তারকারাজি সিজন2 পর্ব-৫

0
270

তারকারাজি- (০৫)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
|| দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ||

আর দু’ঘন্টার যাত্রাকার্যে ঢাকার অভ্যন্তরীণে অবস্থান করতে পারবে জেনেও থেমে যেতে হলো সায়ান ও মিশমিকে। এই এলাকাটায় কালবৈশাখীর মতোন দানবীয় ঝড়ের তাণ্ডব চলছে। একেকটা বজ্রপাতের ভয়ঙ্কর আওয়াজে সায়ানের আত্মাটাই যেন নিস্তব্ধ হওয়ার পথে! মিশমির অবস্থা তো আরো করুণ। তখনকার মতো না-পারছে সায়ানকে আঁকড়ে ধরে গাঢ় লজ্জায় ডুবুডুবু হতে, আর না পারছে অভয়ার ভূমিকা পালন করতে। তাই উপায় না পেয়েই চৈত্রকন্যাকে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, নিম্নমানের একটি হোটেলেই মাথা গুঁজতে হলো তাদের। সায়ান তার মা শিউলি জাহানের থেকে বেশ কিছু টাকা নিলেও ভালো হোটেলে… এমনকি এই নিম্নমানের হোটেলেও দুটো আলাদা ঘরের ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হলো। ফলস্বরূপ আকাশের বিশালতা সমান জড়তাকে বুকে আগলেই সিঙ্গেল বেডের একটি ঘর ভাড়া করল তারা। পরিকল্পিত এই-ই যে— বিছানায় মিশমিকে রাত্রিযাপনের সুযোগ করে দিয়ে, সায়ান নিজে সোফায় ঘুমোবে। পরিকল্পনা ফলানোও হলো সেভাবে। তাম্রবর্ণের মানুষটাকে কোঁকড়া লেগে সোফায় শুয়ে থাকতে দেখে মিশমির অস্বস্তিটা শতগুণে বেড়ে গেল। ওমন দীর্ঘদেহী মানুষ কি অতটুকু সোফায় ঘুমোতে পারে? এই অস্বস্তির কারণ তো একটা ছুতো মাত্র! ওর যে অন্য অস্বস্তিতে হাত-পা নীরক্ত হয়ে আসছে। বুকটা থরথর করে কেঁপে উঠছে। একটা পুরুষের সাথে এক ঘরে রাত্রিযাপনের মতো অভিজ্ঞতা মিশমির নেই। সেই সতেরো বছর আগেই বোধহয় সে শেষ বারের মতো কোনো পুরুষের পাশে ঘুমিয়েছিল। পুরুষটি ছিল ওর বাবা। মা কখনোই কোনো ছেলের পাশে মিশমিকে ঘুমোনোর ব্যবস্থা করে দিতেন না এবং কোনো বিশেষ প্রয়োজনও পড়তো বাবা ছাড়া ঘরে অন্য কোনো পুরুষের উপস্থিতিতে ঘুমোনোর। তবে আজ…? সেই তাম্রবর্ণের টগবগে যুবক যতই বিশ্বস্ত হোক না-কেন! মেয়ে হিসেবে এই নিগূঢ়তম কারণটায় যে মিশমির ভয় অনেকাংশেই বেশি তা নিঃসন্দেহে অভাবনীয়। তবুও পরিস্থিতির ব্যাখ্যার্থে জীবন রক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই এখন। মাকেও তো কম মিথ্যে বলল না সে! নীলাশার ওই প্রাসাদতুল্য বাসায় চার বান্ধবী মিলে রাত্রিযাপন করবে বলেই সে জানিয়েছে মাকে। ঝুমুর বেগম যে এই আবদারে রাজি হবেন না তা মিশমি আগেই বুঝেছিল। তবুও সে সায়ানের শিখিয়ে দেওয়া কথায় বুঝ দিয়েছিল বেশ,

“ আম্মু, নীলাশা তো আগেই আন্টিদের বলে দিছিল যে, আমরা যাব। আমি আগে জানলে কি না করতাম না? এতো রাতেও আন্টি জেগে আছে আমাদের চারজনের জন্য। না থাকলে কেমন দেখায় বলো? নীলটা যদি আমাকে আগে বলতো তাহলে আগেই মানা করে দিতাম আমি। ”

ঝুমুর বেগম অসন্তুষ্টির সাথেই মেয়েকে অনুমতি দিয়েছিলেন। মিশমি বন্ধুদের সাথে ভ্রমণে থাকাকালীন মঈনুল হোসেন বলেছিলেন যে, মায়ের অনুপস্থিতিতে মেয়ে নীলাশাদের বাসায়-ই থেকেছে। আবারও ওদের বাসাতেই ছুটেছে মেয়েটা। এতো ঘনঘন কেউ বান্ধবীর বাসায় রাত্রিযাপন করে না-কি? তবুও কী আর করার… মেয়ের এহেন সততা তো ওনার-ই দেওয়া শিক্ষা। হাজার হোক, নিজের মায়ের সমতুল্য নৌশিন আহমেদকে এইটুকু সম্মান করলেই ওনার এই মুক্তোর মতো বিশুদ্ধ মেয়েটা যে অশুদ্ধ পথে পা বাড়িয়ে ফেলছে, তা তো আর না!

মাঝরাতে এদিক-ওদিক করে যখন ঘুমের নেশালো প্রলেপটা চোখে এসে লাগল, তখনই মিশমি অনুভব করল— তার গলা ভেজানোটা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি। ঘুমের রাজ্যকে ধুলোর স্তূপে লুকিয়ে, এক প্রকার বাধ্য হয়েই উঠে দাঁড়াল সে। পানির বোতলটা টি-টেবিলের ওপর রাখা যা সোফার সামনে নিযুক্ত করা হয়েছে। ঘরে জ্বলন্ত চারটে বাতির স্বল্প আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, সায়ান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সুষুপ্ত সায়ান আবার কথাও বলছে ঘুমের মাঝে। মিশমি ক্ষীণ হাসল। এমন শিশুকালের স্বভাব এখনো টিকে আছে না-কি মানুষটার মাঝে? তবে সায়ানের ঘুম দেখে নিজের ভয়টাও বোধহয় ক্ষীণ হলো তার। সে টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে, বেশ কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে পানির বোতলটা স্পর্শ করল। কিন্তু মেয়েটির ঘুম ওড়ানো সেই তৃষ্ণা সুষুপ্ত সায়ানের কথায় যে এভাবে নিলীন হবে তা সে ঘুণাক্ষরেও উপলব্ধি করেনি। ঘুমের ঘোরে বলা সায়ানের কথাগুলো অস্পষ্ট হলেও বেশ শুনতে পেল মিশমি। সে শুনতে পাচ্ছে,

“ আমি তো মিশমিকে কম ভালোবাসিনি। তাহলে ও কেন আমায় ভালোবাসলো না, আম্মু? বিশ্বাস করো, ওকে ভুলতে চাওয়ার পরও ভুলতে পারি নাই। যদি ভুলতে পারতাম তাহলে বাবার মৃত্যুটাই আমার জীবনের একমাত্র কষ্ট হতো, তাই না? আমি তিহামের কথা জানার পরও ওকে ভালোবাসার মতো বোকামো করলাম কীভাবে, আম্মু? সেই আগের তিহামটাও তো পাল্টে গেল ওকে পেয়ে! এখানে আমার সুযোগটা কোথায়? আমি মিশমিকে ভুলতে পারি নাই। ওকে বলতেও পারি নাই যে, ওকে ভালোবেসে দিন-দিন নিজেকে পাগল মনে হয় আমার। নিঃশ্বাস আঁটকে আসে, মাথা ধরে যায়, মুখে বালিশ চাপা দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করে আমার। কিছুই পারি নাই আমি, আম্মু। কিছুই না৷ সব দিক দিয়েই কেন এত ব্যর্থ হলাম আমি?… ”

মিশমি ধীর স্বভাবেই মেঝেতে বসলো। শুনতে পেল আরো নানান কথা। যেই ছেলেটা ঘুমের ঘোরে তার মায়ের সাথে কথা বলছে, তার ও তার কথার জন্য অত্যন্ত আকস্মিকতাতেই হুহু করে কেঁপে উঠল মিশমির অন্তরাত্মা। চারপাশটা মুহূর্তেই ভুতুড়ে বাড়ির নৈঃশব্দের মতো লাগতে লাগল তার কাছে৷ অথচ বাহিরে এখনও ঝড়ো হাওয়ার তাণ্ডব চলছে। কী ভয়ঙ্কর তার আওয়াজ! যেন হুট করেই এসে উড়িয়ে নিয়ে যাবে মিশমির হৃদয়। চোখে জল এলো অল্প৷ সায়ানের কথাগুলো সত্য বলে মেনে নিতেই শীতের তীব্রতা ভুলে কপালে ঘামের বিন্দু ফুটে উঠল। অঙ্ক মিলিয়ে নেওয়া হলো অনেক। সায়ান তো বলেছিল যে, সে এতগুলো দিনেও তাকে ছেড়ে যেতে পারেনি। অথচ মিশমি কত অবহেলায় সেই কঠিন বাক্যটিকে গিলে নিয়েছিল এক নিঃশ্বাসে!

তিহামের কলটা যখন এলো তখনও মিশমি অনুষ্ণ মেঝেতে বসে সায়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা কত কথা বলে যাচ্ছে তাকে নিয়ে! একবার মাকে বলছে তো একবার মৃত বাবাকে। মিশমি চোখ দুটো জলে ভাসিয়েই শুনে যাচ্ছে সেসব কথা। হাসছে অল্প। আবার ভীষণ পাতলা কণ্ঠে বিলাপ করছে বেশ,

“ এটা কী করে ফেললেন সায়ান ভাই? আমায় কেন শোনালেন এসব কথা? ”

সায়ান শুনতে পায় না সেই বিলাপের স্বর। ওদিকে সব জানা-জানি হয়ে গিয়েছে বুঝতেই মিশমি উঠে এসে তিহামের কলটা রিসিভ করল। সতর্ক পায়ে এই ঝড়-বৃষ্টির রাতেও ছুটে গেল বারান্দায়। ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই তিহামের কণ্ঠ শোনা গেল,

“ এতটা কেয়ারলেস কেন তুমি, মিশমি? বাস মিস করছো… বুঝলাম। কিন্তু অন্য বাসে উঠে নিশানকে ফোন করতে পারলা তাও আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলা না? আর কই তুমি? আমি তো ভাইদের বাসেই আছি। কই নামছো? ”

মিশমি মোটেও সব সত্যিটা বলে দিতে ভয় অনুভব করেনি। আপন মনে মানে সে— তিহামকে মিথ্যে বলার সাধ্য তার নেই! তাই সমস্ত সত্যিটা বলে যখন সে সবাইকে কিছু বলতে মানা করে দিল, তখনই আক্রোশে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য তিহাম তার দুনিয়াময় সকল ক্ষিপ্ততা প্রকাশ করে বসল। মিশমি চুপচাপ শুনে গেল সেইসব কথা। সম্পর্কের সাড়ে পাঁচ মাসে সে এইটা খুব ভালো করেই বুঝে গিয়েছে যে, চুপ থাকাটাই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার একমাত্র অস্ত্র। কিন্তু তিহাম যখন মাত্রাতিরিক্ত রাগ দেখিয়ে অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সাথে প্রশ্ন করল,

“ মিশমি, সত্যি করে একটা কথা বলবা? ”

তখনও মিশমি ছিল স্তব্ধ। মনে একটা প্রশান্তির ও সুখকর ঢেউ খেলে গেল। যাক! তিহাম বোধহয় বুঝতে পেরেছে যে, এখানে তাদের কোনো দোষ নেই৷ তবে সে উত্তর দিতেই তিহামকে বলতে শোনা গেল,

“ তুমি আর সায়ান ভাই একসাথে… মানে একসাথে আছো না তো? ভিডিও কল দিচ্ছি থামো। একদম নড়বা না। যেমন করে আছো ওমন করেই দেখব তোমাকে। যদি সত্যিই ভালোবেসে থাকো তো আমাকে মিথ্যা বলবা না। ওইভাবেই থাকবা তুমি। ”

এই কথা শুনে মিশমির সারা গা তাড়িত বেগে কেঁপে উঠল। তিহাম কীসব বলছে আকারে-ইঙ্গিতে? সে তো বলল মানুষটা অনেক কষ্টে ওই ছোট্ট সোফাটায় শুয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। অথচ সে নিজের প্রেমিকাকেই বিশ্বাস করল না? ঝড়ের বেগ বাড়তেই মিশমি ছুটে এলো ঘরে। বুকটা যেন কেউ নামহীন এক তীক্ষ্ণ অস্ত্র দিয়ে চিড়ে দিয়েছে খুব করে। নিস্তব্ধ ঘরটার চার দেয়াল যেন থেকে থেকেই চেঁচিয়ে উঠে বলছে,

“ মিশমি? তিহাম তোকে বিশ্বাস করে না। একটুই বোঝে না। তোর কথা ওর কাছে বিশ্বাস যোগ্য না। তুই শুধুই মূল্যহীন ওর কাছে। ”

সেই কথাগুলো যে মেয়েটির মনে কীরূপ হাহাকার সৃষ্টি করেছে তা শুধু সে-ই বুঝতে পারছে। তখন তিহামের ভিডিও কল এলো। মিশমিও বাধ্য মেয়ের মতো দেখালো তাদের ঘরটা। কিন্তু এই ব্যতীত তাদের কি আর কোনো কথা হয়েছিল? হয়নি… মিশমির ইচ্ছে করেনি কিছু বলতে। সে জীবনে প্রথম তিহামকে মিথ্যে বলেছে যে— তার খুব ঘুম পাচ্ছে, তিহাম যেন সংযোগ স্থাপন করে। কিন্তু মিথ্যের আড়ালে চোখে যে রক্তবর্ণ হুহু করে ছড়িয়ে পড়ল, তা কি তিহাম বুঝতে পারল একটুও? না, পারল না। কিছুতেই পারল না সে। কষ্টের উত্তাপে যে আত্মাটা দেহ ছাড়তে চাইছে তা-ও বুঝল না সেই সুদর্শন যুবক। অথচ ক্রন্দনের দাপটে তার কণ্ঠটা তো কেঁপেছিল ভীষণ!
আচ্ছা, হুকুম পেয়ে প্রকৃতিই কি বুঝে ফেলল মেয়েটির আকাশসম বেদনা? নয়তো তাকে আজই কেন হতে হলো হৃদয়ঘটিত রহস্যমূলক এক নিগূঢ় দ্বিধার ভুক্তভোগী? কেন হতে হলো এমন ভয়ঙ্করী?
বা এতোটা জ্বালাময়ী…?

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

( সময়ের অভাবে অন্য চরিত্রদের আনতে পারিনি। ইন শা আল্লাহ, এর বর্ধিতাংশ দেওয়ার চেষ্টা করব… খুব তাড়াতাড়ি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here