ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল ২৯ +৩০

0
1016

#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_২৯
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

নারী পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক । একজন পুরুষের যেমন একজন নারীকে প্রয়োজন পড়ে , তেমনি একজন নারীরও একজন পুরুষকে প্রয়োজন পড়ে । কেউ কখনো একা থাকতে পারে না । জীবনে চলার পথটা বড় কঠিন । এই কঠিন রাস্তায় চলাটা বড্ড কঠিন । এখানে একজন সাথীর খুব প্রয়োজন । তবে প্রয়োজন নয় প্রিয়জন হয়ে প্রিয় মানুষের হাতটা ধরাই উত্তম । তাই এইখানে একটা ভরসার হাতের খুব দরকার । আর সেই ভরসার হাতটা অত্যন্ত আপন কারো হওয়ার-ই উচিত । এটাই হয়তো হয়েছে বেলী আর ইরফানের সাথে । দুজন ভালোবাসার মানুষ দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর একত্রিত হতে পেরেছে । যাদের ভেতরের মান অভিমান সব কিছু ধুয়ে মুছে গেছে ।

এভাবেই কেটে যায় একটি সপ্তাহ । ভালোবাসার মুহুর্ত গুলো অনায়াসেই অতিবাহিত হয়ে যায় । এই একটা সপ্তাহে বেলী তার না পাওয়া সুখ গুলোকে নিজের করে নিয়েছে । ভালোবাসা নামক সোনার হরিণ আজ বেলীর হাতের মুঠোয় । ইরফান যেন তার ভালোবাসার সব টুকু খনি ঢেলে দিয়েছে বেলীর আঁচলে । আজ বেলীর আঁচল সম্পূর্ণ কাণায় কাণায় ভর্তি ভালোবাসায় ।

রাতের খাবার খেয়ে ইরফান তখন বিছানায় শুয়ে আছে । বেলী তখন রুম গোছাচ্ছে । এরই মাঝে ইরফানের ফোনে ফোন আসে । রুবির নামটা দেখে একটু ভড়কে যায় ইরফান । সামনে বেলী আছে , যদিও বেলীর এইসবের দিকে খেয়াল নেই বললেই চলে যেখানে তার নিজের মোবাইল কোথায় থাকে তাই সে জানে না , ফোন আসলে শুধু রিসিভ করে এর বেশী আর কিছুই জানে না সে । এইসব জিনিসে তার আগ্রহ নেই বললেই চলে । বেলীর সামনে ফোনটা রিসিভ করা ঠিক হবে না বলেই ইরফান ফোন নিয়ে উঠে অন্য রুমে চলে যায় ।

– হ্যালো ,
– হ্যালো মিষ্টার ইরফান , কেমন আছেন আপনি ?
– ভালো আছি , তুমি ?
– আমি ভিষণ ভালো আছি , আপনি তো ভালো থাকবেনই , নতুন শরীরের গন্ধ গেছে নাকে তাই খুব ভালো আছেন তাই না ?
– মানে ?
– তা রাতে কয়বার হয় ?

রুবির কুরুচিপূর্ণ নোংরা কথা গুলো ইরফানের মেজাজ সহজেই খারাপ করে দেয় । ইরফানকে ইদানীং রাগতে দেখা যায় না খুব একটা । বাঘ যখন শান্ত থাকার পরে হিংস্র হয়ে ওঠে তখন সে আরও ভয়ংকর হয়ে যায় । তখন ইরফানেরও সেই অবস্থা হয়েছে । ইরফান দেয়ালে নিজের হাতটা দিয়ে সজোরে একটা ঘুষি মারে ।

– ওই তুমি কি বলতে চাও ?
– বলতে চাচ্ছি যে , এক বউ তো সরে গেছে এখন অন্য মেয়ে মানুষের শরীর কেমন লাগে আর কয়বার হয় রাতে নাকি রাত দিন বিকাল সব সময় লাগে ।
– shut up you bus,,,,,,,,,,,,,,,
– হা হা হা , আমাকে এখন গালিগালাজও করা হয় ।
– ওই তুই কি বলতে চাস ? হ্যাঁ , কি বলতে চাস । আমি কি পাড়ার মেয়ে নিয়ে রঙ তামাশা করি ? নাকি পাড়ার মেয়ে মানুষ নিয়ে শুয়ে থাকি ? নাকি আমার শরীরে এনার্জি ভরা থাকে যে সকাল বিকাল রাত শুয়ে থাকবো । তোকে নিয়েও কি শুয়ে থাকতাম নাকি ?
– খবরদার আমায় ওর সাথে কম্পেয়ার করবা না ।
– তুই কোথাকার প্রাইম মিনিষ্টার । শুন আমার কাছে ওর দাম যতটা আছে তোর দাম ওর থেকে এক আনাও নাই । হায়রে মেয়ে মানুষ , ওই মেয়ে আরও আমায় প্রতিদিন বলে তোকে ফিরিয়ে আনতে , আর তুই রাতের বেলা ফোন দিয়ে এত নোংরা ভাষায় ওর সম্পর্কেই কথা বলছিস , ছিহ ! তুই কি আসলেই মানুষ ?
– নাহ আমি অমানুষ , হয়েছে ? যাই হোক আমার প্রয়োজনে ফোন দিছিলাম আমি ।
– নাহ , কই তুই প্রয়োজনে ফোন দিছিস , তুই ফোন দিছিস জানতে আমি রাতে কয়বার করি , নিজেকে পরিষ্কার কর আগে । আমার তো নিজের কপালকে জুতা দিয়ে মারতে ইচ্ছা করে কোন কু-ক্ষনে তোর সাথে আমার জীবন আমি জড়িয়েছি ।
– খবরদার তুই তুকারী করবা না একদম !
– ভালো কথা কয়টা বলছিস তুই , রিসিভ করার পর নোংরা ভাষায় কথা বলছিস ।
– আমি ডির্ভোস ফাইল করে দিছি , এখন যখন আমার উকিল তোমাকে ফোন দিবে কোর্টে চলে আসবা ।
– বাহ চমৎকার , অসাধারণ ।
– অবশ্যই , আমি বলেছিলাম না হয় ও নয় আমি , ও-কে না ছাড়লে আমি তোমাকেই ছেড়ে দিবো । তুমি থাকো একটা থার্ড ক্লাস গাইয়া মেয়েকে নিয়ে ,
– ভালো থাক ,

ইরফান ফোন টা কেটে দিয়ে ফোন একদম বন্ধ করে দেয় । মেজাজ তার অনেক খারাপ হয়ে যায় । রুবি এত বাজে ভাবে কথা বলবে পারে আদৌ বুঝতে পারে নি সে । সে ভেবেছিল হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফোন দিয়েছে এখন দেখছে এইসবের সম্পূর্ণ উলটা । এক দিক থেকে ভালো হয়েছে । ডির্ভোস হয়ে যাওয়াটাই উত্তম । রোজ রোজ অশান্তির থেকে ডির্ভোসই উত্তম । যে নারী নিজের স্বামীকে হোক সে বিবাহিত হোক তার আরেক স্ত্রী আছে তাকে এত নোংরা কথা বলতে পারে সে নারী যে সেই স্বামীকে ঘুমের মধ্যে জবাই করে দিবে না তার কি গ্যারান্টি আছে ? ইরফান মেজাজ কন্ট্রোল করে রুমে যায় । বেলী তখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে । ইরফান রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে । দরজা লাগানোর শব্দটা বেশ জোরেই হওয়ায় একটু ঘাবড়ে যায় বেলী । ইরফানের মেজাজ যে ভালো নেই তা বেলীর বুঝতে বাকি নেই । ইরফান বেলীর সাথে কথাও বলছে না তাই অনেক ভেবে নিয়ে ইরফানের সাথে নিজেই কথা বলে ,

– ঘুমাবেন এখন ?
– হ্যাঁ ,
– ওহ ,,,,,,,,,
-,,,,,,,,,,,,,,,,
– কে ফোন দিছিলো , ওই রুমে গেলেন দেখলাম ?
– রুবি ফোন দিছে ,

রুবির নামটা শুনে কলিজায় এক কামড় পড়ে বেলীর । বেলীর মন তখন সাথে সাথে এটাই বলে যে হয়তো এইজন্যই সে তার সাথে কথা বলতেছে না । বেলী আবারও জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায় ,

– তাহলে কি সে আবারও আমার থেকে দূরে সরে যাবে ? আমায় আর ভালোবাসবে না , আমায় আর তার বুকে নিবে না ? রুবি আপুকি তবে আবার ফিরে আসবে ? আমার কপালে কি তার থেকে পাওনা সুখ এইটুকুই ছিল ?

এইসব কথা গুলো ভাবতে গিয়ে বেলীর গলা ধরে যায় । বুক ফেটে কান্না আসে তার । নিজেকে শক্ত করে নিয়ে সাহস করে আবার ইরফানকে জিজ্ঞেস করে ,

– কি বললেন তিনি ?
– ডির্ভোস ফাইল করছে , যেতে হবে ।

ডির্ভোসের কথা শুনে অনেকটাই অবাক সে । এত সহজেই কি ডির্ভোস দিয়ে দেয়া যায় ।

– আপনি যাবেন ?
– যেতে তো হবেই ,
– এইসবের কি খুব প্রয়োজন ?
– কোন সবের ?
– এইযে ডির্ভোস , আপনারা তো একে অপরকে ভালোবাসতেন , তাহলে এইসব কেন ?
– ভালোবাসাটাই যেখানে নেই সেখানে সম্পর্ক থেকে লাভ কি ?
– আমি বলি কি ? আপনি রুবি আপুর সাথে বসে কথা বলে নিন , তাহলে সব ঠিক হয়ে যেতেও পারে ।

বেলীর কথা শুনে এইবার ইরফান আরও রেগে যায় । চেঁচিয়ে এক ধমক দেয় সে বেলীকে ।

– টেনে এক থাপ্পড় মারবো তোমাকে আমি , চিনো তুমি আমাকে ? অতীত ভুলে গেছো নাকি তুমি , নাকি আবারও মনে করিয়ে দিতে হবে ?

ইরফানের এমন ধমকে বেলীর আত্মাটা কেঁপে ওঠে ।

– জনদরদি হয়েছো নাকি , সতীন বিদায় হলে অন্যরা খুশি হয় তোমার দেখি কলিজা পুড়ে যাচ্ছে । কার সাথে বসে কথা বলবো আমি , হ্যাঁ , কার সাথে ? যার জন্যে তোমার কলিজা পুড়ে সে তোমাকে নিচে নামানোর কোন সুযোগই হাত ছাড়া করে না , এটা কি জানো তুমি ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– কি , মায়া বেড়ে গেছে নাকি তোমার ? বলো তো বিয়ে আরেকটা করি । আরেক সতীন এনে দেই তোমার সংসারে । তার কলিজা ফেটে যায় একেবারে ।
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– এই , নিচে কি দেখো ? আমার দিকে তাকাও , তুমি জানো রুবি ফোন দিয়ে কি নোংরা কথা গুলো বলেছে আমাকে আর তোমাকে নিয়ে ? ওর কথা অনুযায়ী তুমি পাড়ার মেয়ে আর আমি সেই পুরুষ যে পাড়ার মেয়ে নিয়ে শুয়ে আছি , আমি রাতে তোমার সাথে কয়বার করি , দিনে করি নাকি দুপুরে করি এইসব জানতে চায় সে ,
– থামুন ,,,,,,,,
– কেন এখন কেন থামুন বলো , আরেকটু শুনো । তোমার তো কলিজা ফেটে যায় । শুনো তার নোংরা ভাষা যা তোমায় নিয়ে করে সে । শুনো বেলী , ভালো হওয়া ভালো এতটা ভালো হওয়া ভালো না যে ভালো তোমার সর্বনাশ হয়ে দাঁড়ায় । কথাটা মনে রাখবা ।
– শুনেন না ?
– নাহ , আর কিছু শুনতে চাই না । আমার মাথা গরম আছে এখন , কিছু শুনলেই মাথা নষ্ট হবে , হয়তো হাত উঠে যাবে । ঘুমাও তুমি আর না পারলে সতীন বিদায়ের জন্যে কেঁদে কেটে বুক ভাসাও আমার দেখার প্রয়োজন নেই । তবে যা করবা রুমের বাহিরে গিয়ে । রুমে যদি কিছু শুনি , খোদার কসম লাথাতে লাথাতে নিচে ফেলবো । আমার ভালো এবং খারাপ দুই রুপ-ই তোমার জানা । এখন আর কোন কথাই বলবা না তুমি ।

এই বলে ইরফান শুয়ে যায় লাইট অফ করে । বেলী জানালার দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলে ,

– সময় জিনিসটা বড্ড বেশি স্বার্থপর । নিজের মন মতই ঘুরছে সে । কাল অবদি যেই আমি রুবির জায়গায় ছিলাম আর আজ আমার জায়গায় রুবি দাঁড়িয়ে আছে । আল্লাহ পাকের লীলাখেলা কেউ বুঝে আবার কেউ বুঝে না । ভালোবেসে কি লাভ হলো রুবি যখন মানুষটাকেই আর নিজের করে রাখতে পারলেন না ।

.
.

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_৩০
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

দুই দিন পর ,

সকাল বেলা বেলী আর মিনু রান্নাঘরে কাজ করছে । ইরফান অফিসে যাবে । নাস্তা গুলো তাড়াতাড়ি টেবিলে দিতে হবে । তাই যত দ্রুত সম্ভব হাত চালায় বেলী । এরই মাঝে মিনু বলতে শুরু করে ,

– ভাবী,,,,,,?
– হু ,
– আমারে একখান কতা কন দেহি ?
– হু বলো ,
– আইচ্ছা ভাবী , শয়তানি ডা ,,,,,,,
– আহহহহহ মিনু , ওনার নাম আছে । নাম ধরে বলো ।
– আইচ্ছা আইচ্ছা , রুবি আফাই কই এহন তো আর হেতি আমাগো ভাইয়ের কেউ লাগে না । ভাবী আন্নের কি মনে অয় , হেতি এত তাত্তাড়ি ডিফোস কিসের জন্যে দিবার চায় ।
– ওইটা ডিফোস না , তুমি বাংলাতেই বলো তালাক আর কি ।
– ওই তো অইলো একডা তালাক আর তুলাক । তা হের মাতায় কোন ভূত সোয়ার অইছে আল্লাহ মালুম ।
– তোমার ভাই অনেক চিন্তিত , জানি না কি হতে চলেছে । রুবি আপু কেন যে এইসব করতে গেলো ।
– ভাইয়ে চিন্তিত নাকি আপনে চিন্তিত আপনের সতীন বিদায়ের দুঃখে ।
– কাজ করো তো ,
– মায়া দয়া মাইনষের লাই রাখিয়েন বুজ্জেন নি শয়তানের লাই মায়া দয়া রাখি লাভ নাই । আস্তারা অসিভ্য আছিল ।
– আহহহহ মিনু ,
– আহহহহ উহহহহ কইরেন না তো ভাবী , আমি তো ভাবছিলাম বড় মজ্জিদে ১০০ টাহা দিমু । আপদ বিদায় হইতাছে ।
– এইসব বলো না মিনু , আল্লাহ পাকের লীলাখেলা আমরা কেউই বুঝি না । তিনি কার ভাগ্যে কি রেখেছেন তাও আমাদের প্রত্যেকের কাছে অজানা । এইসব আমরা কেউই জানি না , কেউই বুঝি না ।
– জানতাম চাইও না , বুঝবারও চাই না । আমি খালি বুঝি আপদ বিদায় হইতাছে , এডাই শান্তি আমার ।

মিনুকে দেখে বেশ খুশিই লাগছিল । মনে হচ্ছিল মিনু যেনো এমন একটা দিনের জন্যে অপেক্ষা করছিল । মিনু এই বাড়িতে আসে রুবি আসার ঠিক এক মাস পর । ইরফানের একটা কাজের বুয়ার প্রয়োজন ছিল যদিও তখন বেলীই ছিল তার চোখে বুয়া । তবুও রুবির কথায় আরও একটা বুয়ার প্রয়োজন আছে তাই ইরফান কার সাথে যেন যোগাযোগ করে মিনুকে নিয়ে আসে । কিন্তু মিনু সেই প্রথম থেকেই কেন জানি রুবিকে পছন্দ করতো না । তার কেন জানি বেলীকেই ভালো লাগতো । আর সব থেকে খারাপ লাগা যদি তার থেকে থাকে তা ছিল ইরফানের বেলীকে মারধর করা । বেলীকে এক রক সময় দেখে মিনুও কাঁদতো ।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিনু আবারও বলতে থাকে ,

– শয়তান এইডা ঘরে আছিল ঘরে হারাদিন ঝগড়া লাইগা থাকতো , শয়তান এইডা এক ওয়াক্ত নামাজ তো পড়েই না , তার উফ্রে ভাইয়েরে এইডা সেইডা কইয়া আপনেরে ফিডা খাওয়াইতো । এহহহ খবিশ মাতারি , যহন দেখছে ভাইয়ে আমার বেলী ভাবীরে ভালাবাসে থহনই হের জ্বলন শুরু । দেখছেন নি ভাবী আমি কইছিলাম না , ভাবী আল্লাহ আছে একজন । শয়তানের বিচার এমনেই করে আল্লাহ । শয়তান এমনেই মরে । ওহন মরুক নাইলে জাহান্নামে যাউক , আমাগো কি ।
– মিনু বাদ দাও , তোমার ভাই শুনলে কি ভাববে ।
– কচুর ছড়া ডা আছে না ? হেই কচুর ছড়াডা ভাববো । এক্কেবারে ভালা হইছে ভাইয়েও মুক্তি পাইবো এই ডাইনীর হাত থিকা ।

মিনুর বক বক নন-স্টপ চলতেই আছে । বেলী আর কথা বাড়ায় নি । সমস্ত নাস্তা এনে টেবিলে সাজিয়ে দেয় । সাড়ে ৮ টা বেজে গেছে । ইরফান এলো বলে ।

তার পর পরই ইরফান চলে আসে । বেলী সব সাজিয়ে আগেই রেখে দিয়েছে । ইরফান শুধু বসবে আর খাওয়া শুরু করবে । বেলী এমনি , সব কিছু ইরফানের হাতের কাছে এনে রাখবে । যাতে ইরফানের কিছু নেক্সট টাইম চাইতে না হয় । এই জন্যই হয়তো খাওয়ার সময় ইরফানের বেলীকেই লাগে ।

– বেলী ,
– জ্বি ,
– তুমিও বসে যাও ,
– নাহ আপনি খেয়ে নেন ।
– নাহ সমস্যা নাই , এক সাথে বসেই খাই ।
– আচ্ছা ।

ইরফানের কথা গুলো খুব সহজেই মেনে নেয় বেলী । কেন জানি হাজারো চেষ্টা করলেও বেলী ইরফানের দিক থেকে মুখ ফেরাতে পারে না । ইরফান ওই রকমই মানুষ , যার কথা বলা , যার চাল চলনে পাগল বেলী যদিও সে মুখ কিছুই স্বীকার করে না । বেলী যে ইরফানকে চোখে হারায় আর সে যে ইরফান বলতে অজ্ঞান এটা ইরফানও বেশ ভালো বুঝতে পারে তাই নিজেও তেমন কিছু বলে না । তবে সে রাতে রুবির সাথে জিদ করে বেলীকে বকে দিয়েছে ইরফান । সে নিজের বলা কথার জন্যে খুব লজ্জিত । তার উপর কিছু শব্দ ব্যবহার করেছিল বেলীর সামনে । তার মুখ থেকে সব থেকে বাজে শব্দটাই বেলীর জন্য ছিল যা হলো লাথাতে লাথাতে নিচে ফেলে দিবে । কিন্তু সে কি করতো , তার মাথা কাজ করছিল না তখন । তার উপর বেলীর এমন মানবদরদী কথা যা তার একদম পছন্দ হয় নি । যার জন্যই মুখ থেকে বেরিয়ে গেছিলো । এখন খুব খারাপ লাগছে ইরফানের । তাই নিজ থেকেই সে রাতের টপিকটা তুলে ইরফান ,

– বেলী ,
– হু ,
– রাগ করে আছো ?
– নাহ , একদম নাহ ।
– সে রাতের জন্যে দুঃখিত বেলী ।
– বাদ দিন , আসলে আমি,,,,,,,
– আপনি খুব চিন্তায় ছিলেন আর আমিই বোকার মত আবল তাবল বলে যাচ্ছিলাম , আপনার জায়গায় আমি থাকলেও এমনটাই হতো ।
– ক্ষমা করে দাও , প্লিজ ।
– ছিহ , কি সব বলেন । এইসব বলবেন নাহ ।

ইরফান আর বেলী নাস্তা খাওয়ার সময় ইরফানের মোবাইলে ফোন আসে । অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসায় একটু দ্রুতই ফোনটা রিসিভ করে নেয় ইরফান ।

– হ্যালো ,
– হ্যালো , ইরফান মাহমুদ ?
– জ্বি ইরফান মাহমুদ , কে বলছিলেন ?
– আমি এডভোকেট রাশেদ বলছিলাম ।
– জ্বি বলুন ,
– মিসেস রুবি মাহমুদ ডির্ভোস ফাইল করেছিলেন , আপনি কি আমার চেম্বারে আসবেন নাকি আমি আপনার বাসায় পেপার পাঠাবো ?

বাসায় এই পেপার আসলে বেলী আবার ডিপ্রেশনে পড়ে যাবে । এইসব ঝামেলা সে বেলীর আশেপাশেও দেখতে চায় না আর । অন্যদিকে বেলী সামনে থাকায় ক্লিয়ারলি কথাও বলতে পারছে না । তাই বুদ্ধি করে ঘুরিয়ে কথা বলে দেয় ।

– নাহ নাহ , আমিই আসবো আপনার চেম্বারে ।
– আর ইউ সিউর মিষ্টার মাহমুদ ?
– ইয়ায়ায়া আই এম সিউর ,
– ওকে , থ্যাংকস ।
– কখন আসতে হবে ?
– বিকেল ৪ টায় ।
– আচ্ছা , ধন্যবাদ ।

চেম্বারের কথা শুনে চোখ তুলে ইরফানের দিকে তাকায় বেলী ।

– আপনি কি অসুস্থ ?
– কই না তো ,
– তাহলে যে বললেন চেম্বারে যাবেন ।
– হা হা , বোকা মেয়েকে নিয়ে কোথাও যাবো আমি । এই বোকা চেম্বার কি শুধুই ডক্টরের হয় । আমরা যারা বড় বড় পজিশনে থাকি তাদের যেই কেবিন থাকে তাকেও চেম্বার বলে ।
– ওহ ,
– বুঝলা এখন ?
– হু ,
– এক স্যার ফোন করেছিলেন , বিকেলে ওনার চেম্বারে যেতে হবে ।
– ওহ ,

এইসব বলে কথা কাটিয়ে দেয় ইরফান । রুবি তাহলে তার কথাই রেখেছে । সে তার মতই করেছে । যা বলেছিল ঠিক তাই করেছে সে । অবশেষে ডির্ভোস ফাইল করেই দিয়েছে ।

– ভালোই হলো , আবেগ দিয়ে আর কত দিন আটকে রাখতাম । এর থেকে ভালো বিবেক খাটিয়ে সবটা মিটিয়ে নিবো ।

মনে মনে চিন্তা করতে থাকা ইরফানের গলা দিয়ে নাস্তা নামছে না ।

বেলীর নজর ইরফানের দিকে । কি যেন ভাবছিল ইরফান , তবে সাহস হয় নি কিছু জিজ্ঞেস করার । ইরফান আর তেমন বেশি কিছু বলে নি । ফোন রাখার কিছুক্ষণ পরই ইরফান বেরিয়ে যায় । বেলী আবার একা বাসায় । ইদানীং মন তার বড্ড বেশি ইরফান ইরফান করে । ইরফান চলে যাওয়ার পর বেলী চুপ করে সেখানেই বসে থাকে । হঠাৎ করেই ফোন বেজে ওঠে তার । ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ইরফানের নাম্বার ।

– কি হলো , এই মাত্রই তো বের হলো , কিছু ভুলে গেছে নাকি ?

ভাবতে ভাবতে ফোন টা রিসিভ করে কানের কাছে নেয় বেলী ।

– হ্যালো বেলী ,
– হু ,
– তোমার রুমে যাও , গিয়ে জানালার পাশে দাড়াও ,
– আচ্ছা ।

বেলী দৌড়ে নিজের রুমে যায় আর রুমের জানালার পাশে দাঁড়ায় । নিচে তাকিয়ে দেখে ইরফান মোবাইল কানে দিয়ে উপরে তাকিয়ে আছে ।

– আমার দিকে তাকাও একবার ,

ইরফানের কথায় জানালা দিয়েই সে ইরফানের চোখের দিকে তাকায় ।

– বলেন ,
– কেন ফোন দিছি জানো ?
– উহু ,
– বলি ?
– হু ,
– ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি অনেকটা বেশিই ভালোবাসি ।

ইরফানের বলা কথাটুকু বেলীর শরীরে কেমন যেনো এক দোলা দিয়ে গেল । পুরো শরীর যেন মুহুর্তের মাঝেই ঠান্ডা হয়ে গেলো বেলীর । ঠোঁটের কোণে না চাইতেও মিষ্টি হাসি এসে গেছে তার ।

– কি হলো , কিছু বলো ?
– কি বলবো ,
– আমি যা বলেছি তার পরিপ্রেক্ষিতে যা বলার তাই বলো ।
– আমি বলবো না ভালোবাসি , শুধু বলবো হারাতে চাই না । আমি বলবো না ভালোবাসি , শুধু বলবো মন পাগলের মত আপনাকে চায় । আমি বলবো না ভালোবাসি , শুধু বলবো আমি আপনার জন্যে মরিয়া হয়ে যাই । আমি বলবো না ভালোবাসি , শুধু বলবো আমি আপনার মাঝে বসত করতে চাই । এইসব যদি ভালোবাসা হয় , তাহলে বলবো হ্যাঁ , আমি ভালোবাসি , আমি আপনাকে ভালোবাসি ।

বেলী লাইন কেটে জানালার পাশ থেকে সরে যায় । বেলীর কথাগুলো ইরফানের বুকের ঠিক মাঝ বরাবরটায় গিয়ে লাগে । এমন ভাবেই লাগে যে তার ঘরে থাকা জলজ্যান্ত বেলীফুলের ঘ্রাণটা তার নাক অবদি এসে গেছে । মুচকি হেসে গন্তব্যস্থলে রওনা দেয় ইরফান ।

– ইয়া রাব্বুল আলামীন আমি কি আসলেই মানুষ ? নাকি এখন মানুষ হয়েছি নাকি তখন অমানুষ ছিলাম ? যেই মেয়েটার সরল মনটা আজও আমাকেই চায় কোন শর্ত ছাড়াই তাকেই কিনা আমি ,,,,,,,,,,,, আল্লাহ পাক আমার সকল অপরাধ ক্ষমা করুন ।

নিজের দোষ গুলো মনে করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয় ইরফান । হয়তো আল্লাহ পাকেরও একই ইচ্ছা এইবার অন্তত সব কিছু ঠিক হোক । রুবি নিজ থেকেই সরে যাচ্ছে , এটাই খটকা লাগছিল ইরফানের কাছে । তার ভাবনা অনুযায়ী রুবি এত সহজে জায়গা ছাড়ার পাত্রী নয় । কিন্তু এত সহজেই সব ছেড়ে দিলো এটাই ভাবাচ্ছে ইরফানকে । রুবি অন্য প্ল্যান করে নি তো ? তবে আজ বাকিটা এডভোকেটের চেম্বারে গেলে বুঝতে পারবে সে ।

বিকালের দিকে মিনু অনেক জোর করছিল বেকীকে নিয়ে বের হতে । মিনু বেলীরে নিয়ে এক জায়গায় যেতে চায় । আর তা এখনি । আর তাছাড়া ইরফানও বাসায় নি । এই সুযোগেই সে বেলীকে নিহে বের হতে চায় । কিন্তু বেলী তো বের হবে না আর ইরফানকে না জানিয়ে কখনোই না । আর তাছাড়া বেলী বাহিরে বের হওয়া পছন্দ করে না । কিন্তু মিনুও জোর করছে ,

– ভাবী আইয়েন না গো পিলিজ
– হা হা , পিলিজ কি ওটা প্লিজ
– ওই একই যেইহানে ১১ হেইহানেই ১২ , হউক পিলিজ আর হউক পুলিজ , লন
– দেখো মিনু আমার ভালো লাগে না ।
– আরে আইয়েন , আপনেরে আইজ্জা ঝালমুড়ি খাওয়ামু আমি ,
– বাহ বাহ
– সইত্য খাওয়ামু , লন ।

মিনু অনেক ভালোবেসে বলছিল , তাই বেলীও আর না করতে পারে নি । তবে বেলী ইরফানকে ফোন দিয়ে দেয় । তখন ঘড়িতে ৪ টা বেজে ২০ মিনিট । ইরফান তখন এডভোকেট রাশেদের চেম্বারে কথা বলছিল । এমন সময়তেই বেলীর ফোন যায় ইরফানের ফোনে ।

– এক্সকিউজ মি ,
– ইয়ায়ায়া সিউর ,

ইরফান সাইডে বেলীর ফোন রিসিভ করে ।

– হ্যাঁ বেলী বলো ,
– আপনি কি ব্যস্ত ? আমি কি বিরক্ত করলাম ?
– নাহ বলো , কিছু বলবা ?
– শুনুন না , মিনু অনেক জোর করছে বের হওয়ার জন্যে ।
– কোথায় যাবে সে আবার ?
– জানি না , বলে এইদিকে নাকি একটা পার্ক আছে আবার বলে ঝালমুড়িও খাওয়াবে ।
– হা হা , ওর কাছে টাকা আছে ?
– কি জানি ?
– হ্যাঁ , পাশেই একটা পার্ক আছে , মিনু ওইটার কথাই বলতেছে । তা যাও না ওর সাথে ঘুরে আসো ।
– যাবো ?
– হ্যাঁ যাও বেশি দূরে না পাশেই । আর বিকেল টাইম ঘরে বসে কি করবা , যাও ঘুরে আসো ।
– আচ্ছা , তাহলে রাখি ।
– আচ্ছা আমার আজকে দেরি হবে । ৯/১০ টা বেজে যাবে , টেনশন নিও না , কেমন ?
– হু ।

ইরফান ফোন রেখে দিলে বেলী রাডি হয়ে মিনুর সাথে বের হয় । মিনু খুব খুশি আজকে , সে তার বেলী ভাবীর সাথে বের হয়েছে আজকে । এটাই তার কাছে আনন্দের ছিল । হাটতে হাটতে তারা পার্কে চলে আসে । এখানে ছোট ছোট বাচ্চারা খেলা করে , আবার প্রেমিক প্রেমিকারাও আসে । বসে বসে গল্প করে তারা । প্রায় অনেক্ষন মিনু আর বেলী একটা বেঞ্চের উপর বসে বসে গল্প করছিল । এক সময় মিনু বলে উঠে ,

– ভাবী ওই দেহেন ঝালমুড়ি , খাইবেন নি ?
– ধরো টাকা নিয়ে যাও ,
– এহহহহহ কিল্লিগা , আমার দারে আছে ।
– এটা নেও ,
– বা গো ভাবী আপনে আমারে বইন মানেন না ?
– মানি তো ,
– তাইলে আমিই আইজ্জা আপনারে খাওয়ামু ,
– আচ্ছা , যাও নিয়ে আসো ।

বেলীর কথায় মিনু দৌড়ে ঝালমুড়ি আনতে যায় । বেলী তখন খানিকটা একা হয়ে যায় । সামনে বাচ্চারা খেলাধুলা করছিল আর বেলীও তা দেখছিল । হঠাৎ করে কে যেন পিছন থেকে ডাক দেয় বেলীলে ।

– বেলীফুল ,,,,,,,,,,,,,,?

সেই চিরচেনা কন্ঠস্বর শুনে বিচলিত হয়ে বেলী পিছনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে যায় । আর ঠিক তখনই বেলীর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় । অবাক নয়নে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখতে থাকে বেলী ।

– রাজু ভাই,,,,,,,,,,,,,??

.
.

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here