বার বার ইমার বলা কথা মনে পড়ে। হ্যাঁ, সে এখন মৃত্যু চায়। মৃত্যুর জন্য আকুতি জানিয়ে গোঙায়। মৃত্যু আসে না। সামিরার বিরুদ্ধে খুন,কিডন্যাপ,ড্রাগ বহনসহ আরও কিছু মামলা হয়েছে। অচিরেই তার স্থান হবে অন্ধকার কারাগারে।
তিনদিন পরে হাসপাতালের বেডে নিজেকে আবিষ্কার করল ইমা। শরীরে এখনো শক্তি কম,ব্যথাও রয়েছে। বিশেষ করে তলপেটের কাছে ভীষণ ব্যথা অনুভব করে ইমা। পেটে হাত বুলিয়ে বুঝতে পারে ওর সন্তান সেখানে নেই৷ গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে। বাইরে থেকে দৌড়ে আসে শান,ইমরোজ, নুসরাত এবং আমেনা বেগম।
” শান আমাদের বাচ্চা। এবারও আমি পারলাম না ওকে ধরে রাখতে।” ইমার শিওরে বসে ওকে বুকে টেনে নেয় শান। ইমা ফুপিয়ে কাঁদে। শান ওর মুখটা দু’হাতে তুলে সামনে চোখ ঘুরিয়ে বলে,
” ঐ দেখো।”
ইমা সেদিকে তাকিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে হেসে চেঁচিয়ে ওঠে,
” আমাদের সন্তান!” শানের দিকে ফিরে তাকাতেই শান ওর কপালে চুমু দিয়ে বলে,
” হ্যাঁ, আমাদের সন্তান।” ইমাকে সবাই সবটা খুলে বলে। খুবই নাজুক অবস্থায় ইমাকে খান প্যালেসের বেসমেন্ট থেকে উদ্ধার করা হয়। হাসপাতালে ভর্তি করালে ওর অবস্থা বিচার করে সিজার করা হয়। জন্ম হয় প্রিম্যাচ্যুর ছেলে বাচ্চা৷ শানের সাহায্যে ইমা বাচ্চার কাছে যায়। ওর খুব ইচ্ছে করে বাচ্চাটাকে কোলে নেওয়ার কিন্তু সেখানে বাধা। নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে বাচ্চাটাকে। একটা নির্দিষ্ট সময় বাদে বাচ্চাটা ওর কোলে আসবে। ইমা শানের বুকে মাথা রেখে বলে,
” আমাদের ছেলে, আপনি খুশিতো শান?”
” তুমি আমায় যা দিয়েছ তা পেয়ে আমার জীবন ধন্য ইমা। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করব না তুমি খুশি কি’না! আমি তোমাকে খুশি রাখার সর্বোত্তম চেষ্টা করব।” ইমার কপালে চুমু দিয়ে কোলে তুলে নেয়। বেডে শুইয়ে দিতেই বাকিরা বাইরে বের হয়ে যায়। শান ইমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ ওর হাতটা টেনে বুকে লুকিয়ে কাঁদে ইমা। শানের কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা,
” কী হয়েছে ইমা? খারাপ লাগছে? ডাক্তার!”
” এই, চুপ।” একহাতে শানের মুখে হাত রেখে কান্নাসিক্ত চোখে চেয়ে বলে,
” জানেন, আমি সেদিন কী পরিমান ভয় পেয়েছিলাম! ভেবেছিলাম আর মনে হয় আমাদের দেখা হবে না। তারপর ও যখন বলল,ও আপনাকে মেরে ফেলবে,,” কান্নার তোড়ে কথা বলতে পারেনা ইমা। শান কাছে টেনে ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয় ইমাকে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয় ইমা। শান ওর চুলগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে বলে,
” আমি সেদিন খান প্যালেসের দক্ষিণ দিক থেকে খান প্যালেসের কাছাকাছি যেতেই বজলুকে দেখলাম। রক্তাক্ত অবস্থায় সে বেরিয়েছে। দৌড়ে গেলাম গেটের সামনে। পুলিশ আমাকে ধরে ফেলল। আমার ব্রেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল ইমা। কী করব বুঝতে না পেরে তোমার নাম ধরে চিৎকার করতে লাগলাম। পুলিশদের অনুরোধ করলাম,বুঝালাম কিন্তু ওরা বুঝল না। বজলু ওদের জানায় কিভাবে ওরা তোমাকে আমার বাসা থেকে কিডন্যাপ করে এখানে নিয়ে আসে। তারপর তোমার উপর করা সামিরার অত্যাচার বর্ণনা। বজলুর ভেতর মানবতাবোধ জেগে ওঠায় এবং পূর্ব রাগে সামিরাকে সে আঘাত করে ফেলে এসেছে। আমি তোমার কাছে যেতে চাইলাম। গাড়ির সাথে হ্যান্ডকাফ বেঁধে আমাকে রেখে ওরা নিচে নেমে গেল। বিশ্বাস করো, এতোটা অসহায়বোধ আমি কোনোদিন করিনি যতটা ঐদিন করেছিলাম। মানুষের সময় কিভাবে বদলে যায় সেটাই আমাকে বিস্মিত করছিল। ওরা যখন বের হলো পেছনে তোমাকে নিয়ে আসছিল। মড়ার মতো একজনের কোলে পড়েছিলে তুমি। আমাকে ছুঁতেও দিল না। একদিন পর আমি, ইমরোজ ছাড়া পেলাম। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে আমরা নির্দোষ প্রমাণিত হলাম। এসে তোমাকে এই অবস্থায় পেয়ে আমি যেন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার সিজার হলো,আমাদের ছেলে সময়ের আগেই আমাদের কাছে চলে এলো,আর এখন তুমি আমার সেই তুমি- যাকে ছাড়া আমার এক মুহূর্ত বিস্বাদ, বিবর্ণ।”
ইমা সুস্থ হলে জেলখানায় গিয়ে বজলুর সাথে দেখা করে আসে। বজলু কথা বলে না। ইমা পুলিশকে সত্যিটা জানাবে বলতেই বজলু ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।হাত জোর করে বলে,
” আপা গো, পাপ তো অনেক করলাম এবার না হয় একটু প্রায়শ্চিত্ত করি! আমার পোলাডার সামনে পশু নয় মানুষ হইয়্যা দাঁড়ায়বার চাই। আমারে ভালো হইবার একটা সুযোগ দ্যান গো আপা!”
শান,ইমরোজের অনুরোধে ইমা সত্যিটা গোপন করলেও মনে শান্তি পায় না। শেষে ইমরোজ ওকে বোঝায়। বলে, সে তো ইচ্ছে করে আর আঘাত করেনি সামিরাকে। বরং নিজেকে বাঁচাতে প্রতিঘাত করেছে। আঘাতে পাপ হয় কিন্তু প্রতিঘাতে পাপ হয়না।
মাসখানেক বাদে ইমা সুস্থ অবস্থায় বাসায় ফেরে। শান এক সেকেন্ডও ওকে চোখের আড়াল করছে না। ওদের বাচ্চাটাও এখন অনেকটা সুস্থ। ফুলটাইম একজন ন্যানি রাখা হয়েছে। মায়ের বয়সী ন্যানি ইমাকে মেয়ের মতোই আদর যত্ন করছে সাথে বাচ্চাটাকেও সামলায়। ইমার ইচ্ছে হয় সর্বক্ষণ বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে কিন্তু এখনো সে এবং বাচ্চা ততটা সুস্থ নয়৷ কাঙ্ক্ষিত সময়ের অপেক্ষায় মা-ছেলে এই সময়টা অবহেলা করেনা। যা পাই কুড়িয়ে নেয় ভালোবেসে। সুখ ধরা দেয় অবশেষে ওদের কাছে।
ইমরোজের আকদে ইমা থাকতে পারেনি। বিয়ের দিন একবারে দেখল বর -কনেকে। বিয়ের সাজে চমৎকার লাগছে রাত্রিকে। ওরা একসাথে ছবি তুললো। আনন্দ করল। রাতে শান-ইমা ওদের বাসায় রয়ে গেল। রাত্রি বাসর ঘরে চুপচাপ বসে আছে। অদ্ভুত এক অনুভূতি ঘিরে ধরেছে ওকে। আকদের পর থেকে ইমরোজকে চিনেছে। মানুষটাকে যা ভেবেছিল তা নয়। যথেষ্ট কেয়ারিং। আকদে ওর পক্ষ নিয়ে ওর কাজিনদের কথা শুনিয়েছিল ইমরোজ। এরপর সাহস করে কোনো কাজিনই ওকে ছোটো করতে আসেনি। রাত্রি নিজের অজান্তেই ইমরোজকে ভালোবেসে ফেলে। ভালোবাসে! কথাটা ভাবতেই কেমন যেন ভালো লাগা কাজ করে। দরজায় শব্দ হতেই চোখ তুলে তাকায়। ইমরোজ ঢুকেছে ঘরে। রাত্রি লজ্জায় বসে রইল মুখ নামিয়ে। বুক ঢিপঢিপ করছে। এভাবে অনেকক্ষণ বসে থেকেও যখন ইমরোজ এলো না রাত্রি চোখ তুলে সামনে তাকায়,তারপর পুরো রুমে৷ কোথাও ইমরোজ নেই। কান্না আসে খুব। অভিমানে গাল ফুলিয়ে ফ্লোরে নেমে শোয়। মধ্য রাতে কারো হাতের স্পর্শে চোখ মেলে। ইমরোজ ওর কপালে হাত রেখে ডাকছে।
” এখানে ঘুমিয়েছ কেন?”
হাত সরিয়ে উঠে বসে রাত্রি,কিন্তু কোনো জবাব দিল না। ইমরোজ ওর হাত ধরতেই রক্তিম চোখে তাকায়। সহসা বাঁধ ভাঙা জলের মতো চোখের কোনা ভরে ওঠে নোনাপানিতে। হাত সরিয়ে নিতে চায়। ইমরোজ ছাড়ে না। শক্ত করে ধরে রাখে হাতটা। রাত্রি অভিমানে বলে,
” গায়ে পড়া মেয়েদের হাত ধরেছেন কেন? পাপ হবে না আপনার। ছাড়ুন।”
বুকে জড়িয়ে ধরে ইমরোজ রাত্রিকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
” আমাকে ক্ষমা করো রাত্রি।”
রাত্রি কাঁদে, কোনো কথা বলে না। ইমরোজ ওর মুখটা দু’হাতে তুলে বলে,
” আজ সব পিছুটান ভুলে তোমার হব আমি। তোমাকে যা কষ্ট দিয়েছি তার বহুগুণ ভালোবাসা দেবো। ওয়াদা করল স্ত্রীর কাছে এই স্বামী। আমার যা ছিল,আছে, থাকবে সব তোমাকে নিয়েই। তুমিময় হব আমি আজ থেকে।” রাত্রির গালে উঞ্চতা ছড়িয়ে কোলে তুলে নেয়। এগোতে থাকে ফুলসজ্জার বিছানায়। অতীত আঁকড়ে নয় বরং অতীত স্মৃতি নিয়ে বর্তমানকে আঁকড়ে বাঁচতে চায় ইমরোজ। এই রাত ভোর করতে চায় নতুন আলোয়। যে আলোতে তেজ থাকবে, প্রশান্তি থাকবে, পরিশেষে ভালোবাসাময় হবে।
ইমার ছেলের নামকরণ করা হয়- ইশয়াত ইহান খান। ছেলের আকিকা অনুষ্ঠানে আত্মীয় স্বজনরা সবাই আসে আশুলিয়া, শানের খামার বাড়িতে। শানের এক দূরসম্পর্কের চাচা আবদুল আজিজ। মানুষটার আপন বলতে আর কেউ নেই। খামার বাড়ির উত্তর দিকে তারই পরামর্শে মসজিদ তৈরি করেছে শান। আবদুল আজিজ চাচা সেখানে ইমামতি করেন, ওরা ডাকে ইমাম চাচা। জায়গাটা নির্জন বলেই অনেকে ভয় পায়। তবে সৎ,ধার্মিক লোক আল্লাহ তাআ’লা ছাড়া ভিন্ন কাওকে ভয় করে না। মসজিদের বাইরে খুব একটা যান না আবদুল আজিজ চাচা। আজ এসেছেন নাতির আকিকায়। নিজ হাতে গোরু,ছাগল জবেহ করে লোক লাগিয়ে রান্না করান। এতিমখানায় খাবার পাঠান হবে, আগত মেহমানদের আপ্যায়ন করানো হবে। ইমা,শানকে আজ কেউ কিছু করতে দেয়না। ওরা ছেলেকে নিয়ে বসে আছে সবার মধ্যমণি হয়ে। আসমা নতুন নতুন কাঁথা সেলাই করেছে ইশয়াতের জন্য। ইমার খালা নাতির জন্য নতুন কাপড়,খেলনা আরও কত কি এনেছে। আনন্দ যেন ধরছে না তাদের। ছেলেকে খালার কোলে দিয়ে মায়ের কথা মনে পড়ল ইমার। শান বুঝতে পেরে ইশারায় হাসতে বলে। ইমা চোখে জল নিয়ে হাসে।
বাইরের সবকিছু মোবারক,ইমরোজ,ইমাম চাচা তদারকি করছে। খাবারের বিরাট একটা অংশ যাবে গরিবদের মাঝে। সেগুলোই প্যাকেটিং করতে লেগে পড়ে সবাই। নিজ হাতে কিছু দেওয়ার আনন্দ কতখানি! এই মুহূর্তে প্রত্যেকে উপলব্ধি করে। ইমা, শানও তাই প্যাকেটিংএ হাত দেয়। সবার সাথে আনন্দ ভাগ করে নেয় ওরা। ইশয়াত ন্যানির কোলে শুয়ে শুয়ে সবকিছু দেখছে। নতুন পৃথিবী, নতুন মানুষ।
ইমার মামা বাড়ি থেকে সবাই এসেছে। দুয়া করে গেল এই দম্পতি এবং তাদের কলিজার টুকরার জন্য। নুসরাতের এক মেয়ে হয়েছে। ইমা বান্ধবীকে এতোদিন পর কাছে পেয়ে খুব খুশি। সবাই মিলে হাসি ঠাট্টা করে সময় পার করে। হঠাৎ নুসরাত বলে ওঠে,
” জিজু, আপনি তো ইতিহাস করে ফেলেছেন। আপনাকে তো এওয়ার্ড দেওয়া উচিত।”
সবার দৃষ্টি শানের দিকে। শান অপ্রস্তুতভাবে হাসে। ইমা নুসরাতের দিকে কৌতূহলে তাকালে নুসরাত হাসে। ইমা চোখ ছোটো করে তাকায়। পাশ থেকে ইমরোজ মুচকি হেসে বলে,
” যদিও আমি জানি আমার বন্ধু সেরার সেরা। তার তুলনা কেবল সেই। পৃথিবীর সব এওয়ার্ড পাবারও যোগ্য সে। তবুও জানতে চাই এক্সাক্টলি তার কোন কাজটার জন্য তুমি তাকে এওয়ার্ড দেওয়ার কথা ভাবছ, নুসরাত?” শান চোখ পাকাতেই ইমরোজ এক চোখ টিপে হাসে। ইশারায় শান বলে,” শালা,তোকে দেখে নেবো আমি।” ইমরোজ ইমার দিকে ইশারা করতেই শান চোখ বড়ো করে। তা দেখে হাসতে লাগল ইমরোজ,বলে,
” আমি মনে হয় বুঝেছি নুসরাতের কথা!” শান সহ সবাই ভ্রুকুটি করে তাকায় ওর দিকে। পাশে বসা রাত্রি চাপাস্বরে বলে,
” কী বুঝেছ?”
” বললে কী দিবা?” ইমরোজ পাল্টা প্রশ্ন করলে রাত্রি ঠোঁট উল্টে বলে,
” তুমি সবসময় কী দিবা,কী দিবা করো কেন?”
” তোমার থেকে সবসময় পেতে ভালো লাগে তাই!”
” ইশশ! নাটক। বলো না কী বুঝেছ?”
” বললে কী তুমিও আমাকে এওয়ার্ডে মনোনীত হবার সুযোগ দিবা?”
ইমরোজের চোখে দুষ্টুমি লক্ষ্য করে রাত্রি লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। সবার অগোচরে ইমরোজের পেটে চিমটি দিতেই সেটা আর অগোচরে থাকে না। আহ! করে উঠতেই সবাই ফের ওর দিকে তাকায়। নুসরাত হেসে বলে,
” আপনারা দুই বন্ধু বউ পেয়েছেন অনন্য। টক,মিষ্টি, ঝাল। ”
রাত্রি লজ্জায় মুখ লুকায় ইমরোজের পেছনে। আলতো করে পিঠ কামড়ে বলে,
” এতো জোরে কেউ আহ! বলে?”
ইমরোজ আবার আহ! করতে গেলে রাত্রি পেছন থেকে শার্ট খামচে ধরে,
” এই না!”
ইমরোজ হাসে মুচকি, মুচকি। ইমা নুসরাতের গায়ে খোঁচা দিয়ে বলে,
” তুই কী শুরু করলি?”
” কী!”
” মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে।”
” মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে, তুই পাচ্ছিস না?” ইমা নিজেও লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিয়েছে। নুসরাত ওর গলা ধরে বলে,
” শান জিজু, ধন্যবাদ আমার এই গুণ্ডি বান্ধবীকে বউ বানিয়ে সংসারি করার জন্য। যারা একদিন ভাবত ইমার দ্বারা সংসার হবে না, আজ চোখ বড়ো বড়ো করে দেখুক তারা- আমার ইমা সংসার করছে। একটা ফুটফুটে রাজপুত্রের মা হয়েছে সে। যে সুখ থেকে বঞ্চিত ছিল আল্লাহ পাক সবই আজ দিয়েছে ওকে আপনার মাধ্যমে। পৃথিবীর সেরা জিজু আপনি।” ইমা বান্ধবীর মুখের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
” আর তুই আমার বিশ্বসেরা বান্ধবী। আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি তোকে তাই না?”
ইমার চোখ মুছিয়ে নুসরাত হাসে। ইমাও ওর চোখ মুছিয়ে দিতেই নুসরাত বলে,
” একদম কাঁদাবি না আজ। আজ শুধু আনন্দের দিন,তাই না বাবা?” ছোট্ট ইশয়াত হাত পা নাড়িয়ে হাসে নুসরাতের কোলে গিয়ে। নুসরাত বাবুকে নিয়ে আদর করে। ওর মেয়েটাও মায়ের পাশে বসে ইশয়াতের ছোট্ট তুলতুলে হাতটা ধরে খেলা করে। ইমা বিমুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখে ছেলের হাসিমুখ। আর ইমার মুখটা দেখে মনপ্রাণ জুড়ায় শান। দু’জনের চোখাচোখি হতেই ওরা মুচকি হাসে। দিনটা সবাই স্মরণীয় করে রাখে আনন্দে,আড্ডায়।পরদিন সবাই চলে যায় ঢাকা।
ন্যানি শান-ইমাকে আজ শেখায় কিভাবে বাচ্চাকে গোসল করাতে হয়। খুব ইনজয় করে ওরা। ছেলেকে গোসল করিয়ে গা মুছিয়ে ব্যালকনির রোদে বসে। ন্যানি নিজের রুমে চলে যায়। ব্যালকনি থেকে এনে বিছানায় শুইয়ে দিতেই ইশয়াত কান্না জুড়ে দেয়। শান ছেলেকে চোখের তারায় বসিয়েছে। ছেলে কাঁদলেই চেঁচিয়ে ওঠে। ইমা বিরক্ত হয়। বলে,
” ছোটো বাচ্চা কাঁদবে না?
” না,আমার ছেলে একটুও কাঁদবে না। ও শুধু হাসবে।”
ছেলের কান্না থামিয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে ইমা বলে,
” আদিখ্যেতা!” মুখ ভেংচি দিতেই ইমার ঠোঁট টিপে ধরে নিজের দখলে নিয়ে নেয়। জড়িয়ে ধরে কানে আলতো চুমু দিয়ে শান বলে,
” একটা মেয়ের খুব শখ আমার, বউ।”
” তুমি আমাকে মারতে চাও?” শানকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দেয়৷ শান ভ্রুতুলে বলে,
” মানে কি! আমি তো জাস্ট ইচ্ছের কথা বলেছি। দিনদিন কেমন কাঠখোট্টা টাইপ হয়ে যাচ্ছ। একদম আনরোমান্টিক।”
” হ্যাঁ, এখন তো বলবাই এসব। আমি জানি তো তোমার মনে কী চলে।”
” কী চলে?” শান চোখ ছোটো করে।
” আরেকটা বিয়ে করতে চাও তুমি। আমি তো পুরোনো হয়ে গেছি। এখন তো আমাকে আর ভালো লাগবে না।”
” হুমম।” শান ভাবুক হতেই ইমা ওর কলার টেনে ধরে, বলে,
” হুমম,কী? ভুলেও যদি এসব চিন্তা মাথায় এনেছিস খুন করে ফেলব। চিনিস তো আমাকে!”
” তুই একটা গুণ্ডিমার্কা বউ আমার। যাকে আমি অনেক ভালোবাসি। যার স্থানে কেউ আসবে না কোনোদিন।”
” তুমি তুই বললে কেন?”
” তুমি যে বললে তখন?” ইমার মুখের উপর উড়ে আসা চুলগুলো কানে গুঁজে দেয় শান। ছেলের গায়ের কাঁথা টেনে ইমা বলে,
” আমি বলব তুমি বলবে না।” ইমার হাতটা ঘুমন্ত ইশয়াতের পেটের উপর। শান ইমার হাতের উপর হাত রেখে ওর কানের কাছে মুখ এনে বলে,
” এঃ আমিও বলব। তুই আমার তুই। তুই ছাড়া আমার নেই কেউ। তুই আমার একমাত্র বউ। ওওও বউ।” শান গানের সুরে সুরে চেঁচিয়ে বলতেই ইমা লজ্জায় লাল হয়ে শানের ঠোঁটে উপর হাত রাখে।
” এই কী করছ? বাবু জেগে যাবে, তাছাড়া আন্টি শুনবে তো।” ইমার হাতে চুমু দিয়ে বুকের বা’পাশে ধরে বলে,
” শুনুক। আন্টি শুনুক, পুরো পৃথিবী শুনুক,জানুক আমার শুধু তুমি আছো,থাকবে। তুমি অতঃপর তুমিই।”
৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷ শেষ।।।।।।।।।।।।।।।