জীবন মানে তুমি পর্ব-২৪

0
4298

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:২৪

(৮৮)

হঠাৎ একদিন ইয়ারাবী কিচেনে ওর শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলছে।পরীক্ষার পর মোটামুটি কিছুদিন ক্লাসগুলো বন্ধ আছে।তাই বেশির ভাগ সময় সামাজিক কাজগুলো করে আর বাড়িতে শ্বাশুড়ি আর জারবার সাথে সময়টা কাটে।শীতকাল এই সময় সবাই পিঠা খুব পছন্দ করে।আর এই বাড়ির মানুষ মিসেস রায়হানের হাতের তৈরি পিঠা খুব ভালোবাসে।তাই মিসেস রায়হান কিচেনে সার্ভেন্টের সাহায্য পিঠা বানাচ্ছেন,আর ইয়ারাবী দাঁড়িয়ে দেখছে।যদিও ওর পিঠার প্রতি মোটেও আগ্রহ নেই আর খেতেও পছন্দ করেনা তবে এই কয়মাসে বুঝতে পেরেছে আরবার খুব পিঠা ভালোবাসে।তাই শেখার জন্য ওর শ্বাশুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে।

-“তুমি কিচেনে কী করছো?”

হঠাৎ একটা রাগী স্বরে ধমকের আওয়াজে ইয়ারাবী লাফ মেরে উঠে।আওয়াজটা শুনে ইয়ারাবীসহ ওর মা তাকিয়ে দেখে আবরার দু’হাত প্যান্টের পকেটে রেখে কিছুটা রাগী চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আবরার আবারও ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“তোমাকে না কিচেনে ঢুকা বারণ তাহলে এখানে কী করছো?”

মিসেস রায়হান আবরারের দিকে রাগীভাবে তাকিয়ে বলে,

-“কথাটা তো ভালো করে মেয়েটাকে বলতে পারতি,তোর ধমক শুনে কতটা ভয় পেয়ে গেছে।আমি বুঝতে পারিনা তোরা ভাইগুলো কার মতো হয়েছিস?”

-“কী করব মম বলো,একে ভালোভাবে বলার পরও মাথায় রাখেনা।কী করছো তুমি এখানে?”

ইয়ারাবী মাথাটা নিচু করে ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,

-“ক্ কিছুনা।এমনি আ আম্মুর সাথে কথা বলছিলাম।”

-“কথা বলার জন্য অনেক জায়গা আছে,বুকে ব্যাথা নিয়ে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে ছিলে।”

আবরার ধমক দিয়েই কথাটা বলে।কিন্তু ইয়ারাবী প্রত্যুত্তরে কোনো কথা বলছেনা দেখে মিসেস রায়হান বুঝতে পারেন ইয়ারাবী ভয় পেয়ে আছে।উনি আবরারের কানটা জোড়ে টেনে ধরে বলেন,

-“তুই ডাক্তার কী করে হলি সেটাই আমার সন্দেহ।মেয়েটা ভয় পাচ্ছে আর উনি আরো ভয় দেখাচ্ছে। আর তুই এখন বাড়িতে কেন?”

-“ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো তাই,এন্ড ইউ এক কাপ কফি নিয়ে ফার্স্ট উপরে এসো।তোমার ভাইয়া হাসপাতালে ওয়েট করছে আমাদের জন্য।”

আবরার চলে যেতেই মিসেস রায়হান ইয়ারাবীর মাথায় হাত রেখে হেসে বলেন,

-“আমি জানি তুই আবরারকে এখনো ভয় পাস,আর এটাও জানি তুই ওর সাথে নরমাল হতে পারিসনি।তবে ছেলেটা খুব ভালো,তোকে কখনো ঠকাবেনা।”

-“আম্মু আমি..”

-“তোকে কিছু বলতে হবেনা।এই নে কফি,জারবার জন্য করেছিলাম কিন্তু তোরা বের হবি তাই এটা নিয়ে যা।আমি ওকে পরে করে দিবো।”

ইয়ারাবী মাথা নেড়ে মৃদ্যু হাসি দিয়ে কফিটা রুমে নিয়ে আবরারকে দেয়।আবরার কফিটা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“সরি,আসলে বুঝতে পারিনি তুমি ভয় পাবে।তাছাড়া এই কয়দিন ধরে দেখছি তুমি সবকিছুতে একটু বেশি ভয় পাচ্ছে,কোন সমস্যা হলে বলতে পারো।”

-“ন্ না কিছু না,আমি ঠিক আছি।”

-“তাহলে রেডি হয়ে নাও,তোমার চেকআপ করিয়ে আমাকে হাসপাতালে একবার যেতে হবে।”

ইয়ারাবী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আর বলে উঠে,

-“রাগ না করলে একটা প্রশ্ন করবো?”

-“বলো..”

-“একটু সত্যি করে বলবেন আমার কীসের ট্রিটমেন্ট করছেন আপনারা?এতবার চেকআপ কিসের জন্য?দেখুন এতটুকু জ্ঞান আমার আছে যে সামান্য জরায়ুর প্রবলেমের জন্য এই ট্রিটমেন্ট নয়।সত্য শোনার ক্ষমতা আমার মধ্যে আছে,আগে কিছু হলে ভাইয়া আমাকে কিছু জানতোনা আর এখন আপনিও।”

আবরার ওর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফির মগটা টেবিলে রেখে ওর দিকে এগিয়ে যেয়ে চুলে হাত ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,

-“প্রশ্নটা অনেক সুন্দর বাট্ বিশ্বাস করো আমার এখন একটুও মুড নেই এ্যান্সার দেওয়ার।সো,তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।”

বাঁকা হাসি দিয়ে টেবিলের উপর থেকে মগটা নিয়ে সোফায় আরাম করে বসে।এমন একটা রিয়্যাক্ট করে যেনো কিছু শুনেনি।ইয়ারাবীর এখন ইচ্ছা করছে নিজের মাথা ফাটাতে, সিরিয়াসলি এমনও মানুষ হয়।যখনি ও কোনো সিরিয়াস প্রশ্ন করে তখনি আবরার এমন একটা উত্তর দেয়।ইয়ারাবী কিছুটা সাহস নিয়ে বলে,

-“আমি কোথাও যাচ্ছিনা।”

আবরার কফিতে চুমুক দিতে যেয়ে থেমে একবার ওকে ভালো করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করে বলে,

-“পিংক-হুয়াইট কালারের বোরখাটা পরো,কাল কিনে এনেছি যেটা।”

ইয়ারাবীর বসে বসে এখন নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছা করছে।ওর কানে এখন তারার কথাটা বাজছে,”তোর মতো ঘাড়ত্যাড়া মেয়েকে শুধু আবরার সামলাতে পারবে।কেননা আবরার তোর উপরের ঘাড়ত্যাড়া বুঝলি।”ইয়ারাবী আবরারের সামনে বসে দাঁত দিয়ে নখ কাঁটতে কাঁটতে বলে,

-“আ আমার সত্যি কোথাও য্ যেতে ভালো লাগছেনা।প্লীজ অন্য কোনোদিন যাবো…”

-“ইয়ারাবী নিচের দিকে না তাকিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলো…”

-“না,আপনার চোখের দিকে তাকানো মানে হ্যাপনোটাইজ হয়ে যাওয়া।আমি এখন সব জানি,ফার্স্ট দিন আপনি এভাবেই আমাকে মেডিসিন দিয়েছিলেন।”

আবরার ইয়ারাবীর গালে হাত রেখে বলে,

-“অনেক বেশি বুঝে যাচ্ছো।বাট্ এখনি যেতে হবে সোনা।তুমি জানো তোমার ভাইয়া সেমিনারে শুধুমাত্র তোমার জন্য যায়নি।”

ইয়ারাবী জানে এর সামনে এখন কোনো কথা বলে লাভ নেই।তাই কাবার্ড থেকে নতুন বোরখা,হাত মোজা আর নেকাব বের করে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে আবার আবরারের দিকে তাকায়।যেখানে ইয়ারাবী একটা বোরখা দিয়ে ছয়মাস আরামে চালিয়ে যেতো সেখানে আবরার ওর জন্য প্রতিমাসে দু’টা করে বোরখা কিনে আনে,আর খুব দামীও বটে।ইয়ারাবী নরমাল ড্রেসের উপরে বোরখা আর নেকাবটা বেঁধে নিয়ে একটা জ্যাকেট পরে নেয়।তারপর ওরা নিচে নেমে ওর মায়ের কাছে বলে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরে।

আজকাল বন্ধ জায়গা ইয়ারাবীর একদম ভালো লাগেনা।ওর দমবন্ধ হয়ে আসে,প্রচুর মাথাব্যথাসহ বমি পায়।তাই এত ঠান্ডার মধ্যেও আবরারকে গাড়ির জানালা খুলে রাখতে হয়েছে।কিছুক্ষণ পর ওদের গাড়ি একটা হসপিটালের সামনে দাঁড়ালে ইয়ারাবীর ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়।আবরার প্রথমে বের হয়ে ওর গেট খুলে দিয়ে ওকে নিয়ে প্রথমে ইফাজের কেবিনে যায়।ইয়ারাবী ওর ভাইকে দেখার সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে বলে,

-“কেমন আছো ভাইয়া?এই একমাসে একটা ফোনও করনি কেন?”

-“পরীক্ষা চলছিলো তাই আর কল করিনি।তাছাড়া একটু ব্যাস্তও ছিলাম,সরি পিচ্চি।”

-“ঠিক আছে, সরি বলতে হবেনা।”

ইফাজ আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,

-“ডা.রুপক অনেকক্ষণ ধরে ওয়েট করছে,চলো একবারে চেকআপ করে তবে কথা হবে।”

ইয়ারাবী অনেকটা বিরক্তির সাথে যায় ডাক্তারের কেবিনে।ডা.রুপক ইয়ারাবীকে দেখে বলে,

-“কী ব্যাপার মা,তোমার ভাইয়া বললো তুমি বলে একদম চেকআপ করতে চাইছোনা।”

-“কারন আমি ঠিক আছি…”

ডা.রুপক ইয়ারাবীর কথা শুনে হেসে দিয়ে বলে,

-“জানো পার্ফেক্ট মানুষেরাও মাসে একবার চেকআপ করায়।কী বলেন আবরার স্যার?”

আবরার হাসতে হাসতে চেয়ারে বসে বলে,

-“স্যার,প্লীজ,আমাকে স্যার ডেকে ছোট করবেননা।আপনি আমার শিক্ষক ছিলেন আর এখনও থাকবেন।যতবড়ো পজিশনে যায়না কেন আমি।”

-“তুমি বদলাবেনা আবরার,যাইহোক খুব খুশি হয়েছি এটা জেনে যে তোমার মতো একজন লাইফ পার্টনার পেয়েছে আম্মুটা।আচ্ছা এবার কাজের কথায় আসি,মা তোমার কী এখনো মাথা ব্যাথা করে।”

-“না….”

ইফাজ ওর দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে,

-“উল্টো-পাল্টা বাজে বকবিনা একদম।”

ইয়ারাবী ওর ভাইয়ের ধমক শুনে মাথা নিচু করে বলে,

-“হ্যাঁ,করে।”

-“কখন করে?”

-“আমি ঠিক বলতে পারবোনা তবে যখন কিছু চিন্তা করি,বা কিছু মনে করার ট্রাই করি তখন খুব হয়।”

-“তোমার সব সমস্যাগুলা এক এক করে আমাকে খুলে বললে সুবিধা হয়।”

ইয়ারাবী কথাটা শুনে আবরারের দিকে তাকায়।ডা.রুপক হেসে বলে,

-“দেখ আবরার একজন ডাক্তার তাই ওকে বাইরে বের হওয়ার পারমিশন আমি দিতে পারবোনা।তাছাড়া ও তোমার স্বামী,ওকেও তো জানতে হবে সবটা।”

ইয়ারাবী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা নিচু করে বলে,

-“পেটে আগের থেকে বেশি পেইন হয়,তাছাড়া আঘাতের জায়গাগুলোতে ঠান্ডায় খুব ব্যাথা হয়।মাঝে মাঝে খুব বুকে ব্যাথা হয়,বন্ধ জায়গায় একদম থাকতে পারিনা।”

-“রাতে ঘুম হয় তোমার?”

ইয়ারাবী মাথা নাড়ায়।আবরার পাশ থেকে বলে,

-“ওর খুব ঘনঘন জ্বর আসে উইথআওট এ্যানি রিজন।”

-“বুঝতে পেরেছি,কিছু টেস্ট দিচ্ছি এগুলো করতে হবে।”

ইয়ারাবী মাথা তুলে ডা.রুপকের দিকে তাকিয়ে বলেন,

-“আরে আঙ্কেল,দু’মাস আগেইতো করেছি,এখন আবার কেন করবো?”

ইয়ারাবীর কথা শুনে ডাক্তান রুপক হেসে বলেন,

-“ডোন্ট ওরি মা,তোমাকে ব্লাড টেস্ট দিচ্ছিনা।তুমি সিস্টারের সাথে যাও,কিছু হবেনা…”

ইয়ারাবী টেস্টের জন্য গেলে ডা.রুপক ওদের সাথে কিছু কথাবার্তা বলেন।ইয়ারাবী চলে আসার কিছুক্ষণ পর রিপোর্টে এলে ডা.রুপকের মুখটা কালো হয়ে যায়।উনি ইয়ারাবীকে একটু বাইরে যেতে বলে ওদের সাথে রিপোর্ট নিয়ে কথা বলে।ইয়ারাবী ইফাজের কেবিনে বসে থেকে বোর হচ্ছে।কেননা টেস্টের আগে ফোনটা আবরারের কাছে দিয়ে গেছে।কিছুক্ষণ পরে ওরা কেবিনে ঢুকতেই ইয়ারাবী ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,

-“আমার কী হয়েছে?”

ইফাজ ওর মাথায় একটা চুমু দিয়ে বলে,

-“তেমন কিছুনা,কিছু মেডিসিন দিয়েছে আর ইনজেকশন।ওগুলো রেগুলার নিলে ঠিক হয়ে যাবে।”

-“কিন্তু ভাইয়া…”

-“এক মিনিট…”

ইফাজের ফোনে কল আসাতে ও ওকে থামিয়ে দিয়ে ফোনটা রিসিব করে কথা বলে।ওর কথা বলার ধরন দেখে ইয়ারাবী বুঝতে পারে বাসা থেকে কেউ দিয়েছে।ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“কে ফোন করেছে?”

-“আম্মু,সামনের পাঁচ তারিখে ইস্মিতা মারা গেছিলো তাই…”

-“আপুনি,ব্ বাসাতে হবে…”

-“হ্যাঁ,এবার তোকে যেতে হবে।আর কতদিন এমন করে থাকবি বল।ইয়ারাবী…”

ইয়ারাবী হঠাৎ করেই বেহুশ হয়ে গেলে আবরার সাথে সাথে ওকে ধরে ফেলে।একে ওর শরীর দুর্বল তার উপর ইস্মিতার ব্যাপারে শুনে আর ঠিক থাকতে পারেনি।ওকে কেবিনে রেখে ইফাজের দিকে তাকিয়ে,

-“ইস্মিতার মার্ডার কীভাবে হলো?আর মার্ডারের সাথে ওর কী কানেকশন?”

ইফাজ ওর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

-“অদ্ভুত ব্যাপার আবরার,তোকে কিন্তু কেউ ইস্মিতার ব্যাপারে বলেনি,না তোকে এটা বলেছি ওকে মার্ডার করা হয়েছে।তাহলে তুই কীভাবে জানলি?”

-“আমি কীভাবে জানলাম আর কে বললো এগুলো পরে বলছি।আগে তুই এটা বল নয়তো আমি ইয়ারাবীর কাছ থেকে কথা বের করে নিবো।”

-“এই কাজটা ভুলেও করবিনা,আমি তোকে সব বলছি।দেখ ইস্মিতা হচ্ছে ইয়ারাবীর বড় বোন তবে আপন নয়।”

আবরার ইয়ারাবীর স্যালাইন লাগানো হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে করে বলে,

-“মানে?”

-“মানেটা হলো ইস্মিতাকে এডোপ্ট করা হয়েছিলো। খালার বিয়ের দু’মাস পর ওদের বাসার দারোয়ান ক্যান্সারে মারা যায়।মেয়েটাকে ওর বাবা এতিমখানায় দিতে বলেছিলো তখন ওর বয়স ছিলো পাঁচ বছর।খালা আর ওকে কোথাও না দিয়ে নিজের মেয়ের মতো আদরে বড় করতে।তার তার বছর পর হয় ইয়ারাবী।”

-“তাহলে কী এর মৃত্যুর সাথে কোনো সূত্র ধরে কেউ ইয়ারাবীকে দেখতে পারেনা?”

ইফাজ হতাশ হয়ে চেয়ারে বসে বলে,

-“না,যদি এমনটা হতো তবে মনটাকে বুঝ দেওয়া যেতো।কিন্তু এমনটা হয়নি,তবে ওর প্রতি অবহেলার পরিমান আরো অনেকটা বেরে গেছে।ইয়ারাবীর ছয় বছর বয়স থেকে খালা-খালু ওকে উঠতে বসতে গায়ে হাত তুলতো।তবে ইস্মিতা সব সময় ওকে আগলে রাখতো,খাওয়ার সময় খাইয়ে দিতো,সব সময় ওকে গুছিয়ে রাখতো,বলতে পারিস নিজ হাতে সবটা করতো।সেদিনটা ছিলো সোমবার,জানুয়ারির শুরুর দিকে সবাই চিটাগাং গেছিলো।তখন ইয়ারাবীর বয়স ছিলো আট বছর।

বরাবরের মতো ইস্মিতার সাথে ইয়ারাবী ঘুরেছিলো।কিছুক্ষণ ধরে ওদের দু’জনকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়না।দু’তিন ঘন্টা খোঁজাখুঁজির পর যখন আব্বু পুলিশে ফোন করবে তখন রিসোর্টের পিছন থেকে ইস্মিতার চিৎকার শুনতে পাওয়া যায়।সবাই সেই শব্দের সূত্র ধরে দৌঁড়ে যেয়ে দেখে ইস্মিতাসহ আরেকটা মেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পরে আছে আর ইয়ারাবীর হাতে ছুরি।”

আবরার ওর কথাটা শুনে চমকে যায়,ওর বিশ্বাস করতে পারছেনা ইয়ারাবী মাত্র আট বছর বয়সে দু’টা মেয়েকে খুন করতে পারে।ও ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলে,

-“মাত্র আট বছর বয়সে দু’টা মেয়েকে মার্ডার,হাউ ইজ্ দিস্ পসিবল?”

ইফাজ খানিকটা মৃদ্যু হেসে বলে,

-“চোখের দেখার মধ্যে অনেকটা ভুল থাকে,আর ভুলটা সেখানেই ছিলো।আমরা যখন ওখানে পৌঁছায় দেখি ইয়ারাবীর বাম হাতে ছুরি,আর খুব কান্না করছে।খালা-খালু ইস্মিতার লাশ দেখে ওখানে থমকে যায়।বাবা ইয়ারাবীর কাছে যেয়ে রুমাল দিয়ে ছরিটা নিয়ে ওকে কোলে তুলে বলে,

-“আম্মু এখানে কী হয়েছিল,দেখ সোনা ভয় পাবেনা?”

-“আঙ্কেল আমি আপুনির সাথে এখানে বল নিয়ে খেলছিলাম।হঠাৎ বলটা বাগানের ভিতর চলে গেলে আপুনি বল অনতে যায়,অনেক্ষণ হওয়ার পর আপুনি যখন আসিনি তখন যেয়ে দেখি আপুনি এখানে পরে আছে।আমি ডাকি আপুনি উঠেনি,আপুনি ব্যাথা পাবে বলে এটা বের করে দি…তারপরও উঠেনা।”

মি.রহমান ইয়ারাবী চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলেন,

-“তুমি জানো এগুলো কারা করেছে,দেখেছো তাদের?”

-“ত্ তিনটা পঁচা আঙ্কেল ছিলো,একজনের মুখ দেখেছিলাম।”

ততক্ষণে ওখানে পুলিশ চলে আসে,মি.ফুয়াদ ইয়ারাবীকে দেখিয়ে বলেন ও খুন করেছে দুজন কে।এসব শুনে মি.রহমান রেগে যেয়ে বলেন,

-“এখানে কোনো নাটক চলছেনা ফুয়াদ,এতটুকু বাচ্চা মেয়ে ওর বোনকে কেন মারবে?”

ওখানকার পুলিশ অফিসারও কথাটা শুনে রেগে যায়।উনি বলে উঠেন,

-“আপনি কী পাগল,এমন সাক্ষীকে প্রথম বার দেখছি যে কীনা নিজের দুধের শিশুর বিরুদ্ধে কথা বলছে?এতটুকু মেয়ে তাও আবার দু’জনকে কীভাবে মারবে?”

মিসেস ইশানি কাঁদতে কাঁদতে ইস্মিতার লাশের পাস থেকে উঠে মেয়েকে মি.রহমানের কাছ থেকে বলে উঠে,

-“ও হচ্ছে কাল নাগিনী,কারো সুখ সহ্য হয়না।নিজে মেরে এখন নতুন নাটক সাজাচ্ছে।তোর মতো অপয়া মেয়ে শেষে কীনা বোনকে খেলি?”

-“আম্মুনি আমি কেন মারবো,আমি মারিনি।”

মিসেস ইশানি আর মি.ফুয়াদ সকলের সামনে ওকে মারতে থাকে।ওনাদের দু’জনকে কেউ আটকাতে পারছিলোনা।এক পর্যায়ে ওর মা যে পায়ের হিল দিয়ে ওকে মারছিলেন,তখন মাথার পিছনে অনেক গভীরভাবে ওটার আঘাত লাগে…ফলে ওর মাথার অনেকটা অংশ কেটে যেয়ে রক্ত পরতে থাকে।অনেক কষ্ট করে পুলিশেরা ওনাদের আটকান।”

আবরারের ভাবতে খারাপ লাগছে কতটা কষ্ট হয়েছিলো মেয়েটার।ইফাজ আবার বলতে শুরু করে,

-“ওকে তখনি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।টানা তিন দিন পর ওর জ্ঞান ফেরে।এর মাঝে এটাও প্রমান হয়ে যায় ও যেটা বলছে সেটা ঠিক।কেননা ছুরিতে ওর বামহাতের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছিলো কিন্তু ও ল্যাফ্টহ্যান্ডের ছিলোনা।তবে আসল খুনি পর্যন্ত পৌঁছানো যায়নি,আজও ওর বাবা-মা মনে করে ইস্মিতাকে ওই মেরেছে।আর এটাও মনে করে ওর শাস্তি না হওয়ার পিছনে বাবা আর ওর ফুপার কোনো হাত আছে।ইয়ারাবীকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর ওনারা ওর কাছে পর্যন্ত আসতেন না।যে মেয়ে না খেয়ে থাকতে পারতো না সেই মেয়ে পুরোটা দিন না খেয়ে থাকতো।রুমের ভিতর এক কোনে বসে কান্না করতো।দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ হয়ে যায়,হঠাৎ করে ওর আচারন বদলাতে শুরু করে,আস্তে আস্তে মানসিক ভারসম্য হারিয়ে ফেলে।ইস্মিতার কথা বললে অদ্ভুত আচারন করতো,সারাদিন রুমে বসে কল্পনায় ইস্মিতার সাথে কথা বলতো।তুই বিশ্বাস কর আবরার,ওই সময়টা খালা-খালু সবটা দেখেও না দেখার ভান করতো।আম্মু ওই সময় জব করতো তাই বেশি একটা যেতে পারতো না ওই বাসায়।একদিন অচলা মামী ফোন করে সবটা বললে আম্মু ওকে বাসায় নিয়ে আসেন।দেখার মতো ছিলোনা ও,আমাদের বাসায় রেখেই তিনমাস ট্রিটমেন্ট করার পর নরমাল হয়।তবে এখনো ওর নাম শুনলে ভয় পেয়ে যায়।কেননা নিজের চোখের সামনে দু’টা খুন হতে দেখেছে।”

-“অদ্ভুত ব্যাপার ওই বাসায় যখন গেলাম তখন না ইস্মিতার ছবি দেখলাম না কেউ ওকে নিয়ে কিছু বললো?”

-“ওর জন্য ছবিগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে,কেননা অনেক ভালো বন্ডিং ছিলো ওর সাথে।আর ওর সামনে কখনো ওর ব্যাপারে কিছু বলা হয়না।খালারা এসব ধারনা নিয়ে আজও বেঁচে আছে বলে ইয়ামিলাকেও ওর আশেপাশে আসতে দেয়না,আর না ওকে যেতে দেয়।ইয়ারাবী সাহসী মেয়ে তবে কিছু কিছু জিনিস ওর মাথার মাঝে এমনভাবে গেথে আছে যার জন্য ওকে প্রায় ভুগতে হয়…”

-“এজন্য রাতে ওমন অদ্ভুত আচারন করে..”

-“হতে পারে,কিন্তু তুই এসব জানলি কীভাবে?”

আবরার ইয়ারাবীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

-“কেননা ইস্মিতার সাথে যে মেয়েটা মারা গেছিলো সেই মেয়েটা ইকরা ভাবীর ছোট বোন ইলা ছিলো।”

ইফাজ কিছুটা চমকে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“তারমানে তুই আগে থেকে ইয়ারাবীকে চিনতি?”

-“মিথ্যা বলে লাভ নেই তোকে,হ্যাঁ চিনতাম ওকে।এমনকি ইকরা ভাবীও ওকে চেনে।তুইতো জানিস,ইকরা ভাবী আমার খালাতো বোন।”

-“তাহলে কী তোরা কেসটা আবার রি-অপেন করেছিস?”

-“না…”

-“ওহ্,আমার কিছু পেসেন্টদের দেখতে হবে।ওর জ্ঞান ফিরলে আমাকে কল দিস আর কিছু লাগলে নার্স তো আসেই।”

আবরার একটা মৃদ্যু হাসি দিলে ইফাজ একবার ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।আবরার ওর ইয়ারাবী দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে কাউকে ম্যাসেজ করে।

(৮৯)

-“আপনি যায় বলেন না কেন ফুপু,ইস্মিতাকে আপনার মেয়েই মেরেছে।আসলে আপনারা ওর থেকে ইস্মিতাকে বেশি ভালোবাসতেন তো তাই।”

জারিকা কথাগুলো বলে প্লেট থেকে একটা পাকোড়া মুখে পুরে নেই।আজ সকালেই জারিকা ওর বোন-মা আর মিসেস জামান, ইশানিদের বাড়িতে আসেন।আসে বললে ভুল হবে একেবারে কাপড়-চোপড় নিয়ে থাকতে এসেছে।কেননা কাল বাদে পরশু ইস্মিতার মৃত্যুবার্ষিকী।সেজন্য মি.ফুয়াদ প্রতিবারের মতো গরীবদের খাওয়ান আর হুজুদের দিয়ে দোয়া করেন।

মিসেস জামান জারিকার কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলে,

-“দেখ ইশা জারিকা ঠিকই বলছে,নয়তো পুলিশ বুঝি খুঁজে পেতোনা খুনিদের?”

ইশানি এবার চুপ করে থাকতে না পেরে বলেন,

-“এটাও একটা বেসামাজিক কথা আপু,অতটুকু বয়সে দু’জন মেয়েকে কীভাবে মারবে ও?তাছাড়া ওরা ইয়ারাবীর থেকে বয়সে বড়ো।যদি ইস্মিতাকে মারতে চায় তাহলে দিত্বীয় অচেনা মেয়েটাকে কেন মারলো?”

-“আচ্ছা দিত্বীয় মেয়েটা কে ছিলো জানিস?”

-“না….”

-“আজকাল দেখছি মেয়েকে নিয়ে খুব নাচছিস, কেউ তোর মেয়েকে নিয়ে কিছু বললে তাকে বাঘের মতো ধরিস।ভুলে গেছিস ওর জন্য কী কী হয়েছিলো?”

-“আর তোদের কথা শুনে মেয়েটাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলাম।একটাকে হারিয়েছি আরেকজন কে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে পাঠাচ্ছিলাম।”

মিসেস জামান রাগে গজগজ করতে করতে বলে,

-“ওই মুখপোড়া,অপয়া মেয়েকে নিয়ে বেশি মাতামাতি করবিনা বলে দিলাম।ইরাকের মাকে কিছু বলিনা বলে তোকেও কিছু বলবোনা এটা মনে করিসনা।”

মিসেস ইশানি বোনের কথা শুনে আজ খুব রেগে যান।হাতের জগটা টেবিলে জোরে করে রেখে বলেন,

-“দু’টা মেয়েই আমার,তাই ওদের নিয়ে মাতামাতি করবো না দূরে ঠেলে দিবো সেটা আমি বুঝবো।আর হ্যাঁ,মেজো আপু যা করেছে আজ আমার সত্যিই তার পা ধরতে ইচ্ছা করছে।ওই একটা মাত্র মানুষ যে মেয়েটাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবেসেছে।তোমরা এসেছো,থাকবে খাবে চলে যাবে…এর বাইরে আর একটাও না।”

মিসেস ইশানি ডাইনিং থেকে দ্রুত পায়ে রুমে যেয়ে বেডে বসে পড়েন।মি.ফুয়াদ আজসহ দু’দিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন তাই বাড়িতে আছেন।রুমে বসে একটা বই পড়ছিলেন।স্ত্রীকে রেগে রুমে আসতে দেখে ওনার দিকে তাকিয়ে বলেন,

-“কী হয়েছে?”

-“ফুয়াদ,একটাবার মেয়েটাকে ফোন করবে?আমার ফোন তো ধরেনা।”

মি.ফুয়াদ স্ত্রীর কথা শুনে বইটা বেড বক্সের উপর রেখে বলেন,

-“তোমার নাম্বার ধরেনা কিন্তু আমারগুলো তো ব্লাকলিস্টটে দিয়ে রেখেছে।তো হঠাৎ ওকে কেন ফোন করতে চাইছো,তুমি জানো ও আসেনা।বরং এই দিনগুলোতে য়ুহার ওকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে চলে যেতো।আর ডাক্তারও কিন্তু বলেছিলো ইস্মিতার প্রসঙ্গে ওকে যেনো কোনো কথা না বলি।”

মিসেস ইশানি এবার কেঁদে দিয়ে বলেন,

-“আচ্ছা,আমরা আদেও যা করতাম সেগুলো কী ঠিক ছিলো?আমাদের জন্য মেয়েটার আজ এই অবস্থা,জানো আজকাল খুব ওর কথা মনে পরে।ও কথা বলতোনা ঠিকই কিন্তু চোখের সামনে তো ছিলো।”

-“কী জানি,তবে মনে হয় খুব বেশি করে ফেলতাম।শাষনের নামে ওকে টর্চার করতাম,যখন ও সুইসাইড করার চেষ্টা করছিলো তখন বুঝতে পেরেছিলাম কিন্তু তারপরও কোথাও একটা কিন্তু থেকেই গেলো।”

-“আমার কী মনে হয় জানো?মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে,পরশু মেজো আপু এসে ওর মেডিকেল রিপোর্টগুলো নিয়ে গেলো,আমি জিজ্ঞেস করলে বললো,”জন্ম দিয়েছিস,সেই হিসাবে না হয় মেয়েটার জন্য একটু দোয়া করিস”।”

-“যদি হয়েও থাকে তাহলে কী বলবে আমাদের?সামান্য কিছু হলে মারধোর করতাম,যখন কী ওর পাশে আমাদের বেশি প্রয়োজন ছিলো।ও সব সময় বলতো, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম কেউ বোঝেনা।একবার কবি নজরুল বলেছিলেন,”মৃত্যুর যন্ত্রণার চেয়ে বিরহের যন্ত্রণা যে কতো কঠিন, কতো ভয়ানক তা একমাত্র ভুক্তভুগিই অনুভব করতে পারে”।সাধে কী মেয়েটা আমাদের সাথে কথা বলেনা,যদি কাল আসেও আমরা কিছু না বললেও তোমার বোনেরা চুপ থাকবেনা।”

-“সব কিছু নিয়তির লিখন কিন্তু আমরা ওই অবুঝ মেয়েটাকে দোষ দিতাম।আমাদের বড়ো দোষ আমরা মানুষের কথাকে বিশ্বাস করতাম।মেজো আপা কত বুঝাতো কিন্তু বোঝতাম না।”

মি.ফুয়াদ স্ত্রীর কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।শুধু অপরাধ ওনার স্ত্রী নয় উনিও করেছেন।যে মেয়ে বাবা বলতে পাগল ছিলো সেই মেয়ে তার দিকে ফিরেও তাকায়না।মি.ফুয়াদ মোবাইলটা হাতে নিয়ে ওনার স্ত্রীকে বলেন,

-“ইয়ামিলা কোথায়,এখনো আসেনি?”

-“না,আজ প্রাইভেটে পরীক্ষা আছে।আচ্ছা তুমি বাকীদের ফোন করে আসতে বলো আমি রাতের বান্নার ব্যাবস্থা করি।”

মিসেস ইশানি রুমে থেকে বের হতে হঠাৎ ওনার চোখ দোতালার ইয়ারাবীর রুমের দিকে পরে।মিলিস্তা ওর রুমের দরজা খোলার চেষ্টা করছে সাথে মিসেস নিন্দুও আছেন।মিসেস ইশানি শাড়ীর আচলটা ঠিক করে চুল বাঁধতে বাঁধতে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে ওদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

-“তোরা এখানে কী করছিস?”

মিসেস নিন্দু হাসার চেষ্টা করে বলেন,

-“তেমন কিছুনা আপা,ওই মিলিস্তা বলছিলো এই রুমে থাকবে।আসলে ইয়ারাবী তো নেই…”

-“বাড়িতে আরো অনেক রুম আছে,এটাতে থাকার কোনো দরকার নেই।”

-“না ফুপু আপনার মেয়েতো নেই,আর আসবেও না এবার… তাহলে থাকলে সমস্যা কী?”

-“সমস্যা অাছে,সব কথা তোকে কেন বলতে হবে?এই ঘরটা ইয়ারাবীর জন্য বরাদ্দ,তাই অন্য কেউ থাকুক সেটা আমার পছন্দ নয়।”

মিসেস নিন্দু হেসে বলে,

-“আপা ভুলে গেছেন মেয়ের বিয়ের বিয়ের পর বাবার বাড়ির কোনো কিছু নিজের থাকেনা।”

-“তাহলে তোর মেয়ে কেন বিয়ের পর থেকেই তোর ওখানে পরে থাকে?আর তুই বা কেন ওর সংসারে নাক গলাতে যাস?”

মিসেস নিন্দু আর বেশি কথা না বাড়িয়ে মেয়ের হাত ধরে নিয়ে চলে যান।উনি বুঝতে পেরেছেন এটা ওনার সেই ননদ নয় যাকে ইয়ারাবীর নামে হাজার কথা শুনালেও চুপ করে ওদের সাথে তাল মিলাবে।কিন্তু ওনারা বুঝতে পারছেন না হঠাৎ করে ইশানির হলোটা কী?

মিসেস ইশানি অনেকদিন পর আজ ইয়ারাবীর রুমে ঢোকেন।রুমের যে স্ট্যাডি টেবিল আছে ওটা পুরো ফাঁকা।কাবার্ডে শুধু মাত্র কয়টা কাপড় আছে।হঠাৎ ওনার চোখ যায় দেওয়ালের একটা বড় পেইন্টিং এর উপর,যেটা ইয়ারাবী নয় বছর বয়সে একেঁছিলো।আসলেই ওনার মেয়ের অনেক প্রতিভা ছিলো,কিন্তু ওনারা সেগুলো নিজের হাতে মেরে ফেলেছেন।উনি যেয়ে পেইন্টিং এর সামনে দাঁড়িয়ে ওর উপরে হাত বুলান।ঠিক এই জায়গাতে ইস্মিতা আর ইয়ারাবীর একটা বড় ছবি ছিলো।কিন্তু ওনার বোন ইয়ারাবীর জন্য ছবিটা সরিয়ে দিয়েছিলেন।উনি নিজে নিজে বলতে থাকেন,

-“আসলে তুই ঠিক বলেছিলি মেজো আপু,আমি মা হওয়ার যোগ্যতা রাখিনা।নয়তো দুধের বাচ্চাকে কখনো মারি পারতাম বল?”

(৯০)

রাত এগারোটা বাজে,ইয়ারাবী বিছানায় বসে পড়ছে আর আবরার ল্যাপটপে কাজ করছে।বিয়ের আগে ও কত শুনেছে,শ্বশুড়বাড়িতে বলে মেয়েরা কাজ করতে করতে ফ্রি হওয়ার টাইম পাইনা।আর এখানে ওকে সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকতে হয়,নয়তো ফ্রি টাইমে বাইরের কাজগুলো করতে হয়,মাঝে মাঝে অনুর বাসায় যেয়েও আড্ডা দেয়।এই একমাসে ইকরার সাথে ভালো একটা বন্ডিং তৈরি হয়েছে,ইকরা একদম নিজের বোনের মতো ট্রিট করে ওকে।

আবরার কাজ করতে করতে একবার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“না পড়ে বসে আছো কেন?কোন সমস্যা নাকী?”

-“সারাদিন তো পড়তেই থাকি।”

-“আজ তো আর পড়তে পারোনি,সেগুলো কম্পিলিট করো।”

-“অন্য স্বামীরা চাই তার ওয়াইফ যেনো মন দিয়ে সংসার করে,আর এখানে আপনি সারাদিন পড়ার কথা বলেন।শুধু আপনি কেন এই বাসার তো সবাই করে।একটু ছাদে গেছিলাম আজ ইকরা আপু এসে ওমনি বললো রুমে যেয়ে পড়তে বসো।”

-“হয়ে গেছে, নাকী আরো বাকী আছে?”

-“ছিলো অনেক কিছু কিন্তু আপনাকে বলে কোনো লাভ নেই।কারন,আমি যা জানতে চাইবো আপনি বলবেন মুড নেই।বলছি প্লীজ,এ্যান্সার দেওয়ার জন্য আপনার কোন সময় মুড থাকে একটু জানালে ভালো হতো।”

ইয়ারাবীর কথাগুলো শুনে আবরারের জোরে জোরে হাসি আসছে কিন্তু কোনো ভাবে কন্ট্রল করছে।কেননা এই প্রথম ইয়ারাবী এভাবে ওর সাথে কথা বলছে।আবরার সোফা থেকে উঠে গায়ের টি-শার্ট টা খুলতে খুলতে ওর দিকে এগিয়ে যায়।অবশ্য ওর নিচে একটা গেন্জি পরে আছে।ইয়ারাবী ওর এভাবে আসা দেখে ভয় পেয়ে যায়।

-“আ আপনি এভাবে এগোচ্ছেন কেন?”

-“কেন তুমিতো চাও আমি যেনো অন্য স্বামীদের মতো হই?তাহলে ওরা যা করে সেটা আমিও করি।”

-“নাহ্হ্,আ আপনিতো খুব ভালো মানুষ,আমি তো এ্ এমনি ব্ বলছিলাম।পড়্ পড়বো তো,প্লীজ এমন কিছু করবেন না।”

ইয়ারাবী মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ রেখে কথাটা বলে।আবরার হো হো করে হেসে ওর মাথার চুলগুলো নেরে বলে,

-“বেলকনিতে যেয়ে একটু দাঁড়াও,যদিও ঠান্ডা পড়ছে তারপরও ভালো লাগবে।অনেকক্ষণ ধরে পড়েছো,ঘুমাতে হবে।”

ইয়ারাবী কথা শুনে বেলকনিতে চলে এসে লম্বা শ্বাস ফেলে।আবরার ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কাজ করতে থাকে।হঠাৎ ইয়ারাবীর চিৎকার শুনে ও বেলকনিতে যেয়ে দেখে ইয়ারাবী একটা কর্নারে চুপ করে বসে আছে।আবরার লাইট জ্বালিয়ে ওর কাছে যেতেই দেখে ওর কান্না করছে,আর চোখে লেগে আছে একরাশ ভয়।ও ইয়ারাবীর মুখে কাঁধে হাত রাখতেই ও আবরারকে জড়িয়ে ধরে বলে,

-“আ আপুনি,আপুনি এসেছিলো….”

-“আপুনি,কার কথা বলছো তুমি?”

-“ইস্মিতা আপুনি,এ্ এখানে ছিলো।খুব ভয়ানক চ্ চেহারা।”

আবরার বুঝতে পারছে এটা ওর কল্পনা যেমনটা ইফাজ বলেছিলো।আবরার ওর বুক থেকে মাথা উঠিয়ে বলে,

-“দেখো ইয়ারাবী,এটা তোমার মনের ভুল ছাড়া আর কিছুই নয়।”

-“না, এ এখানে ছ্ ছিলো….”

-“ওকে,আগে রুমে চলো।”

আবরার ইয়ারাবীকে রুমে নিয়ে এসে পানি খাওয়ায়।তারপর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-“ইয়ারাবী শোনা,তুমি যা দেখছো সেগুলো তোমার কল্পনা।কেননা মৃত ব্যাক্তিরা কখনো ফিরে আসেনা।আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা করেছেন, ‘পৃথিবীর প্রতিটি জীবনকেই একদিন মৃত্যুবরণ করতে হবে।’ সে হিসেবে মানুষও একদিন মারা যাবে।শুধু মাত্র পূনরুত্থানের সময় তারা আবার উঠে দাঁড়াবে।তাছাড়া আল্লাহ তাআ’লা কুরআন মজীদে এরশাদ করেন,
“(হে নবী!) আপনি বলে দিন, হে মানবমন্ডলী! আমি আকাশ-জমিনের রাজত্বের মালিক আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের সবার নিকট প্রেরিত রাসূল। তিনি ব্যতীত সত্য কোন উপাস্য নাই। তিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু দান করেন। সুতরাং তোমরা সবাই আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তাঁর প্রেরিত নিরক্ষর নবীর উপর, যিনি বিশ্বাস রাখেন আল্লাহ এবং তাঁর সমস্ত কালামের উপর। তাঁর অনুসরণ কর যাতে সরল পথপ্রাপ্ত হতে পার।” (সূরা আরাফঃ ১৫৮)
তাই দেখো এভাবে অযথা ভয় পাওয়ার কোনো দরকার নেই এটা তোমার ভ্রম।তাছাড়া একজন মুসলিম হিসাবে এটা বিশ্বাস করতে হয়না,মৃত ব্যাক্তিরা ফিরে আসে।তুমি আজ তোমার আপুকে নিয়ে চিন্তা করছো তাই তোমার এমন মনে হয়েছে।”

ইয়ারাবী হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে বলে,

-“আব আবরার আমি সত্যি আপুনিকে দ্ দেখেছি।আমার ভ্ ভয় করছে,”

আবরার ইয়ারাবীকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে গায়ে ব্লাঙ্কেটটা টেনে দিয়ে শ্যাডা লাইটটা অন করে দেয়।ইয়ারাবী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বিড়ালের মতো গুটিশুটি মেরে আবরারের বুকে মাথা রেখে কান্না করছে,আর সেটা আবরার বুঝলেও ওকে থামাচ্ছেনা।ও মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শুধু ঘুমাতে বললো।

জীবনটা খুব অদ্ভুত তাইনা?আমরা কখনো বুঝতে পারিনা কষ্টগুলো কখন এসে আমাদের সুখের দুয়ারে হানা দিবে।যে ভয়ংকর মূহুর্ত থেকে আমরা বাঁচার জন্য আপ্রান চেষ্টা করি সেটাই আমাদের সামনে কাল হয়ে দাঁড়ায়।যে কোন কিছুতে ভীত নয়; সে নয়, বরঞ্চ যে ভয়কে জয় করে সেই হচ্ছে প্রকৃত সাহসী।কিন্তু ইয়ারাবী আর কতবার নিজের ভয়কে জয় করবে?প্রথমে ওর মনে হতো ইস্মিতা সব সময় ওর সাথে আছে কিন্তু ওকে যখন বুঝানো হলো তখন ভয়টা ওকে তাড়া করে বেড়ালো।মাঝে তো বেশ ভালো ছিলো,তবে আবার কেন এমন হলো?

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here