#টক_ঝাল_মিষ্টি
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-১২
আজ কুহুর গাঁয়ে হলুদ। গাঁয়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে ছাদে। ছেলেরা সবাই হলুদ পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পড়েছে আর মেয়েরা পড়েছে হলুদ শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ।মেয়েরা মাথায় ফুল গুঁজেছে অনেকেই। ছাদের এক পাশে স্টেজ, এখানে কুহুকে এনে বসানো হবে। স্টেজের সামনেই অনেক চেয়ার রাখা অতিথিদের জন্য। রেলিং ঘেঁষেও অনেক চেয়ার রাখা হয়েছে।একপাশের টেবিলে খাবার দাবারের ব্যবস্থা।
কুহুকে এখনো সাজানো হচ্ছে। তার মেয়ে কাজিনরা সব ঘিরে আছে তাকে। তনয়া লেহেঙ্গার ওড়না পিন দিয়ে আটকে দিলো। কুহুর চুলগুলো বেনি করে এক পাশে ফেলে রাখা হয়েছে।বেনির ভাঁজে ভাঁজে ছোট ছোট হলুদ ফুল। সারা শরীরে হলুদ ফুলের গয়না।সাজানোর সময় মেয়েরা বিভিন্ন কথা বলে কুহুকে উত্ত্যক্ত করলো। কুহুর কানে কানে বিভিন্ন নিষিদ্ধ বাক্য উচ্চারন করলো। কুহু নাক সিটকে বললো “ছি!অসভ্য তোরা”। এই কথায় যেন তাদের উৎসাহ আরো বাড়লো। গলা ফাটিয়ে সবাই হেসে আবারো ওই এক ই কাজ করলো।
কুহুকে স্টেজে তোলা হলো মধ্য দুপুরে। প্রথমে হলুদ দিলো শিরিনা বেগম। চারদিক থেকে ফটোগ্রাফারের ফ্ল্যাশ পড়লো তাদের উপর। তারপর এলেন মোয়াজ্জেম হোসেন।বাবাকে দেখে কুহু নড়েচড়ে বসলো। বাবার সাথে তার তেমন সখ্যতা নেই।বাবা মেয়ের মাঝে এক অন্যরকম দূরত্ব। কিন্তু সেই দূরত্বে ভালোবাসার কমতি নেই। মোয়াজ্জেম সাহেব এসে মেয়েকে হলুদ দিলেন,মিষ্টিমুখ করালেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে চলে এলেন। স্টেজ থেকে নেমে সিড়ির গোড়ায় এসে সবার আড়ালে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন। একমাত্র মেয়েকে কাল বিদায় দিতে হবে এই কথা চিন্তা করে তাঁর বুকের ভিতর মোচড় দিচ্ছে। মেয়েকে আরো পরে বিয়ে দিলেও পারতেন কিন্তু শাহাদের বাবার জোড়াজুড়িতে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হলো তাঁকে।
শিরিনা বেগম স্বামীর কাঁধে হাত রাখলেন। মোয়াজ্জেম হোসেন স্ত্রীকে দেখে তাড়াতাড়ি রুমাল পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিলো।নিজেকে স্বাভাবিক করে হাসলো।শিরিনা বেগম বললেন-
“শুরুতেই বলেছিলাম মেয়েটাকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিও না।এমনিতেই এই মেয়ের বুদ্ধিসুদ্ধি কম। আরেকটু বয়স হলে হয়ত সংসারটা আরো ভালো বুঝতো।”
“ওসব তুমি ভেবো না।আমার মেয়ে ও। ভুলভাল কাজ যাই করুক না কেন ওর বুক ভর্তি ভালোবাসা রয়েছে। এই ভালোবাসা দিয়ে ও ঠিক শ্বশুড় বাড়িতে সবার মন জয় করে নিবে।”
শিরিনা বেগম পিছন ফিরে একবার মেয়ের দিকে তাকালেন। তার চোখ দুটোও ভিজে গেলো। তিনি আর দাঁড়ালেন না, নিচে নেমে গেলেন।
যিয়াদ এসে কুহুকে হলুদ লাগালো। বিভিন্ন পোজ দিয়ে দুই ভাই বোন ছবি তুললো। নিচ থেকে ভেসে এলো গাড়ির হর্নের শব্দ৷ বরের বাড়ি থেকে হলুদের ডালা নিয়ে এসেছে বরের বাড়ির লোকজন। মেয়েরা দৌড়ে গেলো রেলিঙের কাছে। যিয়াদ ছাদে থাকা ছেলেদেরকে নিয়ে নিচে গেলো সবাইকে আপ্যায়ন করে নিয়ে আসতে।
খানিক বাদেই ছাদে ঢুকলো বরের বাড়ির সবাই,হলুদের ডালা নিচে রেখে এসেছে তারা। রাফা দূর থেকে কুহুকে দেখে হাত নাড়ালো। এক প্রকার দৌড়ে এলো স্টেজের দিকে।এসেই কুহুর সাথে বসে পড়লো। ফোন উঁচিয়ে বললো-
“ভাবিমনি পোজ দাও।”
অনেক ছবি তুললো রাফা কুহুকে নিয়ে। যিয়াদ অতিথিদের আপ্যায়ন করে বসালো। তাদের সবাইকে খাবার সার্ভ করলো।
“শালিকা উঠো, আমাকে একটু আমার শালার বউ এর সাথে পরিচিত হতে দাও।”
রাহাতের কথায় রাফা উঠে গেলো। রাহাত কুহুর পাশে বসে বললো-
“আমি তোমার হবু বরের বোনজামাই।আর তুমি আমার শালার বউ। এখন থেকে সেই সম্পর্ক বাদ।এখন থেকে তুমি আমার শালী। আর দুলাভাইরা সবসময় শালীর দলে থাকে।’
রাফা ফোড়ন কেটে বললো-
” একটু আগে ভাইয়াকে বলে আসলেন আপনি ভাইয়ার দলে।এক ঘন্টার ব্যবধানে দল চেঞ্জ করে ফেললেন?”
“তুমি শালী বেশি কথা বল।দুলাভাইদের বেলায় প্রয়োজনে দল চেঞ্জ করা জায়েয আছে।”
রাফা নাক সিটকালো রাহাতের কথায়। রাহাত একটা মিষ্টি তুলে খাওয়াল কুহুকে। কুহু একটুখানি খাওয়ায় অসন্তুষ্ট হয়ে মাথা নেড়ে বললো-
“উহুম উহুম! এতো কম মিষ্টি খেলে কিভাবে হবে। তুমি হলে মধু মিয়ার বউ। তোমার তো সারাবছর মিষ্টি খেতে হবে।”
তনয়া পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো-
“মধু মিয়া কে দুলাভাই।”
“আমার শালা। শাহাদ নামের অর্থ মধু। মিষ্টি খেতে না জানলে মধু হ্যান্ডেল করবে কিভাবে?”
কুহুর লজ্জায় প্রাণ যায় যায় অবস্থা।সে মুখে কুলুপ এটে বসে থাকলো।রাহাত বিভিন্ন পোজ দিয়ে ছবি তুলে উঠে চলে গেলো,যাওয়ার আগে মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস করতে বললো। তনয়া কুহুর কানের কাছে মুখ এনে বললো-
“একটু মধু এনে দেই? এখন থেকেই খেয়ে প্র্যাক্টিস কর।”
কুহু কটমট করে তাকালো। তনয়া দুষ্টু হেসে চোখ মারলো। রাফা হুট করে মোবাইল কুহুর সামনে ধরে বলল-
“ভাবিমনি দেখো।”
কুহু মোবাইলের দিকে তাকালো।মোবাইলে ভিডিও কল হচ্ছে। সেখানে শাহাদকে দেখা যাচ্ছে,সে হলুদের স্টেজে বসে আছে।হলুদ পাঞ্জাবির উপর ডিজাইনার গোল্ডেন কটি আর সাদা পায়জামা।গালের দুপাশে হলুদ, কপালে আর নাকেও হালকা আছে। বরাবরের মতো পাঞ্জাবির হাতা গুটানো আর হাতে ঘড়ি। তার আশেপাশে অনেক ছেলে সবাই পোজ দিয়ে ছবি তুলছে। স্টেজের এদিক ওদিক অনেক মেয়েরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারাও এসে যে যার মতো সেলফি তুলে যাচ্ছে। মেয়েদের সাথে ছবি তোলা দেখে কুহুর হালকা জ্বলুনি অনুভব হলো। রাফা গলা উঁচিয়ে বললো-
“রিদি ফোনটা ভাইয়ার কাছে নিয়ে যা।”
অপর পাশে ভিডিও কলে থাকা রিদি ফোনটা শাহাদের হাতে ধরিয়ে দিলো। আচমকা ফোন হাতে পেয়ে শাহাদ তাকিয়ে দেখলো ফোনে কুহুকে দেখা যাচ্ছে। শাহাদ কিছুক্ষনের জন্য ভড়কে গেলো।সে বসা থেকে উঠে স্টেজ থেকে নেমে এলো। একটা কোনায় এসে ফোন সামনে ধরে বলল-
“কেমন আছেন কুহু?’
রাফা কুহুর হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে ইশারা করে তনয়াকে নিয়ে এখান থেকে নেমে গেলো,আর কাউকে স্টেজে উঠতে দিলো না।কুহু জবাব দিলো-
” ভালো, আপনি?”
শাহাদ একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে বসলো।বললো-
“একটু খারাপ আছি। মা চাচীরা নিয়মের নামে আমাকে রীতিমতো হলুদে চুবাচ্ছে।”
কুহু ফিক করে হেসে দিলো। শাহাদ শান্ত চোখে সেই হাসি দেখলো।তারপর নিজেও ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল-
“ইউ আর লূকিং প্রিটি,মিস কুহু।”
কুহুর চোখেমুখে লজ্জা উপচে পড়লো। সে শাহাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না, এদিক ওদিক চোখ ঘুরালো। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো শাহাদ তার দিকে তাকিয়ে আছে এখনো। সে গলা পরিষ্কার করে বলল-
“এখন তাহলে রাখি।”
“কেন?লজ্জা পাচ্ছেন?”
“না পাচ্ছিনা। ”
বলেই কুহু ফোন কেটে দিলো। তার পক্ষে এই পরিস্থিতিতে থাকা আর সম্ভব না।
————-
কুহু ফোন কেটে দেয়ায় শাহাদ হাসলো।কাল দিন পর সারাজীবন একসাথে থাকা হবে আর এই মেয়ে এখন লজ্জা পাচ্ছে।সে ফোন হাত উঠে দাঁড়ালো। স্টেজে গিয়ে এই হলুদের ঝামেলা তাড়াতাড়ি শেষ করে ঘরে যেতে চায় সে। বাড়ির চারপাশের পুরো বাগান জুড়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন। এদিক ওদিক চেয়ার টেবিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেখানে গেস্টরা বসে আছে।অনেক ভিআইপি গেস্টরা এসেছে। আশফাক খান আর আব্দুল গাফফার খান তাদের সময় দিচ্ছেন। শাহাদ তার চাচ্চুর অভাব অনুভব করলো। তার চাচ্চু থাকলে প্রোগ্রামটা আরো জম জমাট হতো।শাহাদ আবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে স্টেজের দিকে হাঁটা দিলো। পথিমধ্যে হঠাৎ পাঞ্জাবি পায়জামা পড়া একটা লোক সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। লোকটার মুখে একটা সাদা কাপড় প্যাঁচানো,শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে।লোকটার চোখের দৃষ্টি দেখে শাহাদের অবচেতন মন সচেতন হয়ে গেলো।শাহাদকে কিছু ভাবার সময় না দিয়ে লোকটা হঠাৎ রিভল*বার বের করে গুলি করলো শাহাদের বুক বরাবর।
_________
নাইমুর একটা ফ্যাক্টরির ছাদে হাত দুটো রেলিঙের উপর ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার বাম হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। তার দৃষ্টি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িটার দিকে। চারদিকে সবুজ বাগান তার ঠিক মাঝখানে সাদা ধবধবে বাড়িটা।বাড়ির বাগানে আজ হলুদের প্রোগ্রাম।দূর থেকে শোরগোল, গান বাজনা ভেসে আসছে।নাইমুর কান পেতে আছে একটা নির্দিষ্ট শব্দের জন্য।শব্দ টা পেয়ে গেলেই কিছুটা নিশ্চিন্ত হতো। বাকিটা নিশ্চিন্ত হতো খবর পাওয়ার পর। মিজান দৌড়ে এসে নাইমুরের পাশে দাঁড়িয়ে বললো-
“ভাই আসিফ বাড়ির ভিতর ঢুকে গেছে।”
নাইমুর ভারী ভাঙা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
“এত গার্ড ফাঁকি দিলো কিভাবে?”
” বাড়ির পিছনে প্রাচীরের বাইরের গার্ডগুলোকে টাকা খাওয়াতে হয়েছে ।”
“শা*লার সব জায়গায় গা*দ্দারে ভরা। যার নূন খাচ্ছে তাকেই মা*রার জন্য টাকা নিয়ে সাহায্য করছে। কাজ শেষ হলে এদেরকেও সরিয়ে দিবি।গা*দ্দারদের দুনিয়ায় থাকার কোনো অধিকার নেই।”
মিজান মাথা নাড়ালো,সে বুঝেছে।নাইমুর কান পেতে থাকলো শব্দ শোনার জন্য। অনেক্ষন কান পেতে থাকার পর আনন্দ করতে থাকা বাড়িটা থেকে ভেসে আসলো গুলির শব্দ। মুহুর্তেই থেমে গেলো সব গানবাজনা।শোনা গেলো মেয়েদের চিৎকার। কিছুক্ষন যেতেই ভেসে এলো আরো একটা গুলির শব্দ।এবার মেয়েদের সাথে ছেলের হাঁক ডাকের চিৎকারও যোগ হলো। গার্ডদের ব*ন্দুক গুলো থেকে বেশ কয়েকবার ব্রাশ ফা*য়ার করা হলো। ভেসে আসলো আরো কতগুলো গু*লির শব্দ। নাইমুর ঠোঁট কামড়ালো। কাজ হয়ে গেছে তার। প্রথম দুটো গু*লির শব্দ আসিফের রিভ*লবারের,যেটা সে আসিফকে দিয়েছে। পরের গুলো গার্ডগুলোর। মিজান চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“আসিফ বোধ হয় শেষ।”
“শেষ হলেই ভালো, ঝামেলা কমলো।নয়ত বেঁচে ফিরে এলে আমার একটা গু*লি নষ্ট করতে হতো।”
নাইমুর সিগারেটের ছাইটা ফেলে দিয়ে টান দিলো।তারপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ছাদের দরজার দিকে পা বাড়ালো। মিজান আস্তে করে ঢোক গিললো।নাইমুরের সাথে কাজ করতে তার বুক কাঁপে।কাজের স্বার্থে নাইমুর যেকোনো সময় যেকোনো কাউকে মে*রে ফেলে। মিজান বহুবার চেষ্টা করেছে নাইমুরের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে, এসব কাজ না করতে কিন্তু এসব কাজে একবার ঢুকলে ফেরার আর উপায় নেই।মিজান দেরি না করে নাইমুরের পিছু পিছু গেলো। দেরি করলে নেক্সট মিশনে তাকেও যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারে।
চলবে