ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল ৩৭+৩৮

0
1151

#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_৩৭
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

দেখতে দেখতে সুখে শান্তিতে কেটে যায় ৬ টা মাস । এর মাঝে প্রায় কয়েকবার বেলী অসুস্থ হয়ে গেছে । ইরফানের শান্তি বলতে এই ৬ মাসে সব গায়েব । মিনু একা হাতে অনেকটাই সামলে নিয়েছে সবটা । এই বাসায় একমাত্র মিনু-ই সেই ব্যাক্তি যার উপর ইরফান আর বেলী চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারে । মিনু যদি তাদের বিষও দেয় তারা অনায়াসে বিষটাও খেয়ে নিতে রাজি । মিনু এতটাই বিশ্বস্ত তাদের কাছে ।

গ্রাম থেকে বেলীর মাকে আনা হয়েছে । বেলীর শরীর ভালো যাচ্ছে না ইদানীং । মিনুও পারে না আর তাই বেলীর মাকে আনানো হয়েছে ।

এখন বেলীর ৭ মাস প্রায় শেষ হতে চললো । শরীর আস্তে আস্তে ভারী হয়ে যাচ্ছে । বসলে আর তার উঠতে মন চায় না আর শুলে তো উঠতেই চায় না । আগের থেকে অনেকটা সুন্দর হয়ে গেছে বেলী । মেক্সি পরে এখন । ইরফান নিজে পছন্দ করে কাপড় কিনে এনে দেয় । বেলী কখনো দামী দামী কাপড়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না । তাই তার কথা অনুযায়ী ৬০ টাকা গজের কাপড়ই কিনে এনে দেয় ইরফান । আর মিনুকে দিয়ে নিচে মোড়ের মাথার দর্জির দোকার থেকে সেলাই করিয়ে আনে বেলী । বেলী এখন যা পড়ে তাই-ই ভালো লাগে বেলীকে । প্রায় সব রং-ই বেলীকে মানায় ।

ইরফানও বেশ সিন্সিয়ার হয়ে গেছে । এই ৭ মাসে কম করে না হলেও প্রায় ২৫ বার ডক্টরের কাছে নিয়ে গেছে বেলীকে । বেলীর প্রবলেম একটাই বেলীর রক্তের প্লাটিলেট অনেক কম । তাই ১৫ দিন কি ১ মাস পর পর বেলীকে বাসায় এসে সেলাইন পুষ করে দিয়ে যাওয়া হয় । এইসব কিছু ইরফান নিজেই দেখাশুনা করে ।

ইরফান মোটেও চায় না বেলীর একটুও অযত্ন হোক । সে বেলীকে কোন রকম অযত্ন করে না এবং অযত্নে রাখেও না । বেলীর জামা-কাপড় থেকে শুরু করে বেলীর মাথার চুল অবদি পরিপাটি দেখতে চায় সে ।

আর বেলী সে ইদানীং বড় বেশিই খুতখুতে হয়ে গেছে । অল্পতেই রেগে যায় , বিরক্ত হয় , আবার মাঝে মাঝে কাঁদে । তার মন এক এক সময় এক এক রকম থাকে । তাই ইরফান বেচারাও বেলীর কথায় হা/না করে । বেলীর সব কথা-ই ইরফান অনায়াসে শুনে নেয় । ইরফান অনেক এঞ্জয় করে এই সময়গুলোকে । কারণ সে বাবা হতে চলেছে ।

আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসেছে ইরফান । বিকেলের দিকেই চলে এসেছে সে । বেলী তখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল । ইরফানকে গেইটের ভেতরে ঢুকতে দেখে বেলীর বুকে মোচড় দিয়ে উঠে । ইরফান কলিংবেল দেয়ার আগেই বেলী গিয়ে দরজা খুলে দেয় । বেলীর এইভাবে দরজা খুলে দেয়া দেখে ইরফানও অনেকটা অবাক । ইরফান হাসি মুখে বেলীর গালে আলতো করে ছুয়ে দেয় , আর বলে

– আজকে একেবারে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছো যে ?
– তুমি এখন এই সময়ে বাসায় ?
– চলে আসলাম ।
– শরীর ভালো তো ?
– আলহামদুলিল্লাহ ।

ইরফান ভেতরে গেলে বেলী দরজা লাগিয়ে দেয় । ইরফান বদলে গেছে । শুধু বদলে যায় নি অনেকটাই বদলে গেছে । নামাজ পড়ে ৫ ওয়াক্ত । ১ ওয়াক্ত নামাজ সে কাযা করে না । অফিসেও নামাজ আদায় করে নেয় । ইরফান রুমে ঢুকতে ঢুকতে বেলীকে জিজ্ঞেস করতে থাকে ,

– মা কি করে ?
– শুয়ে আছে ,
– আর মিনু ?
– মিনুও মায়ের সাথে আছে ।
– মায়ের সাথে মিনুর ভালো জমেছে ,
– হ্যাঁ অনেকটা ।

ভেতরে গিয়ে ফ্যান ছেড়ে বসে ইরফান । এইখানেও বেলীর সমস্যা ।

– ফ্যান ছাড়লা কেন ?
– বাহিরে থেকে আসছি , একটু হাওয়া লাগুক গায়ে ।

বেলী বিরক্তিকর চেহারা করে দাঁড়িয়ে থাকে । ইরফান বুঝে যায় বেলীর বাতাসে সমস্যা হচ্ছে । তাই নিজ থেকেই ফ্যান অফ করে দেয় ।

রাতে খাবার খেয়ে বেলী রুমেই হাটাহাটি করছে আর ইরফান বিছানায় বসে লেপটপে কাজ করছিল । বেলী রুমের এ মাথা থেকে ও মাথা অবিদি এইভাবেই হাটাহাটি করতে থাকে । আর তার কিছুক্ষন পর বিছানায় এসে ইরফানের পাশে বসে সে । ইরফানের কাঁধে হাত দিয়ে ইরফানকে ডাকতে থাকে সে ,

– শুনছো ,,,,,?
– হু বলো ,
– দেখো না পা গুলা কেমন ফুলে গেছে ।

বেলীর পায়ের দিকে তাকায় ইরফান । আসলেই পা গুলা ফুলে গেছে বেলীর । ডক্টর গতবার বলেছিলেন হাতে পায়ে পানি নামবে । হয়তো তাই ফুলে গেছে । ইরফান লেপটপ অফ করে দেয় । দিয়ে বেলীর দিকে ফিরে ।

– এটা কিছু না , স্বাভাবিক ব্যাপার । ভয় পেও না ।
– পায়ের কামড়ানি কাকে বলে ,
– ব্যাথা বেশি করছে ?
– হু ,
– টিপে দেই ?
– আরে নাহ , লাগবে না ।

ইরফান বেলীর কথা আমলে না নিয়ে বেলীকে শুইয়ে দেয় আর বেলীর পাগুলো টিপতে থাকে ।

– আমার জন্যে যে মানুষটা এত করতে পারে তার এই সময়ে তার সেবা না করলে আমি তো কাফের থেকেও খারাপ হয়ে যাবো বেলী । তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো ।

ইরফানের কথায় বেলী শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে । ইরফান যে এত বদলে যাবে সে ভাবে নি । একজন আদর্শ মানুষ এবং একজন আদর্শ স্বামী হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে ইরফান । হয়তো এমনি করে একদিন নিজেকে আদর্শ বাবা হিসেবে গড়ে তুলবে । হালকা মুচকি হাসি দিয়ে বেলী চোখে ঘুম নামায় । আর ইরফান বেলীর ঘুমানোর আগ পর্যন্ত বেলীর পা গুলো টিপতে থাকে ।

আল্লাহ পাকের এক অদ্ভুত লিলা চলে এই ধরায় । সেই লিলা চলে মনুষ্য জীবনে । মনুষ্য এক জীবনে সব পায় না । আবার অনেকে এক জীবনে সব পাওয়াগুলো না চাইতেই পেয়ে যায় । বেলীও ঠিক তেমন এক মনুষ্য যে এক জীবনে বহুত কিছু হারিয়েছে । হারিয়েছে তার বাবাকে , হারিয়েছে এক সহজ সরল মানুষের ভালোবাসা । এক বুক স্বপ্ন নিয়ে স্বামীর ঘরে এসেছিল সে । সেখানে পাওয়া হয়নি স্বামীর ভালোবাসা । একদিন হুট করেই আল্লাহ পাক কেন জানি তার ঝোলা পরিপূর্ণ কর‍তে থাকে । তারপর তার গর্ভে আসে এক নতুন প্রাণ । আল্লাহ পাক তার সব টুকু নেয়ামত এক সাথে বেলীর ভাগ্যে ঢেলে দিয়েছেন । এ হয়তো বেলীর পাওনা ছিল । এভাবেই হয়তো আল্লাহ পাকের নেয়ামত আদায় করে নিতে হয় উপরওয়ালার কাছ থেকে ।

আজ ৯ মাসে পড়েছে বেলীর প্রেগন্যান্সির । এই মাসের লাস্টের দিকে ডেট পড়েছে । শরীরের কন্ডিশন ততটা ভালো না বেলীর । নরমাল সম্ভব না তাই সিজারিয়ান করাতে হবে । বেলী যথেষ্ট শক্ত আছে , ভয় পাচ্ছে ইরফান । কারণ বেলীর শারীরিক অবস্থা তেমন ভালো নেই । গতকাল কোরআন খতম করেছে বেলী । ইরফান মসজিদে মিলাদ দিয়েছে । যে নারী সন্তানসম্ভবা অবস্থায় কোরআন খতম করে তার সন্তান একজন নেককার মানুষ হোন । হয়তো বেলীও এমনটাই চায় ।

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বেলী । হঠাৎ করেই পুরনো সব কিছু স্মৃতি মনে পড়ে যায় তার । আজ ইরফানকে বেলীফুল আনতে বলেছে বেলী । ইরফান বার বার করে জিজ্ঞেস করার পরেও বেলী কিছু বলেনি । আজ রাতে সে সাজবে । বন্ধ ঘরে ইরফানের সামনে আজ আবার সাজবে সে । সেই সাদা শাড়িটা পরে খোঁপায় বেলীফুলের মালা পরবে সে । অবশ্য এর কারণ আছে । সেদিন রাতে একবার ইরফান বলেছিল ,

” বেলী , আবার সেই সাদা শাড়িটা পরবা ? শাড়িটায় অনেক সুন্দর লাগে তোমায় ”

তাই ভাবছে আজ একবার পরবে তবে এক পেচ বাঙালি ভাবেই পরবে । তাই বেলীফুল আনতে বলা ইরফানকে ।

ইরফান বেলীফুলের মালাটা এনে টেবিলের উপর রেখে দিয়েছে । রাতে খাবারের পর ইরফানকে প্রায় ৩০ মিনিট রুমের বাহিরে দাড় করিয়ে রেখেছে বেলী । ইরফান প্রায় বিরক্ত হয়ে গেছে। এইভাবে এতক্ষন ড্রইং রুমে দাঁড়িয়ে থাকা যায় নাকি ? তারপর দরজায় নক করে সে ,

– বেলী , এই বেলী ,
– হুউউউউ
– তোর হু আমি বের করবো , দরজা খোল ফাযিল ,
– হি হি হি ,
– বেলী শরীর খারাপ তোমার আর তুমি দরজা আটকে রাখছো । এইগুলা কি ফাইযলামি বেলী ।
– এক মিনিট ,
– এক সেকেন্ডও না , দরজা খুলো ।

তার কিছুক্ষণ পর বেলী দরজা খুলে ইরফানের সামনে দাঁড়ায় । ইরফান আর দরজার ভেতরে ঢুকতে পারেনি । সে সেখানেই ফিট হয়ে যায় বেলীকে দেখে । এ যেন এক সাদা অপ্সরা তার ঘরে । একেবারে বাঙালি নারী বেলী । মাথায় খোঁপা করে বেলীফুলের মালাটা গুজে দিয়েছে । চোখে কাজল , ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক । এক পেচ করে শাড়ি পরে ভরা পেটে দাঁড়িয়ে আছে বেলী । ইরফান যেন ঘোরের মাঝে চলে গেছে বেলীকে দেখে । হঠাৎ করেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে যায় ,

” বেলীফুল ”

বেলী মুচকি হেসে ইরফানের হাত ধরে তাকে রুমের ভেতরে ঢুকিয়ে নেয় । তারপর দরজাটা লাগিয়ে দেয় সে । ইরফান বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে এক পলকে । এরই মাঝে বেলী ইরফানকে বলে উঠে ,

– কেমন লাগছে ?
-……………..
– এই , কি দেখো এইভাবে ,
– অসাধারণ , মাশা-আল্লাহ । আমার বউ একেবারেই সাদা পরী লাগছে ।
– এইবার গান শুনাও ।

বেলীর এমন অদ্ভুত আবদারে অবাক ইরফান । বার বার না করছে সে , সে তো গান পারে না , কি গান গাইবে । বেলী আরও জেদ করে ,

– তুমি গাইবে না ?
– আমি পারি না তো ,
– না পারলেও গাও , আমি শুনবো

প্রায় কয়েকবার না না করা হয়ে গেছে ইরফানের । কিন্তু বেলী শুনছেই না । তারপর ইরফান চাপা গলায় গান শুরু করে । সাদা শাড়িতে বেলীকে অত্যন্ত সুন্দর লাগছিল । অনেকটা দেবীর মত । বেলীকে দেখে ইরফান সেই দারুণ গানটা তার গলায় ধরে ,

” এই রাস্তা গুলো লাগে বড় অচেনা
আকাশটার সাথে নেই জানা শোনা
আমি তোর প্রেমেতে অন্ধ
ছিল চোখ কান সব বন্ধ
থেমে গেছে জীবনের লেনাদানা
সেই পুরনো রাস্তাটায় আজ একা হেটে যাই
হচ্ছে না হিসাবের বনিবনা
এখন এমনি করে ভালো কেমনি করে বাসি
অন্য কোন পাখিকে
তার চেয়ে ভালো ছিল তুই নিজ হাতে খুন করে
যেতি
আমাকে……………….”

মুগ্ধ নয়নে এক হাতে ইরফানের কাঁধ ধরে অন্য হাতে নিজের ভারী পেটে হাত দিয়ে চাঁদের আলো উপভোগ করে বেলী । আজ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে । এই নিঃশ্বাসে আছে শুধুই শান্তি । বেলীর কোমড় আঁকড়ে ধরে আপন মনে গান গাইছে ইরফান । এ যেম এক অসাধারণ মুহুর্ত । এ যেন এক ভালোবাসার মুহুর্ত । এ যেন এক স্পর্শকাতর অনুভূতি যা মনকে অনায়াসেই ছুয়ে যায় ।

.
.

চলবে…………………………
#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_৩৮
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

হাত পা ফুলে গেছে বেলীর । শরীরে জোর নেই বললেই চলে তবুও সে মনের দিক থেকে শক্ত আছে । আর এক এক সময় বাবু ভেতরে ফুটবল খেললে তো বেলীর দফা রফা হয়ে যায় । ইদানীং বাবু ভেতরে ভালোই খেলাধুলা করে । সে হয়তো খেলে মজা পায় কিন্তু এদিকে উপরে বেলীর অবস্থা খারাপ হয় ।

রাতে বেলী শুয়ে আছে , ঠিক শুয়ে আছে বললেও ভুল হবে খাটের সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে বসে আছে । ইরফান বেলীর পা গুলো বালিশের উপর তুলে দিয়েছে । কিন্তু বেলীর মনে শান্তি নেই । কারণ আজ অফিস থেকে আসার পর ইরফানকে অন্যরকম লাগছিল যা বেলীর চোখে সহজেই পড়ে যায় । অন্যান্য দিন ইরফান বেলীর সাথে কথা বলে , হাসিখুশি থাকে কিন্তু আজ একদম অন্যমনস্ক । কিছু তো একটা হয়েছে যা বেলীর মন ধরতে পেরেছে । আস্তে করে উঠে গিয়ে অতি সাবধানে হেটে হেটে ইরফানের পাশে গিয়ে বসে বেলী । ইরফান গালে হাত দিয়ে লেপটপ দেখছে । ইদানিং ইরফানও কেন জানি সুন্দর হয়ে যাচ্ছে । ছেলের বাপ হবে নাকি মেয়ের হবে কে জানে তবে বাপ মাশা-আল্লাহ অনেক সুন্দর হয়ে গেছে সাথে মাও । পেটে হাত দিয়ে ইরফানের পাশে বসে বেলী । ইরফান এতটাই মগ্ন আছে যে বেলী যে তার পাশে এসে বসেছে তার কোন ধারণাই নেই । এতেই বেলী আরও বুঝে গেছে যে ইরফানের কিছু তো একটা হয়েছে । বেলী আস্তে করে ইরফানের কাঁধে ধরে ।

– কাজ করতেছো ?

বেলীর হাতের স্পর্শ আর মুখের কথা শুনে অত্যন্ত শান্ত নজরে ইরফান বেলীর মুখের দিকে তাকায় । বেলীর চেহারার মাঝে এক অসাধারণ আকর্ষণ আছে যা অন্যের মন মানষিকতাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে বেশি সময় নেয় না । হালকা মিষ্টি হেসে বেলীর গালে স্পর্শ করে উত্তর দেয় ,

– একটু বাকি আছে ,
– কি হয়েছে তোমার ?
– কোথায় কি হয়েছে ?
– লুকিও না , তোমার কিছু তো হয়েছে , বলো না কি হয়েছে ?
– আরে নাহ রে পাগলী , কিছুই হয়নি । আমি ভালো আছি ।
– মিথ্যা কেন বলো ,

বেলীর মনটা ছোট হয়ে যাক ইরফান চায় নি । আবার বেলীকে মিথ্যাও বলতে চাচ্ছে না সে । তাই বাধ্য হয়ে সত্যিটাই বলে দেয় সে ।

– আজকে অফিস থেকে বের হয়ে যখন আসতে যাবো তখন একজনকে দেখলাম ।
– কাকে দেখলা ?
– রুবিকে ,

রুবির কথা শুনে ধক করে বুকে একটা মোচড় দিয়ে উঠে বেলীর । হঠাৎ রুবির সাথে দেখা । কি চায় রুবি এখন ? নানান চিন্তা এক নিমিষেই বেলীর মুখে ভেসে ওঠে । যা ইরফানের মনে দাগ কাটতে এক মিনিটও লাগে নি । ইরফান বুঝে গেছে এত কিসের চিন্তায় ডুবে গেছে বেলী । মুখে না বললেও ভেতরটা তার ফেটে যাচ্ছে তাও ইরফানের জানা আছে । আলতো করে বেলীকে বুকে টেনে নেয় ইরফান ।

– ইরফান বেলীফুলেরই থাকবে । সে আর দ্বিতীয়বার অন্যপানে যাবে না । সে ভালোবাসে তার এই সহজ সরল বেলীফুলকে । যে কিনা তাকে এক নতুন প্রাণের সন্ধ্যান দিয়েছে । আমি ভালোবাসি আমার বেলীফুলকে ।

ইরফানের কথা গুলো শুনে বেলীকে ইরফানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয় । নিশ্চুপ মুখ করে শুধু চোখ থেকে পানি ঝড়াচ্ছে বেলী । কিচ্ছু বলছে না সে । বেলীর এই অসাধারণ কিছু আচরণ যা ইরফান চাইলেও অদেখা করতে পারে না । আরও জড়িয়ে নেয় সে বেলীকে ।

– কেঁদো না , আমি রুবিকে দেখেছি অন্যভাবে । নতুন বিয়ে করেছে । গত দুই মাস আগে বিয়ে হয়েছে তার । ছেলে নাকি তার পূর্ব পরিচিত । রুবি সেই লেভেলের মেয়ে যে কিনা সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হয়ে যায় । তার থেকে নোংরা আর কা-পুরুষ তো আমি যে কিনা,,,,,,,,,,,,,,

ইরফানকে আর কিছু বলতে দেয় নি বেলী । ইরফানের মুখে হাত দিয়ে চুপ করিয়ে দেয় সে ইরফানকে । ইরফান চুপ করে চোখের পানি ছেড়ে দেয় । বেলীও কাঁদতে থাকে মুখ বুঝে । এর মাঝেই ইরফান বেলীর ভারী পেটে হাত রাখে আর বলে ওঠে ,

– আম্মাজান আমার কেমন আছে গো ?

চোখ মুছে ইরফানের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে সেও বলে ,

– লাথি মারে তোমার আম্মাজান ।
– হা হা হা , ওমেন্স ফুটবল টীমে ভর্তি করাবো আম্মাজানকে ।
– আর আমায় যে যন্ত্রণা দেয় তার বেলায় ?
– তাকে আসতে দেও আর তুমি সুস্থ হও , সব যন্ত্রণা সুখে পরিণত করে দিবো ।
– হুপ ,
– হা হা হা ,

ইরফানের হাসিটা মাশা-আল্লাহ । এক পলকে চেয়ে আছে বেলী ইরফানের দিকে । ইরফান দিন দিন অনেক হ্যান্ডসাম হয়ে যাচ্ছে আর অনেক সুন্দরও । এরই মাঝে ইরফান বলে ওঠে ,

– আর তো কয়েকটা দিন । তারপর আম্মাজান চলে আসবেন আমার ।
– আল্লাহ পাকের দোয়ায় ।
– হুম ,

হ্যাঁ বেলী আর ইরফানের মেয়ে হবে । লাস্টবার আল্ট্রা করিয়েছিল তারা । সেখানেই ডক্টর সুনিশ্চিত করেছেন যে তাদের মেয়ে হবে । ইরফান অনেক খুশি তার মেয়ে হবে বলে । হঠাৎ করেই বেলী দুই হাতে পেট চেপে হালকা চিৎকার করে ওঠে ,

– মাগোওওও ,,,

ইরফান বেলীর চিৎকার শুনে আৎকে উঠে । হট করেই বেলীকে ধরে ফেলে সে ।

– কি হয়েছে বেলী ,
– লাথি মারলো , উফফফফ ।
– তাই ?
– উফফফফ ,
– অনুভূতি কেমন বেলী ?
– এ এক অজানা অনুভূতি , এই অনুভূতিটুকু না হয় আমারই থাক ।
– কেন , আমাদের হওয়া যায় না ?
– হ্যাঁ , তাও যায় । এই অনুভূতিটুকু না হয় আমাদেরই থাক ।
– হ্যাঁ থাক আমাদের হয়ে , এখন চলো ঘুমাবে ।
– তোমার কাজ ?
– শেষ , চলো ।
– চলো ।

ইরফান বেলীকে ধরে উঠায় । পেট টা বেশ বড় হয়ে গেছে । নয় মাস চলছে বেলীর পেট তো বড় হবেই । বিছানায় নিয়ে গেছে ইরফান বেলীকে । আলতো করে শুইয়ে দেয় সে বেলীকে ।

– পা ব্যাথা করে ?
– মাজা থেকে শুরু করে পায়ের আঙুলের মাথা অবদি । এত ব্যাথা আর কি ফুলে গেছে দেখছো ।
– আমি টিপে দেই ?
– আরে নাহ , লাইট অফ করে আমার পাশে আসো । ঘুমাও ,
– তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো ।
– তুমি পাশে আসো , আমি তোমার বুকে হাত দিয়ে রাখবো না হয় ঘুম আসবে না ।

বেলীর কথায় হাল্কা হেসে ইরফান লাইট অফ করে বেলীর পাশে এসে শুয়ে যায় । ইরফান শোয়ার পর বেলী কাত হয়ে ইরফানকে জড়িয়ে ধরে । কিন্তু ইরফানকে নিজেকে ধরতে দেয় না বেলী । কেউ ধরলে নাকি বেলীর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে । তাই চুপ করেই ইরফান এক হাত দিয়ে বেলীর হার ধরে আর অন্য হাতে বেলীর চুলে বিলি কেটে দেয় যাতে বেলী ঘুমিয়ে যায় । এক সময় বেলী আসলেই ঘুমিয়ে যায় । বেলীর মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে ইরফানও ঘুমিয়ে যায় ।

ভালোবাসা গুলো এখানে আস্তে আস্তে ধরা দেয় সুখ রুপে । যা এসেছে ইরফান আর বেলীর মাঝে ।

শেষ রাতের দিকে বেলীর চিৎকার শুনে ইরফানের ঘুম ভেঙে যায় । বিছানায় বসে ইরফান বেলীকে দেখতে পায় না । হঠাৎ ওয়াসরুমের দিকে নজর দেয় ইরফান । শব্দ সেইখান থেকেই আসে । ইরফানের কলিজায় আর পানি নেই । ধুপ ধাপ করে তাড়াহুড়ো করে নেমে ওয়াসরুমের কাছে যায় ইরফান । ওয়াসরুমের দরজা খোলা ছিল । ইরফান ভেতরে ঢুকে যায় , দেখে বেলী ফ্লোরে বসে আছে । প্রচন্ড কাঁদছে মেয়েটা । ইরফান কি করবে না করবে বুঝতে পারছে না । এই মুহুর্তে তাকে পাগল পাগল লাগছিল । ইরফান দৌড়ে গিয়ে বেলীকে তোলার চেষ্টা করে । বেলী উঠতে পারছে না । ইরফান প্রায় কেঁদেই দিয়েছে ।

– মাকে ডাকো , মাকে ডাকো ।

বেলীর মুখ থেকে মায়ের কথা শুনে ইরফানের মাথায় আসে তার শ্বাশুড়ির কথা । ইরফান বেলীকে বলতে শুরু করে ,

– তুমি একা একা কেন আসলা ?
– আহহহ , মাকে ডাকো আহহহ
– আমাকে ডাকলা না কেন ?
– তুমি ঘুমাচ্ছিলে , মাকে ডাকো ,
– হু ,

ইরফান দৌড়ে গিয়ে বেলীর মাকে ডাকে । জামাইয়ের মুখ থেকে এই খবর শুনে বেলীর মা দৌড়ে আসে । মেয়েকে এইভাবে পড়ে থাকতে দেখে বেলীর মা কেঁদে দেয় ।

– কেমনে পড়ছত রে মা ,
– মা ধরো আমারে ,
– হায় হায় গো , জামাইরে ডাকলি না কিলিগা ।

ইরফান আর বেলীর মা মিলে বেলীকে তুলে । বেলীর লেবার পেইন উঠে গেছে । বেলীকে উঠানোর সাদা টাইলসের দিকে নজর যায় ইরফানের । ফ্লোরে রক্ত দেখে আৎকে উঠে ইরফান । ওর মুখ দিয়ে আচমকাই বের হয়ে যায় ,

– মা , রক্ত,,,,,,,,,,,

ইরফানের কথা শুনে বেলীর মা ফ্লোরে তাকায় সাথে বেলীও । বেলীর রক্ত ছুটে গেছে । বেশিক্ষন অপেক্ষা করা যাবে না । যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিতে হবে তাকে । এইদিকে ব্যাথার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা বেলী বার বার চিৎকার করে উঠে । মিনু চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে আসে । বেলীর মা কোন রকম বেলীর মেক্সি পালটে দেয় আরও কিছু জামা কাপড় নিয়ে নেয় । মিনুও কেঁদে দেয় বেলীকে দেখে ।

ঘড়িতে রাত প্রায় সাড়ে ৩ টা । এত রাতে এই বিপদ । কথায় আছে বিপদ সব সময় রাতেই আসে । রাতেই এসেছে বিপদ । ভয়ানক বিপদ যা উলটে পাল্টে দিচ্ছে ইরফানকে । বেলীর কান্না তার কলিজায় গিয়ে লাগছে । পেট ধরে বার বার চিৎকার করছে বেলী । কোন রকম সি এন জি একটা নিয়ে হাসপাতাল রওনা দেয় ইরফান । মিনুকে বাসায় রেখে গেছে সবাই । মিনু বার বার বলেছে যাবে সাথে । কিন্তু বাসা খালি থাকায় তাকে আর নিয়ে যায়নি ইরফান । বেলীর মা বেলীকে জড়িয়ে রেখেছে আর পাশে ইরফান বসা । যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতাল যাচ্ছে তারা ।

ব্যাথার যন্ত্রণায় বার বার ইরফানের হাতটা চেপে ধরে বেলী । কোন রকম হাসপাতালে নিয়ে যায় বেলীকে । ডক্টর তখন অফ ডিউটিতে ছিল । তাকে ফোন করে আনানো হয় । সে এসে চেঁচামেচি শুরু করে দেয় ।

– কিভাবে পড়েছে ?
– হয়তো পিছলে গিয়ে ,
– হয়তো , আপনি কোথায় ছিলেন ? ব্লাড ছুটেছে , নার্স O.T রেডি করেন এক্ষুনি ।

নার্স ডক্টরের কথায় দ্রুত O.T রেডি করতে চলে গেছে । ১৫ মিনিটের মাথায় বেলীকে O.T তে নিয়ে যাওয়া হয় । যাওয়ার সময় বেলী খুব কেঁদেছে ইরফানকে ধরে । অনেক কেঁদেছে নিজের মাকে ধরে । ডক্টরের তাড়াহুড়োয় বেলীকে O.T তে নিয়ে যাওয়া হয় ।

এইদিকে ইরফানের শরীর কাঁপা শুরু হয়ে যায় । বেলীর রক্ত দেখে আর ব্যাথা দেখে ইরফান হতভম্ব হয়ে আছে । ইরফান পাগলের মত করতে থাকে । এই সময়ে ভরসা একমাত্র আল্লাহ পাক আর বেলীর মা । বেলীর মা বার বার বড় খতমের দোয়া পাঠ করছেন আর জামাইকে সান্তনা দিচ্ছেন । এরই মাঝে O.T রুমের লাইট টা জ্বলে উঠে । আর ইরফান তা দেখে নিজের হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় ।

.
.

চলবে…………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here