জীবন মানে তুমি পর্ব-৩১

0
3872

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৩১

(১০৯)

কথাটা বলে শৈল রুম থেকে বেরিয়ে যায়।য়ুহার বুঝতে পারছেনা ও কী করবে?জীবনের হাতেগুনা কয়েকটা দিন ওর পরিবার যাতে সুখে থাকুক এটাই চাইবে।কিন্তু কীভাবে বাকীদের ঠকাবে?আর শৈলই বা কেন চাই ওর এই দু’দিনের জীবনের সঙ্গী হতে?

এক অর্কভ,যাকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসতো,যে কীনা সুখে-দুঃখে ওর সাথে পথ চলতে চেয়েছিলো…কিন্তু নিজের জীবনের সুখের জন্য মাঝরাস্তায় ছেড়ে চলে যায়।আর এই শৈল,সবটা জেনে ওকে আপন করে পেতে চাইছে ।বুঝতে পারছেনা কী করবে ও?দ্বিধা-দ্বন্দ ভুলে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে চলে যায়।

শুধুমাত্র পরিবারের লোকজনকে সাক্ষী রেখে কাবিন সম্পন্ন হলো।শৈলের পাগলামি দেখে সবাই খুব হাসছিলো,আসলে এমন পাগলি বাস্তবে কেউ করে কারো জানা ছিলোনা।এমন ভালোবাসা গল্প, কাহিনিতে প্রচুর দেখা যায় তবে বাস্তবেও আছে নাকী?কথাটা য়ুহার নিজের মনকে প্রশ্ন করে আপনা-আপনি হেসে ফেলে।

মিসেস আকৃতি য়ুহারের বাবাকে বলেন,

-“ভাই সাহেব,তাহলে ভালো একটা দিন থেকে ঘরের লক্ষীকে নিয়ে যেতে হবে।”

-“তা ঠিক,”

-“তাহলে সামনের সপ্তাহে…”

য়ুহার বলে উঠে,

-“না না আন্টি,সামনের সপ্তাহে নয়।আসলে ইয়ারাবী দেশের বাইরে।তাই বলছিলাম..”

মিসেস অচলা মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে,

-“আম্মু ওতো চিন্তা করিস না,ইস্মা এলেই তবে করবো।”

-“তাহলে আপনারা কবে করতে চাইছেন?”

য়ুহারের বাবা পানি খেয়ে বলেন,

-“এই মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শুক্রবারে অনুষ্ঠানটা সেরে ফেলবো।আসলে বুঝতে পারছেন আমার একটা মেয়ে,তাছাড়া আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা অনেক।সব ম্যানেজ করতে কিছু সময় লাগবে,তাছাড়া আমার বোনের মেয়ে ইস্মাকে য়ুহার অনেক ভালোবাসে।তাকে ছাড়া কিছুতেই এমনটা করতে চাইবেনা।”

-“আমরা জানি,তাহলে শুক্রবারের ডেট ফাইনাল।আজ আমরা উঠি…”

মিসেস অচলা তাড়াতাড়ি উঠে বলেন,

-“মাথা খারাপ নাকী,যতই আকদ হোক খাবার খেয়ে তারপর যাবেন।বাবা শৈল তুমি য়ুহারের রুমে যেয়ে রেস্ট করো।আম্মু শৈলকে নিয়ে যাও আর নিলয় তুই আমাকে হেল্প কর।আপা আপনারাও রুমে যান।”

য়ুহার শৈলকে রুমে নিয়ে যেয়ে বলে,

-“ওয়াশরুম আছে ফ্রেস হয়ে নাও…”

-“ডাইরেক্ট তুমি,বাবা একটু লজ্জাও পেলেনা।”

য়ুহার কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে,

-“আমি বাকীদের মতো লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া ঢং করতে পারবোনা।তাছাড়া বিয়ে করা হাসবেন্ড, সো আমার থেকে এসব এক্সেপ্ট করতে আসবেনা।”

-“বাবা,এতো কথা।আচ্ছা বিয়ের পর কী মেয়েদের রুপ পাল্টে যায়,আগে ভিজা বিড়াল আর এখন বাঘিনী।”

-“বাজে কথা বলবেনা,আমাকে আপন করতে চাও তো।ওকে ডান,যতদিন বেঁচে আছি জ্বালিয়ে মারবো তোমাকে…”

-“আমিও তাই চাই মহারাণী।”

য়ুহার শৈলকে ওয়াশরুমে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে নিজের স্ট্যাডি রুমের দিকে পা বাড়াই।অনেকদিন ধরে ডাইরি লেখা হয়নি,অনেক কথা জমা হয়ে আছে মনের গহীনে।য়ুহার শাড়ির আচলটা ঠিক করে চেয়ারে বসলো।অনেক ধুলাবালিতে ভরাট হয়ে আছে ডাইরির মলাটটা।টেবিলের টিস্যু বক্স থেকে একটা টিস্যু উঠিয়ে খুব সাবধানে ময়লাটা ঝেড়ে ফেললো।এই ডাইরিটা দিয়েছিলো ইয়ারাবী,ওর আঠারো তম জন্মদিনে নিজের হাতে তৈরি করে।এগারো বছরের মেয়ে তারপরও হাতের কাজ সত্যিই অসাধারণ।প্রতিটা ফাঁকা পৃষ্ঠার কর্নারে বিড়ালের স্টিকার,ডাইরির মলাটের উপর ফোম পেপার আর রং তুলিতে অনেক সুন্দর কারুকার্য।প্রায় অর্ধেক পৃষ্ঠায় পরিপুর্ন করেছে য়ুহার,ওর আর অর্কভের সুন্দর মুহুর্ত দিয়ে।তাছাড়াও নিজের জীবনের নানা ঘটনা উল্লেখ আছে।

য়ুহার পাতাগুলো উল্টিয়ে একটা শূন্য পাতায় যায়।অর্কভের চলে যাওয়ার পর থেকে আর কিছু লেখা হয়নি।

সেদিন কোর্ট থেকে বের হয়ে অর্কভের সাথে ঘুরতে বের হয়েছিলো য়ুহার।গত দুই বছর ধরে ওর শরীরের নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে।প্রথমে ডাক্তার দেখালে ওনারা বলে রাত জেগে পড়ার কারনে, দ্বিতীয়বারে অরেকজনকে দেখালে উনি টেস্ট করতে দেন কিন্তু সেই বারও রেজাল্ট শূন্য আছে।তাই আর বেশি গুরুত্ব দেয়নি,শরীর খারাপ হলে সাধারন মেডিসিন নিতো।

ওরা যেই রিক্সায় উঠতে যাবে হঠাৎ করে য়ুহারের নাক দিয়ে রক্ত পরতে থাকে।অর্কভতো পাগলের মতো হয়ে যায়,সেই রিক্সায় করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।তবে হাসপাতালে যাওয়ার আগেই ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

ডা.মিজান য়ুহারকে দেখে চমকে যান।উনি তৎক্ষণাৎ অর্কভকে কিছু টেস্ট করাতে দেন।য়ুহারের জ্ঞান ফিরলে ডা.মিজান য়ুহার সামনে এসে কিছু সংকোচ করে।য়ুহার সেহেতু একজন আইনজীবী সেহেতু ওর একটুও বুঝতে অসুবিধা হয়না একটা অপরাধী নজর।য়ুহার স্বাভাবিক ভাবে বসে ডাক্তারকে প্রশ্ন করে,

-“কিছু বলার হলে বলুন,এভাবে অপরাধীর মতো তাকিয়ে আছেন কেন?”

ডা.মিজান ওনার চোখ নামিয়ে বলে,

-“আপনি আমার কাছে এসেছিলেন নিজের ট্রিটমেন্টের জন্য আর আমিও আপনাকে টেস্ট দিয়েছিলাম।”

-“হ্যাঁ,কিন্তু টেস্টে আপনি বলেছিলেন কিছু হয়নি।”

-“আসলে আমাদের দ্বারা কিছু ভুল হয়েছে”

-“মানে?”

-“আসলে রিপোর্টে ভুল এসেছিলো মানে একজনের সাথে বদলে গেছিলো,পরে জানাবো তবে আমাদেরও মনে ছিলোনা..”

ডাক্তারের কথা শুনে য়ুহার কিছুটা নড়েচড়ে বসে।ডাক্তার য়ুহারের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করে,

-“আমাকে আপনার গার্জিয়ানের সাথে কথা বলতে হবে”

-“যা বলার আমাকে বলুন,কেননা ট্রিটমেন্টটা আমার পার্সোনালি করাতে এসেছিলাম।তাই অনুগ্রহ করে আমার পরিবারকে টানবেন না।”

-“আসলে একজন ডাক্তার হয়ে যে ভুলটা হয়েছে সেটার জন্য আমি সত্যি লজ্জিত।আসলে আপনার ক্যান্সার হয়েছে,আর বর্তমানে সেটা সেকেন্ড স্টেজে।”

ডাক্তারের কথা শুনে য়ুহার দাঁড়িয়ে যায়।নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে কষ্ট হচ্ছে।মুহুর্তের মধ্যে ওর পৃথিবী পাল্টে যেতে শুরু করলো।একরাশ মৃত্যু ভয় ওকে জেকে ধরেছে,তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ,কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।ডাক্তার ওর অবস্থা বুঝতে পেরে একটা টিস্যু এগিয়ে দেয়।

-“আমার আগের র্ রিপোর্টে কী এসেছিলো?”

-“রিপোর্ট ঠিক এসেছিলো কিন্তু আমাদের ভুলের জন্য…”

য়ুহার এবার রেগে যায়।আর রাগবে নাই বা কেন?এমন ভুল কীভাবে হতে পারে?আর যদিও হয় তাহলে টের পেয়ে পরবর্তীতে ফোন কেন করলোনা।

-“দেখুন আমাদের…”

-“কীভাবে ভুল হতে পারে আপনার?আর যখন আপনি জানলেন তখন জানালেন না কেন?আপনি তো আমাদের এ্যাপার্টমেন্টে থাকেন,চিনেন তো আমাকে তাহলে?”

-“আসলে ব্যাস্ততায়…”

-“আপনার দ্বারা কীভাবে সম্ভব।এটাতো সেই প্রবাদ বাক্যের মতো হলো,ডাক্তার আসিতেছেই, কিন্তু তার পূর্বেই রুগিটি মারা গেল।”

ডাক্তার মিজান কোনো কথার উত্তর দিতে পারেন না।কেননা বলার কোনো মুখ নেই,ওদিন যখন সঠিক রেজাল্টটা হাতে পেলো তখন য়ুহারকে ফোন করার আগেই ওনার বাসা থেকে ফোন করেন ওনার স্ত্রী।তার ছোট শালীর গায়ে হঁলুদ।তাই সব ফেলে ছুটে যান সেখানে।এর মাঝে অনেকবার এ্যাপার্টমেন্টের সিড়িতে বা পার্কিং এরিয়ায় দেখা হলেও তেমন একটা মাথায় আসেনি ওনার।

য়ুহার নিজেকে কিছুটা শান্ত করে চেয়ারে বসে।তারপর ডা.মিজানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-“এখন ট্রিটমেন্ট করলে বাঁচার চান্স কতো হবে?”

-“দেখুন ট্রিটমেন্ট করলে আপনি অবশ্যই আল্লাহ চাইলে ভালো হয়ে যাবেন।তাছাড়া অনেক রুগি সুস্থ হয়ে যাচ্ছে।”

ওইদিন ডাক্তারের দেওয়া কিছু মেডিসিন আর ট্রিটমেন্টের ব্যাবস্থা করে আসে।সেই সাথে এটাও বলে যে,এই ব্যাপারে ওর ফ্যামিলি যেনো কিছু টের না পায়।এমনভাবে দু’মাস চলতে থাকলো।এই দু’মাসে কাজের বাহানা করে হাসপাতালে যেয়ে থেরাপি নিয়ে এসেছে।তবে একটা জিনিস বাকীদের থেকে ভিন্ন,কেননা য়ুহারের চেহারায় রোগের কোনো চিহ্ন প্রকাশ পায়নি,কিন্তু ওর চুল পরে যাচ্ছে।এজন্য,ও ওর লম্বা চুলগুলো কাঁধের কিছুটা নিচে পর্যন্ত কেঁটে ফেলে।মিসেস অচলা খুব অবাক হন মেয়ের আচারনে,তবে বর্তমান যুগের ফ্যাশান বলে কিছু বলেননা।কিন্তু এর মাঝে য়ুহার অর্কভের অনেক পরিবর্তন দেখতে পায়।ছেলেটা আগের মতো কথা বলেনা,দেখা করেনা শুধু বাহানা বানায়।হঠাৎ একদিন অর্কভ ফোন করে য়ুহারকে ডাকে দেখা করার জন্য।সকাল থেকে য়ুহার খুব খুশি।অর্কভের জামদানি সবুজ রঙের শাড়ী খুব পছন্দের।কিন্তু য়ুহারের সবুজ শাড়ি না থাকায় ওর মায়ের কাছে চাইতে যায়।মিসেস অচলাও খুশি মনে মেয়েকে নিজের হাতে শাড়ি পরিয়ে দেয়।চুলগুলো খোঁপা করে তাতে গাজরা লাগিয়ে দেয়,চোখে কাজল,ঠোঁটে লাল লিপিস্টিক,কপালে সবুজ টিপ,কানে ঝুমকো আর হাতে কাচের একগুচ্ছ রেশমি চুড়ি।ওর মা ওকে যেভাবে সাজিয়ে দিয়েছে সেই সাজ একদম অর্কভের পছন্দের।ঘড়ির দিকে চোখ পরতেই য়ুহার নিজের ব্যাগটা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।আজ ইচ্ছা করেই গাড়ি নেয়নি।কেননা ওর মনে হয়,ওর গাড়ি দেখে অর্কভের মন খারাপ হয়।কেননা অর্কভরা ওদের মতো মধ্যবিত্ত হলেও ওতোটা নয়,ওর বাবার পুরানো বাইক বিক্রি করে একটা নতুন বাইক ওকে কিনি দিয়েছে।যদিও অর্কভ চাকরি করে তবুও ওর টাকা কখনো হাতে দ্বারায় না।কেননা অনেক পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করতে হয়।

তাই য়ুহার একটা রিক্সা নিয়ে টিএসসির মোড়ে যায়।ওর বলা কফিশফের দিকে পা বারিয়ে অর্কভকে দেখতে পায়।তবে আজ অর্কভ একা নয় ওর সাথে একজন মেয়েও আছে,পরনে নীল শাড়ি, কুকড়ানো চুলগুলো একপাশে বেনি করা,কপালে নীল টিপ,ফর্সা তবে মাঝারি গড়নের।য়ুহারকে দেখে অর্কভ উঠে দাঁড়ায়।য়ুহার কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে তবে মনে মনে চাইছে ওর ধারনা যেনো মিথ্যা হয়।য়ুহার কিছু বলার আগে অর্কভ বলে উঠে,

-“স্যরি য়ুহার,আসলে এই কয়মাসে খুব ব্যস্ত ছিলাম।আসলে নতুন বিয়ে তো বুঝতে পারছো।”

-“বিয়ে?”

অর্কভ হালকা হেসে বলে,

-“হ্যাঁ,বিয়ে।আসলে তাড়াহুড়োর মধ্যে কাউকে জানানো হয়নি।মিট মাই ওয়াইফ শশী,আমার বাবার বন্ধু অনেক বড় বিজন্যাসম্যান।এখন থেকে আমি দেখাশোনা করছি।আসলে ও ওর বাবার একমাত্র মেয়ে।”

শশী খানিকটা লজ্জিত হয়ে বলে,

-“থামবে তুমি?”

-“থামবো কেন যা সত্য তাই বলছি?শশী এ হচ্ছে য়ুহার,অনেক ভালো একজন লয়ার আর সাথে আমার একজন ভালো বন্ধু।”

হঠাৎ শশীর একটা ফোন এলে ও কথা বলতে বাইরে চলে যায়।য়ুহার অর্কভের দিকে তাকিয়ে বলে,

-“তুমি কী মজা করছো অর্কভ?”

-“আমি সিরিয়াস”

-“আর আমাদের ভালোবাসা,যে স্বপ্নগুলো দেখতাম…”

-“স্যরি য়ুহার,তুমি জানো আমাদের টাকার খুব প্রয়োজন।তাই বিয়েটা করেছি তাছাড়া আমার মা চাকরিজীবীকে বাড়ির বৌ মানতে পারবেনা।আর যেখানে তোমার জীবনের কোনো গ্যারান্টি নেই সেখানে আমার জীবনের সুখগুলোকে বির্সজন দিতে পারিনা।আমি বাড়ির বড় ছেলে।ধরো আমাদের বিয়ে হলো,তুমি মারা গেলে তখন কী হবে পরিবারের,আমার একটাবারও ভেবে দেখেছো?স্বার্থপরের মতো শুধু নিজেরটা ভাবলে, আসলে কোনো উকিলের সাথে এজন্যই সম্পর্কে জড়াতে হয়না।তোমাকে এখানে ডেকেছিলাম আমাদের সম্পর্ক শেষ করতে,তাই এখন যেতে পারো।”

অর্কভের কথা শুনে য়ুহার কী বলবে বুঝতে পারছেনা।এতবছরের সম্পর্ক মাত্র দুইমাসের ব্যাবধানে শেষ করতে একবারও ভাবলোনা।আর স্বার্থপর,যেখানে বাঁচার অফুরন্ত চান্স আছে সেখানে অর্কভ কত সহজে ওকে মৃত ঘোষণা করলো।য়ুহার কিছু না বলে চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে বেড়িয়ে এলো।শশী খুব অবাক হলো য়ুহারের আচারনে।তবে কিছু বললোনা। হঠাৎ কিছু মনে হতে য়ুহার আর ভিতরে যেয়ে অর্কভকে জোড়ে একটা চড় মারলো।অর্কভ চড়টা খেয়ে কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকলো।শপের অনেক মানুষ ওদের দিকে তাকিয়ে আছে,শশী কিছুটা অবাক আর রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে,

-“আপু আপনি ওকে মারলেন কেন?”

-“সেটা তুমি তোমার ছোটলোক,কাপুরুষ বরের কাছ থেকে জেনে নিও।”

য়ুহার কথাগুলো বলে বাইরে চলে আসে।টিএসসি থেকে বেরিয়ে একটা শান্ত নদীর পাড়ে যেয়ে নিজের চোখের জল বির্সজন দেয়।আর মনে মনে ভাবতে থাকে,
“কার জন্য আমি বাঁচতে চেয়েছি, লড়ছি মৃত্যুর সাথে।এখন থেকে আর না,আল্লাহ যতদিন হায়াত রেখেছে ততদিন বাঁচবো।টাকাগুলো খরচ না করে জমাবো মা-বাবা আর নিলয়ের জন্য।”

চোখের পানি মুছে শান্তভাবে নদীর পাড় থেকে বাসায় দিকে রওনা দেয়।তার আগে ওর অবুঝ মায়ের জন্য তিনটা শাড়ি,বাবার জন্য পান্জাবি,ঘড়ি আর নিলয়ের জন্য দু’টা জামা আর জুতা কেনে।আসলে যে টাকা দিয়ে শপিং করছে সেটা অর্কভকে দেবে ভেবেছিলো,কেননা ওর বাবার হার্টের অপারেশনে অনেক টাকা ধার-দেনা হয়েছে।কিন্তু যখন মানুষটা বেইমানি করলো তখন আর তার কথা ভেবে কী লাভ? সামনে কুরবানি তাই সুযোগে ব্যবহার করে,এগুলো নিয়ে বাসায় ফেরে।বাসায় ফিরে সবাইকে জিনিসগুলো দিলে ওনারা খুব অবাক হয়।ওর বাবা ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“তোর জামা কই?”

-“আসলে বাবা নিজের জন্য কিছু পছন্দ করতে পারিনি,তাছাড়া যা নিয়ে গেছিলাম টাকা কম পরেছিলো।তাই বিকালের দিকে আমরা সবাই মিলে আবার শপিং এ যাবো।”

নিলয় শপিং-এ যাওয়ার কথা শুনে অনেকটা লাফিয়ে উঠে আনন্দে।য়ুহার ওর পরিবারের মানুষের দিকে চেয়ে থাকে।কতটা খুশি এরা,আর এই মানুষদেরকে অবসর সময়ে সঙ্গ না দিয়ে ওর ছেলেকে সঙ্গ দিতো।ও অবশ্য জানে অসুখটা বাহানা আসল কারনটা হলো টাকা।

হঠাৎ নিলয় এসে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আর আদরমাখা কন্ঠে বলে,

-“কী করো আপু?”

-“কিছুনা..তোর কী হয়েছে?”

-“তুমি চলে যাবে তাই খুব কান্না পাচ্ছে..”

য়ুহার ডাইরিটা একপাশে রেখে চেয়ার থেকে উঠে নিলয়কে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু দিয়ে বলে,

-“পাগল আজ তো শুধু আকদ হয়েছে,বিদায় হওয়ার এখনো বাকী..”

-“তোমার ছাড়া ভালো লাগবেনা।আচ্ছা দুলাভাইকে ঘর জামাই করলে কেমন হয়?”

য়ুহার হেসে বলে,

-“জানিস ইয়ারাবীও এমন কথা বলতো,আসলে সবকয়টা এক গোয়ালের গরু,ও হলো গুরু আর তোরা হলি শিষ্য…”

নিলয় য়ুহারকে ছেড়ে দিয়ে চুলগুলো হাত দিয়ে স্টাইল করতে করতে বলে,

-“আরে যাও যাও,তুমি গেলে বাড়িতে আমার রাজ চলবে…”

য়ুহার খানিকটা রাগের ভঙ্গি করে মাজায় হাত দিয়ে বলে,

-“কী বললি তুই?”

নিলয় আমতা আমতা করে বলে,

-“ম মজা করছিলাম,চলো খাবে আম্মু ডাকছে..”

কথাটা বলে নিলয় রুম থেকে দৌড় মারে।য়ুহার ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে হঠাৎ বলে উঠে,

-“এদের আনন্দ দেখে আরো অনেক বছর বাঁচতে ইচ্ছা করছে,কিন্তু নিজের হাতে তো সবটা শেষ করে ফেলেছি।এখন যে ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই।”

(১১০)

আজ আবরারের সাথে ইয়ারাবীর প্রথম নাম জানা তবে অচেনা একদেশে যাওয়া।আজ আবরার ওকে বোরখা পড়তে দেয়নি।অফ-হুয়াইট কালারের একটা গাউন সাথে মাথায় হেজাব,ব্লু কালারের শাল,পায়ে হুয়াইট কালারের জুতো,চোখে চশমা, সবকিছু নরমাল হলেও এক মনোরম স্নিগ্ধতা ভর করেছে ওর মুখে।তবে কিছু পুরুষের স্বভাব আছে অন্য নারীদের দেখা এখানেও তাই হয়েছে।এয়ারপোর্টে অনেক পুরুষই ওকে দেখছে,সেই জন্য আবরার ওর হাত সার্বক্ষণিকভাবে ধরে আছে।

ওরা প্লেনে উঠতেই কেউ পিছন থেকে বললো,

-“ইজ্ দ্যাট ইউ এআর?”

আবরার ঘুরে তাকিয়ে দেখে এক আমেরিকান সুদর্শন যুবক সাদা ক্যাপ্টেনের পোশাকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্রুজ দাঁড়িয়ে আছে।আবরার ইয়ারাবীর হাত ছেড়ে দিয়ে হেসে ওর বন্ধুকে আলিঙ্গন করে।লোকটি আবরারকে ছেড়ে দিয়ে ওকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-“ছয় মাসের জন্য বিডিতে এসে আমাদেরকে ভুলে গেছো বন্ধু?”

-“তোমাদের কীভাবে ভুলা যায়,তুমি এটা অন্যায় কথা বলছো।মিট মাই ওয়াইফ ইয়ারাবী।আর ইয়ারাবী এচ্ছে আমার বন্ধু ব্রুজ একজন কমার্শিয়াল পাইলট।”

ব্রুজ হেসে ইয়ারাবীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-“এয়া..র,ওকে আমার দ্বারা নামটা উচ্চারন সম্ভব নয়।আমিতো মিসেস এআর বলবো।”

ইয়ারাবী হেসে ব্রুজের সাথে কুশল বিনিময় করে।ব্রুজ আবরারকে বলে,

-“মানতে হবে তুমি সত্যি ভাগ্যবান বন্ধু।এবার স্থায়ীভাবে লন্ডনে যাচ্ছো?”

-“না,ইয়ারাবী একজন শিক্ষার্থী,এখানে ওর পড়া সম্পুর্ন হলে তবে যাবো।এখন ঘুরতে যাচ্ছি আর তোমাদের সাথে দেখা করতেও বলতে পারো।”

ব্রুজ আনন্দিত হয়ে হেসে বললো,

-“অতি চমৎকার,এটাই শেষ আমার, বিশ দিনের ছুটি আছে মজা করা যাবে।তাহলে তোমরা যাও কয়েক মিনিট পরে প্লেন টেকঅফ করতে হবে।আশা করি যাত্রা শুভ হবে।”

ব্রুজ চলে যেতেই আবরার ইয়ারাবীকে নিয়ে ফার্স্টক্লাস আসনের দিকে যেয়ে নিজেদের সিটে বসে পরে।আবরার হেসে বলে,

-“ড্যাডকে সত্যি থ্যাংকস জানাতে ইচ্ছা করছে ফার্স্টক্লাসে কাঁটার জন্য।”

-“কেন?”

-“তুমি জানো ভাইয়াদের হানিমনের টিকিট প্রিমিয়াম ইকোনোমিতে করেছিলো।”

ইয়ারাবী আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,

-“আমার মতে প্রিমিয়াম ইকোনোমিটাই বেশি ভালো কাপলদের জন্য।”

-“কেননা সাথে বসা যায় তাইতো।সেই ক্ষেত্রে অবশ্য ভাইয়ার খুব ভালো হয়েছিলো।তবে এক্ষেত্রেও আমরা সাথেই আছি,তোমার যদি সমস্যা হয় তবে আমি চেন্জ করার চেষ্টা করতে পারি।”

-“বসা নিয়ে কোনো সমস্যা নই,তবে মাথা ব্যাথার কোনো ঠিক নেই যেকোনো সময় শুরু হতে পারে।”

-“বারো ঘন্টার যাত্রা,চিন্তা করোনা আমি আছিতো সাথে।ঘুম দাও একটু,ভালো লাগবে…জানিতো সকাল থেকে মাথাব্যথা হচ্ছিলো।”

ইয়ারাবীর এই কথায় কোনো অবাক করেনা।কেননা ও জানে আবরার ওর দিকে খুব সূক্ষভাবে নজর রাখে ও আশেপাশে থাকুক বা না থাকুক।প্রথম প্রথম এগুলো খুব বিভ্রান্তি সৃষ্টি করলেও সময়ের সাথে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।তবে এটা বুঝতে পারছেনা আসার সময় ইকরা ওকে এই কথা কেন বললো,

-“আবরার যা করবে তোমার ভালোর জন্য করবে।কখনো ভুল ধারনা মনে পোষন করবেনা,ছেলেটা ভালোবাসে তোমাকে।”

ইয়ারাবীকে কিছু ভাবতে দেখে আবরার ওর কাঁধে হাত দিয়ে হালকা ঝাকিয়ে বলে,

-“কীসের চিন্তায় মগ্ন আছো?”

-“কিছুনা…”

ডিপার্চারের আগে আবরার ওকে সিট বেল্ট বেঁধে দিয়ে কপালে এটা চুমু দেয়।এর সাথে ও সহজ হয়ে গেছে তাই তেমন লজ্জা বা ভয় কাজ করেনা,এক অজানা ভালো লাগার অনুভুতি ওকে ছুঁয়ে দেয়।ডিপার্চারের পুরো সময় ওর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে রাখে।ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে হালকা মৃদ্যু হাসি দিয়ে চুপ করে থাকে।আবরার ওর হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে খেলা করতে করতে বলে,

-“তোমার না উচ্চতায় ভয় আছে?”

-“হ্যাঁ,আছে তবে সেটা উঁচু খোলামেলা জায়গায়।”

-“বদ্ধ জায়গাতেও তো ভয় পাও?”

-“আগে পেতাম তবে মানিয়ে নিয়েছি,এই ভয়টা আসলে বাচ্চা মনের একটা কল্পনা থেকে হয়েছিলো।কোনো বন্ধ জায়গায় একা থাকলে মনে হতো এই বুঝি ভুত আসবে…”

-“একটাবার হাসলে কী হয়?”

-“হাসি তো আমি,এখনো তো হাসছি…”

-“মন খুলে হাসছো নাকী?”

ইয়ারাবী কথাটা ঘুরানোর জন্য আবরারকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-“আপনার হাতের কাছে আমার হাত নিতান্তই বাচ্চা…”

-“হামম,তবে বাচ্চা হাতটা অনেক ভালো সাথে বাচ্চা বৌ…”

-“আমি মোটেও বাচ্চা নয়,কিছুমাস পরে উনিশে পড়বো।”

-“তুমি স্কুলে অনেক দ্রুত ভর্তি হয়েছিলে”

-“ছয় বছরে তাছাড়া দু’টো ক্লাসে অর্ধেক মাস থেকে পরবর্তী ক্লাসে উঠেছি,আর থ্রী তো পড়িনি।তবুও মাশাল্লাহ্ রেজাল্ট কিছুটা ভালো আছে।”

-“কিছুটা নয় অনেকটা ভালো।”

-“আচ্ছা আপনি বলেননা যে ঘড়িটা কেমন হয়েছে?জানি আপনার মতো দামী কিছু দেওয়ার সামর্থ্য নেই…”

-“পাগলি,তুমি ভালোবেসে যেটা দিবে সেটাই আমার কাছে অনেক।তবে কিনলে কখন?”

-“কাল যখন আপনি ফোনে কথা বলছিলেন তখন।”

আবরার হেসে ইয়ারাবীর হাতে একটা চুমু দেয়।এতে ও খানিকটা কেঁপে উঠে,এই প্রথম এমন কিছু আবরার করলো।ও নিজের সিটবেল্টটা খুলে ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“আমি একটু আসছি,সমস্যা হলে বা সিক ফিল করলে এয়ারহোস্টেসকে জানাবে।”

ইয়ারাবী মাথা নাড়ালে আবরার চলে গেলো।কয়েক মিনিট পরে ইয়ারাবী দু’হাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরে আছে।এর মাঝে আবরার ফিরে আসে।ইয়ারাবীকে ওই অবস্থায় দেখে ও এটেন্ডেন্টকে একটা হ্যাংওভার ড্রিংক আনতে বললো।ইয়ারাবীর ব্যাগ থেকে ওর ঔষধ বের করে ওকে খেতে বলে ড্রিংকটাও শেষ করতে বললো।ও কিছু খেতে পারছেনা তবুও জোর করে খেলো।আবরার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-“কিছু খাবে?”

-“না”

-“তাহলে ঘুমাও,আমি ডেকে দিবো।”

আবরারের কথামতো ও চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দেয়।আবরার ওর হাতে তিন আঙ্গুর দ্বারা ওর পালসের ওখানে চেপে ধরে।ওখানে ধরার জন্য কিছুটা ব্যাথা করে তবে ইয়ারাবীর কিছু স্বস্তি পাচ্ছে।কিছুক্ষণের মধ্যে ও ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দেয়।

আবরার একটা ইংলিশ ম্যাগাজিন নিয়ে পড়তে শুরু করে।প্রায় লান্চের সময় অর্থাৎ তিন ঘন্টা পরে এটেন্ডেন্টটি আবরারের নিকট আসে কিছু লাগবে কীনা জানার জন্য।আবরার হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তারপর ইয়ারাবীর দিকে তাকায়।মেয়েটার ঘুমের মধ্যেও মুখে এক মায়া কাজ করছে,তবে না খেয়ে আর অসুস্থতার জন্য মুখটা শুকিয়ে গেছে।

রেয়ার টুনা এন্ড ক্যাভিয়ার অনট্রে স্টার্টার, রোস্টেভ স্যামন ইন স্প্যানিচ এন্ড ক্যাভিয়ার লাইট গ্রেভি,চিজ প্লাটার,ডার্ক চকলেট ট্রাফলস,ফ্লেবার ইয়োগার্ট,চকলেট রাস্পবেরি মুজ কেক আর পানি অর্ডার করলো আবরার।এটেন্ডেন্টটি আনতে গেলে এই ফাঁকে ও আস্তে করে ইয়ারাবীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়।ইয়ারাবী নিজের মাথাটা চেপে ধরে বলে,

-“কী হয়েছে?”

-“তোমার কী বেশি খারাপ লাগছে?”

-“বোঝাতে পারবোনা,খুব খারাপ লাগছে।”

আবরার একটা নিঃশ্বাস ফেলে ওর মাথায় হাত দিয়ে বলে,

-“একটু ফ্রেস হয়ে আসো আর হেজাবটা খুলে হালকা মাথায় পানি দিবে,ভালো লাগবে।”

ইয়ারাবী সিটবেল্টটা খুললে আবরার ওকে বলে,

-“আসবো আমি নাকী এদেরকে বলবো সাহায্য করতে।”

-“আমি পারবো…”

আবরারের মনে হচ্ছে,প্রিমিয়াম ইকোনোমিতে নেওয়া ভালো ছিলো।কেননা এই ক্লাসের প্রতিটা আসনের পরিমাপ আর দুরত্ব একটু বেশি।মেয়েটা মাত্র পাঁচ ঘন্টায় এমন হয়ে পরেছে বাকী সাত ঘন্টা কীভাবে কাঁটাবে?ইয়ারাবী ফিরে এলে ততোক্ষণে খাবারও চলে আসে।ইয়ারাবী বসতেই আবরার ওর বেল্টটা বেঁধে দেয়।

-“খাবারগুলো খেয়ে নাও…”

-“বিশ্বাস করুন আমার প্রচুর খারাপ লাগছে, এগুলো খেলে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পরবো।”

-“মেডিসিনগুলো তো নিতে হবে তাইনা,এমন করলে চলবে?”

ও আবরারের ডানবাহু জড়িয়ে ধরে বলে,

-“আজ খুব কষ্ট হচ্ছে, প্লীজ জোর করবেন না।আমি তো সব কথা শুনি…”

-“বেশি খারাপ এজন্য লাগছে কারন তোমার দুশ্চিন্তা আর সকালে মেডিসিন নেয়া হয়নি।”

-“আসলে দ্রততার জন্য মনে ছিলোনা..”

আবরার ক্রুধচোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“বলো দোষটা কার?”

-“আ আমার”

-“তাহলে চুপচাপ একটা কিছু খেয়ে নাও,বেশিনা হালকা কিছু।”

ইয়ারাবী চিজ প্লাটার,ডার্ক চকলেট ট্রাফলস, চকলেট রাস্পবেরি মুজ কেক তাও হালকা একটু খেয়ে মেডিসিন নিলো।কেননা আবরারকে ও রাগাতে চাইনা,ও যদি রেগে যায় তবে ইয়ারাবীকে ওর ধমকের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা।অবশ্য সেটা এখানে নয়,বাড়িতে যেয়ে।বাকী খাবারগুলো আবরার শেষ করলো।ইয়ারাবী কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো।

আবরার এবার নিজেও কিছুটা বিশ্রাম নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।তাই আরাম করে যেই মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো তখনি ওর মনে হলো কেনো মহিলা কন্ঠস্বর ওকে উদ্দেশ্য করে বলছে,

-“আর ইউ্ ডা.এআর?”

আবরার ওর চোখটা খুলে কন্ঠস্বর অনুসর করে তার পার্শ্ববর্তী সিটে তাকিয়ে দেখে অনূর্ধ্ব চল্লিশ বছর বয়সী পরনে সাদা স্কার্ট আর কোর্ট পড়া,চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত,মাঝারি গড়নের,মুখে এক অমায়িক হাসি বয়স্ক ব্রিটিশ লেডি ওর দিকে চেয়ে আছে।আবরারের কেন জানি মনে হচ্ছে মহিলাকে আগে কোথাও দেখেছে।মহিলাটি হাতের ম্যাগাজিনটা পরিপাটি করে রেখে আবরারকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-“ইয়াংম্যান মনে হয় চিনতে পারোনি আমাকে?”

-“অনুগ্রহ করে মাফ করবেন,আমি সত্যিই আপনাকে চিনতে পারিনি।”

ব্রিটিশ লেডি মৃদ্যু হেসে বলে,

-“অবশ্য আমাকে চিনার কথা নয়,কেননা ডাক্তারের কাছে একজন নয় প্রতিনিয়ত প্রচুর রোগী আসে।তবে আমি ফ্রোজমেরির মা,যে মেয়েটাকে তুমি সুস্থ করে তুলেছিলে।”

আবরার কিছুক্ষণ ভেবে বলে,

-“জ্বি,ফ্রোজমেরি একবছর আগে বাসায় তিনমাস ট্রিটমেন্ট করেছিলাম।আপনাকে চিনা লাগছিলো তবে চিনে উঠতে পারছিলাম না।আমি সত্যিই দুঃখিত।আপনার কন্যা কেমন আছে?”

-“কোনো ব্যাপার নয় ইয়াংম্যান,ফ্রোজমেরি এখন আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক।ধন্যবাদ তোমাকে”

-“আমার কর্তব্য”

-“পাশের মেয়েটি কী তোমার সহধর্মিণী?”

-“জ্বি,”

-“অসুস্থবোধ করছে”

-“আসলে ও কিছুটা সিক,এজন্য।”

-“নাম কী ওর?”

আবার জানে বিশেষত অনেক বিদেশীরা বাংলা জটিল ভাষা উচ্চারন করতে পারেনা।তাই ও মহিলাটিকে মৃদ্যু হেসে জবাব দিয়ে বলে,

-“ইস্মা”

-“এস্মা,অনেক চমৎকার নাম,দেখতেও চমৎকার।”

আবরার সেই ব্রিটিশ লেডির সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললো।এই মহিলাটির স্বামী একজন সৈনিক ,ওনাদের একটি মেয়ে যার নাম ফ্রোজমেরি।তবে কিছু টিনেজারদের মতো মতো সবে পনের বয়সী মেয়েটা বখে যায়।খারাপ সঙ্গীদের সাথে মিলামিশা করে,নানা ধরনের ড্রাগ নেয়।ধীরে ধীরে মানষিক বিকারগ্রস্ত হতে শুরু করে,তাই লন্ডনের বেস্ট ডাক্তারদের মধ্যে আবরারের কাছে ওনার মেয়েকে নিয়ে যায়।আবরারের তিনমাসের প্রচেষ্টায় মেয়েটা সুস্থ হয়ে উঠে।

(১১১)

-“বাবা-মার সঙ্গে সন্তানের সুসম্পর্ক নিয়ে কুরআন এবং হাদিসে অনেক নির্দেশ ও নসিহত রয়েছে। কুরআনের এসব নির্দেশ ও হাদিসের নসিহত সন্তানের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ,জানো সেই হাদিসগুলো কী কী আদিবা?”

আদিবা মাথা নাড়িয়ে না ইশারা করে বলে,

-“আমি আপনার মতো কুরআনে হাফেজ নই।আসলে আমার এক দূর সম্পর্কের আপু ছিলো তার ননদের কাছে থেকে যতটুকু শিখার আর জানার জেনেছি।তিনমাসে বেশি কিছু শিখতে পারিনি।তারপর থেকে পড়ার ফাঁকে নেট আর বই থেকে যা জেনেছি তাই রপ্ত করেছি।”

হাসান কিছুটা হেসে দেয় ওর কথা শুনে,তবে বরাবারের মতো মুচকি হাসি।যে হাসিতে সুন্নত লাভ করা যায়।তারপর ওর মাথাটা আদিবার উরুর উপরে রাখে।যদিও বা একমাস করে আদিবাকে অনুষ্ঠান করে উঠিয়ে দিতে চেয়েছিলো কিন্তু একমাস পরে উঠিয়ে এনেছে তবে অনুষ্ঠান করে নয়।হাসানদের কথা ছিলো ওরা মেয়ের বাবার অতিরিক্ত খরচ হোক এমন কিছু চাইনা।তাই ঘটা করে অনুষ্ঠান করেনি।

হাসান মৃদ্যু হেসে আদিবার অাঙ্গুলগুলো নিয়ে নিজের হাত দিয়ে খেলতে খেলতে বলে,

-“জানার আগ্রহ থাকলে সবাই জানতে পারে।তোমার যতটুকু ছিলো তুমি জেনেছো।তবে মাঝরাস্তায় শয়তানের ধোঁকায় পথভ্রষ্ট হয়ে গেছিলে।”

কথাটা শুনার সাথে সাথে আদিবা চুপ হয়ে যায়।হাসান ওর কথা দ্বারা কী বুঝিয়েছে সেটা ও বুঝতে পেরেছে।হাসান হেসে বলে,

-“দেখো মন কেন খারাপ করছো?শয়তানের কাজ হলো মুমিনকে পথভ্রষ্ট করা।আর যে কয়টা হাদিস বলবো মন দিয়ে শুনবে,প্রথমে

তাওহিদের দ্বিতীয় দায়িত্বوَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُواْ إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং বাবা-মার সাথে উত্তম ব্যবহার কর।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৩)

>> বাবা-মাকে ধমক না দেয়াإِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا فَلاَ تَقُل لَّهُمَا أُفٍّ وَلاَ تَنْهَرْهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوْلاً كَرِيمًاতাদের মধ্যে একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে, তাদের উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদের ধমক দিও না এবং তাদের সঙ্গে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা বল।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৩)

>> বাবা-মার অনুগ্রহ স্মরণ করাوَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًاতাদের সামনে ভালোবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল, ‘হে আমার পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৪)

>> অমুসলিম বাবা-মার প্রতি অনুগ্রহ করাوَإِن جَاهَدَاكَ عَلى أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًاপিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৫)

এবার বলো আজ যে তুমি তোমার মায়ের সাথে উঁচু গলায় কথা বললে এটা কী ঠিক হলো?”

আদিবা হাসানের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশ।কিন্তু সেই মা যদি স্বয়ং সন্তানের হত্যাকারী হয়,সন্তানকে নিজে হাতে হাতে ভুল পথে চালিত করে তখন করনীয় কী হাসান?”

-“পবিত্র হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘মা পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত।’ এর মর্ম হলো, মা-বাবার সঙ্গে সদাচরণ ও তাদের সন্তুষ্ট করার মাধ্যমেই সন্তানরা জান্নাতের উপযুক্ত হবে। এ ক্ষেত্রে বিধান হলো, মা-বাবা সৎকর্মশীল হোক বা পাপী ও হত্যাকারী হোক, এমনকি কাফিরই হোক, তবু তাদের সঙ্গে সদাচরণ করা সন্তানের ওপর অপরিহার্য। যদিও মা-বাবা স্ব স্ব পাপের শাস্তি আল্লাহ তাআলার নিকট ভোগ করবে। কিন্তু সন্তানদের পাপী মা-বাবার সঙ্গেও অসদাচরণ করা বৈধ হবে না।

হ্যাঁ, যদি মা-বাবা শরিয়ত বিরোধী কোনো কাজের জন্য সন্তানকে আদেশ দেয়, তাহলে সন্তানরা তাদের ওই হুকুম অমান্য করে তা থেকে বিরত
থাকতে হবে।

তবে তাদের সাথে কোনো প্রকার খারাপ আচারন করা যাবেনা।কেননা শয়তান সব সময় চাই মুমিনকে পথভ্রষ্ট করতে এবং নিজের ক্ষমতা দেখাতে।

কেননা হাদিসে কখনো বলা হয়নি বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের খারাপ আচারনের কথা।কেননা কুরআনে এবং হাদিসসহ আরো অনেক জায়গায় এবং স্বয়ং রাসুল (সাঃ) বলেছেন বাবা-মার সাথে সঠিক আচারন করতে। কোনো মা-বাবা যদি সন্তানের ওপর অত্যাচার করে, তবে তাদের জন্য দোয়া করতে হবে। যখন তাদের মন ভালো থাকে তখন তাদের বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। তবে কোনো অবস্থায়ই খারাপ ব্যবহার করা যাবে না।

তুমি বিকালেই তোমার আম্মুকে ফোন করে ক্ষমা চেয়ে নিবে।তিনি যাই করেছেন বা করেন না কেন তুমি তাকে সব কিছু ঠান্ডা মাথায় বুঝাবে।”

-“বোঝাতেই তো গেছিলাম কিন্তু কী হলো,উপর থেকে বেশি কিছু না জেনে আমাকে যা নয় তাই শুনালো।”

-“ধৈর্য্য ধরো,সফল অবশ্যই হবে।”

-“একটা কথা বলবো হাসান?”

-“বলো…”

-“আমার মা কোনোদিন সুধরাবেনা,উনি আজও ইস্মার ক্ষতি করতে চাই।শুধু ইস্মা নয় আরো অনেকের করতে চাই।”

-“আচ্ছা মা এসব কেন করেন,এসব করে কী লাভ হয় তার?”

-“জানিনা,তবে যে খেলায় মেতেছে তা তারা জানে।সাথে আমার মামী নিন্দুও আছে।জানো আমার মায়ের জন্য ইস্মা কোনোদিন মায়ের আদর পায়নি।সব সময় কানে বিষ ঢালতো ওকে নিয়ে,যখন ইস্মিতা মারা যায় তখন তো সুযোগ আরো পেয়ে বসে।”

-“যতটুকু শুনেছি তাতে মনে হচ্ছে এই ইস্মিতার মৃত্যু কিন্তু এখনো একটা রহস্য হয়ে আছে।তাছাড়া সাথের মেয়েটাই বা কে?আর তাকেই বা কেন মারলো?”

আদিবা কী বলবে ভেবে পায়না,পুলিশ কোনো সমাধান সেই সময় করতে পারেনি।অসমাপ্ত হয়ে কেসটা সহস্র ফাইলের নিচে জমা পরে যায়।অনেকগুলো বছরও কেটে গেছে তবে উত্তর আজও মেলেনি।তবে কে বা কারা যেনো কেসটা আবার অপেন করেছে,যদি কিছু মেলে।কেননা একজন সন্তানের লাশ যখন কোনো বাবার কাঁধে উঠে তখন তার থেকে বড় কষ্ট আর কিছুই হয়না।মি.ফুয়াদের ইস্মিতা নিজের মেয়ে না হলেও আপনের থেকে কম ভালোবাসেননি উনি।যখন ইস্মিতাকে শেষ গোসল করে কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে খাটিয়ার রাখা হয় তখন মিসেস ইসানির আর্তনাদে পরিবেশ ভারী হয়ে গেছিলো।মেয়ের কাছ থেকে কেউ ওনাকে সরাতে পারছিলেননা।মি.ফুয়াদ খাটিয়ার পায়া ধরতে যেয়ে পরে যাচ্ছিলেন তখন মনে হচ্ছিলো তার উপর কোনো মস্তবড় এক বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে যার ভর সামলানো তার কাছে খুব কঠিন।ওকে কবরে মি.ফুয়াদ নামিয়ে ছিলেন আর শেষবারের মতো কাফনের কাপড়ের উপর দিয়ে শেষ আদরটুকু করেছিলেন।

আদিবা ইস্মিতার সমবয়সী ছিলো,ভালো বন্ধুত্ব ছিলো দুইজনের মধ্যে।মিসেস জামান ইস্মিতাকে সহ্য করতে পারতেন না তবে,সেদিন লোক দেখানো কান্না উনিও করেছিলেন।সেদিন আদিবা তার মায়ের এই রুপটার সাথেও পরিচিত হয়।ওর ভাবী ইতি ঠিকই বলে,মিসেস জামানের রুপ গিরগিটির নিকটেও হার মানবে।

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here