#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_৩৯
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
O.T চলছে , আর বাহিরে ইরফানের বুকটা খা খা করছে । কেন যে এত ঘুম এলো তার আর কেন যে বেলী তাকে ডাকলো না । বেলীর খুব কষ্ট হচ্ছে এইভেবে বার বার চোখ জোড়া তার পানিতে ভরে উঠছে । নিজের কাছে নিজেকে খুব খারাপ মনে হচ্ছে তার কাছে । পাগল পাগল লাগছে তার সব কিছু ।
বেলীর মা ইরফানের পাশে বসে আছে । ইরফান বেলীর মাকে উদ্দেশ্য করে বলে ,
– ভেতরে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে , তাই না মা ?
ইরফানের কথায় বেলীর মা মনে মনে ভেঙে পড়লেও জামাইয়ের সামনে নিজেকে কঠিন অবস্থায় রেখেছেন যাতে জামাই ভেঙে না পড়ে । দৃঢ় কন্ঠে তিনি বলেছেন ,
– মা হইতে গেলে কষ্ট করন লাগে বাবা , ধৈর্য ধরো বাবা । আল্লাহ পাক আছেন তো । তিনি একটা দিক করবোই ।
– আমার ভালো লাগছে না কিছুই । আমি যে কেন এত ঘুম দিলাম ।
– এইডা কি কও বাবা , ঘুমাইবা না কি দাড়াইয়া থাকবা নাকি । যা হইছে তা হওয়ার আছিলো তাই হইছে । আল্লাহরে ডাকো ।
শ্বাশুড়ির কথায় খানিকটা শান্ত হয় ইরফান । তবুও তার মন আর রুহ পড়ে আছে O.T তে । ইরফান চুপ করে বসে তো আছে কিন্তু তার ভেতরের ঝড় কেবল সে একাই সামলে নিচ্ছে ।
অন্যদিকে , O.T তে প্রায় ১ ঘন্টা সময় নিয়ে নিয়েছে ডক্টর । ব্লিডিং হয়ে যাওয়াতে সমস্যা হয়েছে । আর তাছাড়া বেলীর শরীর অনেকটাই দুর্বল যার কারণে বেলীর রেসপন্স খুব কম । তাই ডক্টর তার সর্বোচ্চ চেষ্টা প্রয়োগ করেছেন এইখানে । যাতে বাচ্চা এবং মা দুজনেই বেঁচে বাহিরর বের হতে পারে ।
বিগত দেড় ঘন্টা যাবত O.T করে অবশেষে পৃথিবীর মুখ দেখে বেলীর মেয়ে । সর্বোচ্চ চেষ্টার ফলাফল অবশেষে বেলী এবং তার সদ্য নবজাতক মেয়ে আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে । বাচ্চাকে ক্লিন করে বাহিরে বের করে আনে নার্স ।
নার্সের হাতে বাচ্চা দেখে ইরফানের জানে যেন পানি আসে । নার্স বাচ্চাকে এগিয়ে দিয়ে বলে ,
– কে নিবেন কোলে ?
বেলীর মা তখন নার্সকে উদ্দেশ্য করে বলে ,
– বাবুর বাবার কোলে দেন ।
নার্স ইরফানের দিকে বাচ্চাকে এগিয়ে দেয় । নার্সের হাতে বাচ্চা দেখে ইরফানের হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে যায় । এতটুকুন একটা জান এই এতটুকুন একটা শরীরে । একদম ছোট ছোট হাত পা , ছোট ছোট আঙুল । হাই তুলছে বার বার বাচ্চাটা ।
এমতাবস্থায় বেলীর মা ইরফানকে বলে ,
– কোলে লও বাবা , তোমার মেয়েরে কোলে লও ।
শ্বাশুড়ির কথায় ইরফান তার মেয়েকে কোলে নেয় । মেয়ে বাপের কোলে উঠে হাত পা ছুড়ে , হাই তুলে , টিপ টিপ করে চায় । মেয়েকে কোলে নিয়ে ইরফানের পুরো শরীরে শীতল হাওয়া বয়ে যায় । ইরফানের চোখ বেয়ে অনায়াসে পানি ঝড়ে যায় । অনুভূতিগুলো হয়তো এমনি হয় । সন্তানের বাবা হওয়ার হয়তো এটাই হয় । বাবা হওয়ার অনুভূতি হয়তো এমনটাই হয় । নিজেকে তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী মনে হচ্ছিল ইরফানের । কারণ এই মুহুর্তে তার হাতে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ ছিল । মেয়েকে কোলে নিয়ে ইরফানের বেলীর কথা মনে পড়ে যায় । সে তখনই নার্সকে জিজ্ঞেস করে ,
– বেলী কেমন আছে ? মানে আমার স্ত্রী সে কেমন আছে ।
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে । আরেকটু পরেই কেবিনে দেয়া হবে তাকে ।
নার্সের কথায় কলিজা ঠান্ডা হয় ইরফানের । সে মেয়েকে নিয়ে চেয়ারে বসে যায় ।
– আমার মা কেমন আছে ? কেমন আছে আমার আম্মাজান ।
মেয়েকে কোলে নিয়ে কত কথা ইরফানের । কিচ্ছুক্ষণ পরেই ইরফান তার শ্বাশুড়ির কোলে দেয় বাচ্চাকে । বেলীর মায়ের এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি । যেই বেলীকে আতুর ঘরে জন্মের পর এইভাবে কোলে নিয়েছেন আজ সেই বেলীর মেয়েকে হাসপাতালের করিডোরে এইভাবে কোলে নিয়েছেন । নানীদের এই জিনিসগুলো খুব ভাগ্য করে আসে । প্রথমে নিজের সন্তানকে কোলে নেয়ার স্বাদ তারপর সেই সন্তানের সন্তানকে কোলে নেয়ার স্বাদ । এ যেন আত্মা জুড়িয়ে যাওয়া এক অনুভূতি ।
বেলীকে প্রায় ২০ মিনিট পর কেবিনে দেয়া হয় । জ্ঞান পুরোপুরি ভাবে ফিরে নাই তার । চোখ তার ঘুমের রাজ্যে । একটা পরিষ্কার কেবিনে বেলীকে রাখা হয়েছে । তার এক পাশে পাশাপাশি দুইটা বেড আরেক পাশে একটা দোলনা রাখা হয়েছে । বেলী সেখানে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে । বাচ্চাও তার নানীর কোলে আছে । ইরফান বেলীর দিকে চেয়ে আছে , ইরফান বসে থেকেই বুঝে গেছে ঘুমন্ত বেলীর শরীরটা কতটা ক্লান্ত । পুরো শরীরের ক্লান্তটা বেলীর চেহারায় ভর করেছে ।
প্রায় এক ঘন্টা পর পুরোপুরি ভাবে বেলী সেন্সে আসে । সকাল টা যে কোন দিক দিয়ে হয়ে আছে তা কেউই বুঝতে পারে নি । সকাল হওয়ার পরে ইরফান তার বাবাকে ফোন করে জানায় । অফিসে বসকে মেইল করে দেয় , তার ছুটি লাগবে । সে যে বাবা হয়েছে । অন্যদিকে কয়েকজন কলিগকে ফোন করে সু-খবর জানিয়ে দেয় ইরফান । অবশ্য সেই কয়েকজন কলিগ সবটাই জানে । বেলী কে , রুবি কে , কিন্তু তারাও প্রথমে ইরফানকেই কথা শুনিয়েছে । না দেখেও বেলীকেই সাপোর্ট করেছে । অফিসের অন্যান্য কলিগরা এত কিছু জানেও না । তাই তাদের খোলসা করে কিছুই বলার নেই ইরফানের ।
বেলীর জ্ঞান ফেরার পর ইরফানকে সামনে দেখতে পায় সে । ইরফানকে দেখে খুশিতে হেসে দেয় বেলী । O.T রুমেই বেলীকে তার বাবুকে দেখানো হয়েছিল একবার । তবুও ইরফানকে জিজ্ঞেস ,
– বাবুকে দেখছো ?
ইরফান হাসি মুখে জবাবও দেয় ,
– হ্যাঁ দেখছি ।
– কেমন হয়েছে দেখতে ?
– বেলীর ঘরে আরেক বেলী , ছোট্ট বেলী ।
বেলীর মা নাতনিকে কোলে নিয়ে এসে মেয়ের পাশে দাঁড়ায় । আর বলে ,
– তোর মেয়ে মাশা-আল্লাহ একেবারেই চুপচাপ রে বেলীফুল ।
– মাশা-আল্লাহ বলো মা ,
এটা বলতে যা দেরি , আম্মাজান এইযে চিৎকার শুরু করছে । ছোট কন্ঠে ওয়া ওয়া করে তার কান্না শুরু । এই কান্না জানান দিচ্ছে যে তার ক্ষুধা পেয়েছে । বড় হয়ে গেলে তো মাকে বকে দিতো এখন তো সে এতই ছোট যে মা বলতে পারে না তাই ওয়া ওয়া করে জানান দিচ্ছে মা আমার ক্ষুধা পেয়েছে ।
মায়ের বুকের প্রথম শালদুধের স্বাদ সব নবজাতকের প্রাপ্য থাকে । বেলীর বাচ্চাটাও গলা ফাটাচ্ছে তার জন্যে । বেলীর মা ইরফানকে একটু বাহিরে যেতে বলে , শ্বাশুড়ির কথায় ইরফান উঠে বাহিরে যায় । এর ফাঁকে বেলী তার সদ্য নবজাতককে দুধ দেয় ।
অন্যদিকে আজ ইরফান পরিপূর্ণ । আজ তার সংসার পরিপূর্ণ । স্বয়ংসম্পূর্ণ সে , বেলী আজ তাকে দুনিয়ার সেরা সম্পদ উপহার দিয়েছে । বেলী এক মহান আত্মত্যাগী নারী । যে কিনা তার এই এতটুকু জীবনে নিজের সবটা বির্সজন দিয়েছে ইরফানের কাছে । বেলী সেই নারী যে কিনা ইরফানের মারধর ইরফানের রাগ সব সহ্য করে নিজের মাঝে ধারণ করে নিয়েছিল অনায়াসে । নিজের বক্ষে ধারণ করেছিল সব ব্যাথা সব যন্ত্রণা । তবুও মুখ ফুটে কিছুই চায়নি সে । বেলীর ধৈর্যশীলতা আজ তাকে সব টা দিয়েছে । ইরফানের ভালোবাসা , একটা সাজানো সংসার , একটা ফুটফুটে সন্তান সব পেয়েছে ।
১০ দিন পর বেলীকে আর তার মেয়েকে বাসায় আনা হয় । পুরো বাসা পরিষ্কার করে রেখেছে মিনু । এই ১০ দিনের মাঝে মিনু হাসপাতালে মোট ১৫ বার গেছে । এমনও দিন গেছে দিনে ২ বারও গিয়েছে সে । সে বেলীকে খুব ভালোবাসে তেমন ভালোবাসে বেলীর সংসারকে আর এখন সব কিছুর উর্ধ্বে ভালোবাসে বেলীর সন্তানকে । মা ছাড়া তার মুখে কথাই রোচে না এখন । মিনু চায় সারাক্ষণ বেলীর বাচ্চা তার কাছে থাকুক ।
গ্রাম থেকে ইরফানের বাবা এসেছেন । বেলী আর ইরফানের বাচ্চার নাম করণ হবে সাথে মিলাদ হবে । কিছু মেহমানও দাওয়াত করে ইরফান । শুক্রবার যথারীতি জুমার পরে মিলাদ হয় ইরফানের বাসায় । মসজিদের বড় হুজুর ইরফানকে ডেকে বাচ্চার নাম কি রাখবে জিজ্ঞেস করেন , মানে তাদের পছন্দ অনুযায়ী কোন নাম আছে কিনা , তখন ইরফান বেলীকে জিজ্ঞেস করতে রুমে যায় । বেলী তখন বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসা । ইরফানের কথায় বেলী তার বাচ্চার দিকে তাকায় । কোরআন শরীফে একটা শব্দ বার বার পড়েছে বেলী । জান্নাত , তাই মেয়ের নাম দিয়েছে সে ” জান্নাতুল ইকরা ” । বেলীর কথা অনুসারে মেয়ের ভালো নাম রাখা হয় ” জান্নাতুল ইকরা ” ।
বাবার নামের সাথে মিল রেখে ডাক নাম রাখা হয় ” ইন্নি ” । সারা ঘর এখন মেতে থাকে ইন্নিতে । কখনো বেলী কখনো ইরফান কখনো মিনু । মিনুতো চোখে হারায় ইন্নিকে । বেশিরভাগ সময় ইন্নি মিনুর কাছে থাকে । অফিসে যাওয়ার আগে ইরফানের ইন্নিকে দেখাই লাগে ।
ইন্নি মাশা-আল্লাহ অনেক সুন্দর , যেন এক মিষ্টি পরী । যে দেখে তারই কোলে নিতে ইচ্ছে করে । দুধে আলতা রঙ তার , জিবটা বের করে তা তা করে । বাবাকে চিনে সে ভালো মত , মায়ের ওড়নার নিচে লুকিয়ে লুকিয়ে খেলে সে । মিনুর মুখে যদি একবার মা ডাক শুনে ইন্নি লাফিয়ে উঠে । হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে সারা ঘর খেলে ইন্নি আর তা তা করে । কলিংবেলের শব্দ পেলেই ইন্নি মায়ের আঁচল ধরে টানে , বা,,,,,, বা,,,,,,বা,,,,,বা,,, করে বুঝাতে চায় তার বাবা এসেছে । বেলী তখন ইন্নিকে কোলে নিয়ে দরজা খুলে দেখে । দরজায় ইরফানকে দেখলেই খিলখিলিয়ে হেসে দু’হাত বাড়িয়ে দেয় ইন্নি । এর মানে বাবাকে জানান দিচ্ছে তাকে কোলে নিতে ।
ইন্নির বয়স ৬ মাস । একটু একটু দাঁড়ায় ইন্নি । বেলী আর ইরফানের বাঁচার অনুপ্রেরণা ইন্নি । ঘরে ইন্নির খেলনার অভাব নেই । ইরফান অফিস থেকে আসার সময় কিছু না কিছু নিয়ে আসবেই তার রাজকুমারীর জন্যে । সুখের কমতি নেই এই ঘরে । বেলীর জীবন আজ কানায় কানায় পূর্ণ । ইরফানের অনেক ভালোবাসা আর সুখের মাঝে ইন্নিকে নিয়ে বেশ আছে বেলী ।
পরদিন সকাল বেলা বেলী ইরফানের জন্যে নাস্তা বানাচ্ছিল রান্নাঘরে । ইরফানের পাশে ইন্নি শুয়ে শুয়ে হাত পা ছুড়ছে । ইরফান ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নিয়েছে । বেলী আর ইরফানের মেয়ে ইন্নি অনেক শান্ত হয়েছে । ক্ষুধা লাগা আর ব্যাথা পাওয়া ছাড়া সে কাঁদে না ।
ইরফান ব্লেজার পরতে পরতে ইন্নিকে ডাকে ,
– আম্মাজান , ও আম্মাজান ।
ইন্নি কি বুঝেছে কে জানে । ইরফানের মুখে আম্মাজান ডাক শুনে ইন্নিও সেই সাথে তাল মেলায় ।
– তা,,,,,, তা,,,,,,
ইরফান আবারও ডাকে ,
– আম্মাজান , ও আমার আম্মাজান , আমার আম্মাজানটা কি করে ।
ইন্নি তখন ইরফানের কথা শুনে তা তা করতে করতে বিছানার একদম কর্ণারে চলে আসে । দু’হাত এগিয়ে দিয়ে বাবাকে ইশারা করে ,
– বা,,,,,,,,বা,,,,,,বা,,,,,,বা,,,,,,
ইরফান আয়নায় ইন্নিকে দেখে দ্রুত গিয়ে কোলে নেয় ইন্নিকে ।
– আম্মাজান পেকে গেছে । আমার আম্মাজান পেকে গেছে ।।
ইরফান ইন্নিকে কোলে রেখেই বেলীকে ডাকতে থাকে । আর বেলীও তখন সব কাজ রেখে দৌড়ে চলে আসে রুমে ।
– কি হলো ,
– টাই টা ঠিক করে দেও ।
– নিজেই ঠিক করে নেও ।
ইরফান ইন্নিকে শিখিয়ে দেয় মাকে ডাকতে । ইন্নি যেন কত কিছু বুঝে । সেও বাবার কথা মত মাকে হাত দিয়ে ইশারায় ডাকে ,
– মাহ,,,,,,,মাহ,,,,,মাহ,,,,, আ,,,আ,,,,
বেলীও মেয়ের কথায় হাসিমুখে ভেতরে ঢুকে যায় । ইরফান ইন্নিকে খাটে বসিয়ে রেখে বেলীর কোমড় জড়িয়ে ধরে । বেলী পরম মমতায় ইরফানের টাই ঠিক করে দেয় । ইরফান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি । বেলীর কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে দেয় ।
মায়ের কপালে চুমু দেয়ায় ইন্নি খিল খিল করে হেসে দেয় আর হাত তালি দেয় । ইরফান আর বেলী ইন্নির হাসি দেখে নিজেরাও হেসে দেয় । তখন ইরফান ইন্নিকে কোলে নিয়ে বলে ,
– মাকে চুমু দেয়ায় আম্মাজান আমার খুশি হয়ে গেছে । বাবা চুমু দেই আম্মাজানকে ?
এই বলে ইন্নির গালে চুমু দেয় ইরফান । আর ইন্নি ” তা,,,,,তা,,,,” করে হেসে দেয় ।
এ যেন এক ভরা এবং পরিপূর্ণ সংসার । ইরফান বেলীর সুখের সংসার যেখানে ইন্নি নামের এক ফেরেশতা ইরফান বেলীর সুখের স্থায়িত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে ।
.
.
চলবে…………………