#তিক্ত_বুকের_বাঁপাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_২৪(বিষন্ন ক্ষণ)
রুহেলের র’ক্তা’ক্ত মাথাটা কোলে তুলে নেয় তোহা। কাঁপা কাঁপা হাত রাখে রুহেলের কপালে। প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে তার। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তোহার জামা। অথচ রুহেলের মুখে হাসি। যেন ভীষণ তৃপ্তি পেয়েছে সে।
কিছুক্ষণ আগে,
রুহেল এদিকে এসেছিল একটা কাজে। হটাৎ করে তোহাকে দেখে থেমে যায় সে। দুচোখ ভরে দেখতে থাকে তোহার উল্লাসে ভরা চেহারা। কিশোরীর ন্যায় দুই হাতে হাওয়াই মিঠাই উঁচিয়ে রনকের সাথে ইশারায় মেতে ওঠাও তার দৃষ্টি এড়ায়না। হটাৎ করে আশেপাশে তাকাতেই তার চোখ পড়ে তোহার দিকে ধেয়ে আসা গাড়িটার দিকে। পাগলের মত ছুটে যায় রুহেল। এক ধাক্কায় তোহাকে সরিয়ে ফেলে রাস্তার কিনারায়। কিন্তু নিজে সরার সময় আর পায়না, তার আগেই সেই গাড়ির সাথে সংঘর্ষ ঘটে তার দেহের। প্রবল ধাক্কায় ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে সে।
“কেন এমন পাগলামি করলে রুহেল!”
ক্রন্দনরত তোহাকে দেখে রুহেলের হাসি চওড়া হয় আরও। খানিকটা ধিমি কন্ঠে বলে ওঠে,
” তুমি আমার জন্য কাঁদছো তোহা! আমার জন্য! ইশ, তোহা এত খুশি আমি কোথায় রাখি! কাঁদলে আরো বেশি মায়াবি লাগে তোমাকে। তোমার চোখে আমার জন্য পানি, তোমার মনে শুধু আমার জন্য চিন্তা, তোমার কোলে আমার মাথা। ইশ, কি যে ভালো লাগছে। এমনটা জানলে তো আমি রোজ এক্সিডেন্ট করতাম তোহা।”
“প্লিজ রুহেল, এমন বলো না। আমাকে বাঁচাতে কে তোমার এই আজ এই অবস্থা।”
“এই মেয়ে আমার খুশি বুঝি সহ্য হচ্ছে না তোমার! ভালোবাসার মানুষের কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সৌভাগ্য কয়জনের হয় বলো! আমি নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান।”
“রুহেল প্লিজ, কোন কথা বলো না। হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে তোমায়। তোমার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কখনোই মাফ করতে পারবোনা আমি।”
“তোহা, আমার সময় ফুরিয়েছে। আমার করা সমস্ত অন্যায়ের ফল তো একদিন না একদিন পেতে হতো আমাকে। কতগুলো মেয়ের মন নিয়ে খেলেছি আমি। তাদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস আমাকে যে প্রতিমুহূর্তে অভিশাপ দিয়েছে!”
“ভালোবাসি ভীষণ। আমার তিক্ত বুকের বাঁ পাশ তুমি। উইপোকার মত একটু একটু করে আমার বুকের ভেতরটা খেয়ে ফেলেছো তুমি। এখন যে আমার বুকটা পুরো ফাঁকা!”
“প্লিজ রুহেল আর জেদ নয়। হসপিটালে যেতে হবে। অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে তোমার।”
“তোহা আমার হাতে বেশি সময় নেই। হসপিটালে নিয়ে গিয়ে কোন লাভ হবে না। তার চেয়ে বরং আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো। তোমার ছেলে হলে তার নাম রুহেল রেখো কেমন! তুমি যখন তাকে ভালবাসবে, আদর করবে, আমি আমার ভালোবাসা পেয়ে যাব তার মাঝে।”
কাঁপা কাঁপা রক্তাক্ত হাতে রুহেল ছুঁয়ে দেয় তোহার মুখ আলতো হাতে। অতঃপর বিদায় জানায় পৃথিবীকে। তোহা চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ডাকতে থাকে রুহেলকে। আর যাই হোক, সে তো কখনো রুহেলের এমন করুন দশা হোক সেটা চায়নি। রাস্তার মাঝে তাদেরকে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে আছে অনেক মানুষ। এই ঘটনায় তাদের প্রত্যেকের চোখে জল। একটা মানুষ ঠিক কতখানি ভালোবাসলে প্রিয় মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই ঢুলে পড়ে মৃত্যুমুখে।
জ্ঞান ফেরে রণকের। দূরে মানুষের ভীড় দেখে বুক ছ্যাত করে ওঠে তার। দৌড়ে যায় তোহার কাছে। উৎসুক জনতার ভিড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই বিস্ময় হতবিহ্বল সে। কেমন রক্তাক্ত বিবর্ণ চেহারা তোহার। রুহেলের মাথাটা কোলে রেখে কাঁদছে সে। রনক হাঁটুমুড়ে বসে তোহার পাশে। প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে আরো জোরে শব্দ করে কেঁদে ওঠে তোহা। রনক একহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে তোহার মাথা। শান্তনাস্বরূপ চুমু আঁকে তোহার চুলের ভাঁজে।
২৮.
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে প্রকৃতিতে। তোহা জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আনমনে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। প্রতিটা বৃষ্টির ফোঁটা কী দারুনভাবে একে একে পড়ছে আকাশ হতে। একপর টুপ করে মিলিয়ে যাচ্ছে ভূমিতে। এই দৃশ্য তার বহুবার দেখা। কিন্তু আজ কেনো যেনো ভালো লাগছে। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। কোথাও একটা শুনেছিলো, আকাশ ঘিরে বৃষ্টি আসে দুই কারণে। হয়তো কেউ খুব বেশী খুশি নয়তো খুব দুঃখ। আচ্ছা, আজ যে তার মন খারাপ একথা কি জেনে গেছে প্রকৃতি! তবে কি তার জন্যই এই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি!
সেদিনের পর চার মাস কেটে গেছে। বিয়ের ডেট পিছিয়ে ফেলা হয়েছে আপাতত। সেই মুহূর্তে তোহার মানসিক অবস্থার কথা ভেবে, রনক নিজেই বিয়ের ডেট পিছানোর কথা বলে। সকলে একমত হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নম্রমিতার ডেলিভারির পরে শুভ কাজ সম্পন্ন করবে তারা। রনক এবাড়িতে আসে মাঝে মাঝে। তবে রোজ নিয়ম করে তোহাকে কলেজ পৌঁছে দেয় সে নিজেই। এই বাহানায় দুজনের দেখাও হয়ে যায় প্রতিদিন। প্রথম একটা মাস তোহা কারোর সাথে কথা বলতো না সেভাবে। এমনকি রনককেও এড়িয়ে চলতো খানিকটা। রনক বুঝেছে তোহাকে। ছায়ার মতো সঙ্গ দিয়েছে তাকে প্রতি মুহূর্তে। তোহাও ধীরে ধীরে বের হয়ে এসেছে সেই ট্রমা থেকে। তবে সেই চঞ্চলতা আর নেই। কেমন যেনো অল্প কয়েক মাসের ব্যবধানে বড়ো হয়ে গেছে সে।
আচমকা দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে বাইরের দিক থেকে দৃষ্টি ফেরায় তোহা। আস্তে ধীরে গিয়ে খুলে দেয় দরজা। অসময়ে রনককে দেখে বেশ চমকায় সে। তবে প্রকাশ করেনা। দরজা ছেড়ে ঢুকে পড়ে রুমে। ভিজে পুড়ে একাকার অবস্থা রণকের। তোহা তোয়ালে এগিয়ে দেয় তার দিকে। চোখ তুলে তাকায় রনক। অভিমানী কণ্ঠে বলে,
“এতোদিনে জামাই আদর পাওয়ার কথা ছিল আমার। কেউ একটু যত্ন করে চুলটাও মুছিয়ে দেয়না।”
মুচকি হাসে তোহা। নিজেই এগিয়ে যায় রনকের কাছে। বেডে বসে আছে রনক। তার একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজে হাতে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছিয়ে দেয় সে।
“এতো ভিজে ভিজে আসতে গেলেন কেনো?”
রনক কোমর জড়িয়ে ধরে তোহার। পেটে নাক ঘষতে ঘষতে বলে, ” খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো তোমায়।”
হাসে তোহা। এমন পাগলামির সাথে সে অভ্যস্ত। রণকের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রাফিদের রুম থেকে একটা শার্ট আর ট্রাউজার এনে দেয় তাকে। রনক ওয়াশরুম থেকে চেঞ্জ করে আসে। ভেজা শরীরে বেশিক্ষণ থাকলে জ্বর এসে যায় আবার তার।
নম্রমিতার প্রেগন্যান্সির পাঁচ মাস চলছে। এই কয়েকমাসেই একেবারে কাহিল দশা তার। ঠিক মতো খেতে পারেনা সে। কিছু মুখে দেওয়া তো দূর খাবারের গন্ধেই বমি উঠে আসে তার। শুধুমাত্র টক জাতীয় কিছু জিনিস ছাড়া কিছুই মুখে রোচেনা তার। সেই সাথে মাঝে মাঝেই হুট করে শরীরটা ছেড়ে দেয় তার। একেবারে অবচেতনের মতো পড়ে থাকে। শরীরে শক্তি কুলিয়ে উঠতে পারেনা। একেবারে ক্লান্ত যেনো। রাফিদ প্রতি মুহূর্তে চোখে চোখে রাখে তাকে। যতক্ষণ বাড়িতে না থাকে, তোহাকে রেখে যায় নম্রমিতার কাছে। যেনো ভুল করেও কিছু ভুল না হয়। নম্রমিতা র প্রেগন্যান্সি আর পাঁচটা প্রেগন্যান্সির মতো স্বাভাবিক নাহ। বেশ কিছু টেষ্ট করে জানা যায় বেবির পজিশন ঠিক নেই। সেইসাথে প্রয়োজনের তুলনায় উঁচু পেট। যমজ বাচ্চা আছে বলে সন্দেহ করেন তারা। আগামী সপ্তাহে শিওর হয়ে যাবে। নম্রমিতার চিন্তায় ঘুম নেই রাফিদের চোখেও। যতক্ষণ নম্রমিতা জেগে থাকে, সেও জেগে থাকে তার সাথে। আবার নম্রমিতা ঘুমালেও ঘুমাতে পারেনা সে। বারবার মনে হয়, সে ঘুমিয়ে পরলেই বুঝি কিছু অঘটন ঘটে যাবে নম্রমিতার সাথে। যে কোনো মূল্যেই রাফিদ নম্রমিতাকে হারাতে পারবে না। নিজের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি ভালোবাসে যে তাকে!
২৯.
নম্রমিতাকে কোলে নিয়ে রাফিদ ঢোকে ডক্টরের চেম্বারে। লজ্জায় হাঁসফাঁস করতে করতে রাফিদের বুকে মুখলুকায় নম্রমিতা। সকলে হা করে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। যেনো এমন দৃশ্য বিরল। ভীষণ আশ্চর্য্যের কিছু দেখে ফেলেছে তারা। এমন ভালোবাসার মানুষ সত্যিই আজকাল বিরল।
ডক্টরের চেম্বারে বসে আছে তারা দুজন। থমথমে মুখে ডক্টর একে একে পাতা উল্টে যাচ্ছেন রিপোর্টগুলোর। তার মুখ দেখেই বলে দেওয়া যায়, রিপোর্ট খুব একটা ভালো নাহ। আজকাল মাঝে মাঝেই পেতে তীব্র ব্যথা হয় নম্রমিতার। থমথমে কণ্ঠে ডক্টর বলে ওঠে,
“আপনার গর্ভে টুইন বেবি আছে। তবে আমরা একজনকে বাঁচাতে পারবো না। শিরার সাথে একেবারে জড়িয়ে গেছে সে। যে কোনো মুহূর্তে গলায় ফাঁস লেগে মারা যেতে পারে। তবে দুয়া করুন যা হওয়ার আরো দুই মাস পরে যেনো হয়। এই মুহূর্তে একটা বাচ্চা গর্ভে মারা গেলে দ্বিতীয়জনকেও বাঁচানো মুশকিল। পচন ধরবে তার দেহে। সেইসাথে বিষাক্ত হয়ে পড়বে সবকিছু। যার ফলে দ্বিতীয়জনেরও মৃত্যু নিশ্চিত।”
আঁতকে ওঠে নম্রমিতা। কাঁপা কাঁপা হাত রাখে পেটে। তার যে দুজনকেই চাই। রাফিদ মলীন কণ্ঠে বলে ওঠে,
“এই সমস্যার কোনো সমাধান নেই? কোনোভাবেই কী দুইজনকে বাঁচানো যায়না?”
“নাহ মিষ্টার রফিদ। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও পারবো না। বাচ্চার পজিশন একদমই ঠিক নেই। কিছুদিন পর থেকে ওনার পেটে ব্যথা শুরু হবে। মাঝে মাঝে খিঁচে ধরবে পেট। যে কোনো মুহূর্তে কোনো সমস্যা হলে সবার আগে আমাকে জানাবেন। একজন বাচ্চাকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। আমি নিজেও হতবাক এতটুকু একটা মেয়ের প্রথম প্রেগন্যান্সিতে এতো ক্রিটিকাল একটা কেস।”
হতাশার শ্বাস ছাড়ে রাফিদ। পাশে বসে থাকা নম্রমিতার থমথমে মুখ দেখে বুকে টেনে নেয় সে। আহ্লাদী কণ্ঠে বলে ওঠে,
“একে ছাড়া আর কিছুই চাইনা আমার। যাই হয়ে যাক, আপনি শুধু এই মানুষটাকে যেভাবে ওটির ভেতরে নিয়ে যাবেন, সেভাবেই ফেরৎ দিয়েন আমাকে। আর কিচ্ছু চাইনা আমার, কিচ্ছু না। আর জীবনেও সন্তানের নাম মুখে আনবো না। আমার নম্র থাকলেই চলবে, আর কাউকে লাগবেনা।”
#চলবে!
দেরি করার জন্য দুঃখিত। আজ বড়ো করে গল্প দিলাম। কাল থেকে আবারো রেগুলার হয়ে যাবো আগের মতো।