টক ঝাল মিষ্টি পর্ব ১৫

0
99

#টক_ঝাল_মিষ্টি
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-১৫

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে এবার বিদায়ের পালা। শিরিনা বেগম আর মোয়াজ্জেম সাহেব কুহুকে ধরে নিয়ে বাইরে এগুচ্ছেন। তাদের পিছনে যিয়াদ আর বাকিরা। যিয়াদের এতক্ষনের এত আনন্দ হঠাৎ করেই থেমে গেছে,চারদিকে এত রোশনাই,আলোকসজ্জা যেন তার কাছে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। কুহু যতই গেটের দিকে আগাচ্ছে ততই যেন তার ভিতরটা ফাঁকা লাগছে। মাটিতে গড়ানো কুহুর ওড়নাটা তুলে হাতে নিলো,হাত নিয়ে কুহুর হাঁটার সাথে তাল মিলালো।

গেটের সামনে গাড়ির কাছে শাহাদ দাঁড়িয়ে আছে। অন্যান্য বরযাত্রীরা অনেকেই রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে। শিরিনা বেগম যতই কুহুকে নিয়ে সামনে আগাচ্ছেন ততই যেন তাঁর বুক ভেঙে আসছে৷ মোয়াজ্জেম সাহেব আগে থেকেই উনাকে কান্নাকাটি করতে বারন করেছেন। তবুও তিনি আদরের মেয়েকে সারাজীবনের জন্য স্বামীর বাড়ি পাঠিয়ে দেয়ার সময় কান্না ধরে রাখতে পারছেন না। আস্তে আস্তে সবাই গেটের বাইরে শাহাদের গাড়ির সামনে এসে থামলো। শাহাদ গাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মোয়াজ্জেম সাহেব কুহুর ধরে রাখা হাতটা বাড়িয়ে দিলেন শাহাদের দিকে। তাঁর চোখ ভিজে গেছে। কুহু নিঃশব্দে ফুপিয়ে উঠলো। কেঁপে উঠলো তার শরীর। মেয়েকে কান্না করতে দেখে শিরিনা বেগম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না কুহুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। কুহুও জড়িয়ে ধরলো মাকে। মা বোনকে কাঁদতে দেখে যিয়াদও কেঁদে দিলো। মা আর বোনকে জড়িয়ে ধরলো। মোয়াজ্জেম সাহেব রুমাল বের করে চোখ মুছলেন। আশফাক খান কাঁধে হাত দিয়ে বন্ধুকে সান্ত্বনা দিলেন। শিরিনা বেগম মেয়েকে ছেড়ে চোখ মুছলেন। কুহু যিয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল-

“আর তোর পড়াশোনায় বিরক্ত করব না। ”

যিয়াদের বুকটা হুহু করে উঠলো। শব্দ করে কেঁদে বললো-
“আপু তুমি যেও না।আমার পড়ায় বিরক্ত করলেও আমি কিছু বলব না। আমি সারাদিন তোমার সাথে গল্প করব।”

কুহু মুখ চেপে কাঁদলো। শাহাদ কি করবে কিছু বুঝলো না। সবার কান্নাকাটির মাঝে নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। কুহুর পরিবারের কান্না দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মোয়াজ্জেম সাহেব চোখ মুছে শিরিনা বেগমকে ইশারা দিয়ে মেয়েকে শান্ত করতে বললেন।শিরিনা বেগম কুহুর চোখ মুছে দিলেন। আকড়ে ধরে শাহাদের কাছে নিয়ে গেলেন।মোয়াজ্জেম সাহেব কুহুর ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলে শাহাদের দিকে। শাহাদ হাত বাডিয়ে কুহুর হাত টা ধরলো। মোয়াজ্জেন সাহেব শাহাদের হাত চেপে বললেন-
“আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো।ভুল ত্রুটি মাফ করে দিয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে নিও। খুব আদরে বড় করেছি,ওকে কষ্ট দিও না।”

শাহাদ মোয়াজ্জেম হোসেনের হাত স্পর্শ করে বলল-
“কুহু আজ থেকে আমার দায়িত্ব। ওর সব কিছুর দায়ভার আমার। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”

মোয়াজ্জেম সাহেব কুহুকে এগিয়ে দিলেন শাহাদের দিকে। শাহাদ আলতো করে টেনে নিলো কুহুকে নিজের দিকে।গাড়ির দরজা খুলে কুহুকে বসতে ইশারা করলো। কুহু পিছন ফিরে তার মা বাবা আর ভাইকে দেখলো। তারপর উঠে বসলো গাড়িতে।শাহাদ গাড়ির দরজা লাগিয়ে দিয়ে মোয়াজ্জেম সাহেবের দিকে তাকালো। মোয়াজ্জেম সাহেব শাহাদের কাঁধ চাপড়ে বিদায় জানালেন, শাহাদ এবার শিরিনা বেগমের কাছে গেলো। শিরিনা বেগম চোখের পানি মুছে শাহাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-

“আমার মেয়েটা একটু চঞ্চল, ভুলভাল কাজ করে।কিন্তু মনটা অনেক ভালো।তুমি ওকে একটু দেখো।”

শাহাদ বিনিময়ে হাসলো। শিরিনা বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যিয়াদের দিকে তাকালো। যিয়াদের চোখ মুখে দুঃখের ছাপ।শাহাদ জড়িয়ে ধরলো যিয়াদকে। শাহাদ জড়িয়ে ধরায় যিয়াদের চোখ পানি আসলো।শাহাদ যিয়াদ কে ছেড়ে দু কাঁধ ধরে বলল-
“মন খারাপ করো না।বোনকে যখনই দেখতে মন চাইবে বোনের বাড়ি চলে আসবে। চাইলে বোনকে সাথে করে নিয়েও আসতে পারো।”

সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শাহাদ কুহুর পাশের সিটে উঠে বসলো।আস্তে আস্তে গাড়ি গুলো চলতে শুরু করলো। কুহু শেষবারের মতো গাড়ির জানালা দিয়ে পরিবারের সবার দিকে তাকালো। মোয়াজ্জেম হোসেন শিরিনা বেগমকে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন আর যিয়াদ চোখ মুচছে।আস্তে আস্তে গাড়ি বড় রাস্তায় উঠে এলো। গাড়ির স্পিড বাড়লো। কুহু চোখ মুছে নিলো।শাহাদ কুহুর কোলের উপর থাকা মেহেদী রাঙা হাতটা আলতো স্পর্শ করলো। কুহু তাকালো শাহাদের দিকে। শাহাদ হাত বাড়িয়ে কুহুর গালে থাকা পানি ভাল করে মুছে দিলো। একটু ঝুঁকে কুহুর নাকের নথটা ঠিক করে দিয়ে বলল-

“এটা তো এভাবেই থাকে তাই না? এটাতে এরকম লাল নীল পাথর ঝুলিয়েছে কেন? ভার লাগে না?””

কুহু ফিক করে হেসে দিলো। নথের হালকা পাথরে ভার লাগবে কেন? সে দুপাশে মাথা নেড়ে বললো-
“লাগে না।”

কুহুর মুখে হাসি দেখে শাহাদের মন খারাপ দূর হয়ে গেলো। আধা ঘন্টা পর বর কনের গাড়ি থামলো খান বাড়ির সামনে। বাড়ির গেট পেরিয়ে গাড়ি বাগানের রাস্তা ধরে বাড়ির সামনে থামলো। শাহাদ গাড়ি থেকে নেমে কুহুর হাত ধরে কুহুকে নামালো। তাকিয়ে দেখলো সদর দরজায় রেজিয়া সুলতানা আর সবাই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।শাহাদ কুহুকে নিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। দুপাশ থেকে ফুল ছিটালো তাদের উপর। সদর দরজায় এসে থামলো তারা। রেজিয়া সুলতানা কুহুর হাত নিয়ে নিলেন শাহাদের কাছ থেকে। রেজিয়া সুলতানা আর জয়া বেগম দুদিক থেকে কুহুকে ধরে ঘরে প্রবেশ করলেন। কুহুকে বসানো হলো ড্রয়িং রুমে।।

শাহাদ মায়ের কাছে ঠিকঠাকভাবে বউ হস্তান্তর করে দম ফেললো। ফ্রেশ হওয়ার জন্য এক ছুটে চলে গেলো নিজের ঘরে। কুহুকে বসানো হলো কুলসুমা বেগমের পাশে।কুলসুমা বেগম কুহুর থুতনিতে ধরে এদিক ওদিক মুখ নাড়িয়ে দেখলেন। সন্তুষ্ট হয়ে বললেন-
“মা শা আল্লাহ!আমার নাতি চাঁদের মতো বউ পেয়েছে।কই রে মালা। আমার গয়নার বাক্সটা নিয়ে আয়।”

মালা একটা পুরনো আমলের গয়নার বাক্স এনে দিলো। কুলসুমা বেগম সেটা থেকে একটা ভারী গলার হার কুহুর হাতে দিলেন। রেজিয়া সুলতানা কুহুকে প্রশ্ন করলেন-
“কুহু তোমার নাকে ব্যান্ডেজ কেন?”

রাফা বললো-
“একটা বাচ্চা ছেলে বল মে*রে ভাবিমনির নাক ফাটিয়ে দিয়েছে।”

সবাই “আহারে” বলে শব্দ করলো। আনিশা দৌড়ে নিচে নামলো। সে তার ঘর গুছাচ্ছিলো, কুহুকে আজ তার ঘরে রাখার কথা। কুহুর কাছে এসে বসে বললো-
“বাহ বউ সাজে বেশ লাগছে তোমাকে।”

জয়া বেগম বললেন-
“কুহুকে এবার ঘরে নিয়ে যা তো। ফ্রেশ হয়ে নিক।আমি কিছু খাবার পাঠাচ্ছি।”

আনিশা কুহুকে নিয়ে ঘরে আসলো। কুহুর সাজ খুলে দিয়ে একটা নরমাল শাড়ি পড়িয়ে দিলো। কুহুকে বিছানা বসিয়ে দিয়ে খাবার নিয়ে আসলো।কুহু অল্প একটু খেলো।খানিক বাদেই বাড়ির মেয়ে বউরা কুহুকে ঘিরে বসলো।বিভিন্ন গল্পে মেতে উঠলো তারা। কুহু শুধু চুপচাপ শুনে গেলো আর মাঝে মাঝে হাসলো। রাতে ঘুমানোর আগে কুহু বাবা মায়ের সাথে কথা বললো।কথা বলতে গিয়ে কুহু কেঁদেই দিলো। শিরিনা বেগম অপর পাশ থেকে নিজেকে সামলে রাখতে চাইলেও পারলেন না। মেয়েকে কোনোদিন কাছ ছাড়া করেননি আজ সেই মেয়ে সারাজীবনের জন্য পর হয়ে গেলো।

রাতে শাহাদের জায়গা হলো না তার ঘরে৷ বাসর রাতের আগ অবদি এই ঘরে সে আসতে পারবে না বলে ঘোষণা করলো রাফা-রিদি। শাহাদ কি আর করবে সে রওয়ানা করলো আউটহাউসের দিকে। তার পড়নে পাঞ্জাবি পায়জামা। ঠিক সময়ে চেঞ্জ করার জন্য নিজেকে ধন্যবাদ দিলো নয়ত চেঞ্জ করার সময়টুকুও হয়ত রাফা দিত না।ড্রয়িং রুমে দেখা হলো রাহাতের সাথে, সে বিরস মুখে বসে আছে।শাহাদ জিজ্ঞেস করলো-
“কি হয়েছে ব্রো?”

রাহাত মুখ তুলে শাহাদের দিকে তাকিয়ে বলল-
“তোমার বোন আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। সে আজ কুহুকে নিয়ে থাকবে।”

শাহাদ হাসলো।বললো-
“আমাকেও আমার ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। চল শোয়ার জন্য অন্তত একটা জায়গা খোঁজা যাক ”

শাহাদ আর রাহাত চলে এলো আউটহাউসের ছাদে।পুরো ছাদ জুড়ে মাদুর বিছিয়ে তার উপর তোষক দিয়ে বিছানা করা হয়েছে। কয়েকটা ফুলের টব ছিলো সেগুলোকে ছাদের কিনারে রাখা হয়েছে।সমস্ত ছেলেরা ছাদে এসে আড্ডা জমিয়েছে।আজ তারা এখানেই থাকবে। শাহাদ আর রাহাতকে দেখে তমালসহ বাকিরা হৈহৈ করে উঠলো। শাহাদ ওদেরকে আড্ডা চালিয়ে যেতে বলে রাহাতকে নিয়ে এক কোনায় বসে পড়লো। একটা ছেলে এসে দুটো বালিশ দিয়ে গেলো। রাহাত অদূরে তমালদের সাথে বসে থাকা আসিফকে দেখিয়ে বলল-
” ওর বউ বাচ্চা কোথায় এখন?”

“নিয়ে আসা হয়েছে।আউটহাউসের একটা ঘরে ওদের থাকতে দেয়া হয়েছে।বিয়েটা মিটে গেলে অন্য কোথাও ব্যবস্থা করে দিব।”

“ওকে এতো বিশ্বাস করো না।এরা টাকার জন্য সব করতে পারে।”

শাহাদ তাকালো আসিফের দিকে। তমালদের সাথে গুটিসুটি মেরে বসে আছে।অপরাধী চোখে তাকিয়ে আছে।হয়তো শাহাদকে আক্রমণ করার বিষয় টা নিয়ে এখনো অস্বস্তি অনুভব করছে। অন্যরা তার অস্বস্তি কাটাতে যথেষ্ট ফ্রি হয়ে কথা বলছে তবুও তার মুখ থেকে অপরাধী ভাবটা সরছে না।শাহাদ আকাশের দিকে মুখ করে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো।চোখ বন্ধ করে ঘুম ঘুম গলায় বলল-
“তাহলে টাকা দিব।দেখব ও টাকার জন্য কতদূর যায়।”

————–

আজ শাহাদ কুহুর বউ ভাত।বাড়ি ভর্তি মানুষ। একের পর এক ভিআইপি গাড়ি ঢুকছে গেট দিয়ে। বাগানের এক পাশে স্টেজ করা হয়েছে। সেখানে শাহাদ আর কুহুর ফটোসেশান হচ্ছে।শাহাদের পড়নে কালো স্যুট কালো জুতা।স্যূটের নিচে সাদা শার্ট। ক্যাজুয়াল লূক নেয়ার জন্য টাই পড়ে নি বরং শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা রেখেছে।চুলে জেল দিয়ে খাড়া করে রাখা মুখে হালকা খোচা খোচা দাড়ি।কুহুর পড়নে ডীপ মেরুন কালার লেহেঙ্গা,মাথায় ওড়না,গা ভর্তি গহনা সাথে ভারী মেকাপ।
শাহাদ সরাসরি কুহুর দিকে তাকালো। তার এক হাত কুহুর কোমড়ে অন্য হাত পকেটে। ফটোসেশানের জন্য পোজ দিয়েছে তারা। শাহাদ মুগ্ধ চোখে তাকালো কুহুর দিকে। হালকা হাসলোও। কুহু আড় চোখে একবার তাকিয়ে আর তাকালো না।তার লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। এখানেই ফটোসেশান শেষ হলোনা রাফা আরো বিভিন্ন পোজ আবিষ্কার করে দুজনকে দিয়ে ইচ্ছা মতো ছবি তোলালো। একসময় দুজনকে নিস্তার দেয়া হলো এই অত্যাচার থেকে। দুজনকে বসানো হলো।

কুহুর পরিবারের সবাই আসলো। কুহু আনন্দে আত্নহারা হয়ে গেলো বাবা-মা ভাইকে দেখে। শাহাদ তাদের সাথে কুশল বিনিময় করে অন্যান্য গেস্টদেরকে সঙ্গ দিতে চলে গেলো।খান পরিবারের সবার সাথেই কুহুর পরিবারের সখ্যতা হলো। আশফাক খান এসে মোয়াজ্জেম সাহেবকে নিয়ে গেলেন।প্রোগ্রামে আসা সমস্ত ভিআইপি গেস্টদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, পাশাপাশি অন্যান্য গেস্ট আর নিজের আত্নীয়দের সাথেও পরিচয় করালেন।

একসময় অনুষ্ঠান শেষ পর্যায়ে চলে এলো। কুহুর বাবা মা ভাই বিদায় নিলো কুহুর কাছ থেকে। কুহু শক্ত করে তার মাকে জড়িয়ে ধরলো।শিরিনা বেগম মেয়েকে বুঝ দিয়ে বললেন-
“মন খারাপ করছিস কেন? এখন থেকে এরাই তোর পরিবার। সবার সাথে মিলেমিশে থাকবি কেমন?”

কুহু মাথা নেড়ে সায় জানালো। কুহুর পরিবার খান বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।এবার রাফা রিদিসহ অন্যান্য মেয়েরা কুহুকে নিয়ে শাহাদের ঘরে আসলো।ঘর দেখে কুহু চমকে গেলো।চারদিকে তাজা ফুলের ছড়াছড়ি। খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ঘরটা। ফুলের গন্ধে মঁ মঁ করছে। রাফা কুহুকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো-
“তুমি নাকি ভাইয়ার গাড়িতে তোমার লেবু চিপার যন্ত্র ফেলে গিয়েছিলে?আজ কি লেবু চিপবে?ভাইয়াকে কয়েকটা লেবু দিয়ে পাঠাব নাকি?”

কুহু থতমত খেয়ে তাকালো।রাফা দুষ্টু হাসলো তারপর অন্যসব মেয়েদের নিয়ে ঘর ত্যাগ করলো।কুহু হা করে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি দুষ্টু মেয়ে!! একা রুমে বসে থেকে কুহুর বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে উঠলো।চারদিকে তাজা ফুলের সুবাস আরো তার অজানা ভয় উস্কে দিচ্ছে। বাইরে মেয়েদের চেঁচামেচি শোনা গেলো। তারা টাকা দাবি করছে, টাকা ছাড়া ঘরের দরজা ছাড়বে না।অর্থাৎ শাহাদ এসে গেছে।কুহুর বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো। দম বন্ধ করে তাকিয়ে রইলো দরজার দিকে।খানিক্ষন পরেই দরজা খুলে ঢুকলো শাহাদ। ঢুকে সরাসরি চোখ ফেললো কুহুর দিকে।কুহু তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলো।শাহাদ হাসলো কুহুকে দেখে।কুহুর দিকে চোখ রেখেই গায়ের কালো স্যুটটা খুলে সোফায় রাখলো। শার্টের হাতা দুটো গুটিয়ে কুহুর সামনে একটা লেবু রাখলো। পকেটে হাত গুজে দুষ্টুমি করে বলল-
“তুমি নাকি লেবু চিপতে চাও। রাফা আমাকে লেবু দিলো।”

কুহু চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললো।অন্যদিকে মুখ করে মিনমিন করে বলল-
“রাফা মজা করে বলেছে আর ওইটা লেবু চিপার জিনিস না।আমি মিথ্যা বলেছিলাম।”

“উমম জানি আমি।”

কুহুর চোখ খুলে গেলো।শাহাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“কিভাবে জানেন?”

শাহাদ আলমারি খুলে বললো-
“আপু বলেছে। ও আমার ঘরে এসে জিনিসটা পেয়ে আমাকে বলেছে।”

শাহাদ হাতে করে একটা গোলাপের তোড়া আর একটা গয়নার বাক্স নিয়ে এলো। কুহুর সামনে বসে তোড়াটা কুহুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল-
“এটা তোমার জন্য।”

শাহাদ যে তুমি করে ডাকছে তা কুহু এতক্ষন খেয়াল করে নি।সে হাত বাড়িয়ে ফুলের তোড়াটা নিলো।শাহাদ গয়নার বক্সটা খুলে কুহুর দিকে ফিরিয়ে বলল-
“আমার পছন্দ তেমন ভালো না।তোমার পছন্দ না হলেও এটা পড়ো,, কেমন?”
কুহু দেখলো খুব সুন্দর একটা ডায়মন্ড সেট। সে বললো-
“আমার পছন্দ হয়েছে। ”

শাহাদ খুশি হলো। বক্সটা বন্ধ করে বেডসাইড টেবিলে রেখে দিলো।কিছুক্ষন দুজনেই চুপ থাকলো।শাহাদ গলা পরিষ্কার করে কপাল চুলকে বললো-
“ছাদে যাবে?”

কুহু মাথা হেলিয়ে সায় দিলো সে যাবে। শাহাদ বললো-
“এতো ভারী গয়নাগুলো খুলে নাও।”

কুহু উঠে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। মাথা থেকে ওড়না সরিয়ে একে একে সব খুললো কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো একটা হার খুলতে গিয়ে। কিছুতেই হারটার প্যাচটা খুলতে পারছে না।শাহাদ এতক্ষন কুহুকে দেখছিলো সে কুহুর পিছনে দাঁড়িয়ে বললো-
“আমি খুলে দেই?”
“আচ্ছা।”

কুহুর অনুমতি পেয়ে শাহাদ খুলতে চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না।হারটার আংটাটা খুবই শক্ত।শাহাদ বিরক্তিতে মুখে “চ” জাতীয় শব্দ করলো। জেদ চেপে গেলো তার, সিদ্ধান্ত নিলো দাঁত দিয়ে খুলবে। সে হারের শক্ত আংটাটায় দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলো। হঠাৎ উন্মুক্ত ঘাড়ে শাহাদের ভেজা ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে কুহু কেঁপে উঠলো।খামছে ধরলো লেহেঙ্গার অংশ। শাহাদ দাঁত দিয়ে কামড়ে আংটাটা আলগা করে ফেললো।হাত দিয়ে হারটা খুলে নিলো কুহুর গলা থেকে।হারটা খুলে আয়নায় তাকিয়ে দেখলো কুহু চোখ বন্ধ করে আছে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে শাহাদ কুহুর অবস্থা বুঝতে পারলো।

কুহু কারো কোনো সাড়া না পেয়ে চোখ খুলে তাকালো। আয়নায় তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো। তার পিছন থেকে শাহাদ মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কুহুর লজ্জায় মাটির নিচে চলে যেতে ইচ্ছে হলো। সে ঝট করে শাহাদের দিকে ফিরে বললো-
“ছাদে যাব না?”

শাহাদের ঘোর কাটলো। গাল চুলকালো। তারপর কুহুর হাত ধরে আস্তে আস্তে বের হয়ে আসলো ঘর থেকে। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে এগিয়ে চললো ছাদের সিড়ির দিকে।বাড়ির অনেকে এখনো নিচে ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে। শাহাদ কুহুকে নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যেতে লাগলো।কিন্তু বাঁধ সাধলো কুহুর পায়ের নুপুর।হাঁটার তালে তালে শব্দ করছে।এগুলো খোলা হয় নি।এগুলোর শব্দে কেউ জেনে যেতে পারে ওদের ছাদে যাওয়ার ব্যাপারটা।শাহাদ কোনো উপায় না পেয়ে কুহুকে কোলে তুলে নিলো।কুহু চমকে শাহাদের গলা আকড়ে ধরলো।নাকে ধাক্কা খেলো শাহাদের গায়ের গন্ধ।

শাহাদ কুহুকে ছাদে এনে নামিয়ে দিলো। হাত ধরে টেনে একটা টেবিলের কাছে এনে চেয়ারে বসালো। নিজে গিয়ে বসলো কুহুর সামনের চেয়ারে। কুহু এখনো ঘোরের মাঝে আছে।তার মস্তিষ্কে শাহাদের গায়ের গন্ধ জেঁকে বসেছে।শাহাদ কুহুর মনোযোগ পাওয়ার জন্য মুখের সামনে তুড়ি বাজালো।কুহুর ঘোর কাটলো। তাকিয়ে দেখল্য সামনের টেবিলে মোমবাতি জ্বালানো। টেবিলের উপর বিভিন্ন খাবার।অর্থাৎ শাহাদ তাকে ক্যান্ডেললাইট ডিনারে নিয়ে এসেছে। শাহাদ একটা গ্লাসে জুস ঢেলে কুহুকে দিলো তারপর নিজের গ্লাসটায় নিয়ে কুহুর গ্লাসের সাথে টুং করে শব্দ করলো।তারপর চুমুক দিলো গ্লাসে। কুহুর দিকে তাকিয়ে বললো-
“আমি কখনো প্রেম করিনি।কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে ছিলো এভাবে একদিন কাউকে নিয়ে ডিনারে বসব। তাই অধৈর্য্য হয়ে আজ প্রথম রাতেই তোমায় নিয়ে এলাম।তোমার অসুবিধা হচ্ছে?”

কুহু হেসে দুপাশে মাথা নাড়লো, তার অসুবিধা হচ্ছে না। শাহাদ এক চুমুকে গ্লাসের সবটা জুস শেষ করে ফেললো।উঠে গিয়ে একটা কোনায় রাখা সাউন্ড সিস্টেমে একটা সফট মিউজিক ছেড়ে দিলো।কুহুর কাছে এসে হাত মেলে দিলো। কুহু বিস্মিত হয়ে হাত রাখলো শাহাদের হাতে।শাহাদ কুহুকে টেনে দাঁড় করালো, নিয়ে আসলো ছাদের মাঝ বরাবর। কুহুর এক হাত নিজের কাঁধে রেখে আরেক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। আর নিজের আরেক হাত কুহুর কোমড়ে রেখে টেনে আনলো কুহুকে নিজের কাছে। সফট মিউজিকের তালে কুহুকে নিয়ে তাল মিলালো।কুহু লজ্জায় মুখ নামিয়ে রাখলো। এক সময় জিজ্ঞেস করলো-
“এটাও কি আপনার আগে থেকে ইচ্ছা ছিলো?”

শাহাদ হেসে জবাব দিলো-“হুম।”

কুহুকে জিজ্ঞেস করলো-
“তোমার কি কি ইচ্ছা ছিলো?আমাকে বলো।আমি ফুলফিল করব।”

কুহু অবনত মুখে বললো-
“কিচ্ছু না।”

শাহাদের ভ্রু কুচকে গেলো।ইচ্ছা কেন থাকবে না?অবশ্যই আছে কুহু তাকে বলছে না।সে ঘাড় নিচু করে কুহুর দিকে ঝুঁকলো।কুহুর মুখের দিকে আগ্রহ ভরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“কিচ্ছুনা?”

কুহু শাহাদের নিশ্বাসের স্পর্শ পেয়ে মুখ তুলে তাকালো।মুখোমুখি হলো শাহাদের শান্ত চোখের দৃষ্টির। চেষ্টা করেও সে চোখ সরিয়ে নিতে পারলো না।কেমন ঘোরে চলে গেলো।অনুভব করলো শাহাদ তার গালে হাত রেখেছে, আরো অনুভব করলো শাহাদের গরম নিশ্বাস তার মুখের আরো কাছাকাছি আসছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here