জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ৬

0
451

#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
||পর্ব: ০৬||

অবিরাম ধারায় অশ্রু ঝরছে। তিন বিষয়ে ফেল এসেছে।‌ এত খাটুনি করেও তিন বিষয়ে ফেল। মানা যায়। আজ বাড়িতে গেলে মায়ের বেতের আঘাত হাতে পড়বে আমার। আমি হিজাব ঠিক করতে করতে বের হলাম ক্লাস থেকে।‌ টিফিন পিরিয়ড চলছে। ভবনগুলো ফাঁকা। মাঠে ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড়। দোতলা থেকে দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। সময় এগারোটা পঞ্চাশ। মন খারাপ করে বারান্দায় দাঁড়ালাম। তুর পাশে দাঁড়িয়ে শান্তনা দিচ্ছে। ম্যাম এতক্ষণে নিশ্চয়ই ফোন করে মা-কে ফেল করার কথা জানিয়েছে।
নবম দশম শ্রেণি একসাথে থাকার কারণে পিয়াস যাচ্ছিল বারান্দা দিয়ে। আমাকে দেখে থামল সে। ভ্রু কুঁচকে বলল, “কাঁদছিস কেন?”

“ফাস্ট সেমিস্টারে ফেল এসেছে তাই। মা আমাকে মে’রেই ফেলবে।”

“শাশুড়ি আম্মা তোকে মা’রবে কেন? হাত কে’টে রেখে দিবো।”

অশ্রু এবার নিয়ন্ত্রণে এলো। কোমরে হাত গুঁজে তীক্ষ্ণ গলায় বললাম, “ঐ পিয়াসের বাচ্চা, তুই কাকে শাশুড়ি বলছিস। সেদিন অপূর্ব ভাই তোকে চড় দিয়েছিল। শিক্ষা হয়নি। পা ধরেছিলি আমার, তা-ও শিক্ষা হয়নি। আমি কিন্তু আবার অপূর্ব ভাই-কে বিচার দিবো।”

“কী করবে তোর অপূর্ব ভাই? ও তো তোকে সহ্যই করতে পারেনা।” ঝালমুড়ি নিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলল। আমি তন্বির কথায় একটু থমকালাম। বিগলে গেল মেজাজ। আজকে সকাল থেকে একটুও কথা বলেনি আমাদের সাথে। দূরে বসেছে। বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম ওর সাথে কথা বলতে। ফলাফল শূন্য। আমি এবার এড়িয়ে গেলাম। তন্বি এগিয়ে এলো। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বলল, “তুই তোর কোনো বিষয়ে একদম হিরো-কে টানবি না। তোর জন্য কালকে হিরোর সাথে হাঁটতে পারিনি। একদম হিরোর আশেপাশে যাবিনা।”

হুট করে চুমু খেল গালে। অবিলম্বে পিছিয়ে গেলাম দু’কদম। চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলে পিয়াস, “এবার গিয়ে তোর অপূর্ব ভাই-কে বল। আমি এখানেই আছি। বড় বড় ছেলে ঠিক করে রেখেছি। আসলেই প্যাঁদানি দিবো।”

বলেই বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল নিচে। আমি নিজ গালে হাত রাখতেও সংকোচ বোধ করছি।
কিছুক্ষণ প্রয়াসের পর হাত রাখলাম গালে। অবিলম্বে অশ্রু গড়ালো পুনরায়। ছুটে গেলাম ওয়াশরুমের দিকে। পানির ঝাপটা দিলাম বার কয়েক। পানির স্পর্শে পুড়ে উঠছে গাল। আরও কয়েকবার ঝাপটা দিলাম। হিজাব দিয়ে ঘষতে লাগলাম গাল। ততক্ষণে পিছনে এসে দাঁড়ালো তুর। নিজের ফোন বের করে বলে, “তুই কাঁদিস না, আমি ভাই-কে ফোন করছি।”

“অপূর্ব ভাই আসবে না, আসলেও আবার আমাকে মা’রবে। ওরা লোক ভাড়া করেছে, অপূর্ব ভাই-কে অনেক মারবে।”

“চুপ কর তুই। অপূর্ব ভাই-কে চিনিস না। আমি ফোন দিচ্ছি আর এই তন্বির কথাও বলব, ব্রেকআপ না হয়ে যায় কই, সেটাও দেখব।”
তুর অপূর্ব ভাই-কে ফোন করল। আমি গাল ঘষতে ঘষতে আয়নাতে দেখলাম। ফর্সা গাল লাল হয়ে এসেছে। চামড়া ছিলে যাবে যখন তখন। আমি ক্লাস করব না ঠিক করলাম। ক্লাসের গিয়ে দরখাস্ত লেখলাম। ম্যামের কাছ থেকে সাইন করে বেরিয়ে এলাম স্কুল থেকে। আমি আর স্কুলে আসব না। পরীক্ষার সময় শুধু পরীক্ষা দিবো।
___

বেত নিয়ে বসে আছে মা। দৃষ্টি তার তীক্ষ্ণ। ভয়ে হাত পা যথারীতি কাঁপছে। ভেতর থেকে ছিটকিনি তোলা দরজার। রেজাল্ট সিটটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পড়নে স্কুলের ড্রেস। হিজাব পিন দিয়ে আটকানো। আজ ভয়াবহ শাস্তি আছে আমার কপাল জুড়ে। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে এগিয়ে দিলাম রেজাল্ট সিট। মা ছিনিয়ে নিলেন হাত থেকে। ম্যাম ফোন করে জানিয়েছেন। রেজাল্ট দেখতে মনোযোগী হলেন। তিন বিষয়ে ফেল দেখে শান্ত রইলেন না। রেজাল্ট ছুঁড়ে ফেললেন। বেতের দু’গা পড়ল পিঠে। আমি চিৎকার করে উঠলাম। দরজার বাইরে তুর চিৎকার দিল। মায়ের ভাবাবেগ নেই। আরও কয়েকটা হাতের উল্টো পিঠে দিল। দ্রুত হাত লুকালাম পেছনে। কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “বিশ্বাস করো মা, আমি ভালো পরীক্ষা দিয়েছিলাম। খুঁটি নাটি ভুলের জন্য ফেল এসেছে।”

“তিন ঘণ্টা সময় লাগিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিস। মাসে মাসে টিউশন ফি, বেতন ফি, পরীক্ষার ফি, জামা কামড়, বই-খাতা কলম-পেন্সিলের তোর পেছনে হাজার হাজার টাকা ব্যয় হয়। আর এখন বলছিস ভুল। তোর পড়াশোনা বন্ধ।”

প্রতুক্তি করলাম না। মা বেতের আঘাত শুরু করলেন। আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। দরজার বাইরে থেকে তুর চ্যাঁচিয়ে বলে, “একটু সহ্য কর, আমি মাম্মাম-কে নিয়ে আসছি।”

আর শব্দ শোনা গেল না। পায়ের শব্দ শোনা গেল। ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে গেল শব্দ। এবার ভয় ঝোঁকে ধরল। পিছিয়ে দেয়ালের সাথে সেঁটে গেলাম। হিজাবের ভেতরে চুলগুলো ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। দেওয়ালে ধাক্কার সাথে সাথে খুলে পড়ল নিচে। মনে হল ব্যান্ড ভাঙা টুকরোগুলো মাথার ভেতরে ঢুকে গেল। দ্রুতি হাতে হিজাবের সেফটিপিন আল পিনগুলো খুলে ফেললাম। চুলগুলো এলোমেলো পিঠ জুড়ে গেল। দরজায় ধাক্কা দিল কেউ। মামুনির কণ্ঠস্বর শোনা গেল। বিচলিত গলায় বলছে, “আপা মেয়েটাকে আর মে’রোনা, দরজা খোলো।”

“ভাবী তুমি ঘরে যাও, আমি আসছি।”

“তুমি আগে আসো, তারপরে আমি যাচ্ছি।”

“তোরে পরে দেখছি, খাওয়া বন্ধ তোর।”
মা চরম বিরক্ত হলেন। মামুনি আসার কারণে এবার ছাড়া পেলাম। আগেরবার যখন মে’রেছিল টানা দু’দিন কিছু খাইনি। কারো সাথে কথা বলনি। ঘর থেকে বের হইনি। প্রচুর মে’রেছিল। মা বেত নিয়ে বের হলেন। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলাম। বড় সাইজের তালা ঝুলিয়ে দিলেন।

বিছানায় বসলাম। আঘাতে স্পর্শ করলাম। জ্বালা বেড়ে গেল। কালচে হয়ে গেছে। এত পড়ি তবুও মনে থাকে। সহজ প্রশ্ন সামান্য একটু বুদ্ধি খাটিয়ে সমাধান করতে পারেনি। আমি শুয়ে পড়লাম। পড়াশোনার জন্য মা’র খেতে হয়, আর পড়াশোনাই করব না। একদম বিয়ে করে নিবো। রান্না বান্না করব। কাবার্ড থেকে ফোনটা বের করলাম।

“আমাকে বিয়ে করলে রেঁধে বেরে খাওয়াবো, তোমার বাচ্চার মা হবো, সংসার সামলাবো, সব কথা শুনবো। পাত্র চাই। ভালো পাত্র পেলে ইনবক্সে যোগাযোগ করবেন।
ছবি সহ পোস্ট করে দিলাম।
একবার বিয়েটা হোক, আর আসবেনা এই বাড়িতে। তারপরে দেখব, কাকে মা’রে।
.
রাত আটটা। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক শব্দে ছুটে চলেছে। ক্ষুধার্ত আমি ঘুমিয়ে আছি দুপুর থেকে। মাঝে মাঝে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলে এক গ্লাস পানি খাই। মায়ের দেখা নেই। বারান্দায় কিছু পড়ার শব্দ পেলাম। হন্তদন্ত হয়ে হয়ে উঠে বসলাম। অন্ধকারের মাঝে হাতরিয়ে বারান্দায় গেলাম। অপূর্ব ভাই তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। ঢিল ছুড়ে ফুলের টপ ভেঙে ফেলেছেন। এখন রেলিংয়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি মাথা নিচু করে নিলাম। আমার বারান্দা থেকে তার বারান্দার দূরত্ব নয় বেশি। ঢিল ছুড়লেন পিঠে। ক্ষত জায়গায় লাগতেই চিৎকার করে বসে পড়লাম আমি। হতবুদ্ধি হলেন তিনি। দূরত্ব ঘুচিয়ে ছুটে এলেন আমার বারান্দায়। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “আরু, বেশি লেগেছে। স্যরি। কাঁদিস না।”

আমি অশ্রু মিশ্রিত দৃষ্টি আড়ালে নিলাম। মুখশ্রী স্বল্প ডানে কাত করে চলে আসার চেষ্টা করলাম। বাহু ধরলেন। আমি হাত সরিয়ে দিতে দিতে বললাম, “ব্যথা পাচ্ছি অপূর্ব ভাই। মা খুব..
বাক্য শেষ করার পূর্বেই ফুঁপিয়ে উঠলাম। চোখ মুছিয়ে দিলেন তিনি। বাহুডোরে আবদ্ধ করে বললেন, “এখন থেকে তুই আমাদের বাড়িতে থাকবি। চল আমার সাথে।”

“একটু খেতে দিবে। খুব ক্ষুধা লেগেছে।”

“ফুফু খেতে দেয় নি?”

“না।”
অপূর্ব ভাই করুন দৃষ্টিতে তাকালেন। রেলিংয়ের উপর উঠে তার বারান্দায় গেলেন। আমাকে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। ভয়ে শরীর কেঁপে উঠল আমার। দোতলা থেকে পড়ে যদি ম’রে যাই, তখন?

“আমি যাবো না, ভয় করে।”
আমার হালকা দেহটা পরক্ষণেই ভাইয়ের বারান্দায় চলে গেল। কীভাবে গেল, বুঝতে পারিনি। মনে হল দৃষ্টিভ্রম। তবে দৃষ্টিভ্রম নয়। তুর এলো খাবারের থালা সাজিয়ে, আমি আসব যেন সে জানতো। অহেতুক হাতের তালু জ্বলছে। খেতে পারছি না। মাথাটাও ধরে আছে। তুর নিজেই বাচ্চা খাইয়ে দিতে পারবেনা। রেখে দিলাম। অপূর্ব ভাই খাবার মেখে এগিয়ে দিলেন। খাবার চিবুতে চিবুতে বললাম, “মামুনি কোথায়?”

অপূর্ব ভাই আরেক লোকমা তুলে দিয়ে বললেন, “মা আর ফুফু বাড়িতে নেই, বিকেলের দিকে বেরিয়েছে। জানি না কোথায় গেছে।”

“ওহ্। তুর তোর এক সুট জামা কাপড় হবে। শরীরটা ভালো লাগছে না। একটু শাওয়ার নিতাম।”

তুর জামা কাপড় আনতে তার ঘরে গেল। আমি খাবার খেতে লাগলাম। অপূর্ব ভাইয়ের মুখশ্রীর পানে চেয়ে বললাম, “আমাকে বিয়ে করবে?”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here