জোনাকিরা ভীড় করেছে part 6

0
485

#জোনাকিরা ভীড় করেছে
#পর্ব-৬

আনোয়ার সাহেব বললেন, গান চালাও আমি দিলারার সাথে কাপল ডান্স করবো।
এক কথা শুনে সবাই হাসিতে ফেটে পড়লো।দিলারা বেগম লজ্জা পেয়ে চলে যান।ধীরে ধীরে ওদের আড্ডার সমাপ্তি ঘটে।গোধূলী শেষে সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগেই।বিশাল আকাশের বুকে চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে। ছাঁদের সবাই নেমে গেছে শুধু মেঘলা আর আদিব ছাড়া।মেঘলা নামতে পারেনি।আদিব তার ওরনার কোণ টেনে ধরে আছে একহাতে।মেঘলা কিছু বুঝতে পারছে না আদিবের হঠাৎ এমন আচরণে। কেমন ভয় লাগছে। আদিব এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মেঘলার দিকে,পলক ফেলছে না। মেঘলা ওরনাটা ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলো কিন্তু আদিব আরও শক্ত করে ধরলো,একটু এগিয়ে এলো।মেঘলার হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল,ভয়ে গলা শুকিয়ে আসলো।আধো অন্ধকারে আদিবকে দেখে অন্যরকম লাগছে!আদিব আরও খানিকটা এগিয়ে এলো। কাঁপা কাঁপা হাতে মেঘলার কপাল স্পর্শ করলো।মেঘলা জমে গেল আদিবের শীতল স্পর্শে।আদিব ছুঁয়ে দিলো কপালের আঘাত পাওয়া জায়গাটুকু।মেঘলা চোখ বন্ধ করে নিলো। আদিব মেঘলার দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো।হালকা স্পর্শে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো মেঘলার কপালে।এই প্রথম স্নেহের স্পর্শ!যেখানে ছিলো না কোনো নোংরামি,কোনো কামুকতা। ছিলো শুধু ভালোবাসা আর সম্মান। এরপর মেঘলার ওরনা ছেড়ে দিয়ে দ্রুত চলে গেল ছাঁদ থেকে। মেঘলাকে সেদিন ওই অবস্থায় দেখে আদিবের বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হয়েছিলো।সে পারছে না মেঘলাকে ভালো রাখতে।সব চেষ্টা যেন ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে, তার প্রমাণ মেঘলা এমন অবস্থা। মোমেনা বেগমের ওপর খুন চেপে গিয়েছিল সেদিন। মেঘলার ওই অবস্থায় ইচ্ছে করছিল নিজের কাছে নিয়ে আসতে।কিন্তু সেটা যে কোনোদিনও সম্ভব হবে কিনা তা নিজেও জানে না আদিব।সেদিন খুব ইচ্ছে করছিলো মেঘলাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে, আমি থাকতে তোমায় এত আঘাত পেতে হচ্ছে,তোমায় এতো কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে, তুমি আমায় শাস্তি দাও মেঘলা।
অসুস্থ মেঘলাকে চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে করছিল না।তাই আমরিনকে বলেছিল প্রতিদিন খোঁজ নেয়ার জন্য। আমরিন তার কথা রেখেছে।প্রতিদিন মেঘলার বাড়ি গিয়েছে।

মেঘলা চোখের পানিটুকু মুছে নিলো।মাঝে, মাঝে পৃথিবীর সব থেকে ভাগ্যবান মনে হয় নিজেকে।আদিব বুঝিয়ে দিলো তার পাওয়া আঘাত গুলো আদিবের বুকে দ্বিগুণ ক্ষত সৃষ্টি করে।এত ভালবাসা কখনো তাকে কেউ দেবে তা কি কল্পনাও করেছিল কখনো?এত ভালবাসার যোগ্য কখনো হতে পারে না সে,কখনো না।

বাড়িতে এসে মামির একদফা বকাবকি শুনতে হলো।কিছুই কানে ঢুকলো না তার।সে এখনো ঘোরের মাঝে আছে।মনে হচ্ছে এখনো সেই ছাঁদেই দাঁড়িয়ে আছে আদিবের সাথে।আজ মালিহা বেগমও রাগ হলেন।জানতে চাইলেন কি এমন দরকার ওই বাড়ি যাওয়ার,রাতে ফেরার। মেঘলা কারও কথার কোনো জবাব দিলো না।বিছানায় শুয়ে পরলো।চোখ বন্ধ করে বারবার ওই দৃশ্যটা মনে করছে।আজ কেন যেন মনকে নিজের বশে রাখতে পারছে না।এলোমেলো লাগছে সবকিছু। এক ছুটে আদিবের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। একসময় শরীর কাঁপিয়ে কান্না এলো তার।সেদিন রাতে আর ঘুম নামলো না চোখে।শুধু তার একার নয় আদিবের চোখেও সেদিন ঘুম নামেনি।

১৫.
আমরিন ফুপির বাসায় আসলো কয়েকটা দিন থাকার জন্য। পরিক্ষা শেষে অফুরন্ত সময় এখন তার।আনোয়ারা বেগম আমরিনকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরলেন।তিনি সবসময় একা থাকেন বাসায়।আনাফ প্রতিদিন কিছুটা সময় দিলেও সারাদিন একাই থাকতে হয়।দুটো মানুষের রান্না করতে বেশি সময় লাগে না।রান্না শেষে শুয়ে বসে থাকেন,টিভি দেখেন।মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে।স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলেকে নিয়ে একা থাকেন। শ্বশুড় বাড়ির মানুষজন দরকার ছাড়া কেউ আসে।

আমরিন ফুপিকে আবার রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে বললো,তুমি এই সময় কি রান্না করছো গো, ফুপি?

আনাফের কিছু বন্ধু এসেছে।ওদের জন্য নাস্তা বানাচ্ছি।তুই ফ্রেশ হয়ে নে।

আমি তোমায় সাহায্য করবো?

লাগবে, আমার হয়ে গেছে। তুই যা ফ্রেশ হয়ে নে তাড়াতাড়ি।

আমরিন আনাফের ঘরের সামনে আসতেই মেয়েলি হাসির শব্দে থমকে গেল।সে ভেবেছিল শুধু ছেলে বন্ধু এসেছে!আমরিন কৌতুহল বশত দরজায় উঁকি দিলো। দেখলো,একটা মেয়ে হাসতে হাসতে আনাফের গায়ে ঢলে পরছে।আমরিনের রাগে মাথা গরম হয়ে গেল।ইচ্ছে হলো মেয়েটার সব চুল ছিড়ে নিতে।আনাফ দরজার বাইরে তাকাতেই আমরিনকে দেখতে পেল।জোরে বললো,আরে খুকি, এইদিক আয় দাঁড়িয়ে না থেকে।

আমরিন চোখ,মুখ শক্ত করে ঘরের ভেতর ঢুকলো।সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে।আমরিন শুধু তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে।চোখ দুটো বেশ লাল হয়ে গেছে।আনাফ বুঝতে পারলো না কিছু, সে মজা করার সুযোগ ছাড়লো না,

“এই তোদের পরিচয় করিয়ে দেই ওর সাথে।ও আমাদের সবার খুকি মনি।”

হাই, তোমার নাম খুকি!আনাফের পাশে বসে থাকা মেয়েটি বাঁকা হেসে বললো।

“নাহ্,আমার নাম খুকি নয় আমরিন।”আনাফ ভাই ঢং করে ডাকে।তোমরা থাকো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।ঘুরে যেতে গিয়েও থেমে গেল,আনাফের পাশে বসা মেয়েটার দিকে একপলক তাকিয়ে বললো,”আনাফ ভাই তোমার বান্ধবী কি জানে তুমি এক সপ্তাহ ধরে গোসল করছো না এমনকি দাত ব্রাশও করছো না।”

আনাফ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। আনাফের পাশের মেয়েটি একটু দূরে সরে বসলো।তা দেখে আমরিন ঠোঁট টিপে হাসলো।ঘরের সবাই আনাফের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টি নিয়ে।আমরিন বেরিয়ে এলো।ইচ্ছে করছে আনাফের মাথাটা ফাটিয়ে ফেলতে।বান্ধবী হয়েছে তো কি, এত ঘেঁষাঘেঁষির করতে হবে?

আনাফ বন্ধুদের বিদায় দিয়ে এসেই আমরিনকে খুঁজে বের করলো। টানতে টানতে দরজার কাছে নিয়ে এসে দাঁড় করালো।

“এখুনি বেরিয়ে যাবি আমার বাসা থেকে।এত সাহস কই পাস তুই আমায় অপমান করার?”

“কেন তুমি যখন আমায় অপমান করো, তখন? ”

“বেশ করি,হাজার বার করবো। কিন্তু তুই কোন সাহসে আমার বন্ধুদের সামনে এভাবে আমায় অপমান করলি? চলে যা আমার বাসা থেকে।”

“যাব না আমি।এটা শুধু তোমার বাসা নয়,ফুপিরও বাসা।দাঁড়াও ফুপিকে ডাকি দেখ তোমায় কেমন বকে?”

আমরিন ডাকার আগেই আনাফ তার বলিষ্ঠ হাতে আমরিনের মুখ চেপে ধরলো।

আমরিন আনাফের বুকের কাছের টিশার্ট খামছে ধরলো।

আনাফ হিসহিসিয়ে বললো,”একদম বাড়াবাড়ি করবি না,মুখ ভেঙে ফেলবো।”

আমরিনের হাস ফাঁস লাগছে।আনাফ তার এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে যে সে ঠিক মতো নড়তেও পারছে না।আমরিন অনেকটা সাহস নিয়ে তার নরম ঠোঁট দিয়ে আনাফের হাত ছুঁয়ে দিলো। আনাফ আমরিনের দিকে তাকাতেই জোরে কামড় বসিয়ে দিলো হাতে।আনাফ ব্যথা পেয়ে ছেড়ে দিলো আমরিনকে। আমরিন দৌড়ে চলে গেল ফুপির কাছে।তার বুক ধুকপুক করছে। আনাফ ভাই তাকে আর আস্ত রাখবে না।

ফয়সাল মেঘলার কলেজের সামনে এসে দাঁড়ালো। আজ মেঘলার জন্মদিন। সে মালিহা বেগমের কাছ থেকে শুনেছে। মেঘলাকে আজ সারপ্রাইজ দেবে সে।খুব দ্রুত মেঘলার মনে জায়গা তৈরী করতে হবে।স্বপ্নের রাণীকে পাকাপোক্ত ভাবে নিজের করে নিতে এটুকু কসরত করতেই হবে।কারণ সে এখনো নিশ্চিত হয়নি মেঘলার মনে কি চলছে।মেঘলা কি শুধুই তাকে পরিচিত, প্রাইভেট টিচার ভাবে নাকি, অন্যকিছু?প্রাইভেটের শুরু থেকেই সে মেঘলাকে পছন্দ করে।অবশ্য মেঘলাকে কখনো বুঝতে দেয় নি।আজও কিছু বুঝতে দেবে না।নিরবে মেঘলার মনে নিজের জায়গা তৈরী করবে।মেঘলার পরিক্ষার পর যাতে দেরী করতে না হয়।

আদিব দূর থেকে দাঁড়িয়ে ফয়সালকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে।কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে।ফয়সাল যে মেঘলাকে পছন্দ করে তা তার অজানা নয় তবে আজ ফয়সালকে অন্য রকম মনে হচ্ছে।

আদিব মেঘলার ফোনে মেসেজ পাঠালো,”বাইরে ফয়সাল দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও যাবে না ওর সাথে। কথার বাইরে কিছু করলে আজ সত্যি সত্যি একটা খুন হয়ে যাবে আমার হাতে।”

মেঘলা ক্লাস শেষে ফোনটা অন করলো।একটু পরেই ছুটি হবে।কমনরুমে এসে বসলো।ফোনটা খোলার সাথে আদিবের মেসেজটা ঢুকলো।মেঘলা কপাল চাপড়ালো।আদিব একটু বেশি বেশি করে ফেলে।ফয়সালকে নিয়ে এমন করার কারণটা সে সত্যি বোঝে না।ইচ্ছে করছে আজ কলেজেই থেকে যেতে।আদিব,ফয়সাল কারও মুখোমুখি না হতে।মেঘলা আজ ছুটির দশমিনিট পর বের হলে।ততোক্ষণে কলেজ ফাঁকা হয়ে গেছে।ফয়সাল ভেবেছে মেঘলা হয়ত কলেজে নেই।চলে যাবে কিনা ভাবতেই দেখতে পেল মেঘলা বের হয়েছে।নিজেকে ধাতস্থ করে এগোলো মেঘলার দিকে।আদিব নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। নড়লো না সে, দেখতে চাচ্ছে মেঘলা কি করে?

মেঘলা তুমি এত দেরীতে বের হলে যে?
ফয়সাল ভেবেছে মেঘলা তাকে দেখে চমকাবে কিন্তু চমকালো না মেঘলা।

হালকা হেসে বললো,এমনিতে,আপনি এখানে?

তোমার জন্য এসেছি!

মেঘলা অবাক হয়ে বললো,আমার জন্য?

ফয়সাল কথা ঘুরিয়ে বললো,একটা কাজে এসেছিলাম,মনে পড়লো আজ তোমার জন্মদিন তাই ভাবলাম উইশ করে যাই।হ্যাপি বার্থ ডে মেঘলা।

“ধন্যবাদ।”
মেঘলা দূরে থাকা আদিবের দিকে তাকালো।মনে মনে ভয় করছে,বেশিক্ষণ ফয়সালের সামনে দাড়িয়ে কথা বললে আদিব না আবার কিছু ঘটিয়ে বসে।আদিবকে বিশ্বাস নেই,যা ঘাড়ত্যাড়া। মেঘলা না চাইতেও সব অধিকার খাটাবে ছেলেটা।

আচ্ছা ঠিক আছে,আম্মা বাড়িতে একা আমি যাই।

আমি তোমায় বাড়িতে দিয়ে আসবো।আমার সাথে চলো।

মেঘলা ফাঁকা ঢোক গিললো।আদিবের দিকে আড়চোখে তাকালো।দূর থেকে আদিবের মতিগতি কিছুই বুঝতে পারলো না। তাড়াতাড়ি বললো,লাগবে না,আপনাকে যেতে হবে না।আমি রিকশা নিয়ে নেব।

ফয়সাল রাগটা সামলে নিয়ে নরম স্বরে বললো,মেঘলা, তোমায় একটা জায়গায় নিয়ে যেতাম।

মেঘলা চট জলদি বললো,আমার শরীরটা ভালো নেই, মাহিম একা বাড়িতে, আম্মা সামলাতে পারবে না।আজ আসি,অন্যদিন যাব।মেঘলা কোনরকম কথা গুলো বলে দ্রুত চলে গেল। আজ আর হাটলো না।কলেজের সামনেই রিকশা নিলো।দশ টাকা বেশি গেলে যাক, এই সমস্যা থেকে বাঁচতে পারলে হয়।মেঘলার আচরণে ফয়সাল অপমানিত বোধ করলো।রেগে চলে গেল সে।মালিহা বেগমের সাথে কথা বলতে হবে তার।

আদিব এসব কান্ড দেখে বাঁকা হাসলো।সেও বাইকে উঠে বসলো।মেঘলা কিছু দূর যাওয়ার পর সস্তির নিশ্বাস নিলো।সামনে তাকিয়ে দেখলো একটা ছোট বাচ্চা, রিকশা থামাতে হাত তুলছে।রিকশাওয়ালা ছেলেটাকে দেখে রিকশা থামালো।ছেলেটা দৌড়ে এসে কয়েকটা বেলুন মেঘলার কোলে দিয়ে দৌড়ে পালালো।মেঘলা প্রথমে বেশ চমকে গেলেও পরে বুঝতে পারলো এসব কে দিয়েছে।প্রতিটা বেলুনের গায়ে লেখা “শুভ জন্মদিন হৃদয়েশ্বরী! ”

১৬.
আনোয়ার চৌধুরী অফিস থেকে ফিরে দিলারা বেগমে কাছে এলেন।দিলারা বেগম বিকেলের নাস্তা বানাচ্ছেন।আনোয়ার সাহেবকে দেখে চায়ের পানি বসালো।

তুমি ফ্রেশ হয়েছ?

নাহ্, তোমার সাথে একটু জরুরি কথা ছিল,একবার ঘরে আসো।

আচ্ছা, তুমি যাও আমি তোমার চা টা নিয়ে আসছি।

আনোয়ার কথা না বাড়িয়ে চলে গেল।দিলারা বেগমের কেমন যেন লাগলো।আনোয়ার সাহেব বেশ গম্ভীর আজ।খারাপ কিছু হয়েছে কিনা সেই ভেবেই অস্থির হয়ে গেল।কারণ আনোয়ার সাহেব কখনো এমন করেন না।হাসি মুখে এসে কথা বলেন সবসময়। দিলারা বেগম চিন্তায় পরে গেলেন।দ্রুত চা ঢালতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেললেন।সেদিকে খেয়াল না করে তাড়াতাড়ি ঘরের দিকে এগোলেন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here