#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_২৭
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
সন্ধ্যার পর রাত প্রায় ৮ টা নাগাদ ইরফান আর বেলী বাসায় ফিরে । মিনু তখন স্টার জলসা নিয়ে বসে আছে । মিনু তাদের দেখে কথা বলা শুরু করে দেয় ।
– আইয়া ফরছেন ?
– হু ,
– এত তাড়াতাড়ি ?
– কি করবো তাহলে , ঘুরাঘুরি শেষ আর থেকে কি করবো ?
– খাইয়া আইতেন ?
– তোমার ভাই খাবার নিয়ে আসছে , আমরা এক সাথেই খাবো ।
– ওহ আইচ্ছা ,
ইরফান আগেই রুমে চলে গেছে । বেলী মিনুর সাথে কথা বলার পরেই রুমে যায় । বেলী রুমে গিয়ে দেখে ইরফান শার্টের বোতাম খুলছে । এটা দেখে বেলী বের হয়ে যেতে নেয় ওমনি ইরফান ডেকে দাড় করায় বেলীকে ,
– বেলী দাড়াও ,
– হু ,
– কি হয়েছে চলে যাচ্ছো যে ,
– নাহ আসলে এসেছিলাম কাপড় বদলাতে এখন দেখলাম আপনি বদলাচ্ছেন ।
– তাতে কি হয়েছে , আমি কাপড় বদলাবো বলে তুমি চলে যাবা ?
– নাহ ঠিক আছে , সমস্যা নাই ।
– আচ্ছা শুনো একটু ,
– হু ,
– শাড়িটা পরে থাকো ,
– রাতের বেলাতেও ?
– হ্যাঁ , আজ তোমার গলায় গান শুনবো ।
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– কিছু বললে না যে ,
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– আচ্ছা বাদ দেও , তা বলো কেমন লাগলো আজকে ঘুরতে বেরিয়ে ।
– ভালো ,
– তুমি যে এত ঝাল দিয়ে ফুচকা খাও , আগে তো বলো নাই ।
– আমি ফুচকায় ঝাল একটু বেশিই খাই ?
– তাই ?
– হু ,
– আমার তো নাকে পানি চলে আসছে ।
– ওহ , আচ্ছা আমি একটু রান্না ঘরে যাই , কেমন ?
– হু ,
বেলী চলে যাওয়ার পর আয়নায় নিজেকে দেখতে থাকে ইরফান । কিছুক্ষণ ভালো করে তাকায় নিজের দিকে সে । তারপর ভাবতে থাকে কিছু কথা ।
– কতটা পরিবর্তিত আমি , এই আমি নিজেকে এখন অনেকটাই অচেনা লাগে । কি আমি কি হয়ে গেলাম আর আগেই বা কি ছিলাম । বেলী যে কিনা অসহায় অবস্থায় আমার জীবনে এসেছিল আর আমি তাকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিয়েছি । মুখ ফুটে কখনো কিছুই বলেনি মেয়েটা । শুধু সহ্য করে গেছে আমার অত্যাচার গুলো । আজ নিজের কাছে নিজেকে অনেকটা নড়পশুর মত মনে হয় । জীবনটাকে নিজের হাতে ধরে দু’মুখো করে দিলাম । আজ বেলী আমার সাথে ঠিকমত কথা বলে না হয়তো আমায় দেখলে তার সেই অসহ্য মুহুর্ত গুলোর স্মৃতি মনে পড়ে যায় । একটা মানুষের পক্ষে কতটা সম্ভব এইভাবে সব কিছু সহ্য করে পড়ে থাকাটা । কেন জানি মনে হয় বেলী একটাই হয় যে ফুল হয়ে ফোঁটে অন্যকে সুবাস ছড়িয়ে দিতে ।
কথা গুলো অনুধাবন করতে থাকা ইরফানের চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে যায় । জীবনটা আসলেই বৈচিত্র্যময় , এখানে জীবন ক্ষনে ক্ষনে রূপ বদলায় । এরই মাঝে বেলীর ডাকে ধ্যান ভেঙে যায় ইরফানের ।
– হু , কিছু বলবে ?
– ৫ বার ডাক দিলাম , যেইভাবে দেখে গেছিলাম এখন ২৫ মিনিট পর সেইভাবেই দেখছি আপনাকে । কি করছেন এখানে দাঁড়িয়ে ?
বাহ বাহ ২৫ মিনিট হয়ে গেছে , অথচ ইরফানের খেয়ালই ছিল না । বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে ইরফান । বেলীর শান্ত চোখের দৃষ্টি ইরফানের মনে ঝড় তুলে দেয় । মুচকি হেসে দিয়ে হাতের ইশারায় বেলীকে নিজের কাছে ডাকে ইরফান । বেলীও ধীর পায়ে ইরফানের দিকে এগিয়ে যায় । আলতো করে বেলীর হাতটা ধরে ইরফান । নিজের একদম কাছে নিয়ে যায় সে বেলীকে । জানালার পাশে নিয়ে গিয়ে দাড় করায় ।
বেলীকে জানালার সামনে দাড় করিয়ে নিজের বুকে বেলীর পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায় ইরফান । ইরফানের স্পর্শে ভেতরটা ভেঙে চূড়ে যাচ্ছিল বেলীর । এ যেনো এক স্বর্গীয় সুখ । যেখানে প্রিয় মানুষটার স্পর্শ পাওয়া যায় । ভালোলাগা হয়তো এটাই , আর এটাকেই হয়তো ভালোবাসা বলে ।
বেলীর কোমড়ের দু’পাশ দিয়ে নিজের হাত রাখে ইরফান । ছোয়া গুলো মায়াবী হলেও নোংরামি ছিল না কিছুতেই । এ যেনো এক প্রকার স্পর্শকাতর ভালোবাসা । বেলীর ঘাড়ে নিজের থুতনি লাগিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ইরফান ।
– বেলী ,
– হু ,
– এত চুপ থাকিস কেন ?
প্রায় বেশ কিছুদিন পর ইরফানের মুখ থেকে তুই শব্দটা শুনে বুকের মাঝে ঝট করেই কামড় দিয়ে উঠে বেলীর । সাথে এক রকম শান্তিও আসে মনে । আত্মাটা তার শুকিয়ে ছিল সেই তৃষ্ণার্ত আত্মায় কে যেন পানি ঢেলে দিয়েছে মনে হলো । পরম অনুভবে চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয় বেলী ।
– আমায় একটা কথার উত্তর দিবি ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,
– কিরে বল না , দিবি ?
– হু ,
– তুই এমন কেন বেলী ? কেন তুই পাল্টাতে পারিস না ? ঘেন্না লাগে না আমার প্রতি ।
– বেলী কখনো পালটায় না । আর ঘেন্না করবো কাকে ? আপনাকে ? তাহলে তো আমি নিজেকেই ঘেন্না করতে পারি ।
– তোকে কেন জানি বুঝতে পারি না আমি ?
– কেন জানি আপনাকে চিনতে পারি না আমি ?
– কেন জানি তুই আমার হৃদয়ে মিশে গেছিস ?
– কেন জানি আপনি আমার অন্তরে আটকে গেছেন ?
– অনেক কষ্ট দিয়েছি তোকে তাই না রে ?
– হয়তো ভাগ্যে ছিল ,
– আমায় ছেড়ে কোথাও যাবি না তো ?
– জানা নেই , তবে মৃত্যু এলে আটকাতে পারবো না ।
– রাগটা দেখাস না ঠিকই কিন্তু অভিমানটা ঠিকই রয়ে গেছে ।
– না আছে রাগ , না আছে অভিমান , যদি কিছু থাকে তাহলে তা হচ্ছে নিরবতা ,
– আর সেই নিরবতায় কে বিরাজমান ?
– যে আমার সব চেয়ে কাছে , যার মাঝে আমার অস্তিত্বের জানান হয় ।
বেলীর কথায় ইরফানের অশান্ত মনটা শান্ত হয় নিমিষেই । বেলীর কোমড়ে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ইরফান ।
– চলেন , খাবেন না ?
– পালিয়ে যেতে চাইছিস ?
– পালাবো কেন , আমি তো এখানেই আছি , আসুন খাবেন আসুন ।
বেলী একটু নড়েচড়ে উঠে , ইরফান বেশ বুঝতে পারে যে তার কাছে থাকতে বেলী আন-কমফোর্ট ফিল করছে । তাই ইরফানও বেলীকে ছেড়ে দেয় ইরফান ।
খাওয়া দাওয়ার পর ইরফান রুমে এসে বসে বসে মোবাইল টিপছে । রুবিকে অনলাইনে দেখে মনটা কড়া নেড়ে ওঠে ইরফানের । একবার নক করবে কি করবে না ভাবছে সে । রুবিও হয়তো ইরফানকে অনলাইনে দেখেছে কিন্তু কোন ম্যাসেজ করে নি ।
– আফসোস লাগে নিজের প্রতি , কেন যেনো এলোমেলো হয়ে গেছে আমার জীবনটা । এখনও জানা নেই রুবির ডিসিশন কি হবে । তবে যাই হোক বেলীকে আমি ছাড়তে পারবো না । বেলীতে মত্ত্ব আমি , সে আমার হৃদয় মন্দিরে আটকে আছে । ভালোবাসি তাকে ভিষণ ।
এরই মাঝে বেলীর প্রবেশ ঘটে রুমে । বেলী ইরফানকে খাটে আধো শোয়া অবস্থায় থাকতে দেখে দরজা লাগিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় । কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে আকাশে ওঠা চাঁদের পাণে নজর রাখে বেলী ।
ইরফান মোবাইল টিপতে টিপতে হঠাৎ করেই তার কানে আসে ,
তুই ফেলে এসেছিস কারে মন ,
মন মন রে আমার ,
তাই জনম গেলো শান্তি পেলি না রে
মন মন রে আমার ,
ইরফান শোয়া থেকে উঠে বসে যায় । বেলীর কন্ঠে এই প্রথম ইরফান গান শুনছে । অসাধারণ কন্ঠে গান গাইছে বেলী । ইরফান হেটে গিয়ে বেলীর পাশে দাঁড়ায় । বেলী তখনও জানালার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে গান গাইছে ।
যে পথ ধরে এসেছিলি ,
সে পথ এখন গেলি ভুলে ,
কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে মন ,
মন মন রে আমার
ইরফান মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে বেলীর মুখের দিকে । বেলীর কন্ঠে তখন গান আর চোখের কোণে তখন অশ্রুর ঢল । গাইতে গাইতেচেক সময় শেষ হয়ে যায় গানটা । ইরফানের তখন হুশ হয় যে গান শেষ ।
– অনেক সুন্দর গাইলি ,
– মন বড়ই অবুঝ , বুঝেও বুঝে না । ফেলে আসা মানুষটা আজও বুঝলো না , মন তো মন-ই । এক অস্পর্শনীয় অনুভূতি।।
.
.
চলবে…………….
#ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
#পর্ব_২৮
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
বন্ধ ঘরে , দুটো শরীর , দুটো আত্মা , দুটো মনের মাঝে খেলা অবিরত । ইরফান বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । বেলীর নজর তখন আকাশের চাঁদের দিকে ।
– একটা কথা বলি ?
– হু , বল
– আকাশের অনেক দয়া মায়া তাই না ?
– মানে ?
– হ্যাঁ , সে তার বুকে হাজারো তারাকে আশ্রয় দেয় , একই বুকে চাঁদকে ঠাই দেয় আবার এই একই বুকে সূর্য হেসে উঠে । আবার কখনো মন খারাপে সে অশ্রু ঝরায় বৃষ্টিরুপে ।
– হ্যাঁ , হয়তো বা
– ওই চাঁদটাকে ঘিরে কত তারাদের ছুটোছুটি ।
– হু ,
– তবে চাঁদের গায়েতেও কলঙ্ক আছে ।
– তুই তো অনেক ভালো বলিস ,
– কলেজে পড়ার সময় বাংলা স্যার পড়াতেন । সেইখান থেকেই শিখা ।
– বেলী,,,,,,,,,,,?
– হু ,
-,,,,,,,,,,,,,,,,,
– কি হলো , নাম ধরে ডেকে চুপ করে গেলেন যে ?
– কিছু না ,
– রুবি আপু আর ফোন দিয়েছিল ?
– নাহ ,
– মানুষটা রাগ করছে অনেক । ফিরিয়ে আনুন তাকে , প্রয়োজনে আমি চলে যাবো ।
বেলীর কথাটা আর সহ্য করতে পারে নি ইরফান । ঝট করেই বেলীর হাত ধরে হ্যাচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে আসে ইরফান । ইরফানের নজর বেলীর দৃষ্টিতে আর বেলী তার শান্ত দৃষ্টি দিয়ে ঘায়েল করছে ইরফানকে ।
– ভুলে গেছিস সে রাতের কথা ?
– কোন রাত ?
– বাহ ভুলে গেলি ?
– মনে পড়ে না ,
” আপনি যখন আমাকে মারবেন আমি কাঁদবো না , একদম কাঁদবো না , শুধু ছাড়তে বলবেন না , সহ্য করতে পারবো না ”
– মনে পড়ে এই কথাটা ?
কথাটা শুনে সেরাতের প্রতিটা কথাই মনে পড়ে যায় বেলীর । সেরাতে বেলীই ইরফানকে বলেছিল না ছাড়তে আর আজ সে বেলীই নিজ থেকে বলে দিল প্রয়োজনে সে চলে যাবে । এখানেই জিদ উঠে ইরফানের ।
– মনে পড়ছে নিশ্চয়ই ,
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– তোকে ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব না ।
– তাহলে রুবি ,
– জানি না আমি কিচ্ছু জানি না শুধু চাই তুই আমার কাছেই থাকবি । আমার বুকে আমার মনে , সব জায়গাতেই তুই থাকবি ব্যাস ।
এই বলে ইরফানে বেলীকে তার বুকের মাঝে জড়িয়ে নেয় । একদম শক্ত করে যেন চলে যেতে না পারে । ইরফানের শরীরের উষ্ণতায় বেলীর শরীর যেন আরাম খুজে পায় । বেলীরও ইচ্ছা হয় একটু জড়িয়ে নিতে তার বরকে । কিন্ত লজ্জা নামক জিনিসটা কেন জানি তাকে আটকে রাখে । যেতে দেয় না তাইএ ইরফানের কাছে ।
ইরফান বেলীর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । হাত বুলাতে বুলাতে বেলীর কানের কাছে মুখ এনে আস্তে করে কথা বলে ইরফান ,
– বেলী,,,,,,,,,,,?
– হু ,,
– একটা কথা বলি ?
– হু ,,
– একটু সুখের মিলন হলে , খুব বেশি কি ক্ষতি হবে বেলী ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,
– কি হলো বল , খুব বেশিই কি ক্ষতি হবে ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– এই অন্তরটা তোকে খুব ভালোবাসতে চায় রে বেলীফুল । খুব ভালোবাসতে চায়
ইরফানের মুখ থেকে বেলীফুল ডাকটা শুনে বেলীর মনে হয় কে যেন তার কলিজায় পানি ঢেলে দিয়েছে । তার পুড়ে যাওয়া ক্ষতস্থানটা হঠাৎ করেই কেন জানি ভালো হয়ে গেল । ইরফান আবারও বলে ,
– বল না একবার , খুব বেশিই ক্ষতি হবে কি একটু সুখের মিলনে ।
– জানা নাই ,
– জানা নেই , সত্যিই কি জানা নেই ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,
– অনেক জায়গায় বলতে শুনেছি নীরবতা সম্মতির লক্ষণ । আমি কি এই নিরবতাকেই তোর সম্মতি ভেবে নিবো ?
ঠিক তখনই বেলী তার দু’হাতে ইরফানের পিঠটা মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় । নিজেই নিজের হাতের ভাজে চেপে ধরে ইরফানের টি-শার্টটা । ইরফান তখন কিছুই বলেনি । শুধু এক গাল হেসে পরম ভালোবাসায় নিজের মাঝে বেলীকে আঁকড়ে ধরে । আর তার কিছুক্ষণ পরেই ইরফান বেলীকে কোলে তুলে নেয় । বেলীর মুখ যেন লজ্জায় আবৃত এক রাঙা বধূর মুখ লাগছিল । বিছানার কাছে নিয়ে গিয়ে আলতো ভাবেই বেলীকে শুইয়ে দেয় ইরফান । আজ ভালোবাসার সপ্তম আকাশে পদার্পণ করলে ক্ষতি হবে না হয়তো । বেলীর লজ্জা রাঙা মুখ তখন ইরফানকে কাছে চাইছে , খুব করেই কাছে চাইছে । আর ইরফান যেন পলক বিহীন চোখে তাকিয়ে দেখছে তার বেলীফুলকে । আজ দুটো হৃদস্পন্দন না হয় এক হলো । এতে হয়তো ক্ষতি কিছুই হবে না । বড় জোড় নতুন আরেকটা হৃদস্পন্দনের আবির্ভাব ঘটবে । ইরফান বেলীর দিকে অনেকটাই ঝুঁকে যায় । ইরফানের এই ঝুঁকে যাওয়াটাই হয়তো বেলীর সুখের সর্বনাশ ।
অন্ধকার বন্ধ ঘরে দুটো মনের সুখের মিলন ঘটে এই রাতে । আজ রাতে পূর্নিমার চাঁদটাও লজ্জায় তার চোখ জোড়া বন্ধ করে দেয় । দূরে ডাকতে থাকা ডাহুক পাখিটাও আজ একদম চুপচাপ । হয়তো তার মনেও জানান দিয়েছে যে আজ কিছু অপ্রকাশিত ভালোবাসার পূর্ণতা ঘটবে ।
বাহিরে হিম শীতল বাতাস বইছে । পরিবেশটা একদম নিস্তব্ধ । আজ না আছে বেলীর মুখে কথা না আছে ইরফানের মুখে কথা । শুধু আছে ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ আর কিছু সুখের আর্তনাদ । দু’জোড়া হাত যেন আজ মিলেমিশে একাকার । এ যেন এক স্বর্গীয় সুখ ।
পরদিন ,
ভোরের দিকে বেলীর ঘুম ভেঙে যায় । নিজেকে ইরফানের সঙ্গে লেপ্টানো অবস্থস্য আবিষ্কার তার । কাল রাতে ঘটে যাওয়া সুখের মিলনটাই হয়তো আজকে ভোরের লেপ্টে থাকার স্বাক্ষী । ইরফানের শরীরের সাথে নিজের শরীরটা এইভাবে দেখে লজ্জার শ্রেষ্ঠ চূড়ায় অবস্থান করছে বেলীর মন । অবশেষে তাহলে সুখের মিলনটা তাহলে হয়েই গেল । অপ্রকাশিত ভালোবাসাটা অবশেষে প্রকাশিত ভালোবাসার পবিত্রতার ডোরে বাঁধা পড়েই গেল ।
বেলী আস্তে করে ইরফানের পাশ থেকে উঠে যায় । ওয়াসরুমে গিয়ে নিজেকে আয়নায় পর্যবেক্ষণ করে বেলী । শরীরের কিছু কিছু অংশে যেমন ঘাড়ে , হাতে লাল হয়ে আছে । হঠাৎ করেই বাম হাতের কব্জায় নজর দেয় বেলী । সেখানে পুরো ৪ টা আঙুলের ছাপ পড়ে আছে । লাল হয়ে আছে হাতের কব্জিটা । হাতটা দেখে অনায়াসেই হেসে দেয় বেলী । চোখের পানি গুলো টপ টপ করে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে । চোখের এই পানি গুলো হয়তো বেলীর সমস্ত কষ্টের সমাপ্তির স্বাক্ষী হয়েছে আজ ।
ঝরনা ছেড়ে নিজেকে ধুয়ে নেয় বেলী । প্রায় এক ঘন্টা সময় নিয়ে শাওয়ার নেয় বেলী । ওযু করে একেবারেই বের হয়ে যায় বেলী । ইরফান তখনও ঘুমে কাতর । বেলী পশ্চিম-মুখী হয়ে জায়নামাজে দাঁড়ায় । ফজর নামাজ আদায় করে আজ কোরআন কালীম নিয়ে বসে । ইরফানের ঘুমের যাতে ক্ষতি না হয় তাই গুন গুন করে আস্তে আস্তে কোরআন কালীমের পুরো এক পারা এক বসায় শেষ করে মোনাজাত ধরে বেলী ।
– রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াকিনা আযাবান্নার – হে মহান আল্লাহ পাক আমাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বোত্তম কল্যাণ দান করো এবং আগুনের আযাব হতে আমাদের রক্ষা করো । আল্লাহ পাক তুমিই একমাত্র বুঝো আমার অন্তরে কি চলে । মানুষটাকে আমি ভালোবাসি অনেক ভালোবাসি । তাকে ছেড়ে যেতে পারব না । তার দূরত্বটা আমায় বার বার কষ্ট দেয় । আমি চাইনা আর এই দূরত্বটা বাড়ুক । আমি এটাও চাই না যে রুবি আপু কষ্ট পাক । কারণ আমি কারো অভিশাপ নিয়ে বাঁচতে পারবো না । তাই তুমি এমন কিছু করো যাতে সেও কষ্ট না পায় । আল্লাহ পাক তুমি সবাইকে ভালো রাখো সাথে আমাকেও ভালো রাখো । আমার তুমি ছাড়া কেউ নেই আল্লাহ ।
মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় বেলী । ওড়নার ভাজ খুলে ভেজা চুল গুলো খুলে দেয় বেলী । চারদিকে ফর্সা হয়ে গেছে । আলো ফুটে গেছে । প্রকৃতি আবার আরেকটি নতুন সকাল উপহার দিল মানবজাতিকে । জানালার পাশে দাঁড়িয়ে উপরে আকাশে নজর দেয় বেলী । আজ বেলী বুঝেছে ভেজা চুলে কতটা ভালোবাসা জড়ানো থাকে ।
আজ ইরফানের অফিস আছে । নিজের হাতে সব নাস্তা বানিয়ে টেবিল সাজিয়ে দেয় বেলী । মিনু রান্নাঘরের বাকি কাজ গুলো করছে । ইরফান রুম থেকে বেলীকে ডাকতে থাকে ,
– বেলী ,,,,, এই বেলী,,,,,,?
ইরফানের ডাক শুনে বেলী হাতের কাজ ফেলেই রুমে দৌড়ে যায় বেলী ।
– জ্বি ,
– কই থাকো ?
– টেবিলে নাস্তা দিলাম ।
– এইদিকে আসো আমার সামনে ।
ইরফানের কথায় বেলী তার সামনে দাঁড়ায় । বেলীর নজর নিচের দিকে । ইরফান কিছুক্ষন বেলীর দিকে তাকিয়ে থাকে । তারপর কি যেন ভেবে বেলীর ওড়নার নিচে তার দু’হাত ঢুকিয়ে দেয় । আচমকা এইভাবে হাত দেয়ায় বেলী একটু ঘাবড়ে যায় । পরক্ষনেই বুঝতে পারে ইরফান তার গলায় কিছু একটা পরাচ্ছে । তখনই বেলী ওড়নার ভাজ খুলে দেয় । তারপর যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারে নি সে । তার গলায় ততক্ষণে একটা স্বর্নের চেইন উঠে গেছে । বেলী ইরফানের দিকে অবাক নয়নে তাকায় । তখন ইরফান বেলীর কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বলে ,
– এটা আমার পক্ষ থেকে তোমাকে দেয়া প্রথম স্বর্ন ।
– এইসবের কি প্রয়োজন ছিল ?
– সব কিছুতে প্রয়োজন খুজতে নেই । কিছুটা ভালোবাসাও থাকে । বুঝলেন ম্যাডাম ,
– হু ,
– দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার । খেতে দেও , আমি অফিসে যাবো ।
– দেয়া আছে সব আপনি আসুন ।
সুখের মুহুর্ত গুলো কেন যেন খুব দ্রুতই পাড় হয়ে যায় । হয়তো দুঃখের সময় গুলোই পাড় হতে চায় না । এ যেন সুখ দুঃখের এক অসাধারণ মেলবন্ধন । বেলী যেন তার সুখ গুলোকে দু’হাতে কুড়িয়ে নিচ্ছে আর ইরফান যেন তার ভাগের সুখ গুলো বেলীর মাঝে বিলীন করে দিচ্ছে । এই সুখটুকু খুব করে পেতে চায় । যাতে পরে হারিয়ে গেলেও আর আফসোস না থেকে যায় ।
.
.
চলবে……………………