তবু মনে রেখো পর্ব ৮

0
100

#তবু_মনে_রেখো
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৮

জোহরা ভাতের প্লেট নিয়ে সন্ধ্যার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে দুইবার দরজা ধাক্কালো। না, ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। জোহরা ভাবনায় পড়ে গেল। কলেজ থেকে ফিরে কী হয়েছে মেয়েটার!
সে ঘরের বাইরে তাকালো। কুসুমটা কোথায় জানি বেরিয়েছে। এই মেয়েটাকে নিয়েও আর পারা যায় না। স্কুলের পরে এসেই যে বের হয় আর পাওয়া যায় না। তাই তো সে আসার সাথে সাথে জোহরা ভাত খেতে দিয়ে দেয়। আজকেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। জোহরা ভেবেছিল, সন্ধ্যা প্রতিদিনের মতো আস্তে ধীরে গোসল করে খাবে। আজকেও এটাই ভেবে সে নামাজে বসেছিল।
জোহরা নামাজ শেষে এসে রান্নাঘরে সব একইরকম দেখে সন্ধ্যার রুমের দিকে এগিয়ে গেল। ভাবলো, তার সাথে খাবে বলে হয়ত মেয়েটা না খেয়ে অপেক্ষা করছে। সে সন্ধ্যার রুমে যেতে যেতে বার দুয়েক ডাকলো। মেয়ের সাড়া না পেয়ে তার টনক নড়লো। মেয়েটার শরীর খারাপ হলো না কি! জোহরা দ্রুতপদে সন্ধ্যার রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
রুমে ঢুকতেই সন্ধ্যাকে জানালার বাইরে সুদূর বিলের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেল। জোহরা এগিয়ে গেল।
‘এভাবে ডাকছি। সাড়া দিচ্ছিস না কেন? ভাত খাবি না? আমি ভাত বেড়ে দিচ্ছি। খাবি আয়।’ বলেই জোহরা চলে আসতে নিতেই মেয়ের সাড়া শব্দ না পেয়ে আবার পিছু ফিরলো। জোহরা এগিয়ে সন্ধ্যার কাঁধে হাত রাখতেই সন্ধ্যা ফিরে তাকালো।

আচমকা জোহরা দূরে সরে গেল। মেয়ের এমন কান্নামাখা ভয়মিশ্রিত চেহারা দেখে থমকে গেল সে।
সে দৌড়ে মেয়ের একদম কাছে চলে আসলো। সে উদভ্রান্ডের ন্যায় মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘মা, তোর কী হয়েছে? এমন ক্যান লাগছে?’
সন্ধ্যা মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে ফেলল। তার ভয়ার্ত চেহারা দেখে জোহরা মেয়ের দুগালে হাত রাখলো। আদুরে কণ্ঠে বলল,
‘কী হয়েছে? মাকে বল?’
মায়ের ভরসা মাখা কণ্ঠে সন্ধ্যা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
‘মা, আমি ভুল করে ফেলেছি।’
‘কী করেছিস? আর এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন?’
‘আমি থা’প্প’ড় মেরেছি।’ বলেই সন্ধ্যা নিজের ডান হাতটা সামনে এনে দেখলো,’এই হাত দিয়ে।’
জোহরা মেয়ের কথা বুঝতে পারলো না। সে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে রইল। কী বলছে তার মেয়ে এসব। তার মনে অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। জোহরা নিজেকে শান্ত করলো। আস্তে ধীরে সব জানবে কিন্তু তার আগে তার নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে হবে। কিন্তু স্বাভাবিকই বা কীভাবে থাকবে! তার মেয়ে এসব কী বলছে! ততক্ষনে কুসুম রুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো।
‘মা, আপা ওই বখাটে হারুনকে থা’প্প’ড় মেরেছে।’
জোহরা চমকালো। সে কুসুমের কথা শুনে সন্ধ্যার দিকে তাকালো। এই হারুনকে তো সবাই চিনে। তার ভয়ে পুরো এলাকার মহিলারা তাদের মেয়েদের সাবধানে রাখে আর তার মেয়ে কিনা সা’পের লেজেই পা দিয়ে দিয়েছে! তার আগে সব জানতে হবে। জোহরা নিজেকে শান্ত আর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। এমন ভাব করলো যেন সেটা স্বাভাবিক।
সে মেয়েদের জিজ্ঞেস করলেন,
‘মাকে খুলে বলতো সব।’
কুসুম এসে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব বলতেই জোহরা থমকে দাঁড়ালো। মেয়েদের ভাবভঙ্গিমা দেখে জোহরা নিজেকে স্বাভাবিক করলো। এখন আর আফসোস করে লাভ নেই। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। তারই মেয়েগুলোকে সাবধানে রাখা উচিত ছিল। এখন থেকে সাবধানে থাকতে হবে।
জোহরা হাসার চেষ্টা করলো।
‘এটার জন্য এমন করছিস? হ্যাঁ, এটা তোর উচিত হয়নি কিন্তু ন্যায় করেছিস। অন্যায় তো কিছু করিসনি। ভয় পাস না। কিচ্ছু হবে না। তোর এই মা তোর পাশে আছে।’
জোহরার সান্ত্বনা পেয়ে সন্ধ্যা মাকে জড়িয়ে ধরলো। সে মায়ের ভরসা পাচ্ছে কিন্তু পরে যদি কিছু হয়!
জোহরা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ভাবনায় ডুবে গেল। হারুন যদি এটার রেশ ধরে কিছু করে বসে! কিন্তু কী বলবে সে! তার মেয়ে যে তারই তেজি রূপটা পেয়েছে! সে যে ভুলটা করেছিল সেটারই প্রতিচ্ছবি ভাসছে তার চোখে। জোহরা আঁতকে উঠল। না এটা কী ভাবছে সে! এটা সে জীবনেও হতে দিবে না। সে বেঁচে থাকতে এটা হবে না। জোহরা মেয়েকে বুঁকের মাঝে আগলে নিল। সন্ধ্যা মায়ের বুকে ছানার মতো করে ঢুকে গেল।
মায়েদের গায়ে একটা অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে যেটাতে একটা সম্মোহনী মায়া মেশানো আছে,যা মুহূর্তেই ভুলিতে দেয় সমস্ত যন্ত্রনা,হতাশা। যা হাজার ভুলের মাঝেও একটা পূর্ণাঙ্গ ভরসা দেয়। সন্ধ্যাও ব্যতিক্রম নয়। সে মায়ের বুকে আরো ঝাপ্টে পড়ে কাঁপতে লাগলো। সে জানে তার সাথে মা আছে কিন্তু কোথাও জানি তার ভয় হচ্ছে ভীষণ। হারুন পারে না এমন কোনো কাজ নেই।
দিন পেরিয়ে রাত হলো। গভীর রাতে সন্ধ্যার মনে হলো তাদের ঘরের আশেপাশে কেউ আছে। সন্ধ্যা ভয় পেল। সে উঠে বসতেই জোহরা হারিকেন নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। অন্যদিনের তুলনায় আজ জোহরার কান বেশি সজাগ হয়ে উঠেছে। সে বড়ো করে শব্দ করে ডাক দিল।
‘কে ওখানে!’
জোহরার শব্দ পেয়ে ধুপ ধুপ শব্দ শোনা গেল। মনে হলো কেউ দৌড়ে পালাচ্ছে। জোহরা সন্ধ্যার মাথায় হাত বুলিয়ে ভরসা দিল।
‘শুয়ে পড় মা।’
জোহরা নিজের জায়গায় শুয়ে পড়তেই সন্ধ্যা উঠে হারিকেনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার এই ব্যাপারটা কী আর কাউকে বলা উচিত! আর কেউ বলতেই সন্ধ্যার মুহিবের কথা মনে পড়লো। কেননা মুহিবকে দেখতে এলাকার বড়ো ঘরের মনে হয়েছিল। মুহিব তাকে একটা চিঠি দিয়েছিলো যাওয়ার আগে। সেই চিঠিতে তার শহরের পোস্ট অফিসের ঠিকানা দেওয়া আছে। সে কী ব্যাপারটা মুহিবকে বলবে? তার কী তাকে অবগত করা উচিত যে সে কাউকে থা’প্প’ড় মেরেছে!
সন্ধ্যা তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো। সে ব্যাগ থেকে মুহিবের শেষবার দেওয়া চিঠিটা নিয়ে বুকে আগলে নিল। হাতে কলম নিয়ে লিখতে গিয়েও সে লিখলো না। থাক, পরীক্ষার মাঝে আবার মুহিব চিন্তা করবে।

———

আজ কুসুমের পরীক্ষা শুরু। জোহরা সন্ধ্যাকে কলেজ যেতে দেয়নি। সন্ধ্যা নিজেও যাবে না। স্কুল বেশি দূরে নয়। এই এলাকার পথ দিয়ে কিছুদূর হাঁটলেই স্কুল কিন্তু বিলের আইল ধরে হাঁটলে একদম কাছে। জোহরা কুসুমকে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছে। সে চাই না বাড়িতে সন্ধ্যা একা থাকুক।

দুপুরের আজান পড়ে গেছে সেই অনেকক্ষন যাবৎ কিন্তু কুসুমের আসার সাড়াশব্দ নেই। জোহরা আশেপাশে খুঁজলো তবে কুসুমের খোঁজ পেল না। জোহরা প্রথমে ভাবলো প্রতিদিন আপা থাকে তাই সরাসরি চলে আসে আজ হয়ত বন্ধুদের সাথে খেলতে সময় পার হয়ে যাচ্ছে। এদিকে আজই আনিস মিয়া ফিরবেন। সেজন্য ভয়টা একটু বেশিই। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতেই জোহরা আঁতকে উঠল। কুসুম গেল কই! এই বাড়ি ওই বাড়ি কোথাও নেই!
জোহরা হিতায়িত জ্ঞান হারিয়ে সন্ধ্যাকে পাঠালো স্কুলের দিকে আর জোহরা গেলো দূরের এলাকাতে কুসুমের খোঁজ নিতে।
সন্ধ্যা বোনের জন্য উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেল। সে ঘোমটা টেনে বটতলার দিকে যেতেই হারুনের দলকে দেখে টনক নড়লো। সন্ধ্যাকে দেখে হারুন এক বি’শ্রী হাসি দিল। যেন মনে হচ্ছে সন্ধ্যা আসবে সেটা সে জানতো। সন্ধ্যার মনে ভয় চেপে ধরলো। সে ভীতু চোখে আশেপাশে তাকালো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসাতে রাস্তায় আর মানুষ নেই। সন্ধ্যা নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল। তার বুক ধড়ফড় করছে। সে পিছু ফিরে আসতে নিতেই হারুন বসা থেকে লাফ দিয়ে সামনে এসে তার পথ আটকে ফেলল। সন্ধ্যা ভিতরে ভিতরে নিজেকে প্রস্তুত করলো। হাল ছেড়ে দিলে হবে না। তার যেভাবেই হোক পালাতে হবে। সে হারুনকে ডিঙিয়ে দৌড়ে আসতে নিতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। পা জ্ব’ল’ছে খুব। সন্ধ্যা উঠে বসার চেষ্টা করলো। সে দাঁড়ানো হারুনের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো হারুনই তার পা দিয়ে সন্ধ্যাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফেলেছে। হারুনকে তার পাশে বসতে দেখে সন্ধ্যা বসা অবস্থায় পিছনে হেলিয়ে পড়লো। হারুন সন্ধ্যার সামনাসামনি বসে তার ঘোমটা টেনে ফেলে দিল।
সন্ধ্যা চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার শেষ রক্ষা কী আর হলো না!
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। থিমটা যেমনটা ভেবেছিলাম তেমনটাই সেমভাবে আগানো হবে। আমি বেশি টানতে পারি না। খুব তাড়াতাড়ি গল্পটা শেষ হবে। যারা পড়েন, ছোট করে হলেও একটা মন্তব্য করবেন প্লিজ। রিচ একদম নেই। তাই আমার অনুরোধ একটা মন্তব্য। ভুল ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here