#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
||পর্ব: ০৭||
“আমাকে বিয়ে করবে অপূর্ব ভাই। আমি তোমার বাচ্চা সামলাতে পারব, রান্না বান্না করতে পারি। পুরোপুরি পারিনা, তবে শিখে নিবো। করবে বিয়ে?”
আমি সরল কণ্ঠে বললাম। তিনি কর্ণপাত করলেন না। স্বাভাবিক তার মুখশ্রীর ভঙ্গিমা। ‘নিজেকে মাছি মনে হল’ – যেন মাছি তার কান জুড়ে ভনভন করছে। খাবার মাখতে গিয়ে কনুইয়ের সাথে ধাক্কা লাগল পানি ভর্তি গ্লাসের। গ্লাসটা বিছানায় কাত হয়ে পড়ল। পানিতে ভিজে গেল বিছানা। অপূর্ব ভাই প্লেট রাখলেন। অবিলম্বে গ্লাস সোজা করে রাখলেন। হাতের সাহায্যে পানিটুকু ফেলে দিলেন। বারান্দা থেকে পাপস্ এনে পা দিয়ে রাখলেন পানির উপরে। দরজার দিকে চাইলেন এক পলক। তুরের ছায়াও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। তিনি চলে এলেন। পাশে বসে খাবার মাখতে লাগলেন। শেষ লোকমা মুখে তুলে দিলেন। চিবুকে চিবুতে বললাম, “বললেন না?”
দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করার দরুন একটু থমকালেন। তবে জবাব দিলেন সোজাসাপ্টা। “কেন? পোস্ট করে ইনবক্সে যোগাযোগ করতে বললি, কাউকে পছন্দ হয়নি?”
আমি দৃষ্টি সরাতে ভুলে গেলাম। আকাশ থেকে পড়ে চড়কগাছে আঁটকে আছি। আমার আইডির সাথে তার এড নেই, তবে জানলেন কীভাবে? তাছাড়া লক করা আইডি। প্রয়োজন ছাড়া ধরিনা। ফোন বোধহয় ঘরে। কে কে মেসেজ করেছে জানি না। কমেন্ট পড়িনি। অপূর্ব ভাই ফোন হাতে নিলেন। নিজের ফোন দেখে চমকে উঠলাম। এটা ঘুমানোর পূর্বে বালিশের কাছে রেখেছিলাম, এখানে কেন? অপূর্ব ভাই ফোনটা এগিয়ে দিলেন। আমি চেক করলাম দ্রুত। পোস্ট নেই। ডিলেট করে দিয়েছে। লাইট দিয়ে করলে আনডু করে যেত। স্ক্রিনে উপরে দিকে সিমকার্ডের নেটওয়ার্ক নেই। ক্রোস চিহ্ন। আমি ফোন বন্ধ করলাম। দ্রুত সিমকার্ড চেক করতে লাগলাম। সিমকার্ড নেই, সিমকার্ড কোথায়? যতদূর মনে আছে, পোস্ট করার সময় সিমকার্ড ছিল। ফোন ওপেন না করেই ধীরে ধীরে শুধালাম, “অপূর্ব ভাই, সিমকার্ড কোথায়?”
“কীসের সিমকার্ড?”
“আমার ফোনে ছিল।”
“তোর আঠারো হয়নি, তাছাড়া জাতীয় কার্ড নেই। ওটা তোর নামে রেজিষ্ট্রেশন করা নয়। অন্যের সিম ব্যবহার করা উচিত নয়। তাই নিয়ে নিয়েছি। আমার কাছেই আছে।”
“দিয়ে দিন না?”
“না! আরেকবার দেওয়ার কথা বললে ফুফুর কাছে বিচার দিবো। বেতের বাড়ি দিয়েছে এবার লাঠির বাড়ি দিবে।”
আমি গালে হাত রেখে বিছানায় বসে রইলাম। সিমকার্ড তন্বির। মায়ের অজান্তে ব্যবহার করি। অপূর্ব ভাই মা-কে বললে, আমার কপালে শনি আছে। শুধু ফেসবুক খুলতেই লেগেছিল। সিমকার্ড ছাড়া চলা যায় না-কি? জিমেইল আইডি খুলতেও সিমকার্ড দরকার হয়। নতুন জিমেইল এড করেছে। অপূর্ব ভাই চলে গেলেন। তুর ওর জামা নিয়ে এসেছে। জিন্স আর টপস। আমি জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেলাম। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলাম। পানি কী ঠান্ডা। পশমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। জামা কাপড় বালতিতে ভিজিয়ে রাখলাম। এখন ধোঁয়া সম্ভব নয়। কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলাম। কী শীত! কী শীত! আগামী এক সপ্তাহ গোসল করা যাবেনা। একদম যাবে না।
চুলে টাওয়াল জড়াতে জড়াতে ঘরে এলাম। ফ্যান বন্ধ করে বিছানায় উঠলাম। কম্বল জড়িয়ে নিলাম দ্রুত। একটু আগেও আকাশ ছিল পরিচ্ছন্ন এখন যেন মেঘের ভেলা। অপূর্ব ভাইয়ের জালানা দিয়ে দেখা গেল চাঁদ বিহীন মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। তুর শপিং প্যাকেট সমেত ঘরে এলো। সেন্টার টেবিলের উপর রেখে বলে, “চৌরাস্তার মোড়ে যেতে হবে। ওখানের দর্জি না-কি খুব ভালো জামা তৈরি করে। এবারের জামাটা সেখানেই বানাবো ভাবছি।”
“মেঘ করেছে, যখন-তখন বৃষ্টি আসতে পারে। এখন যাওয়ার কী দরকার? কালকে সকালে যাই।”
“সবার থেকে আলাদা পোশাকে স্কুলে যেতে অস্বস্তি হয়। তাছাড়া পোশাক বানাতে দিলে সাথে সাথে দিবে না, সময় লাগবে। এখন দিয়ে আসি, তুই ঘরে থাক। আমি আর ভাইয়া যাবো আর আসবো।”
ফট করে বিছানা ছেড়ে নামলাম। গায়ে জড়ানো কম্বলটাকে বিছানায় এলোমেলো করে রাখলাম। একা থাকব বাড়িতে অসম্ভব! আমাদের বাড়িতে হলে মানা যেত। প্রায় বছর দুই এই বাড়ি খোলামেলা ছিল। আমি রাতদুপুরে নুপুরের শব্দ শুনতে পেতাম। ভয়ে কতরাত মায়ের কাছে থেকেছি। আমি একা কিছুতেই থাকতে পারব না। আলতো হাতে চুল মুছতে মুছতে বললাম, “অপূর্ব ভাই-কে যেতে বল, তুই আর আমি থাকি।”
টেনে টেনে বলে, “তুই আসলেই একটা বুদ্ধু। দর্জি কি ভাইয়ার মাপে জামা তৈরি করবে? আমার মাপ পাবে কোথায়?”
“তোর একটা জামা দিয়ে দিবি, তাহলেই হবে।”
“আমি কি বিদেশে জামা পড়েছি? জামা পাবো কোথায়?
“তা-ও তো ঠিক। আমিও যাবো, একটু অপেক্ষা কর। চুলগুলো মুছে নেই।”
ঝড়োহাওয়ার বইছে। বালুকণা হওয়াতে ভেসে যাচ্ছে বহুদূরে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। এখন সচল রাস্তাঘাট। খানিকক্ষণের ভেতরে লোকজনের আনাগোনা কমে যাবে। ঠকঠক করে কাঁপছি আমি। দু’হাতে শরীর আড়াল করে টেইলার্সের দোকানের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি। কম্বলটা সাথে আনার প্রয়োজন ছিল। তুরের মাপ নিচ্ছে। অপূর্ব ভাই দাঁড়িয়ে আছেন পাশে। সব টেইলার্স তো ভালো হয়না, ছলেবলে আপত্তিকর অবস্থায় ফেলত। মাপ নেওয়া শেষ হতেই রশিদ লিখতে বললেন দর্জি। ততক্ষণে তন্বির মতো কাউকে দেখলাম। দোকানের দিকে এগিয়ে আসছে। গুরুত্ব দিলাম না। রশিদ নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। ততক্ষণে তন্বি কাছাকাছি চলে এসেছে। আমি দেখেও না দেখার ভান ধরলাম। চোখ মুখের অবস্থা শোচনীয়। অপূর্ব ভাইয়ের দুহাত ধরেছি আমি ও তুর। তন্বি অপূর্ব ভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। কাঁদতে কাঁদতে বলে, “সেই সকাল থেকে আমি তোমাকে কতগুলো মেসেজ দিয়েছি, ভিডিও অডিও কল করেছি। একবারও রিসিভ করোনি তুমি। কেন করোনি?”
“জবাবদিহিতা আমার পছন্দ নয়। পথ ছাড়ো।”
তন্বি আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। দু’কদম পিছিয়ে গেলাম আমি। হাত ধরল তার। ঝাঁকিয়ে বলল, “তোমাকে বলতেই হবে, আমাকে কেন এড়িয়ে যাচ্ছো।”
“কারণ তোকে আর আমার ভালো লাগছেনা। আর হ্যাঁ বড় হওয়ার পর আমার মা আমাকে আজ পর্যন্ত এভাবে জিজ্ঞেস করেনি, আর আমিও কাউকে জিজ্ঞেস করেনি। তাছাড়া রিলেশনে যাওয়ার আগেই আমি তোকে বলেছিলাম, যখন তখন ব্রেকআপ হতে পারে। সো এখন ব্রেকআপ।”
“কীসব বলছ হিরো, কেন ব্রেকআপ করবে? তুমি এটা করতে পারো না”
“ইচ্ছে হয়েছে তাই করেছি। আমি কী করতে পারি না-পারি, সেটা তুই জানিস না।”
মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। বড়ো বড়ো ফোটা হাতুড়ির মতো শরীরের উপর পড়ছে। শীতলতা বেড়ে গেল। দু’হাত কপালের সামনে ধরে বললাম, “জোরে বৃষ্টি পড়ছে, ঠান্ডা লাগছে। বাড়িতে যাবেন না?”
“হম চল।”
মাঝরাস্তায় তন্বি-কে রেখে দ্রুত বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। চৌরাস্তা থেকে বাড়ির দূরত্ব বেড়ি নয়, তাই পৌঁছে গেলাম তাড়াতাড়ি। বৃষ্টি থামল না, জোরে জোরে পতিত হল। ইট সিমেন্টের ঘর অবস্থান করার পরেও বাইরের গাছ কাঁপানো শব্দ শোনা যাচ্ছে। রাত বাড়ছে। মা বাবা, মামা মামুনির আসার হৌদিস নেই। এত দেরি হচ্ছে কেন? কোথায় গেছে, তা-ও জানি না। বৃষ্টি কারণে আসতে পারবে না, আসলেও রাত হবে।
“সকালে চলে আসবে।” অপূর্ব ভাই জানালেন। আমি অপূর্ব ভাইয়ের বিছানায় বসে রইলাম। অদূরে বাজ পড়ল বিকট শব্দে। আগুনের ফুলকি দেখা গেল। লহমায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটল। রাতে বিদ্যুৎ না ফেরার লক্ষণ। ঘর অন্ধকার। অপূর্ব ভাই তার ফোনের টর্চ জ্বেলে দিলেন। একটু আলোকিত হল। কিন্তু ভয় গেল না। সারারাত বসে থাকার প্রতিজ্ঞা করলাম। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী রইল না। অপূর্ব ভাই আমাকে ভাবনায় ফেলে বিছানা জুড়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। দেয়ালে পড়া মানুষের ছায়াগুলো দৈত্যের মতো ভয়ংকর লাগছে। এই বুঝি খেয়ে ফেলল আমায়। নিচে বিছানা করলো তুর। ভয় নিয়ে মাথা ঠেকালাম বালিশে।
মাঝরাতে ঠান্ডা পড়ল প্রবল। শীত শীত ভাব বেড়ে গেল। মেঝেতে শুয়ে থাকা অসম্ভব। পাশে শুয়ে থাকা তুর সোফায় উঠে শুয়েছে। আমি আড়মোরা ভেঙে উঠে বসলাম। মেঝেতে অগোছালো চাদর দলা পাকিয়ে পায়ের কাছে পড়ে আছে। আমি চার ভাজ করে বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছি। অন্য ঘরে যাওয়ার সাহস নেই। অপূর্ব ভাই বিছানার একপাশে সেঁটে ঘুমিয়ে আছেন। ডাক দিয়ে বলল কি, আমার শীত করছে? সাহস নেই। ধমকে উঠবেন নিশ্চয়। কিন্তু ঠান্ডায় নাক বন্ধ হয়ে গেছে। শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না। ওষ্ঠদ্বয় বিচ্ছিন্ন করে শ্বাস টানতে হচ্ছে। শব্দ করে কাশি দিলাম। ঘড়িতে তিনটা পঞ্চান্ন বাজে, আচ্ছা রাত তো কম হলনা। মায়েরা কি এখনো আসেনি।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]