জ্বালাতে রং মশাল পর্ব ২

0
853

#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
||পর্ব: ০২||

“অপূর্ব ভাই, এতরাতে আপনি আমাদের ঘরে। কোনো কাজ ছিল বুঝি?”

আলো নিভিয়ে সবে বিছানায় শুয়েছি আমি আর তুর। তৎক্ষণাৎ প্রবেশ করলেন অপূর্ব ভাই। অন্ধকারে আমি তেমন দেখতে পাইনা। কিন্তু দরজা খোলার পর আলোর রেখা প্রবেশ করতেই বুঝতে পারলাম কারো উপস্থিতি। তখনই তুর গম্ভীর গলায় বলে, “ভাই তুই এখানে?”

ভাই বলতে অপূর্ব ভাইকে সম্বোধন করা হয়েছে, এই বিষয়ে নিশ্চিত আমি। টেবিলের উপর থেকে চশমা চোখে পড়ে বুঝতে পারলাম, তিনি সত্যি অপূর্ব ভাই। তাই প্রেক্ষিতে বলি,
“অপূর্ব ভাই, এতরাতে আপনি আমাদের ঘরে। কোনো কাজ ছিল বুঝি?”

অপূর্ব ভাই জবাব দিলেন না। ঘরে প্রবেশ করলেন। আলো জ্বালিয়ে দিলেন। নিজের ফোনটা চার্জে দিলেন। আমার ফোনটা নিলেন। চার্জে দিয়ে শুয়েছিলাম সবে। আমার ফোনে লক থাকেনা, যার দরুন অনায়াসেই ব্যবহার করা যায়। তিনি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। ফোন টিপতে টিপতে গম্ভীর গলায় বললেন, “তোরা দুজন বিছানা থেকে নাম, আমি এখন এখানে ঘুমাবো।”

আমি দ্রুত দু’বালিশের ফাঁক থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জড়ালাম। তুরের দিকে তাকিয়ে অসহায় কণ্ঠে বললাম, “তাহলে আমরা কোথায় ঘুমাবো?”

“তোদের ঘুমানো দরকার নেই। আজ আমার সেবা করবি। প্রথমে আমার জন্য ফলের জুস করে আনবি। নিজের হাতে করবি। তারপরে আমি যতক্ষণ জুস খাবো, আরু কান ধরে উঠ-বস করবে। তারপরে মাথা টেনে দিবি একজন, অন্যজন পা টিপে দিবি।”

মেজাজ বিগড়ে গেল এবার। একেই তো রাত বিরেতে ঘুম ভেঙ্গে বিরক্ত করছে আবার সেবা করতে বলছে, মানা রায়? আশ্চর্য! পেটে ব্যথা কমেছে, কালকে স্কুলে যেতে চেয়েছিলাম। মনে হয়না, যেতে পারব। ঝাঁজালো কণ্ঠে বললাম,
“আমরা কেন আপনার সেবা করব? আশ্চর্য! করব না। যান বলছি।”

একটু নিকটে এগিয়ে এলেন। পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে সামনে ধরে মিষ্টি কণ্ঠে বলে, “এবার বল, কী জেনে বলেছিলি।”

আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। হাসতে হাসতে বললাম, “আপনি আমাকে ভিজিটিং কার্ড দেখিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন ভাই। সরুন, সরুন, ঘুমাতে দিন।”

এবার প্রশ্ন করলেন অপূর্ব ভাই, “তুই কখনো বিদেশি অ’স্ত্র দেখেছিস? মনে তো হয়না দেখেছিস। এটা বিদেশি অ’স্ত্র।
এবার বল সেবা করবি কি-না?”

অবিলম্বে মুখের হাসির রেখা মিলিয়ে গেল। ভিজিটিং কার্ডের মতো অ’স্ত্র থাকতে পারে? চোখ জোড়া ছলছলিয়ে উঠল। ভাইয়ার বিরুদ্ধে গেলে কালকের সুন্দর সকাল দেখা হবেনা। মুখের সৌজন্য হাসির রেখা ফুটিয়ে মৃদু হেসে বললাম, “আমি কখন বললাম আপনার সেবা করব না। আপনি আমাদের বড়ভাই অবশ্যই করব। বড়দের সেবা করা মহৎ কাজ।”

আমি আর তুর একসাথে রান্নাঘরের দিকে অগ্ৰসর হলাম। মাঝপথে আমাকে থামিয়ে দিলেন অপূর্ব ভাই। তুরকে জুস বানানোর দায়িত্ব দেয়। দেরি যাতে না-হয় তাই তুরের আসার আগ অবধি আমাকে কান ধরে উঠ-বস করতে হবে। তুর গেল রান্নাঘরে। আমি উঠ-বস করা আরম্ভ করলাম। কখনও উঠ-বস না করাতে অল্পতেই পা ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। ভয়ে কথা বের হচ্ছেনা। আমি অশ্রুসিক্ত চোখে চেয়ে বললাম, “ভাই আমি কী করেছি যে, আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন?”

অপূর্ব ভাই ফোনে টাইপিং করতে লাগলেন। “তুই নাকি আমার মাথায় গোবর দিবি, তার শাস্তি। ভেবেছিলাম আমি তোর মাথায় গোবর দিবো। কিন্তু তুই বোকার চেয়েও নিচের ধাপে, তাই এই শাস্তি। সেটাই দিচ্ছিলাম আর-কি।”

আমি দরজা দিকে দৃষ্টি দিলাম। তুরের দেখা নেই। কোথায় গেছে মেয়েটা। এদিকে আমার পায়ের অবস্থা বেহাল। করুন গলায় কিছু বলতে যাওয়ার পূর্বেই ভাই বললেন, “ইউ আর সো হট বেবি। ইচ্ছে তো করছে..

অপূর্ব ভাইয়ের পরবর্তী স্বর আমার কর্ণপথ পর্যন্ত পৌঁছায় না। আমি কাঁদো কাঁদো মুখে নিচের দিকে চেয়ে রইলাম নিচের দিকে। পিয়াস প্রায়ই এই কথা আমায় বলতো, একদম ভালো নয়। হেঁচকি তুলে বললাম, “ভাই আপনিও আমাকে এইসব বলছেন?”

আমার পানে অবলোকন করলে বিস্মিত হলেন তিনি। বেশ অপ্রস্তুত। কল রেখে দিলেন। আমাকে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে ধীর কণ্ঠে বললেন, “কান্না থামা, কান্না থামা। প্লীজ থাম। কেউ জেগে গেলে আমাকে আস্ত রাখবে না।”

পরক্ষণেই বললাম, “তুমি আমাকে বিশ্রী কথা কেন বলল?”

হতভম্ব হয়ে বলে, “কখন বলেছি, কী বলছি?”

“মিথ্যা বলছ। একটু আগে বলেছ। বেবি না-কি হট বলেননি?”

“ঐটা আমি আমার গার্লফ্রেন্ড’কে বলছি, তোকে না।”
আমি বসে রইলাম চুপচাপ হয়ে। একটু শান্তি পেলাম। উঠ-বস করতে হয়নি। পুনরায় কান্নার গতি বেড়ে গেল। থামানো যাবে না, থামলেই উঠ-বস। ইতোমধ্যে তুর জুস করে এনেছে। অপূর্ব ভাই জুসের গ্লাস ডানহাতে ধরলেন জুসের গ্লাসে চুমুক দিলেন। তুরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বিট লবণ দিতে বলে। তুর ঠিক তাই করল। পরিমাণমতো লবণ দিল। চামচ দিয়ে মিশিয়ে অপূর্ব ভাইকে এগিয়ে দিলেন। আমাদের অন্য ঘরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। তবে কড়া গলায় শাসিয়ে দিলেন, বাকি শাস্তি তুলে রেখেছেন। প্রতিটা সময় ফোনে মেসেজ করেছে তার গার্লফ্রেন্ড’কে।
____

সময় এক টা পঁয়তাল্লিশ। স্কুল ছুটি হয়েছে পঁচিশে। জীব বিজ্ঞান ক্লাসে স্যারের কথা শুনতে শুনতেই সময় ফুরিয়ে গেল। ক্লাস টাইম শেষ করেও এক্সট্রা পনেরো মিনিট করিয়েছেন। ক্লাস পিরিয়ড শেষে বেরিয়ে এলাম। চারপাশে স্যার ছাড়া কাউকে দেখতে পেলাম না। দুপুর হওয়ার দরুন অন্য ক্লাসের সবাই বাড়িতে চলে গেছে। শিক্ষকদের একাংশ চলে গেছে। যারা দূরে থাকে তারা আছেন। এমনি আমাদের স্কুলে শিক্ষকদের জন্য পাশেই একটা হোস্টেল। বেসরকারি বলে কথা। আমাদের স্কুলটা বেশ বড়। সাথে কলেজ ভবন। মোট তিনটা ভবন, সম্মুখে বিশাল খেলার মাঠ। আমি আর তন্বি, তুর’কে বিদ্যালয়ের আশেপাশে দেখাতে দেখাতে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলাম। মাঠের অন্যদিকে পিয়াস আর তার বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছে। শহিদ মিনারের সামনে টাইলস ব্যবহার করে সাজানো জায়গায় বসে আছে। একে দেখলে বখাটের ভাব আসেনা, তবে আমি বেশ ভয় পাই। কিছুদিন আগে আমাকে একটা চড় দিয়েছিল। সবে ক্লাস টেনে পড়ে। ক্লাস টেনে উঠেই সিনিয়র সিনিয়র ভাব নিচ্ছে। দেখে মন হয় ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র। ভেংচি দিয়ে তুরকে নিয়ে হাঁটা দিলাম। মাঝপথে ডেকে উঠে পিয়াস। তর্জনী আর মধ্যমা দিয়ে ইশারায় কাছে ডাকল। আমি বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার হাটা দিলাম। আবার ডাকল, “ঐ পিচ্চি এদিকে আয়।”

পিচ্চি কথাটা ইগোতে লাগল। তারচেয়ে বেশি ভয়ে ভীত। আবার চড় দিলে। আমি চঞ্চল পা নিয়ে এগিয়ে গেলাম। কোমরে হাত রেখে রাগান্বিত কণ্ঠে বললাম, “সমস্যা কী আপনার? পিচ্চি পিচ্চি বলে কাকে ডাকছেন? আপনি আমার থেকে এক বছরের সিনিয়র। বুঝেছেন।”

পিয়াস ব্যাগের চেইন খুলে সিগারেট বের করল। মুখে দিয়ে পকেট হাতরে কিছু খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু নিরাশ হল। তার বন্ধু মুন্নাকে বলে, “লাইটার আছে?”

মুন্না দ্রুত সিগারেট কেড়ে নিল। পকেটে রেখে শান্ত বলে, “শা’লা সিগারেট রাখ। সামনে স্যার। একবার দেখলে স্কুল থেকে বের করে দিবে।”
অবিলম্বে উঠে দাঁড়ালো পিয়াস। সোজা হয়ে ভদ্র ছেলেদের ন্যায় হাসল। স্যার চলে যেতেই নিজের আসল রুপে ফিরল। মাথা চুলকে শুকনো গোলাপ বের করল। ইতস্তত নিয়ে ফুলটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “আমার কাছে তাজা ফুল কেনার টাকা নেই। ত্রিশ টাকা ছিল। হাত পায়ে ধরে তোর জন্য নিয়ে এসেছি।”

আমি নিলাম না। একটু ধমকে উঠল। কঠোর গলায় বললেন, “ডাকলে কাছে আসিস না। ধরতে বললে ধরিস না। জানিস-না বড়দের কথা শুনতে হয়? তাদের সম্মান করতে হয়?”

আঙুল গুনে গুনে বললাম, “হ্যাঁ। জানি তো! বড়দের সম্মান করা, শিক্ষকদের সম্মান করা। ছোটদের স্নেহ করা, ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেওয়া নৈতিক অধিকার। এগুলো বিবেক থেকে আসে।”

দুপুরের রোদ্দুর একটু বেশিই তাপ ছড়ালো। সবুজ গাছপালা শুকিয়ে যাচ্ছে। পিয়াস কপালের ঘামটুকু মুছে নিল। অতঃপর অনুভূতি নিয়ে বলল,
“ঐসব বাদ দাও। আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গভীর ভাবনায় লিপ্ত হলাম। নিজের ভেতরে কিছুক্ষণ বিবেচনা করে বললাম, “ভালো বাঁশি। আমার কাছে কোনো বাঁশি নেই, ভালো বাঁশি তো দূরের কথা।”

পিয়াস রাগলো একটু। তবুও স্বাভাবিক থাকার মতো করেই বলে, “এটা গানের সরঞ্জামের বাঁশি নয়, ভালোবাসি। মানে ভালোবাসা।”

এবার কিছু বুঝতে পারলাম না। চিন্তাগ্রস্ত কণ্ঠে বললাম, “আমি মাত্র নাইনে পড়ি। বাবার বাসায় থাকি। বৃষ্টি এলে বারান্দায় পানি জমে। আপনাকে কীভাবে ভালো বাসা দিবো?”

পিয়াস এবার বেজায় বিরক্ত। মাথায় হাত রেখে বলল, “তুই যা। বিজ্ঞানী নিউটনের মাথায় আপেল পড়ে আমাদের পড়ালেখা বেড়েছে আর তোর মাথায় তাল পড়ে ঝামেলা বেড়েছে।”

আমি পা বাড়াতে গিয়েও থামলাম। ঘাড় কাত করে মৃদু স্বরে বললাম, “ভালো বাসা লাগবে না?”

পিয়াস এবার দেয়ালে মাথা ঠুকলো নিজের। হাতজোড় করে বলল, “বইন, যা তুই। আমার বাবারও ভালো বাসা আছে। আমি ওখানেই থাকতে পারব।”

তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হল অপূর্ব ভাই। অন্তরে হানা দিল, সকালের ঘটনা। তুর’কে ভর্তি করতে এসেছিলেন। আমাকে ডাক্তার দেখিয়ে একসাথে বাড়িতে ফিরবেন। আমাকে ডাক্তারে কাছে নিয়ে যাবেন তিনি। মাসে মাসে ডাক্তারের সরণাপন্ন হতে হয়। আমার ব্যক্তিগত ডাক্তার একটু সমস্যার কারণে দূরে আছেন, তাই নতুন ডাক্তার দেখাতে হবে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here