তারকারাজি সিজন2 পর্ব-১৮

0
261

তারকারাজি- (১৮)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
|| দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ||

প্রাপ্তমনস্ক মানবদেহীর জীবগুলো বড়ই অদ্ভুত হয়! এইযে এখনকার কথা… প্রায় আধ ঘন্টা ধরে খুব কাছাকাছি থেকেও সায়ান ও মিশমি একে-অপরের সাথে টুঁ শব্দটাও বিনিময় করেনি৷ এখানে তাদের এই জড়ীভূত ভাবপ্রবনতা বা কর্মটি কি প্রকৃতপক্ষে অদ্ভুত নয়?
রাত্রি আড়াইটার বেশি বাজে। অথচ ফোনে কথা বলার সময়-ই মাথার উপর অনিদ্রার নিবিড় বোঝা বহন করে নিশান, রিশান ও সায়ান এসে উপস্থিত হয়েছে হসপিটালে। ও-মুখ থেকে আরাভও হাজির হয়েছে। মিশমির সাথে দেখা করার ভীষণ তাড়া আছে যেন! কিন্তু মিশমি তার বন্ধু তিনজনের সাথে দেখা করলেও আরাভ এবং সায়ানকে দেখে হাতের পাতা দিয়েই আংশিক মুখমণ্ডল ঢেকে নিয়েছে। কথা বলেনি, কোনোকিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তরও দেয়নি। অথচ তার কণ্ঠনালীটা বারবার কেঁপে উঠে জানান দিচ্ছিল যে, মেয়েটি কাঁদছিল। সকলের থেকে মুখ লুকিয়ে সে কাঁদছিল। এইতো… এখনও কাঁদছে মিশমি। অথচ কান্নাটা নিসাড়, আওয়াজহীন। কয়েক মাস আগে যে ভয়ঙ্কর লজ্জায় তার মরমর অবস্থা হয়েছিল, অপমানের বিষাক্ততায় বাবা-মায়ের নতমুখ দেখেছিল, এতো-এতো মানুষকে উপেক্ষা করে তিহামের হয়ে লড়েছিল; সেই মেয়েটা কী-করে ভুলে যাবে বুকে হাহাকার জাগানো সেই স্মৃতিগুলো? কী-করে মুখ দেখাবে সকলকে? কী-করে ভুলে যাবে যে, তার বাবা-মা তার একটা কথাও শোনার প্রয়োজন মনে করেনি? আর কীভাবেই বা ভুলবে এই মানুষটিকে দেওয়া আঘাত যে মানুষটি তাকে এখনও ভালোবাসে? লজ্জায়, অভিমানে শত শারীরিক যন্ত্রণা থাকা সত্ত্বেও মুখের উপর থেকে হাতটা সরাতে পারল না মিশমি। সক্রিয়তা ফিরে পেয়ে দুনিয়াময় সকল আনন্দ উপভোগ করা মেয়েটির এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে— তার নিশ্চল দশাটাই অত্যুত্তম ছিল। শান্তির ছিল। বিরহভার অন্তরে শারীরিক যন্ত্রণার থেকে তার মানসিক যন্ত্রণাটাই যেন তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ ধারণ করছে। সে তো ওই তিহাম ছেলেটার পাকা ধানে মই দেয়নি, তাহলে কেন সে-ই…? অন্তরটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে মিশমির। তার মৃত্যু হোক। তবুও তার জীবন্ত, স্বাভাবিক মুখখানা ওই অপমানিত পিতা-মাতা না দেখুক। কাছে বসে থাকা এই পাগল প্রেমিকটা না দেখুক। ‘তার মৃত্যু ঘোষিত হোক’ এটাই যেন তার শেষ চাওয়া!

এদিকে সায়ান চাইলেও কথা বলে উঠতে পারছে না প্রেয়সীর সাথে। সে তো আগেই প্রকাশ করেছিল— তার মতে ভালোবাসার থেকে তীক্ষ্ণ, জঘন্য ও ভয়ঙ্কর অনুভূতিময় ব্যাথাটির মতো কোনো ব্যাথা আর দ্বিতীয়টি নেই এই জীবন্ত গোলকে। অথচ কাব্যজগতে না-কি এর থেকে কান্তিময় শব্দ আর কিছুই হতে পারে না, এটাও কি গ্রহণযোগ্য? এইযে নিজের অবিনাশী ও অবিকৃত অনুভূতি নিয়ে মেয়েটির সাথে কথা বলার জন্য উন্মাদের মতো ছুটে এসেছে সে, অথচ মেয়েটি কি একবার তার দিকে তাকাতে পারছে না? তার ওই সুশ্রাব্য কণ্ঠ শুনতে কোনো জীব যে তৃষ্ণায় ধুঁকছে তা কি মিশমি কোনোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে না? কত বিরহের কথা, লুকায়িত ব্যাথা জমিয়ে রাখা হয়েছে এই মেয়েটিকে জানানোর জন্য। কিন্তু না, মেয়েটি তাকায় না। তার ভালোবাসাটা অপ্রকাশিতই থেকে যায় বার-বার। তাহলে ‘ভালোবাসা’ কী-করে কান্তিময় শব্দ হতে পারে যা সায়ানের মন জুড়িয়ে দিতে পারে না? হয়তো সত্যিই কান্তিময় হতে পারে। তবে তা শুধুই কাব্যজগতে, আমাদের জীবনে না বলেই ধরে নিয়েছে এই পাগলটা। তারই-বা কী দোষ? ওই অবিনাশী অনুভূতিময় ব্যাথাটা মিশমির হাত ছোঁয়ার মাধ্যমে সেই যে সায়ানকে ঝাপটে ধরল, তা তো আর ছাড়ানো গেল না কোনোক্রমেই!
সময় বয়ে গেল অনেক। উপায়ন্তর না পেয়ে, বুকে আকাশসম অস্বস্তি জমা রেখেই সায়ান ডাকল,

“ মিশমি? ”

মিশমি কি শুনতে পেল না? সায়ান বোঝার চেষ্টা চালালো কিয়ৎক্ষণ। আবারও ডাকল সস্নেহে, তৃষ্ণাদগ্ধ কণ্ঠে৷ নীরব মেয়েটি আসলে ঘুমের নিয়ন্ত্রণে নিমজ্জিত হয়েছে বুঝতে পেরেই সায়ান তার মুখমণ্ডলের উপর থেকে হাতটি সরিয়ে দিল৷ ঠিক সেই মুহূর্তেই চমৎকারভাবে মিশমির আলতারঙা শুভ্র মুখটি জ্যোতির্ময়ী হয়ে উঠল সায়ানের চোখে। সায়ানের গলা কণ্টকাকীর্ণ হলো, নিষ্পলক চোখ দুটোর পরিধি বাড়লো৷ ঠোঁটের কোণে উঁকি দিল খুশির উজ্জ্বল রেখা। প্রিয়তমার অশ্রুসিক্ত গাল দুটোতে তর্জনী বুলিয়ে, তাকে মোহনিয়া কণ্ঠে অনেক প্রণয়পূর্ণ কথা বলে বিদায় নিল সায়ান। অথচ মিশমি তার কিছুই শুনতেই পারল না। বোধহয় সায়ান-ই তা কোনোদিন মিশমিকে শোনাতে পারল না!

এর পরের চারটে দিনও কাটলো চোখের সামনে বিস্ময়বোধক দৃশ্য দেখে। সায়ান পরের দিনও এসে দেখলো মিশমি ঘুমোচ্ছে তবে দেখা হয়ে গেল তার বাবা-মায়ের সাথে। বাকি সবার সাথে কথা বলতেই সে জানতে পেল— মা বলতে গুটিয়ে যাওয়া মেয়েটি না-কি বাবা-মার সাথেও ঠিকঠাক কথা বলছে না। হু-হা করে উত্তর দিচ্ছে, মুখটা গায়ের চাদরে ঢেকে রাখছে, কারো কোনো কথা মানতে চাইছে না। আবার তার পরের দিনও সায়ান এসে দেখলো মিশমি ঘুমোচ্ছে। মস্তিষ্ক চট করেই ধরে ফেলল যে, এটা মিশমির ঘুমের সময়। তাকে সময় পরিবর্তন করে আসতে হবে এখানে। তৃতীয়দিন অবশ্য জেগে ছিল মিশমি তবে সায়ান এসেছে শুনেই চাদরে মুড়িয়ে ফেলেছে নিজেকে। মিশমিকে দেখা তো দূরের কথা, মেয়েটার একটা চুলও চোখে পড়েনি সায়ানের। সে তার পাঁচবন্ধু ছাড়া কারো সাথেই কথা বলছে না বলে জানালো উপস্থিত সাইফ, শিহাব ও আরাভ। বেদনার জ্বালাময়ী দ্রাবকে নিমজ্জিত সায়ানের মনটা আর সইতে পারল না এই বাঁধা। কারণবিহীন বাঁধা কি সত্যিই মেনে নেওয়া যায়? শিহাবকে বলতেই সে গোপনে, অত্যন্ত একাকীভাবে ডেকে আনল রিশানকে৷ মিশমির এরূপ আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করতেই রিশানকে কেমন অস্থিরপূর্ণ চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে দেখা গেল। অতঃপর আকস্মিকভাবেই সায়ানদের নয়নগোচর হলো রিশানের মুখভঙ্গির কঠোরতা৷ আরাভ আরেকটু তাড়া দিল,

“ কী রে, তোরে কিছু জিগ্যেস করলাম না? ওর কি আমাদের এখানে আসাটা পছন্দ হইতেছে না? তা হলে আমরা না-হয় আসব না এখানে বাট তুই বলবি তো কারণটা এইটা কি-না? এখন তুই আবার বলে বসিস না যে, মিশমি তোদের বন্ধু হয়েও তোদেরকে ওর এমন করার কারণ জানায় নাই। ”

রিশান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দাঁতে দাঁত চেপে, চাপা স্বরে বলল,

“ তা ক্যান হবে, আরাভ ভাই? ও বলছে ও কাউকে মুখ দেখাতে চায় না… কাউকে মুখ দেখাতে পারবে না। ”

অবিলম্বেই রিশানের কথাটা বুঝতে পারল না কেউ৷ সাইফ তো প্রশ্নও করল, “ ক্যান? ”

“ ক্যান আবার বুঝতে পারতাছো না, ভাই? ”

রিশানের এই একটি বাক্যই যথেষ্ট ছিল চারটি পুরুষকে নির্বাক করে দিতে। সায়ানের মনটা যেন কেউ দুমড়েমুচড়ে, খামচে ধরে আছে। কী জ্বালার প্রবল স্রোত বইছে এই বুকটায়! মিশমি স্বাভাবিকতা ফিরে পেতেই আগে এমন কিছু ভেবে নিয়েছে? না-কি জ্ঞান ফেরার পর এই সাতটা মাস এসব ভেবেই কষ্টে জর্জরিত হয়েছে? সায়ান ফের সিদ্ধান্ত নিল সময় পরিবর্তন করে এখানে আসার। কারণ ঝুমুর বেগম ও মঈনুল হোসেনের উপস্থিতিতে মিশমির সাথে কথা বলাটা খুবই অস্বস্তিকর হতে পারে। কিন্তু সে ভাবেনি তার পরবর্তী দিনটা এমনও হতে পারে!
মধ্যাহ্নের পূর্ব লগ্নে ভার্সিটি থেকে নীলাশারা পাঁচজন যখন মিশমির কাছে আসছিল তখন সাথে ছিল সায়ান, সাহেল, আরাভ ও রোহানও। সায়ান আজ জোর-জবরদস্তিই আরাভকে ছুটি নিইয়েছে এবং সাহেল ও রোহান গোটা চারটে দিন কেটে গেলেও মিশমির সাথে দেখা করেনি বলে আজ-ই বন্ধুর সাথে ছুটে এসেছে। তখন মিশমিকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। পুরো শরীরের মাঝে কাঁধ ও বাম পায়ে অস্বাভাবিক আঘাত পাওয়ায় শুয়ে থাকাও তার জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমন সময় যখন হঠাৎই সায়ানের উপস্থিতি দেখা গেল তখন মিশমির গায়ের কাঁপুনি ছিল লক্ষণীয়। চাদর মুড়িয়ে নিজেকে আড়াল করার কী তোরজোর তার! কিন্তু আঘাতপ্রাপ্ত স্থানগুলোয় ব্যাথার তীব্রতা বাড়ায় এক প্রকার ব্যর্থই হলো মেয়েটি। সাহেল আর রোহান এসে টুকিটাকি কথা বললেও মিশমি চোখ নামিয়ে ‘হু, হ্যাঁ, না’ ছাড়া আর কোনো উত্তর দিল না। ঠিক এমন সময়ই কেবিনের দ্বারে দেখা মিললো তিহামের। পুরো ভার্সিটিতেই ছড়ে গিয়েছে— আত্মহত্যা করতে চাওয়া মেয়েটি এখন আগের থেকে তুলনামূলকভাবে সুস্থ। তাই তিহামের উপস্থিতি ভাবায়নি কাউকে। কিন্তু তিহামের কণ্ঠ পেয়ে, তিহামকে চোখে দেখে যে অপ্রতিরোধ্য ঘৃণায় ধিকধিক করে ভিজে উঠল মিশমির আঁখি জোড়া তা একান্তই মিশমি বুঝতে পেল বৈ অন্যকেউ নয়। তিহাম এর আগেও দু’বার এসেছিল এখানে কিন্তু পক্ষাঘাতগ্রস্ত মিশমিকে এক মুহূর্তের জন্যই চোখে দেখে চলে যেতে হয়েছিল তাকে। মিশমি শুনেছে— আরাভ, সাহেল আর সাইফ মিলে তিহামকে মেরেছে অনেক। এক হাতে ব্যাণ্ডেজ নিয়ে এবং এক পায়ের জোরেই বেশ কয়েকদিন চলতে হয়েছিল ছেলেটিকে। ব্যাণ্ডেজ করা হাতটা এখনো লক্ষণীয় যা খুব সামলে নিয়েও নিশানের সাথে কথা কাটাকাটি করছে ছেলেটি। মিশমি মুখ উঁচিয়ে তাকাল। মানুষটাকে দেখে মনে হলো যেন তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে সে নিজের বুকেই সব থেকে বেশি ব্যাথা পেয়েছে। এতো কেন জ্বালা এই বুকে! মিশমি ডাকল,

“ নিশান? ভিতরে আসতে দে। ”

নিশান থতমত খেয়ে তাকিয়ে রইল মিশমির দিকে। মেয়েটা কি এখনো এই তিহামের জন্যই মরিয়া হবে? সে মিশমিকে শাসিয়ে উঠলেও লাভ বিশেষ হলো না। তিহাম এসে মিশমির খুব কাছে বসতেই মিশমি যেন গুটিয়ে গিয়ে অপর পাশে সরে বসতে চাইলো। সে অসুস্থতার দুর্বল স্বরেই শুধালো,

“ কেন আসছো? ”

তিহাম হাসল মিষ্টি করে। বলল, “ তোমাকে দেখতে আবার কেন? ”

“ ওহ, আচ্ছা। আমাকে দেখতে? ”

মেয়েটির কথা বলতে বেশ বেগ পেতে হলো। কিন্তু সেই মুহূর্তে যে দানবীয় থাপ্পড়ে তিহামকে বিছানায় বসা থেকে সরাসরি মেঝেতে ফেলে দিতে সক্ষম হলো মিশমি, তার বেগ সম্পর্কে ধারণা করাটাও দায় হয়ে দাঁড়াল উপস্থিত সকলের। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই যেমন পাথুরে হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঠিক অপরদিকে তিহামও এই আকস্মিকতার টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে বসেই দেখতে লাগল মিশমির অমর্ষ মুখভঙ্গি। মিশমি গা থেকে চাদর সরিয়ে পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। যে হাত নাড়িয়ে মুখে খাবার তোলাটাও দায় ছিল, সেই হাতে এভাবে কাউকে আঘাত করার জন্য ভীষণ ব্যাথায় ঝিমঝিমিয়ে উঠল তার হাতের শিরা-উপশিরা। মেয়েটি যখন কোনোভাবেই দাঁড়াতে সক্ষম হচ্ছে না তখন সানাম এগিয়ে গেল মিশমির কাছে। উত্তেজিত তবুও আদুরে স্বরে মিশমিকে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় বলল,

“ মিশা, নামিস না। তোর পায়ে প্লাস্টার করা। তুই তো হাঁটতে পারবি না উল্টে আরো ব্যাথা পাবি। নামিস না তুই। ”

সানামের কথায় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জেদটা যেন বেড়ে গেল মিশমির। কয়েক মুহূর্তেই রণরঙ্গিণী মূর্তি ধারণ করে, আগুনচোখে শাসিয়ে উঠল বান্ধবীকে। কাছে আসতে বারণ করে সে এগিয়ে গেল তিহামের দিকে। তিহাম তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। মিশমিকে সামলে নেওয়ার কত মিঠে-মিঠে বুলি তার! কিন্তু মিশমির তা সহ্য হলো না। তিহামের কলার খামচে ধরে তার করা বিশ্বাসঘাতকতার কৈফিয়ত চাইতেই উন্মাদী হতে দেখা গেল তাকে। চিৎকার করে বলতে লাগল,

“ আমি তোমাকে লাইব্রেরিতে কেন ডাকছিলাম, বলো? কেন ডাকছিলাম? তুমি কেন এইটা করলা আমার সাথে, তিহাম? আমিই কেন? কী ক্ষতি করছিলাম তোমার? ”

রাগের দাপটে মিশমির কপালের কিনারায় প্রায় শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতটির থেকেই দরদর করে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল। এই মুহূর্তে মানুষের দিকে মুখ তুলে চাইতে না পারার যে সর্বগ্রাসী যন্ত্রণা তার অন্তরে মরে যাওয়ার তীব্র বাসনা সৃষ্টি করছে তা হয়তো মুখের ভাষায় ব্যাখ্যাতীত। মিশমি তিহামকে আবারও থাপ্পড় মারল। একটা নয়, দুইটা নয় বরং ততোগুলো বা ততোক্ষণই থাপ্পড় মারল ঠিক যতক্ষণ সময় লাগল তার এই কথাটি বলতে,

“ কতোবার বলছিলাম— তুমি আমাকে টাচ করবা না, আই ডোন্ট লাইক দিজ? বলো, কতোবার না করছিলাম? তুমি এতোটা নির্লজ্জ কীভাবে হতে পারলা, তিহাম? আমাকে তোমার রাস্তার মেয়ে মনে হইছিল যে, যখন তোমার টাচ করতে মনে চাইবে, তোমার কিস করতে মনে চাইবে তুমি আমাকে ইউজ করবা? জাস্ট ফর আ লিটল কিস তুমি আমার লাইফটা এভাবে নষ্ট করে দিলা? তোমার ভালোবাসা কোথায় ছিল তিহাম? এতো এতো ভালোবাসার থেকে তোমার কাছে একটা কিস খুব বড় হয়ে গিয়েছিল সেদিন? ”

কথাগুলো বলতে বলতেই ক্ষীণ হয়ে এলো মিশমির স্বর। মস্তিষ্ক কাজ করছে না, কারো উপস্থিতিই মেয়েটাকে দমিয়ে রাখতে পারছে না। এই শান্তশিষ্ট মেয়েটাও এমন তেজস্বিনী হতে পারে না-কি? তাকে নিশান সামলাতে গেলেও উল্টো ধমক খেয়ে দূরে সরে আসতে হলো। বন্ধু বলল,

“ মিশু? আর একটা কথাও বলবি না এর সাথে৷ তোর মাথা থেকে রক্ত পড়তাছে, বুঝতাছোস না? এদিক আয় তুই। ”

না, মিশমি এক পা-ও সরে দাঁড়ালো না। তখন সে নিজ গালে তিহামের স্পর্শ পেতেই ধক করে জ্বলে উঠল৷ ছেলেটা তার গাল, কাঁধে হাত বুলিয়ে যতই কথা ঘুরিয়ে নিতে চাইছে ঠিক ততই যেন ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে যাচ্ছে মেয়েটির। মিশমি বজ্রকণ্ঠে বলল,

“ হাত সরাও। ”

তিহাম সরালো না। সে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দিতেই ব্যস্ত। তিন-চারবার বলার পরও যখন তিহামকে থামানো গেল না তখন রণরঙ্গিণী মিশমি হাতের কাছে কাঁচের এক সরু ফুলদানি পেয়ে সজোরে তিহামের মুখমণ্ডলে আঘাত করল। এইবারের আঘাতে শুধু তিহাম-ই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল না, আঘাতকারী মিশমিও কাঁধে হাত চেপে মেঝেতে বসে পড়ল। সকলে মিশমির কাজে একপ্রকার হতভম্ব প্রায়! চোখের সামনে যা ঘটছে তা স্বপ্ন না-কি সত্যি? সবাই দেখতে পেল— তিহাম নাকে হাত দিয়ে আর্তনাদ করছে কিন্তু মিশমির মনে দয়ার সঞ্চার হলো না৷ সে পায়ে ব্যাথা নিয়েই এগিয়ে গেল ছেলেটির কাছে। চোখমুখ খিঁচে, দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগল,

“ তোমার কি বিন্দুমাত্রও লজ্জা নাই যে এখানে ছুটে আসছো? আমাকে আর কতো পঁচাবে তুমি, কতো? আব্বু-আম্মুর কাছে ছোট করছো, ভার্সিটির টিচারস, স্টুডেন্টস সবার কাছেই ছোট করছো আমাকে। এখন আর কী চাইতে আসছো তুমি? ”

মেয়েটার কান্নাটা বোধহয় থামলো একটু। অতঃপর অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে বলল,

“ ও হ্যাঁ, তুমি না আমাকে অফার করছিলা আমার বাসায় এক রাত কাটাবা? সেইটা তো রিজেকশনেই পড়ে আছে। তুমি এখন ওইটাও হাসিল করার জন্য আমাকেই চাইছো? তুমি কীভাবে আমাকে এমন কিছু অফার করতে পারছিলা, তিহাম? তোমার আমাকে প্রোস্টেটিউট মনে হয়? কোথায় গেছিল তোমার এতো প্রমিজ, এতো ভালোবাসা যখন তুমি আমাকে এমন কিছু অফার করছিলা? এতোটা ছোট তো না করলেও পারতা! এবার কি সেই স্বার্থ হাসিল করে আমাকে একদম মেরে ফেলতেই আসছো তুমি? আরো ছোট করতে চাইছো? ”

কথাটা শেষ করেই মিশমি হুহু করে কেঁদে উঠল। বদ্ধ চার দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হওয়া সেই ভয়ঙ্কর ক্রন্দনের মায়াবী নারীস্বর মুহূর্তেই থমকে দিল প্রত্যেকটি মানুষকে। মিশমি ক্রন্দনে উন্মাদী হয়ে বলে উঠল,

“ তোমার আচরণে আমার মরে যেতে ইচ্ছা করতেছে, তিহাম। ভালো তো বাসো নাই, অন্তত মানুষের সামনে মুখ তুলে দাঁড়ানোর মতো সম্মানটাও তো দিতে পারতা? তুমি তো আমার কাছেই আমাকে খারাপ বানিয়ে দিছো, তিহাম। তোমার হাজার দোষ জেনেও তো তোমাকে শুধরে নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি? আমার আমাকে ঘৃণা হচ্ছে। কী-করে দুনিয়ার সব ভুলে গিয়ে তোমাকে বিশ্বাস করলাম আমি? কী-করে? ”

মিশমি অবিশ্রান্ত কাঁদছে। পাগলের মতো কেঁদে মনে ধরে রাখা সকল কিছুই উন্মুক্ত করে দিয়েছে সে। কিয়ৎক্ষণ পর তিহাম যখন উঠে দাঁড়িয়ে মিশমিকে ফের কিছু বলতে নিবে ঠিক তার আগেই সাহেল ধমকে উঠল চলে যাওয়ার জন্য। সে জানে— ভার্সিটিতে হোক আর ভার্সিটির বাহিরে, সাহেলের কথা না শুনলে তাকে আবারও মারা হতে পারে। এই ক্ষমতাবান ব্যক্তির কথা মান্য করা ছাড়া উপায় নেই। তাই সে চলে যেতেই একে-একে সকলেই দ্বার থেকে চলে গেল, যারা চিৎকার চেঁচামেচিতে ছুটে এসেছিল এখানে। সবটা শুনে একজন ডাক্তার বললেন যেন কেবিনের দরজাটা লাগিয়ে দেওয়া হয়, নয়তো পাশের কেবিনে থাকা রোগীদের অসুবিধা হবে। ঠিক তা-ই করা হলো। যে মেয়েটি মেঝেতে বসে, হাঁটুতে মুখ গুঁজে পাগলের মতো কাঁদছে; সেই মেয়েটির কান্না দেখে নীলাশাও চোখের জলে গলদেশ ভিজিয়ে ফেলেছে। অথচ মিশমিকে দেখো, রক্তে জামাটা জবজবে হয়ে যাচ্ছে দেখেও সে মাথায় ব্যাণ্ডেজ করতে দিবে না। কী-করে দিবে? তার যে মরণ চাই মরণ! এক শান্তির মরণে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে মুখ লুকিয়ে ফেলতে চায় সে। এছাড়া আর উপায়ই-বা কী? এতোগুলো মানুষের মাঝে সবাই শুধু উপলব্ধিই করতে পাচ্ছে তার কষ্ট। অথচ কষ্টটা কিন্তু সে-ই বেশি পাচ্ছে, অন্যকেউ না।

দীর্ঘক্ষণ বাদে ওভাবে কাঁদতে-কাঁদতেই মিশমি শুনতে পেল অতিপরিচিত এক কণ্ঠ। সে মাথা উঠালো না, চেয়ে দেখলো না একটি বারও। অপরজন আবারও ডাকলো,

“ আমার উপর দয়া করে একবার তাকাবা, মিশমি? ”

তবুও সহসা তাকালো না মেয়েটি। সময় নিল মুহূর্ত কয়েক। অতঃপর বৃদ্ধি পাওয়া কাঁধের ব্যাথাটা নিয়ে খুব সাবধানে মাথা উঁচিয়ে তাকাতে দেখা গেল তাকে। ক্রন্দনে ফেঁসফেঁসে কণ্ঠে এলোমেলো বুলিতে বলল,

“ বিশ্বাস করেন, আমি ওর সাথে জেনে-বুঝে যাই নাই। আমি তার আগেরদিন-ই ওকে বলছিলাম শুধু একটা বই নিতে যাব। আমার ফোনে এখনো মেসেজগুলো আছে। ও ওর ফোন থেকে অনেক মেসেজ ডিলিট করে স্যারকে, আমার আব্বু-আম্মুকে দেখাইছে। বিশ্বাস করেন, আমি সত্যিই বুঝি নাই ও… ও… ”

সায়ান বাঁধা দিল, “ তোমার বাবা-মা, তোমার ফ্রেন্ডসরা সবাই তোমাকে বিশ্বাস করে, মিশমি। এরপরও তোমার কারো বিশ্বাস পাওয়ার প্রয়োজন আছে? ”

মিশমি এবার ফুঁপিয়ে উঠে প্রশ্ন করল, “ আপনি করেন না? আপনি বিশ্বাস করছেন না, তাই না? ”

“ আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে তোমার কী আসে-যায়, মিশমি? ”

মিশমি থমকালো। বিস্ময়কর এক অদৃশ্য সত্তা যেন মুহূর্তেই ফুঁ দিয়ে এলোমেলো করে দিল মেয়েটিকে। আশ্চর্য! সে সায়ানের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করেছে বলে এতটাই অনুতপ্ত যে, এই তাম্রবর্ণের করা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের জন্য ফুঁপিয়ে উঠল সে? মিশমির চোখ দুটো পুনরায় জলে টইটম্বুর হলো। রাগে অরুণরাঙা মুখটা ঢেকে নিল সে। ঠিক তখনই… হ্যাঁ, ঠিক তখনই ভরসার সেই হাতটা বাড়ানো হলো তার দিকে। তাকে বলা হলো,

“ তোমাকে আমি, আমরা সবাই এতোটাই বিশ্বাস করি ঠিক যতটা বিশ্বাস করলে নতুন করে বিশ্বাস করার আর কথা-ই থাকে না। আমি আর এই আমরাই কী যথেষ্ট না? ”

এই তৃপ্তিদায়ক কথাটা শুনেও যেন তৃপ্তি মিললো না। মিশমি আবারও ফুঁপিয়ে উঠল,

“ স্যার বলছে— এক হাতে তালি বাজে না। কিন্তু আমি সত্যিই ইচ্ছা করে… ”

সায়ান আবারও থামিয়ে দিল তাকে। বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,

“ যআ হওয়ার তা হইছে৷ আর কান্না করবা না। আমার বড় মানুষের কান্না সহ্য হয় না। ”

মিশমি তবুও থামলো না। সায়ানের হাত ধরেই দুঃসহ শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে বিছানায় বসল মেয়েটি। আজকের পর তার কাঁধ আর পায়ের দশা যে সুকরুণ হবে তা ইতোমধ্যেই বুঝতে পেরেছে সে। তবুও মেয়েটির কান্না থামলো না৷ আর যখন থামলো তখন সায়ানের প্রস্থানের সময় হয়ে এলো। অনেক কথা চেপে রাখা হলো আজও। তবে দীর্ঘক্ষণ পর যখন মেয়েটির বাবা-মায়ের আসার সময় হয়েছে বুঝতে পেরে সায়ান চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো, ঠিক তখনই মিশমি পুরনো দিনের মতোই মিনমিনে স্বরে বলল,

“ আপনার যদি বড় মানুষের কান্না সহ্য না হয় তাহলে আপনি সেইদিন কাঁদলেন কেন? নিশানরা তো বলল ফোনে। আপনি কিন্তু কাঁদছিলেন অনেক! ”

সায়ান দ্বারটা খুলেই পিছনে ঘুরে দাঁড়ালো। উত্তরে হাসি ফিরিয়ে এতোটাই বিড়বিড় করে উত্তরটা দিল যেন মিশমি শুনতে না পায়,

“ তোমাকে ফিরে পাওয়ার তৃপ্তিতে! অথচ দেখো— তোমাকে বলতেই পারলাম না যে, কতটা ভালোবাসলেও তোমাকে আমার পুরনো মনে হয় না। মনেহয় এই প্রথম তোমার-আমার দেখা, এই প্রথম তোমার-আমার কথা বলা। আর এই প্রথম ও শেষবারের মতোই কাউকে ভালোবেসে আমার পাগল হওয়া। তোমাকে ভালোবাসতেও আমার ভালো লাগে, মিশমি। সেই তুমি আমায় ভালোবাসো আর না-বাসো। ”

সায়ান আরেক দফা মুচকি হেসে শুধালো মিশমিকে যে, সে কিছু শুনতে পেল কি-না। সায়ান জানে— এতো দূরত্বে তার কথা মিশমি অবধি পৌঁছাবে না। কিন্তু ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়’ নামে প্রবাদটি তো আর এমনই গড়ে উঠেনি? মিশমির ডাকে সাড়া দিয়ে পিছনে তো আর ঘুরে দেখাই হলো না তার! ওই মেয়েটির স্তব্ধতার অস্বাভাবিকতা দেখে সায়ান যখন পিছনে ঘুরে তাকালো, তখন নিজের সামনে দেখতে পেল নার্সকে। না, এ-অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু নার্সের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ঝুমুর বেগম ও মঈনুল হোসেনকে তার দিকেই বড়-বড় চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখতে সায়ান ভয়ের বশেই পিছিয়ে গেল দু’কদম। মনে হলো ব্যাঙের মতোই লাফিয়ে উঠল ছেলেটি। শ্যাষ! মিশমি আর তার দেখা হবার বুঝি আজ-ই শেষ দিন কারণ, উপস্থিত তিনজনকে দেখে সে ভালোই বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। ও মা, নার্সটা কেমন হাসছে দেখো! সায়ান ফের বিড়বিড়িয়ে উঠল অত্যন্ত ভয়ে, “ আমি শ্যাষ! ”

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

(#বিঃদ্রঃ রাইটিং ব্লকে থেকেও লিখতে হচ্ছে। সুবিন্যস্ত প্লটটাও বেশ অপরিচিত লাগছে। এইযে আজ যেমন লিখলাম! পাঠকদের প্রকৃত উৎসাহ চাই যা তারা মনে করেন। সেখানে কী-কী বিষয় উন্নতি করলে ভালো হয় তা বললে আরও বেশি ভালো হয় আমার জন্য।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here