#তবু_মনে_রেখো
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৯
জোহরা বারান্দায় মাথায় হাত দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে বসে আছে। কুসুম ফিরে এসেছে অনেক আগেই কিন্তু সন্ধ্যা আর ফিরে আসেনি। তিনি কী করবেন ভেবে পেলেন না। ছোট মেয়েকে না পেয়ে ভয়ে হিতায়িত জ্ঞান হারিয়ে সন্ধ্যাকেই কিনা পাঠিয়ে বসলো খোঁজতে! এই ভুল সে কীভাবে করতে পারলো!
জোহরা এগিয়ে গিয়ে কুসুমকে মারতে নিল। কিন্তু হাত তুলেও মারতে পারলো না। সে মেঝেতে বসে পড়ে দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল।
কুসুম ভয়ে পর্দার আড়ালে গিয়ে কাঁপছে। তার জন্য এতকিছু হবে সে সেটা ভাবতে পারেনি। লিনাই তো তাকে খেলতে দিয়ে পথ আটকে রেখেছিল। সে কী জানতো এতকিছু হবে! এখন আপাটা ভালো ভালোই ফিরে আসলেই হলো। আপার জন্য তার নিজেরও ভয় লাগছে।
আনিস মিয়া দৌড়ে এলো। তিনি শহর থেকে মাত্রই ফিরেছেন। বাস থেকে নেমে গ্রামের রাস্তা ধরতেই একজনের কাছ থেকে নিজের ঘরের এমন খবর পেয়ে তিনি দৌড় লাগালেন। বয়সের ভারে এখন আর এতো দৌঁড়াতে পারেন না কিন্তু ঘরের এমন খবর কেই বা চুপচাপ শুনবে!
তিনি স্ত্রীর পাশে বসে হাঁফাতে লাগলেন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আনিস মিয়া চমকালেন। দুনিয়ার যা কিছু হতো না কেন জোহরা নিজেকে অনেক শক্ত আর স্বাভাবিক রাখতো কিন্তু আজ! আজ কীভাবে এতটা ভেঙে পড়েছে সে!
আনিস মিয়া কাঁধে হাত রাখলো। জোহরা স্বামীর কোমর জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। কান্নার মাঝে অস্পষ্ট সুরে বলতে লাগলেন,’আমার মেয়ে আমার সন্ধ্যা কই!’
আনিস মিয়া চুপ থেকে স্ত্রীর মাথায় হাত রাখলেন। ভরসার কণ্ঠে বলে উঠলেন,’এভাবে ভাইঙ্গা পইড়ো না।’
রাত গড়িয়ে এসেছে। ধরণীর বুকে আলো বিদায় নিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে। আশেপাশের প্রতিবেশীরা কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে জোহরাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। উঠানের বারান্দায় হারিকেনের নিভু নিভু আলো ঘরটাকে অদ্ভুত করে রেখেছে। জোহরা উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়াতেই সে তাল সামলাতে পারলো না। মাথা ঘুরে পড়ে গেল। পাশের এক মহিলা এসে তাকে ধরে বারান্দার খাটে শুয়ে দিল। চোখ বন্ধ অবস্থায়ও তিনি সন্ধ্যার নাম জপতে লাগলেন।
আনিস মিয়া স্ত্রীর পাশে বসে ভরসা দিল। তার দেহটা ক্লান্তিতে আর সইছে না। এভাবে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। তার মাইয়াকে খুঁজে আনা লাগবই। এই মাইয়াকে সে কোনোদিন কাছে টাইনা আদর করেনি। যেই মাইয়াকে নিয়ে তার এতো ভয় আছিল সেই মাইয়াই কিনা! না, আনিস মিয়া ভাবতে পারলো না। তার বইসা থাকলে চলবো না। সে উঠে দাঁড়ালো। এরপর উঠান পেরিয়ে কয়েকজন মানুষ নিয়ে চলে গেলেন।
হারিকেনের নিভু নিভু আলোর দিকে জোহরা তাকিয়ে আছে। তার চোখে আর পানি নেই। শুকিয়ে যাওয়া চোখ কিন্তু জ্বলছে খুব।
‘সর্বনাশ হইয়া গেছে খালাম্মা!’
জোহরা চমকে উঠে দাঁড়ালো। বারবার সে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে কিন্তু এইবার শক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো।
উঠান দিয়ে আনিস মিয়া সন্ধ্যাকে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসছে।
জোহরার পা আপনাআপনি থেমে গেল। সে আর পা সামনে আগাতে পারছে না। যেন মনে হচ্ছে সে একটা শক্ত পাথরে পরিণত।
আনিস মিয়া দ্রুত সন্ধ্যাকে ঘরে নিয়ে গেল।
——-
চেয়ারম্যান সাহেব এসেছেন প্রস্তাব নিয়ে। প্রস্তাবটা হলো তার ভাইপো হারুনের সাথে সন্ধ্যার বিয়ে।
তা শুনে জোহরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আনিস মিয়ার কড়া নিষেধাজ্ঞার জন্য সে এতক্ষন সব চুপচাপ হজম করছিল কিন্তু তাই বলে এমন একটা প্রস্তাব তো মানা যায় না। সে এসব অন্যায় আবদার মানবে না। ম’গের মু’ল্লু’ক পাইছে নাকি।
‘এই বিয়ে হবে না। আমি থাকতে এটা কিছুতেই হবে না।’
আজগর শেখ ফিরে তাকালেন। কতগুলো বছর পরে সেই তেজি মানুষটি তার সামনে!
‘তুমি কী কইতাছো তুমি নিজেই জানো না।’ বলেই আনিস মিয়া তড়িঘড়ি করে স্ত্রীকে জোর করে ঘরে নিয়ে গেলেন কিন্তু জোহরার প্রতিবাদী গলা ভেসে আসছে। আজগর শেখ হাসলেন। তার জীবনের প্রথম মানবী! অথচ সেই আগের মতোই রয়ে গেল! একটুও বদলায়নি!
জোহরাকে আনিস মিয়া মেয়ের সাথে সাথে রুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।
দিন পেরিয়ে বিকাল গড়িয়ে এলো। সন্ধ্যা নামবে বলে!জোহরা উঠানের দিকে দৃষ্টি দিল।
চেয়ারম্যান সাহেব যাওয়ার পরে আনিস মিয়ার সাথে তার কথা কাটাকাটি হয়েছে। তিনি যাওয়ার সময় বলে গিয়েছেন এই বিয়ে সে দিবেই। চেয়ারম্যানের কথা সে ফেলবে না। সে যে তখন বের হলো এখনো ফিরলো না। জোহরা আর মাথা ঘামালো না। সে মেয়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
সন্ধ্যা গায়ে চাঁদর মুড়িয়ে খাটে হেলান দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা এখনো সময়টা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। জোহরার খারাপ লাগলো। তার এমন চঞ্চল মেয়েটাকে এমন নিথর বানিয়ে দিল কে সে এখনো জানে না। একদিন না পেরোতেই আনিস মিয়া এভাবে মেয়ের বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তা জোহরার সহ্য হচ্ছে না। আনিস মিয়ার মতে,সেদিন কিছু হতে পারেনি। কেননা, ওই ঝোপঝারে ভাঙা ঘরটাতে চেঁচানোর আওয়াজ শুনে তারা সেখানে গিয়েছিল। তখনই অনেক লোকের পালানোর শব্দ হয়েছিল। আনিস মিয়ার মতে সর্বনাশ না হলেও মেয়ের বদনাম তো হয়ে গিয়েছে। তাই তিনি চান তড়িঘড়ি করে মেয়েকে বিয়ে দিতে কিন্তু জোহরা মানতে নারাজ।
আনিস মিয়ার কথানুযায়ী,এমন বদনামওয়ালা মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না। তাই যেই পাত্রই হোক না কেন বিয়ে পড়িয়ে দিলেই সম্মান বাঁচবে। কিন্তু জোহরা তা মানতে পারছে না। তার মেয়ে কী ফেলনা! তার উপর ওই বখাটে হারুনের সাথেই বিয়ে! জোহরা আন্ডাজ করছে সন্ধ্যার এসবের জন্য হারুনই দায়ী। যদি এমনটা হয় তবে সে ওই ছেলেকে ছাড়বে না কিছুতেই।
সন্ধ্যা বাইরে তাকিয়ে আছে। জোহরা আস্তে করে মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি মেয়ের কাঁধে হাত রাখলেন। সন্ধ্যা ফিরে তাকালো না।
‘মা, কিচ্ছু তো হয় নি। তুই এভাবে ভেঙে পড়িস না মা।’
মায়ের কথায় সন্ধ্যা নিশ্চুপ রইল। তা দেখে জোহরার মনে আরো অপরাধবোধ জেগে উঠল। সে মেয়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছে না। তার নিজের ভুলের জন্য মেয়ের জীবন নাশ হতে যাচ্ছিলো। জোহরা এসে মেয়ের পাশে বসলেন।
সন্ধ্যা মায়ের দিকে ফিরে তাকিয়ে চুপচাপ জড়িয়ে ধরলো। জোহরা মেয়ের মাথায় হাত বুলালেন। কাল বাদে পরশু মেয়েটার বিয়ে তাও বা সেই হারুনের সাথেই! এটা কিছুতেই সে মেনে নিতে পারছে না। তার ফুলের মতো মেয়ের সাথে এমন একটা ছেলের বিয়ে। কিন্তু আনিস মিয়া তার কথায় অনড়। চেয়ারম্যান সাহেব স্বয়ং এই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। তাতে তিনি দিরুক্তি করবেন না তার উপর এমন বদনাম ওয়ালা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে এটাই অনেক।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। রিচেক করা হয়নি, তাড়াহুড়োয় লিখেছি তাই অনেক ভুল আছে। এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী।)