#জোনাকিরা ভীড় করেছে
#পর্ব-১৫
বিয়ে শেষে কান্নার রোল উঠলো।বিদায় বেলার রেশটা সব বিয়েতেই একই।তবু যেন, এত বিষাদের মাঝে আনন্দ ছড়িয়ে আছে।আমরিনের খুশির শেষ নেই।এই মুহূর্তে তার হাতপা ছুঁড়ে নাচতে ইচ্ছে করছে।এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না সত্যি আদিবের সাথে মেঘলার বিয়েটা হয়ে গেল!কিছুক্ষণ আগেই বড়সড় একটা কান্ড ঘটে গেছে।শেষ সময়ে এসে মালিহা বেগমই ওদের বিয়েটা দিয়েছেন।মেঘলা শুধু সবকিছু চুপচাপ দেখছিলো।ফয়সালের সময় মেঘলা যেমন স্বাভাবিক ছিলো আদিবের বেলাতেও সেভাবেই আছে।
ফয়সাল আসার পরপরই কাজী সাহেব চলে আসেন বিয়ে পড়াতে। কিন্তু মাহিম হঠাৎ করে ফয়সালের হাতে কামড় বসিয়ে দেয়।ফয়সাল জোড়ে চড় মেরে বসে মাহিমকে।মাহিম পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারায়।এই ব্যাপারটা মালিহা বেগমের কানে যেতেই তিনি স্থির হয়ে যান।মেঘলা বিয়ের আসর থেকে উঠে যায় ভাইয়ের কাছে।
আমরিন অবাক হয়েছিলো ফয়সালের এমন কান্ডে।একটা মানুষ এতটা জঘন্য কি করে হতে পারে?মাহিম যে আর দশটা সাধারণ বাচ্চাদের মতো নয় সেটা সবারই জানা।
পরিস্থিতি সামলে নিতে রেবেকা বেগম এগিয়ে আসেন।কিন্তু মালিহা বেগম বেঁকে বসেন।তিনি যে আসলেই মানুষ চিনতে ভুল করেছেন তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন।মেঘলাকে নিজে কষ্টের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছেন তাই ভেবে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিলো তার।রেবেকা বেগম বোঝায়,ফয়সালের একটু রাগ বেশি, মাহিম এভাবে কামড় দিয়ে বসবে তা বুঝতে পারেনি ফয়সাল।মোমেনা বেগমও মালিহা বেগমকে বোঝায়,যা হবার হয়ে গেছে,বিয়েটা পড়ানোর জন্য তাড়া দেন।কিন্তু মালিহা বেগম অনড়।
তিনি সোজা আমরিনের কাছে এসে বলেন,”তোমার ভাইকে একটু ডেকে দেবে, মা?”
আমরিন তখন যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না।সে দ্রুত ভাইয়ের ফোনে ফোন দেয় কিন্তু আদিব ফোন তোলে না।আমরিন বাধ্য হয়ে আনাফকে ফোন দেয়।আনাফের মাধ্যমে আদিবের সাথে কথা বলিয়ে দেয় মালিহা বেগমকে।
মালিহা বেগম শুধু একটা কথাই বলেছিলেন আদিবকে,”আমার মেয়েকে তুমি এমুহূর্তে বিয়ে করতে পারবে,বাবা?”মালিহা বেগমের গলায় ছিলো অনুরোধ আর অনুশোচনার সুর।
আদিব জবাবে কিছুই বলেনি।ফোন কেটে দিয়ে ছুটে গিয়েছিলো বাবার কাছে।দিলারা বেগম,আনোয়ার সাহেব,আনাফ, আদিব সবাই এক সাথে এসেছিলো।তারপর ঘটনা গুলো স্বপ্নের মতো ঘটে গেছে।ফয়সাল বেশ চোটপাট করলেও রেবেকা বেগমের জন্য পারেনি। রেবেকা বেগম অপমানিত বোধ করে বেরিয়ে গেছেন ছেলেকে নিয়ে।
আমরিন,দিলারা বেগমের বিয়ের শাড়ি নতুন করে পরিয়ে দিয়েছে মেঘলাকে।আদিবের এক কথা, ফয়সালের দেয়া কোনো জিনিস যেন মেঘলার আশেপাশেও না থাকে।মেকআপ পর্যন্ত তুলতে হয়েছে আদিবের জন্য।
বেশ সাদাসিধে ভাবে বিয়ে হয়ে গেছে দুজনের।কাজী কবুল বলতে বলার সাথে সাথেই আদিব পরপর তিনবার কবুল বলে ফেলেছে।মালিহা বেগম দিলারা বেগমের হাত ধরে মাফ চেয়েছেন।সেদিন মুখের ওপর না বলে দিয়েছিলেন তবুও আজ তাঁরা মেঘলাকে সম্মানের সাথে ছেলের বউ করে ঘরে তুললেন।আদিবের পুরো পরিবারের প্রতি মালিহা বেগমের শ্রদ্ধা বেড়ে গেল হাজার গুন।বিদায়ের সময় মেঘলা কান্নাকাটি করে একহারা হলো।আদিব মেঘলার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলো। মাহিম বোনের আঁচল ধরে চললো,সবার সাথে।
৩৩.
আমরিন মেঘলাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে ভাইয়ের ঘরে।আপাতত আদিবকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
মেঘলা লজ্জায় মাথা নামিয়ে রেখেছে।আমরিন শুধু মিটিমিটি হাসছে।
তোমায় কি বলে ডাকবো, আপু নাকি ভাবী?
মেঘলা লজ্জায় আরো মিইয়ে গেল।তা দেখে আমরিন জোরে হেসে ফেললো।বললো, ভাইয়া কিন্তু এখনো ক্ষেপে আছে তোমার ওপর!উফফ, যেন ঝড় বয়ে গেল কিছুক্ষণ আগে।জানতো,আমার মন বলতো ভাইয়ার সাথেই তোমার বিয়েটা হবে।দেখ,ঠিক তাই হলো।আমি যে কি খুশি তা তোমায় বলে বোঝাতে পারবো না!
মেঘলা আমরিনের খুশি দেখে হাসে।আমরিনের মতো সেও যে মনের জোড়কে সম্বল বানিয়েছিলো!সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রেখে মনে জোড় রেখে সবকিছু নিরবে মেনে নিয়েছিলো।মায়ের সাথে অভিমানও ছিলো প্রচুর। প্রথমে সে কিছুতেই রাজি হয়নি কিন্তু মালিহা বেগম তাকে বাবার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বারবার।বাবা মারা যাওয়ার আগে যে তাকে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল মায়ের,ভাইয়ের।সেই মাকে কষ্ট দিয়ে নিজের সুখের কথা ভাবতে পারবে না কখনো।সে তো নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করে দিয়েছে তাদের জন্য। মা যখন বুঝতেই পারলো না তাকে তখন বড্ড অভিমান হলো তার।চুপচাপ মেনে নিলো বিয়েটা।তবে কথায় আছে, মন থেকে কিছু চাইলে সেটা পাওয়া যায়!মেঘলার পুরো মনটাই তো আদিবের জন্য বরাদ্দ।
দিলারা বেগম এসে আমরিনকে সামান্য ধমক দিয়ে বললো,কিরে ওকে এভাবে জাপটে ধরে আছিস কেন?এমনিতেই ওর অনেক ধকল গেছে।
উফ মা!তুমি জানো আজ আমি কতো খুশি?আমার তো ছাড়তেই ইচ্ছে করছে না আপুকে।
মেঘলা বললো,থাক না আন্টি,আমার সমস্যা হচ্ছে না।
আমায় এখনো আন্টি ডাকবি?দিলারা করুন চোখে তাকালো।
মেঘলা অসস্তিতে পরে গেল।তার মনেই ছিলো না এখন থেকে দিলারা বেগম তার শ্বাশুড়ি। আসলে সবকিছু এমন ভাবে হয়ে গেল যে নিজেকে ধাতস্থ করতেই অনেক সময় লাগছে।অপরাধীর মতো বললো,আমি বুঝতে পারিনি আন্টি স্যরি, মা।
মেঘলার কথায় আমরিন দিলারা দুজনেই হাসলো।দিলারা বললেন,ভয় পাচ্ছিস কেন পাগলি মেয়ে?আস্তে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।আয় তোর শ্বশুর মশাই খেতে ডাকছে!আদিবটা যে কোথায় গেছে?আশ্চর্য! বিয়ে করেই ভেগেছে,বাপটাকে দেখেও কিছু শিখতে পারেনি এতদিন?ঘরে নতুন বউ রেখে কোথায় যে হাওয়া হয়ে গেল!
মেঘলা মুচকি হাসলো মাথা নামিয়ে। আমরিন বললো,মা কি ভেবেছ,তোমার ছেলে লজ্জায় বাসায় আসছে না?মোটেও তা নয়,ভাইয়ার কোনো লজ্জা শরম নেই।নিশ্চয়ই কোনো কাজেই গেছে।আনাফ ভাইকেও তো দেখছি না।দুজনে মিলে ঠিকি কোনো কাজে গেছে।
কি এমন কাজ আছে তোর, ভাইয়ের?
আমি তো জানি না।
আচ্ছা আয় মেঘলাকে নিয়ে।তোর বাবা অপেক্ষা করছে।
আদিবদের বাড়িতে কেউই নেই।মেঘলার এই দিক থেকে স্বস্তি লাগছে।কারণ বিয়ে বাড়িতে কত লোকজন থাকে,অপরিচিত অনেকেই থাকে কিন্তু তার বেলা উল্টোটা হয়েছে।নতুন বউ হিসেবে কোনো ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না। অবশ্য লোকজন থাকবেই বা কি করে?আদিবের সাথে তো তার বিয়ের কথা ছিলো না!
আদিব কিছু কেনাকাটা করে আনোয়ারা বেগমকে নিয়ে বাসায় ঢুকলো।তাকে ছাড়া বাবা মা মেঘলাকে নিয়ে কি সুন্দর ভাবে খেতে বসেছে দেখে বুকটা ভেঙে গেল তার।একদিনেই সে পর হয়ে গেল!মুখটা কালো করে সে নিজের ঘরে চলে গেল।দিলারা বেগম ডাকলেও শুনলো না।আদিবের এমন কান্ডে সবাই হাসলেও মেঘলা বুঝতে পারলো না কিছু।তার খারাপ লাগলো।দিলারা বেগম বুঝতে পেরে বললেন,মন খারাপ করলি নাকি?আদিব এমন ঢং প্রায়ই করে, ওকে ছাড়া খেতে বসেছি, যে?
মেঘলা বুঝতে পেরে মাথা নামিয়ে হাসলো।আনোয়ারা বেগম হেসে বললেন,ভাবী তুমি তো শ্বাশুড়ি হয়ে গেলে,এতো সুন্দর বউ মা পেয়ে!
মেঘলা বললো,কেমন আছেন ফুপি?
ভালো আছি, মা।তোমায় দেখে আরও ভালো হয়ে গেছি।আজ আমরা যে সবাই কতটা খুশি তা তোমায় বোঝাতে পারবো না।
আনাফ আমরিনের পাশে খেতে বসলো।ফিসফিস করে বললো,কিরে খুকি কেমন ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিলি সেদিন, এখন হে হে করে হাসছিস কেন?
তা হাসবো না,মেঘলা আপু আর ভাইয়ার বিয়ে হয়ে গেছে!অবশ্য তুমি এসব বুঝবে না।তুমি তো অটিস্টিক, এসব অনুভূতি তোমার বোঝার কথাও নয়?
আনাফ রেগে তার পা দিয়ে আমরিনের পা চেপে ধরলো। আমরিনের খাওয়া থেমে গেল,গলায় ভাত উঠে গেল তার।কাশতে কাশতে চোখ দিয়ে পানি বের হলো।
৩৪.
মালিহা বেগম পুরো ঘরটার দিকে একবার তাকালেন।কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মেয়েটা চলে গেল শ্বশুর বাড়ি, তবু শান্তি, আদিবের সাথে মেয়েকে বিয়ে দিতে পেরেছেন।ফয়সালের সাথে হলে অন্তরের এই শান্তিটা থাকতো?আদিব ছিলো জন্যই মালিহা বেগম বিয়েটা ভেঙে দিতে পেরেছিলেন। আজ যদি আদিবের মতো কেউ না থাকতো তবে কি ভাঙতে পারতেন?সমাজের চোখে একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়াটা মোটেই ভালো নয়।এখন ভাবেন তাদের কপাল আসলেই বুঝি ভালো তা না হলে আদিবের মতো পরিবারকে তাদের পাশে পেতেন?মাহিম যদি কামড়টা না দিতো তবে জানতেই পারতো না ফয়সালের আসল ব্যবহারটা।আচ্ছা মাহিম হঠাৎ ওভাবেই বা কামড় দিলো কেন?
আগে থেকেই একটু কেমন মনে হলেও মেয়ের ভালো হবে এই চিন্তায় তেমন তলিয়ে দেখেন নি,আসলে দেখতে চান নি।মেঘলা চুপচাপ সবটা মেনে নিয়েছিলো অভিমানে।সত্যি তো,মেয়েটাকে একবারও বুঝতে চান নি?যে মেয়ে এইটুকু বয়সে এতো গুলো দায়িত্ব পালন করতে পারে সেই মেয়েকে তিনি কেমন বাধ্য করেছিলেন বিয়েতে রাজি হওয়ার জন্য। মেঘলা পারতো জেদ করতে, বেঁকে বসতে কিন্তু করেনি।জেদ সে ঠিকি করেছে সেটা নিজের সাথে।মেঘলার মতো আর দশটা সাধারণ ছেলে মেয়ে যখন খেলাধুলায় মত্ত থাকতো মেঘলা তখন মামির সাথে ঘরের যাবতীয় কাজ করতো।শৈশবে বাবার আদরে বেড়ে ওঠা মেয়েটা কৈশোরে এসে কেমন পাল্টে গিয়েছিল।এই বয়সে কতশত আবদার থাকে অথচ মেঘলা কখনো সেসবের ধারে কাছেও ছিলো না।নিজের পছন্দ, অপছন্দ কখনো মুখ ফুটে বলেনি।ঈদে মনিরা তিনটে চারটা করে জামা কাপড় কিনতো অথচ তিনি মেঘলার চোখে কোনোদিন এসবের প্রতি লোভ দেখেন নি।এই বয়সে কত কসমেটিকস থাকে মেয়েদের, আর মেঘলার ছিলো ফেসওয়াশ আর ক্রীম।তাও শুধু বাইরে গেলে একটু দিতো।মালিহা বেগম মেঘলার বিছানায় এসে শুয়ে পরলেন। মেঘলার গন্ধ লেগে আছে সবখানে।বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল।নীরবে চোখের পানি ঝরছে তার।মনে মনে বললেন,”হে সৃষ্টিকর্তা মেয়েটার জীবন তুমি অনন্ত সুখের ভরিয়ে দিও!”
আকাশে এক ফালি চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের পানে তাকিয়ে রইলো মেঘলা।পুরো ঘরময় হেটে বেড়াচ্ছে সে। সবকিছু আজ এত সুন্দর লাগছে কেন?অপ্রত্যাশিত সবকিছুই বোধহয় সুন্দর হয়!এই ঘরটা আজ থেকে তার, ভাবতেই অদ্ভুত ভালোলাগায় ছেঁয়ে গেল মন।তবে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে।আদিবের সামনাসামনি হতে হবে তাকে!আদিব নিশ্চয়ই খুব রেগে আছে তার প্রতি।
আদিব দরজা ঠেলে ঢুকতেই মেঘলা চমকে উঠলো। আদিব তা দেখে হাসলো।আদিব সালাম দিলো মেঘলাকে।মেঘলা কাঁপা গলায় সালামের জবাব দিয়ে নিজেও সালাম দিলো।আদিব জবাব দিয়ে ইশারায় বসতে বললো মেঘলাকে।এরপর এগিয়ে এসে আদিব পকেট থেকে কাজগ বের করে মেঘলার কপালে হাত রেখে দোয়া পরলো।ফুপি তাকে কাগজটা দিয়ে পরতে বলেছে।মেঘলার ভেতরটা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল।আদিব একবার মেঘলার দিকে তাকিয়ে বললো,নামাজ পরতে হবে আমি ওযু করে আসছি।মেঘলা নীরবে মাথা নাড়লো। নামাজ শেষে দুজনে কেউ কোনো কথা বললো না।আদিব বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে মেঝেতে কাঁথা বিছিয়ে চট করে শুয়ে পরলো।সে আজ থেকে মেঘলা শাস্তি দেবে,কঠিন শাস্তি।এতদিন ধরে তাকে কষ্ট দেয়ার শাস্তি সে শুধে আসলে শোধ করে নেবে, হু।আদিবের এমন কান্ডে মেঘলা অবাক হয়ে চেয়ে থাকলো।
চলবে…