#জোনাকিরা ভীড় করেছে
#পর্ব-৭
আমরিন চোখ খুলে দেখলো তার ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। বিকেলে একটু শুয়েছিল সে,ঘুমিয়ে পরেছে কখন টেরই পায়নি।কিন্তু ঘর এতো অন্ধকার হয়ে আছে কেন?রাত নেমে গেছে এতক্ষণে নিশ্চয়ই।ফুপিও ডাকে একবারও!আমরিন লাইট জ্বালানোর জন্য উঠতে চাইলো কিন্তু একি! তার পা বাঁধা কেন?আমারিন চট করে উঠে বসলো।দেখলো, হাত দুটোও বাধা।আমরিন ভয় পেয়ে গেল।মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বর বের হলো।ঠিক সে সময়ই ঘরের লাইট জ্বলে উঠলো।আমরিন দেখলো আনাফ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে আর বাঁকা হাসছে। আমরিন সস্তির শ্বাস ফেললো।এসব তাহলে আনাফ ভাইয়ের কাজ!আর সে কত ভয় পেয়ে গিয়েছিল।একবার ছাড়া পাক, সেও দেখাবে মজা।কিন্তু আনাফের দৃষ্টি দেখে বেশ বুঝতে পারলো আজ আনাফ তাকে ইচ্ছে মতো ধোলাই করবে।
আনাফ কিছু বলার আগেই আমরিন বললো,”দেখ আনাফ ভাই, তুমি আমার মুখ চেপে ধরেছিলে জন্য কামড় দিয়েছি তা না হলে তুমি ছাড়তে না আর আমিও দমবন্ধ হয়ে মরে যেতাম।তখন তুমি সমস্যায় পরতে।তোমার ফাঁসি হয়ে যেত আমায় মার্ডার করার অপরাধে।বলতে গেলে আমি তোমায় বাঁচিয়েছি।ফাঁসির থেকে সামান্য একটু কামড় কি ভালো নয় বলো?”
আনাফ ঝড়ের গতিতে এসে আমরিনের দুগাল চেপে ধরলো। খুব বাড় বেড়েছে তোর!আর একটা কথাও বললে তোরে আমি ছাঁদ থেকে ফেলে দেব একদম। পাঁচ তলা থেকে পরলে বাঁচবি না একদম,যদিও বাঁচিস সারাজীবন নুলা হয়ে থাকবি। হেহ,আমায় ফাঁসির ভয় দেখায়!
আমরিনের গাল জ্বলছে, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি বের হচ্ছে। আনাফের শক্ত হাতের চাপে ব্যাথায় কুঁকড়ে গেছে সে।আমরিনের চোখের পানি হাতে পড়ায় আনাফের হুঁশ হলো।সে আমরিনের হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে চলে গেল।আমরিন পায়ের বাঁধন না খুলেই বিছানায় গড়িয়ে পরলো।খুব কষ্ট হচ্ছে তার।আনাফ ভাই এতো কষ্ট কেন দেয় তাকে?আনাফ ভাই তাকে জ্বালিয়ে মজা নেয় সেও মজা করে।এতে আনাফ ভাই এতো রেগে যায় কেন?আনাফ ভাই কি জানে আমরিনের মন জুড়ে শুধু তারই বিচরণ! তাকে এভাবে আঘাত দিতে কি একটুও কষ্ট হয় না আনাফ ভাইয়ের?
রাতে খাবারের সময় আনোয়ারা আমরিনের কাছে জানতে চাইলেন,আমরিনের গাল এমন লাল হয়ে আছে কেন?
আমরিন জবাব দিলো, গালে হাত চাপা দিয়ে শুয়েছিল তাই এমন হয়েছে।
আমরিনের কথায় আনাফ চট করে মাথা তুলে তাকালো।সে ভেবেছিল আমরিন মাকে বলে দেবে তার কথা।কিন্তু তা না হওয়ায় বেশ অবাক হলো।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার খাওয়ায় মন দিলো সে।আমরিন ভাত নাড়াচাড়া করছে কিন্তু খাচ্ছে না।আনোয়ারা বেগম সেটা লক্ষ্য করলেন।আনাফ আর আমরিনকে এতো চুপচাপ দেখে বুঝে নিলেন দুজনের মাঝে কিছু একটা হয়েছে তা না হলে এরা ঝগড়া না করে চুপ থাকার ছেলে মেয়ে নয়।তিনি নিজের প্লেট সরিয়ে রেখে আমরিনেরটা হাতে নিলেন।
খাইয়ে দিতে দিতে বললেন,মন খারাপ করে আছে কেন আমার জানবাচ্চাটা?
আমরিন কিছু বললো না।আজ খুব কান্না পাচ্ছে তার।ফুপির এমন আদর মাখা কথা শুনে কান্না বেড়ে গেল।চেপে রাখতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আনাফ, আনোয়ারা দুজনেই অবাক হয়ে গেল।আমরিনের হঠাৎ কি হলো,এভাবে কাঁদার মেয়ে তো সে না!
আনোয়ারা চটজলদি হাত ধুয়ে নিয়ে আমরিনকে জড়িয়ে ধরলেন। কি হয়েছে পাগলি, হঠাৎ এভাবে কাঁদছিস কেন?
কিছু না ফুপি।আমি কালকেই বাড়ি যাব।তুমি আমায় নিয়ে যাবে, প্লিজ?
ওমা, তুই না বললি কয়েকটা দিন থাকবি আমার কাছে!
পরে আবার আসব ফুপি।আমি বাড়ি যাব,মায়ের কাছে যাব!ফুঁপিয়ে উঠলো আমরিন।
আচ্ছা বাবা কাল আমি নিয়ে যাব তোকে,এখন কান্না বন্ধ কর।চল তো আমরা ঘরে যাই।
আনোয়ারা চলে গেলেন আমরিনকে নিয়ে।সবকিছু নিরব দর্শক হয়ে দেখলো আনাফ।সে কি আসলেই বেশি করে ফেলেছে। এতটা রিয়াক্ট করা উচিত হয়নি, কি?কি এমন করেছে সে যে এতো নাটক করছে, আমরিন?সাধে কি আর খুকি বলে সে,একদম ঠিক বলে। ঠিক কাজই করেছে সে।বেশ হয়েছে কেঁদেছে।এখন থেকে আর লাগতে আসবে না তার সাথে।আনাফ বিড়বিড় করতে করতে ঘরে আসলো।আসার সময় আমরিনের ঘরে একটু উঁকি ঝুঁকি দিয়েছিল।কিন্তু পর্দা টানা থাকায় কিছুই দেখতে পারেনি।আচ্ছা, আমরিন কি এখনো কাঁদছে? আনাফের বুকের ভেতরে হঠাৎ চিনচিনে অনুভূতি হলো।তখনই মানসপটে আমরিনের কান্নারত মুখটা ভেসে উঠলো। নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল আনাফ!
১৭.
মেঘলা পাশের বাড়িতে এসেছে মেহেন্দি অনুষ্ঠানে। বিয়ের দাওয়াত দিয়েছিল মোমেনা বেগমকে।আশে পাশের প্রায় সব প্রতিবেশীদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে।মেঘলা ভালো মেহেদী পরাতে পারে তাই তাকে ডেকে এনেছে।সাথী মেঘলার থেকে বছর দুয়েক বড়।মেঘলাকে অনেক পছন্দ করে। সাথী বলেছে মেঘলাই তাকে মেহেদী পরাবে।মেঘলাও সাথীকে পছন্দ করে।সাথী মাঝে,মাঝে টুকটাক সাহায্য করতো পড়াশোনার বিষয়ে।তার পুরোনো বই গুলো মেঘলাকে দিয়েছিল পরতে।সাথীর দৌলতে কলেজের কোনো বই কিনতে হয়নি মেঘলাকে।মামির চাপে সেভাবে কারও সাথে তেমন মিশতে পারে না মেঘলা।যেটুকু পায় তাতেই সাথীর সাথে বেশ ভালো একটা সম্পর্ক হয়েছে।তবে মেঘলা আসতে চায়নি।এমন বিয়ের অনুষ্ঠানে পড়ে আসার মতো উপযুক্ত জামা কাপড় নেই তার।যে একটা নতুন আছে তা আগামিকাল বিয়েতে পড়ার জন্য রেখেছে। সাথীর জোড়াজুড়িতে বাড়িতে পড়ার একটা মোটামুটি জামা আয়রন করে পড়ে এসেছে।খুব একটা পুরোনো হয়নি।সাথীর মেহেদী শুরু হলো সন্ধ্যার পর।মনিরাও এসেছে বেশ সেজে গুজে।মনিরা কখনো মেঘলাকে বোন হিসেবে সম্মান করেনা।প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলে না ঠিক মতো।অথচ মেঘলা বড় বোন হয়ে মনিরার কতশত ফাইফরমাশ খাটে।আমরিন এসে মেঘলার পাশে বসলো।মেঘলা একটু অবাক হলো আমরিন কে দেখে।আমরিন বেশ শুকিয়ে গেছে কয়েকদিনে। তেমন কথাও বলে না এখন তার সাথে।মেঘলা খুশি হলো আমরিনকে পেয়ে।ভালো একটা সময় কাটবে তার।এতক্ষণ কেমন যেন লাগছিলো।আমরিন বললো,কনের মেহেদী দেয়া শেষ হলে তাকে দিয়ে দিতে।মেঘলাকে অবাক করে দিয়ে সাথীর ভাই বোনেরা আদিবকে টেনে নিয়ে এলো।সবাই জানে গেছে আদিব ভালো গায়।মেহেন্দি অনুষ্ঠানে নাচ গান ছাড়া সর্ম্পূণ হয় নাকি?সবাই জেকে ধরলো আদিবকে গান গাওয়ার জন্য।আদিব ঢুকেই মেঘলাকে দেখতে পেয়েছে।এত জমকালো আয়োজনের মাঝে সাদাসিধে মেঘলাকে তার কাছে অসাধারণ লাগছে।এই সাধারণ মেয়েটার কাছে কি এমন আছে যার কারণে তীব্র আর্কষনে ছুটে আসে মনটা।কিন্তু আদিব গান গাইলো না,কারণ তার গলা বসে গেছে।তাই সবাই আর জোর করলো না।মেঘলা আঁড়চোখে কয়েকবার তাকালো আদিবের দিকে দেখলো দূর থেকে আদিব তার দিকেই তাকিয়ে আছে।তাই সে আর তাকালো না।আমরিনকে মেহেদী পরিয়ে দিয়ে উঠলো সে বাড়িতে যাওয়ার জন্য।তার জন্য যে মামি সবকাজ ফেলে রেখেছে তা জানে সে।যত দেরী হবে, কাজ গুলো শেষ করতে ততো রাত হয়ে যাবে।তাই আমরিনকে বলে সে বাড়ির দিকে এগোলো।তবে বাড়ির দিকে যেতে পারলো না।আদিব কোথা থেকে এসে টেনে নিয়ে গেল ফাঁকা জায়গায়।মেঘলা ভয়ে চমকে উঠলো ভীষন ভাবে।আদিব পকেট থেকে একটা মেহেদী বের করে মেঘলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলো।
অবাক হয়ে মেঘলা বললো,কি করছেন এসব, আপনি?
দেখতেই তো পাচ্ছো।সবাইকে মেহেদী দিয়ে দিলে আমাকেও একটু দিয়ে দাও।
ছেলে মানুষ আবার মেহেদী দেয় নাকি।মেঘলা লজ্জায় অস্ফুট স্বরে বললো।
আমি দেই।নাও শুরু করো।
আমায় যেতে দিন প্লিজ। মাহিম আমায় বেশিক্ষণ না দেখলে কাঁদবে।
এতক্ষণ যখন ওকে রেখে বাইরে ছিলে তখন আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারবে।নাও শুরু করো,তুমি নিজেই কিন্তু দেরী করছো।তোমায় জোর করে আঁটকে রাখার ক্ষমতা নেই সেটা তুমি ভালো ভাবে জানো,যদি থাকতো তাহলে কবেই তোমায় নরক থেকে নিয়ে আসতাম।
মেঘলা জানে আদিব নাছোড়বান্দা। কাঁপা হাতে আদিবের হাতে মেহেদী দিতে শুরু করলো।কিন্তু আদিব থামিয়ে দিয়ে বললো,শুধু তোমার নামটা লেখ হাতে।
মেঘলা হাত নামিয়ে নিলো।আদিবকে যত দূরে রাখতে চায় আদিব ততই কাছে চলে আসছে বারবার।কেন সে তার নাম আদিবের হাতে লিখবে?লেখার মতো কোনো সম্পর্ক হয়নি তাদের।মেঘলার কাছ থেকে আদিব এতকিছুর আশা কেন করে?জানে না আদিব যা চায় তা কখনো সম্ভব নয়।
তুমি লিখবে কিনা?
পারবো না,আপনার হাতে আমার নাম কেন লিখবো আমি?
কেন লিখবে সেটা তোমার থেকে কেউ ভালো জানে না।
মেঘলা লিখলো না।চোখ, মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো।
মেঘলাকে দেখে।আদিব বেশ বুঝতে পারলো লিখবে না। সেও কম যায় না।মেঘলার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। মেঘলা হাত ছাড়িয়ে নিতে চেয়েও পারলো না।আদিব মেঘলার হাতে নিজের নাম লিখে দিলো মেহেদী দিয়ে।হাতটা চেপেই ধরে রাখলো।যাতে মেঘলা মুছে ফেলতে না পারে।জোরাজুরি করে পেরে উঠলো না মেঘলা তাই নিশ্চুপ হয়ে গেল। আদিব মেঘলার কপালে থাকা চুল গুলো ফু দিয়ে সরিয়ে দিলো।মেঘলা কেঁপে উঠলো।তা দেখে আদিব হাসলো।একটু পর মেঘলার হাতটা ছেড়ে দিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,তোমার মনে আমার নামটা লিখতে না পারলেও হাতে লিখে দিলাম।আর আমার হাতে না লিখলেও চলবে,মনের সবখানে তোমার নাম সর্বদা জ্বলজ্বল করছে। আদিব আর দাঁড়ালো না।মেঘলা দৌড়ে চলে গেল বাড়িতে।বাথরুমে ঢুকে হাতটা ধুয়ে ফেললো ঘষে। কিন্তু তবুও আদিবের নামটা রাঙিয়ে আছে হাতে।কি হবে মামি দেখে ফেললে? ভয়ে অস্থির হয়ে গেল সে।
মোমেনা বেগমের সাথে তার ছেলের একদফা ঝগড়া হয়ে গেছে আজ সকালে।পরিবেশ এখন বেশ থমথমে। বিয়ে যাবে কিনা জানে না মেঘলা।মেঘলার মামাতো ভাই মারুফ এলাকারই একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছক।তাকেই বিয়ে করতে চায় কিন্তু মোমেনা বেগম রাজি না।কারণ, মেয়ের বাবার তেমন টাকা পয়সা নাই।মারুফ নাছোড়বান্দা, সে ওই মেয়েকেই বিয়ে করবে।মারুফ বাড়ির কোনোকিছুর খোঁজ রাখে না।বিদেশ থেকে বাবা টাকা পাঠায় আর সে সেগুলো দুহাতে ওড়ায়।কোনোরকম কলেজের গন্ডি পেরিয়েছে।তবে মেঘলাকে সে নিজের বোনের মতো দেখে।মোমেনা বেগম আর মনিরার মতো আচরণ করে না মেঘলার সাথে।
মনিরা মায়ের সাথে বায়না ধরলো বিয়েতে যাওয়ার জন্য। মোমেনা বেগম কোনো কথা বললেন না।মেঘলা বুঝে গেল তার বিয়ে বাড়িতে যাওয়া হবে না।তাই সে কাজে লেগে গেল।দুপুরের রান্না বসাতে হবে।মাহিমকে গোসল করিয়ে দিয়ে সে রান্নাঘরে ঢুকলো। মোমেনা বেগম তখন এসে বললেন, তৈরী হওয়ার জন্য।বিয়েতে না গেলে খারাপ দেখায়।প্রতিবেশীদের মন যুগিয়ে চলতে হয়।বিপদে আপদে প্রয়োজন হতে পারে।তাছাড়া টাকা খরচ করে উপহার কিনেছেন।খেয়ে টাকাটা উসুল করতে হবে।তাইতো মেঘলাকেও নিয়ে যাবেন বিয়ে বাড়িতে।
চলবে..