জীবন মানে তুমি পর্ব:৩

0
5915

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Irini Ori
#পর্ব:৩

(১০)

-“দেখ তোমার কথা আমি মানছি যে বুকে ব্যাথা অনেক কারনে হয়।কিন্ত আমার মনে হচ্ছে তুমি কিছু লুকাচ্ছো।”

-“না আপু এমন কিছুই নয়।”

-“ইয়ারাবী ভুলে যেওনা আমি একজন ডাক্তার।আর তোমার উডবিও কিন্তু একজন ডাক্তার।আমার কাছে লুকালেও ওর কাছে পারবেনা।”

ইয়ারাবী অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,

-“বছর দু’য়েক আগে বুকে কিছুটা আঘাত লেগেছিলো।তখন তেমন একটা বেশি ছিলোনা।বাট্ গত দু’মাসে একটু বেশি হচ্ছে। ”

-“তোমার মতো একটা স্মার্ট মেয়ে পাগল কী করে হতে পারে?তুমি জানো আবরার এসব জানলে কী হবে?”

-“পেইনকিলার নিলে ঠিক হয়ে যেত তাই।”

-“হামমম,তাশা তুমি যেয়ে আবরারকে ভিতরে আসতে বলো।”

আবরার ভিতরে এসে চেয়ারে বসতে বসতে বলে,

-“কেমন দেখলে আপু,সব ঠিক আছে তো?”

-“না কিছুই ঠিক নেই।দেখ আমি কিছু মেডিসিন দিচ্ছি এগুলো কন্টিনিউ করতে হবে।ওর আঘাতটা অনেক গভীরভাবে লেগেছে।আলহামদুলিল্লাহ বল যে ওর পাজরের হাড়গুলো ভেঙ্গে যায়নি।নয়তো….”

-“ইয়ারাবী আপু এগুলো কী বলছে?তোমার আঘাত কীভাবে লাগলো?”

ইয়ারাবী এখন কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছেনা।যদিও আবরার এখন পরিবারের একজন সদস্য তারপরও ওর মা-বাবার কথা বললে অনেকটা ছোট করা হয়ে যাবে।আবার এদিকে মিথ্যাও বলতে পারছেনা।আবরারের যা বুঝার সে বুঝে গেছে, তাই দ্বিতীয়বার আর কোনো প্রশ্ন করেনি।ওরা তনুর সাথে কথা বলে প্রেসক্রিপশন নিয়ে বেড়িয়ে আসে।আবরার ড্রাইভিং করছে আর তারপাশে ইয়ারাবী চুপচাপ বসে আছে।

বুকে ব্যাথার কারনে সারারাত ঘুমাতে না পারলেও ফজরের নামায পড়ে একটু ঘুম দেয়।সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আবরার ওদের বাসায় আসে।মিসেস.ইশানি কিছুটা অবাক হয়ে যান,কেননা ইনগেজমেন্টের পরে এই প্রথম আবরার তাদের বাড়িতে এসেছে।এদিকে ইয়ারাবীর ছোট খালার তো সোনায় সোহাগা,কেননা আবরার একা আসেনি মেঘও এসেছে তার সাথে।

-“আসসালামুআলাইকুম, আন্টি”

-“ওয়ালাইকুমুসসালাম ,তোমরা এখানে।না মানে বলছিলাম হঠাৎ করে এলে তাই।”

-“আন্টি আমিতো প্রায় আসি ইয়ারাবীর বন্ধু হিসাবে।তবে ভাইয়া আজ কাজে এসেছে।তো আন্টি কোথায় সেই পেত্নী?”

-“নিজের রুমেই আছে ঘুমাচ্ছে।আজ ভার্সিটি অফ তাই হয়তো ওঠেনি।”

আবরার সোফায় বসে বলে,

-“আন্টি যদি কিছু মনে না করেন তবে ইয়ারাবীকে একটু ডেকে দিবেন।”

-“কেন কিছু কী হয়েছে নাকী বাবা?কাল বলে দেখা করলে, কিছু কী করেছে নাকী ইয়ারাবী?”-পাশ থেকে ওর ছোটখালা ফোরন কেটে কথাটা বলে।

-“কেন আন্টি কিছু কী করার কথা ছিলো নাকী?”-বাঁকা হেসে আবরার কথাটা বলে।

ওর আন্টি কোনো কোনো কথা না বলে চুপচাপ ওখান থেকে কেটে পড়ে।উনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন ভুল যায়গায় আবার ভুল কথা বলে ফেলেছেন।এর মধ্যে টিকলি বলে,

-“ভাইয়া আপু মনে হয় অসুস্থ, তাই ঘুমাচ্ছে।আপু যখন নামায পরে ঘুমাবে তখন বলেছিলো কেউ যেন না ডাকে।”

মিসেস ইশানি টিকলির দিকে তাকিয়ে বলে,

-“সারা জীবন পরে আছে ঘুমানোর জন্য,তুই যেয়ে ডেকে আন।”

-“টিকলি শোনো একবারে রেডি হয়ে আসতে বলবা কেমন।”

টিকলি ভদ্র মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে উপরে চলে যায়।এদিকে টিকলির ভাই তন্ময় বলে,

-“ভাইয়া আপনারা বুঝি কোথাও যাবেন?”

-“হামম,তোমার আপুর সাথে একটু কাজ আছে।”

এদিকে মেঘ কিচেনে যেয়ে মিসেস ইশানিকে বলে,

-“ও আন্টি পেটের ভিতর ইন্দুর দৌড় দিচ্ছে, কিছু খেতে দাও।ভাইয়াতো খেয়ে আসছে কিন্তু আমাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে এসেছে।”

মেঘের কথায় হেসে দেন উনি।ছেলেটা খুব চটর-পটর।সমন্ধ ঠিক হওয়ার আগেও মেঘ এসেছে এই বাড়িতে।সহজে সবাইকে আপন করে নেয়।ইয়ারাবীর ফ্রেন্ড,খুব ভালো বন্ধুত্ব।ওর সাথে যে থাকবে তার মন খারাপ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

ইয়ারাবী রেডি হয়ে একবারে নিচে নামে ।যখন টিকলি যেয়ে বলে আবরার এসেছে আর কোথাও যাবে তখন আর কোনো কথা না বলে তৈরি হয়ে নেয়।কেননা ওর জানা আছে নিজের মতামত কারোর কাছে প্রকাশ করে কোনো লাভ নেই।অপরদিকে ওর খালা বাসায় আছে।সে জানলে তিলকে তাল বানিয়ে সবার কাছে প্রচার করে বেড়াবে।ইয়ারাবী বুঝতে পারেনা টিকলি কীভাবে তার মেয়ে হয়ে জন্মালো।

ইয়ারাবীকে দেখে মিসেস ইশানি ব্রেকফাস্ট করতে বলেন।কিন্তু আবরার নারাজ, সে করে এসেছে তাই আর কিছু খেতে চায়না।আর এদিকে ইয়ারাবী পরেছে বিপদে,সকালে খাওয়ার ইচ্ছাতো তার একেবারে নেই তারপর বুকে ব্যাথা।যদি এখন ও ব্রেকফাস্ট করতে না বসে তাহলে ওর মা লঙ্কা-কান্ড বাধিয়ে দিবেন।তাই চুপচাপ ও বসে পড়ে।ইশানি মেয়ের কান্ড দেখে খুব অবাক হয়ে যান।

খাওয়ার সময় আবরার খেয়াল করে বারবার ইয়ারাবী তার বুকে হাত দিচ্ছে।আর প্লেটের খাবারগুলো নাড়াচাড়া করছে।ব্রেকফাস্ট শেষে মিসেস ইশানিকে বলে ইয়ারাবীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।সেই সময়ও ইয়ারাবী জানতো না ওরা কোথায় যাচ্ছে।হাসপাতালের সামনে যখন গাড়িটা থামায় ও ভেবেছিলো কোনো কাজ আছে,কিন্তু যখন আবরারের কাজিন তনুকে দেখে তখন বুঝতে পারলো এখানে কেন নিয়ে এসেছে।

আবারারের কথার ইয়ারাবীর হুশ ফেরে।

-“একটা সত্য কথা বলবে?”

প্রশ্নটা শুনে ইয়ারাবী আবরারের মুখের দিকে তাকায়।আবরার আবারো বলে,

-“প্রশ্নটা শুনতে খুব খারাপ লাগবে তবু্ও।আমি চাই তুমি সত্যটা বলবে।আচ্ছা তোমার ছোট খালা তোমাদের বাসায় কেন এসেছে?”

-“অদ্ভুত, উনি আমার সম্পর্কে খাল হন,আমার মায়ের বোন তাই এসেছে।তাছাড়া তো প্রায় আসে।”

আবরার ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,

-“প্রশ্নটা শুনে খুব রাগ লাগছে তাইনা।আমার ও লেগেছিলো যখন উনি আর সম্পর্কে মনে হয় তোমার মামী মানে এমন কেউ আমাদের বাড়িতে যেয়ে বিয়েটা ভাঙ্গার চেষ্টা করেছিলো।”

-“হুয়াট্?এসব ক্ কী বলছেন আপনি?”

-“একদম ঠিক বলছি?ওনারা যেয়ে বলেছে তোমার কোথাও সম্পর্ক আছে,তুমি মেয়ে হিসাবে ভালো নও,তোমার ক্যারেক্টার ভালো নয় ইত্যাদি।আরো অনেক কিছু বলেছিলো যা ভাষায় বর্ননা করা যাবেনা।”

ইয়ারাবী কী বলবে সে বুঝতে পারছেনা।হ্যাঁ,ইয়ারাবী খুব ভালো করে জানে ওর আত্মীয়-স্বজনরা উপর উপর ওর প্রশংসা করলেও ভিতরে খুব হিংসা করে।তাই বলে চরিত্র তুলে কথা বলবে।খুব কান্না পাচ্ছে ইয়ারাবীর।বেঁচে থাকলে যে আর কত কিছু দেখতে পাবে।যদি আত্মহত্যা মহাপাপ না হতো তাহলে মনে হয় ইয়ারাবী সেটাই করবো।মানুষ যে এতটা নিকৃষ্ট তা এদের না দেখলে বোঝা যাবেনা।কিন্তু এই মানুষগুলোকে বিপদে আপদে সাহায্য করেছে।নিজেকে সামলে ইয়ারাবী বলে,

-“ত্ তাহলে বিয়েটা ভেঙ্গে দিলেন না কেন?আমিতো শুনেছি মেয়েদের নামে কোনো রিপোর্ট পাওয়া গেলে বিয়ে ভেঙ্গে যায়।”

আবরার ওকে কিছু না বলে ওর কথায় শুধু হাসলো।এ যেন এক মুগ্ধকর হাসি।যে হাসিতে ইয়ারাবীর বারবার হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে।কিন্তু ওর কপালে যে সুখ নেই।তাই ক্ষণিকের সুখকে আকরে ধরে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে চাইনা।

(১১)

মিসেস জামান তার এক ভাইয়ের বৌকে বাসায় ডেকেছেন।মহিলাটার নাম নিন্দু।নামের সাথে তার চেহারা আর কাজ দু’টায় মিলে যায়।যত প্রকারের বদ-বুদ্ধি আছে এই মহিলার মাথায়।ওনার চার-ছেলে মেয়ে।মেয়েগুলো হয়েছে ওর মায়ের মতো, কিন্তু যে এক ছেলে আছে সে তার সম্পূর্ন বিপরীত।

গুলসানের দু’তালা বাসার ছয় কামরার বাড়িতে থাকেন।নিচেরটা সম্পুর্ন ভাড়া দেওয়া।তাদের বাড়িতে সারাদিন ঝগড়া লেগেই থাকে।মেয়েগুলো বিয়ের পর মায়ের বাড়িতে এসে পরে আছে।এমনটা নয় যে তাদের স্বামীরা খারাপ।তারা খুবই ভালো কিন্তু মায়ের মতো কুট-বুদ্ধি সম্পুর্ন মেয়ে তাই শ্বশুড় বাড়িতে থাকতে পারেনা।

মিসেস নিন্দু জামানের বাড়িতে ডুকে বোরখা খুলতে খুলতে বলে,

-“কোনো কাজ কী হয়েছে আপা?”

মিসেস জামান আফসোসের সুরে বলেন,

-“তুই যার কাছে বলেছিলি তিনি মানা করে দিয়েছে।তবে একজনের খবর পেয়েছি।শুনেছি তার কাজগুলো খুব ভালো। ”

-“তাহলে তো হয়েই গেলো।আর কোনো চিন্তা নেই।এই লোককে যদি আগে খুঁজে পেতেন তাহলে ওই বাড়িতে যেয়ে এত অপমান হতে হতোনা।”

-“আরে বাবা আমি কী করে জানবো যে ওরা ইয়ারাবীকে আগে থেকে চেনে।এতকথা বানিয়ে বললাম তার কিছুই কাজে দিলোনা।”

-“আপা যদি একবার ওরা ইশানি আপাকে বলে দেয় তাহলে আপনার ভাই আমার ডিভোর্স দিয়ে দিবেনে।আপনিতো জানেন আপনার ভাই কত ভালোবাসে বোনের ছেলেমেয়েকে।”

-“আমার ইশানি বা তৌফিকে নিয়ে ভয় হচ্ছে না।ভয় হচ্ছে ইয়ারাবীকে নিয়ে।ও চুপচাপ থাকে তাই কী?পল্লবীর বর ঠিকই বলে ও ঘুমন্ত বাঘিনী। তাই ভালোই ভালোই কাজ যাতে মিটে যায় সেই দোয়াই কর।”

-“আম্মা যদি ভালো কাজের দোয়া করতেন তাহলে হতো কিন্তু যে কাজের দোয়া করছেন তা জীবনেও হবেনা।”-পিছন থেকে নিতুলকে কোলে নিয়ে ইতি কথাটা বলে উঠে।

-“আমি বুঝিনা তুমি কী আদিবার ভাবি না ইয়ারাবীর।”

-“দেখুন আম্মা আমি সম্পর্কে দু’জনেরই ভাবি।যখন আমি মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছিলাম তখন কিন্তু আপনার মেয়ে না ইয়ারাবী আমাকে রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে ছিলো।যখন রক্তের দরকাল হলো তখন আপনি কী বললেন আপনার মেয়ে সুই দেখে ভয় পায়,সামনে এক্সাম নানা বাহানা দিতে লাগলেন।”

-“ত্ তুমি এসব কী বলছো?যা সত্যি আমি তাই বলছি।”

-“আম্মা আপনি আমাকে সহ্য করতে পারেননা তা আমি জানি।তবে আজ আপনার ভালোর জন্য একটা কথা বলি।আপনি যে কাজ করতে যাচ্ছেন তাতে শুধু ইয়ারাবী নয় আপনার মেয়েও বিপদ আছে।”

কথাটা বলেই ইতি রুমে চলে গেল।এদিকে নিন্দু মিসেস জামানকে বলে,

-“আরে আপা চিন্তা করবেন নাতো।এমন কিছুই হবেনা।”

তবুও মিসেস জামানের চিন্তা হচ্ছে। কেননা ওই জায়গা থেকে ফেরার পর রাতে খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছেন আদিবাকে নিয়ে।ওনার কেন জানি মনে হচ্ছে আদিবার জন্য কোনো বিপদ ঘনিয়ে আসছে।

(১২)

নিজে ডিপ্রেশনে থেকে বাকিদেরকে মোটিভেশন দেওয়ার কাজ হলো ইয়ারাবীর।ওর বন্ধু মুনা পারিবারিক সমস্যার কারনে অনেকটা ডিপ্রেশনে পরে গেছে।নিজের রুমে বসে ফোনে মুনাকে নানা ভাবে বুঝায় ইয়ারাবী। এক পর্যায়ে মুনাও কিছুটা উপকৃত হয়।ওকে বদলে থ্যাংকস্ জানায়।ইয়ারাবী ফোনটা কেটে দিয়া হাসতে থাকে।আসলে বাইরের রুপ দেখে ভিতরের কষ্টগুলো বোঝায় কোনো উপায় থাকেনা।সত্যিই কী তাই?না মানুষ চাইলে বুঝতে পারে।কোনো ব্যাক্তিকে ডিপ্রেশন থেকে বের করে আনার উপায় তাকে সঙ্গ দেওয়া,বন্ধুত্বপুর্ন আচারন করা,এমন কিছু কথা বলা যাতে সে ডিপ্রেশন থেকে বের হয়ে আসতে পারে।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ইয়ারাবী বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ায়।

-“আপু আপনি ঠিক আছেন?”

-“টিকলি তুমি,আমার কী হবে?আমি ঠিক আছি।এন্ড সরি কাল তোমার সাথে ভালো করে কথা বলতে পারিনি।”

-“আপু আমি কিন্তু এখন সেই ছোট টিকলি নেই।আমি জানি আপনার শরীর খারাপ।আপনি বাইরে থেকে এসো ঔষুধ খেয়েছেন সেটা আমি দেখেছি।”

-“হা হা, অনেক বড় হয়ে গেছো দেখছি।আরে তেমন কিছুনা।বাদ দাও এখন বলো লেখাপড়া কেমন চলছে?”

-“আপু তুমি কথা কেন ঘুরাও সব সময়?”

কথাও আওয়াজ শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখে ওর আরেক খালাতো বোন জারা দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটার সাথে ছোটবেলার খুব ঝগড়া হতো।মেয়েটা ছিচ কাদুনিও বটে।তবে জারা ইয়ারাবীর সাথে এমন কথা নেই যা সিয়ার করেনা।ছোটবেলার ঝগড়া হলেও দু’মিনিট পরে সেই ইয়ারাবীর পিছনে ঘুরঘুর করতো।ওর বাবা-মা বড়লোক হওয়ার ও কিছুটা স্টাইল নিয়ে চলাফেরা করে।

-“আরে জারা কখন এলে তুমি?”

-“এইতো আপু এখনি এলাম।টিকলি তুই আমার সাথে আমার বাসায় যাবি।খালার প্যারা আমি সামলে নিবো।এবার কিন্তু না শুনবোনা।”

-“কেন তোমার খালাকে সাথে নিবেনা?”

-“নো,ভাবছি আজ থাকবো তোমার সাথে আর কাল তুমি আর টিকলি বাসায় যাবে।আব্বু-আম্মু অফিস থেকে বান্দরবন যাবে।তাই অনেক মজা করবো। ”

-“সরি আমি যেতে পারবোনা।আসলে আমার ক্লাস আছে।”

-“আপু তোমার কী মুড অফ?”

ইয়ারাবী হেসে বলে,

-“ভাই তোর কী কোনো কাজ নেই?আমাকে যখনি দেখো শুধু একটা কথায় বলো মুড অফ নাকী?”

-“কারন তোমাকে দেখলে এমনি লাগে।আগের মতো হাসি নেই,যোগাযোগ করনা,আগে কোনো ফাংশন বা পার্টিতে কত মজা করতাম সেটাও হয়না।তুমি বোঝনা কেন তোমাকে ছাড়া মজা করতে পারিনা।তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি কষ্ট আছো।একলা থাকো কেন সব সময়।”

ইয়ারাবী সীমাহীন আকাশের দিকে দৃষ্টি মিলিয়ে বলে,

-“জারা, যদি পৃথিবীর কষ্টটাকে সুখ হিসাবে ধরা হতো তাহলে আমার থেকে সুখি আর কেউ হতোনা।আর একলা থাকার কথা বলছো সেটা এই জন্য কারন আমি একাকীত্বকে ভালোবাসি।যেখানে কেউ কারো দোষ ধরতে পারেনা,না কেউ কথা শুনাতে পারবে।”

ইয়ারাবীর কথা শুনে জারা আর টিকলি কিছুই বলেনা।অবশ্য টিকলির মাথায় কিছুই ঢোকেনি তারপরও চুপ করে আছে।

বিকালের দিকে ইয়ারাবীর বাবা আর খালু সোফায় বসে টিভি দেখছে।ইয়ারাবী কী মনে করে আজ ওর বাবার পাশে যেয়ে বসে।ওর বাবা একবার ওর দিকে তাকিয়ে টিভির রিমোট দিয়ে দেয়।ইয়ারাবী সেটা দেখেও না দেখার ভান করে বসে থাকে।ইয়ারাবীর বাবা যতই খারাপ ব্যাবহার করুক না কেন তারপর ও বাবার পাশে যেয়ে বকবক করতো।গোটা দু’বছরে ইয়ারাবী চুপচাপ,প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথা বলেনা।কিন্তু আজ যেন একটু বেশিই। ওর এই নীরবতাকে ওর বাবা মেনে নিতে পারছেনা।

মিসেস ইশানি মেয়েকে নিচেই দেখি খুব অবাক হন।কেননা ওনার মেয়ে বিকালের দিকে নিচের রুমেই থাকে।উনি যেয়ে সবাইকে চা কফি দেন।ইয়ারাবী ওনার হাত থেকে কফির গ্লাসটা নিয়ে দেখে ব্লাক কফি।যেই ও কফিতে চুমুক দিতে যাবে ওমনি ওর খালা বলে,

-“তোর না বিয়ে হবে।কোথায় তুই সবাইকে করে খাওয়াবি সেটা না করে মাকে দিয়ে করাচ্ছে। বলছি তোকে কী ওরা বসিয়ে খাওয়াবে।এখন কাজগুলো তো শিখতে পারিস।”

ইয়ারাবী কফিটা না খেয়ে টেবিলে রেখে দেয়।মিসেস ইশানির খুব খারাপ লাগছে তার বোনের ব্যাবহারে।যদি ওর হাসবেন্ড না থাকতো তাহলে কিছু কথা শুনাতো।কিন্তু এখন যদি কিছু বলে তো ওনি বলবে আপা আমাদের অপমান করেছে।এদিকে মি.ফুয়াদের ও খুব রাগ হচ্ছে। একেতো ইয়ারাবী আজকাল কিছু খাইনা।যদিও কফিটা খেতে গেছিলো কিন্তু ওনার শালীর জন্য না খেয়ে রেখে দিলো।

ওর খালা এবার ইয়ারাবীর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

-“আমার সাথে কিচেনে চল।রাতের রান্নাটা তুই করবি।আপুর দ্বারাতো জীবনে এসব হবেনা।কিন্তু আমি যখন এসেছি তোর এসব কাজ করতে হবে।আর এসব কী পরে থাকিস সব সময়।গেন্জি আর প্লাজু, টপস্,গাউন বলছি বিয়ের পরে কী এসব পরবি নাকী?এসব আজ থেকে বাদ দিয়ে থ্রি-পিচ পরবি।”

ইয়ারাবী ওর খালার কথাগুলো শুনেও ডোন্ট-কেয়ার ভাব নিয়ে টিভি দেখছে।ও চাইলে প্রতিবাদ করতে পারতো কিন্তু ওর জানা আছে।এখন ওর খালার উপর দিয়ে টর্নেডো যাবে।হলোও ঠিক তাই।মিসেস ইশানি চুপ করে সব হজম করলেও মি.ফুয়াদ বাঘের মতো গর্জন করে উঠে বলে,

-“আমার মেয়ে বসে খাবে নাকী রান্না করে খাওয়াবে সেটা বুঝার জন্য আমরা আছি।আর তোমার তো সাহস মন্দ নয় এখানে আমি বসে থাকতে তুমি আমার মেয়েকে কথা শুনাচ্ছো।”

এবার ওর খালু হাসতে হাসতে বলে,

-“আরে দুলাভাই আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?দেখেন খালারাও কিন্তু মায়ের মতো তাই আরকি…”

-“আরে রাখো তোমার মায়ের মতো,ওর মা কী মরে গেছে।আর আমার মেয়ে কী পরবেনা পরবে সেটা ওর ব্যাক্তিগত ব্যাপার।ইশানি কান খুলে শুনে রাখো আমার মেয়েকে যেনো আমি কিচেনে না দেখি।তোমার জন্য তিন-চার বছর আগে মরতে মরতে বেঁচেছে।কথাটা মাথায় রেখো।”

কথাগুলো বলে মি.ফুয়াদ নিজের রুমে চলে যান।ওনার কথা হচ্ছে, ওনারা নিজের মেয়েকে বককেন, মারবেন কিন্তু বাইরের মানুষ এসে কথা শুনাবে সেটা ওনার পছন্দ নয়।এটা নয় যে উনি শুধু ইয়ামিলাকে ভালোবাসেন।ইয়ারাবীকে ভালোবাসেন বলেই ওই ঘটনার পর থেকে কিচেনে ঢুকতে দেননি।

ইয়ারাবী ওর খালার দিকে তাকিয়ে হেসে উপরে চলে যায়।আজ যখন আবরার কথাটা বললো তখন থেকেই ইয়ারাবীর একটা ঘৃনা চলে এসেছে।ওনার আশেপাশে থাকলে নিঃস্বাস বন্ধ হয়ে যায়।এই মানুষটার জন্য ওরা কত করলো আর তারা কীনা ওকে বলে ক্যারেক্টার খারাপ।

টিকলি এসে পিছন থেকে ইয়ারাবীকে জড়িয়ে ধরে বলে,

-“আপু আম্মুর মুখটা দেখার মতো ছিলো।”

-“তোর রাগ হচ্ছেনা।তোর মাকে এতগুলো কথা শুনানো হলো।”

-“একদমি না, আমি জানি আমার আম্মু একটু বেশি বেশি।আচ্ছা আপু কী হয়েছিলো বলতো।খালু তোমাকে কিচেনে যেতে দেয়না।”

-“আরে তেমন কিছুনা।আসলে আমার মাশরুমে এলার্জি আছে।আম্মু সেদিন মাশরুম রান্না করেছিলো।রাত অনেক হওয়ার বলেছিলো খেলে ওটাই খেতে হবে নয়তো নিজে রান্না করো।সেদিন আবার আমি থ্রি-পিচ পরেছিলাম।ঔষধ ছিলোনা বলে আর মাশরুম না খেয়ে একটা ডিম ভাজতে গেছিলাম।প্যানে তেল দেওয়ার পর আগুন ধরে গেছিলো আর আমি গাধার মতো পানি ঢালতে গেছিলাম।কিন্তু আমার ওড়নায় আগুন ধরে যায়।তাই সেদিনের পর থেকে তোমার খালু না আমাকে কিচেনে ঢুকতে না দেয় থ্রি-পীচ পরতে।”

-“সত্যি খালু তোমাকে খুব ভালোবাসে।”

ইয়ারাবী টিকলির কথাশুনে কিছু না বলে শুধু হাসলো।ওকে যে কেমন ভালোবাসে সেটা একমাত্র ওই জানে।এত ভালোবাসে যে খুন করতেও দু’বার ভাবেনা।হ্যাঁ,ও এখনো বেঁচে আছি সেটাই অনেক কিন্তু কেমন আছে সেটাই ও নিজেই জানেনা।তবে ওইদিন একটা শেষ ডাক আব্বু ডেকেছিলো আর বলেছিলো,”দাঁত থাকতে কেউ দাঁতের মর্ম বোঝেনা।একটা সময় আসবে যেদিন আমি থাকবোনা।এই বলে ভেবোনা আমি মরে যাওয়ার কথা বলছি তবে ওইদিন হাজার কাঁদলেও ফিরবোনা।আর হ্যাঁ,যদি দেখ মারা গেছি তবে ঘটা করে আমার জন্য কিছু করবেনা। নিজের রুমে ড্রয়ারে আমার কিছু টাকা রেখেছি নিজের কাফনের কাপড় কেনার জন্য। ওইটা দিয়ে করো।আর হ্যাঁ,আমার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করো।জানি জাহান্নামে যাওয়া হবে কেননা তুমি নিজেই বলেছো আমি জাহান্নামে যাবো।আর বাবা-মার দোয়া কবুল হয় সে যা বলুক না কেন।”

এখনো কথাগুলো মনে পড়লে ইয়ারাবীর কান্না পায়।সেদিনের পর থেকে এক বাড়ি থেকেও কোনো কথা বলেনা।অনেক কথা বলার মানুষ যখন একটা সময় চুপ হয়ে যায় তখন বোঝা যায় আঘাতটা খুব গভীর।হ্যাঁ,এত পরিমানের যে ওই রাতের পর থেকে প্রতিটা রাত নির্ঘুমে কেটেছে।বাস্তবতা যে এত কঠিন ইয়ারাবীর জানা ছিলোনা।আগে হাতে পিন ফুটলে যে মেয়েটা কান্না করতো আজ হাত কেটে পরে গেলেও তার কিছু যায় আসবেনা।

(১৩)

-“পল্লবী,কথাটা বোঝার চেষ্টা করো,টাকাটা আমার লাগবে।তুমি তোমার আব্বুকে বলে টাকা আনবে।”

-“কেন লাগবে তোমার? দিব্বিতো ভালো চাকরি করছিলে,এখন বোনের কথা শুনে নাচতে বসেছো।”

-“খবরদার পল্লবী বাজে কথা বলবেনা।”

-“কীসের বাজে কথা?যদি এতোই প্রয়োজন নিজের বাবা-মার কাছ থেকে টাকা নাও।সেদিন তো গ্রামের জমি বিক্রি করে এসেছে।”

-“তোমার তো সাহস বেড়েছে দেখছি।আমার বাবা-মার টাকার উপর নজর দাও।আর এখন বাবার কাছে টাকা চাইতে পারবোনা।তুমি নিয়ে আসবে ব্যাস।”

-“আব্বু এত টাকা দিতে পারবেনা।”

-“কী দিয়েছে বিয়ের পরে?”

-“কী দেয়নি সেটা বলো…এই যে এ বাড়ির অর্ধেক কম্পিলিট করার জন্য বাবা টাকা দিয়েছে।যে বাইকে ঘুরে বেড়াও সেটাও বাবা দিয়েছে।আর তোমার বোন যে গহনাগুলো পরে বেড়াতে যায় ভুলে যেওনা সেটাও আমার।”

-“পল্লবী বেশি তেজ দেখাতে এসোনা।মানলাম সব তোমার বাবা দিয়েছে কিন্তু তুমি কী দিয়েছ।চেয়েছিলাম ছেলে কিন্তু কী দিলে মেয়ে।আবার বড় বড় কথা বলতে আসো।”

-“সায়ন,,,অনেক বলে ফেলেছো।আগে তো এমন ছিলেনা।কী হয়েছে হ্যাঁ?মেয়েকে তুমিও তো আদর করতে।”

-“আমার ফ্রেন্ডের ছেলে হয়েছে।পিয়াশের ও প্রথম বাচ্চা ছেলে, আর আমি….”

-“ঠিক আছে,জারা ঠিকই বলে তুমি একমাত্র ইয়ারাবীকে দেখলেই শুধরাবে।লাস্টবারের ওয়ার্নিংটা মনে আছে তো সায়ন,যখন তুমি আমাকে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলেনা।”

সায়ন কিছুটা চুপসে যায় কথাটা শুনে। ছোট একটা তিন কামরার ফ্লাটে স্বামী,মেয়ে,শ্বশুড়-শ্বাশুড়িআর ননদকে নিয়ে থাকে পল্লবী।সম্পর্কে ইয়ারাবীর খালাতো বোন। মাষ্টার শেষ হওয়ার আগেই বিয়ের তোর জড়ে ব্যাস্ত হয়ে যায় ওর পরিবার।এতটাই ব্যাস্ত ছিলো যে ছেলের ব্যাপারে ভালো খোঁজ-খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।শুধুমাত্র এক ছেলে আর আর একতালা পাকা বাড়ি দেখে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় পল্লবীকে।প্রথম প্রথম সবকিছু ঠিক থাকলেও মাস দু’য়েক পরে বুঝতে পারে ওর কপালে সুখ খুব সীমিত।কেননা শুধুমাত্র তার স্বামীর আয় দিয়েই গোটা পরিবার চলে।তারপর তার ননদ প্রায় শ্বশুড় বাড়ি থেকে ছেলে মেয়েকে নিয়ে এই বাড়িতেই পরে থাকে।

পল্লবীর বিয়ের পরও লেখাপড়া চালিয়ে যায়।তবে যে খুব সুযোগ সুবিধা পায় তা কিন্তু নয়।বিয়ের দেড় মাস পরেই শুনতে পাওয়া যায় পল্লবী মা হতে চলেছে।সবাই খুব খুশি ছিলো।নয় মাসের মাথায় তার একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়।কথায় বলে মেয়েরা বাবার মত দেখতে হয় কিন্তু তা নয়।মেয়েটা দেখতে হুবহু তার মতো হয়েছে।মেয়ে হওয়াতে সবাই খুশি হলেও একমাত্র ব্যাক্তি খুশি হতে পারছিলোনা আর সে হলো পল্লবীর স্বামী।তবে আস্তে আস্তে সেও মন থেকে মেনে নেয়।

সায়নের সেদিনের কথা মনে পড়লে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়।মানুষ বলে শালিকাদের দেখে কীসের ভয়?কিন্তু সায়ন ইয়ারাবীকে দেখে জমের মতো ভয় পায়।তখন ইয়ারাবী কলেজে পড়তো।একদিন খুব ভোরে খবর আসে পল্লবীর পেইন উঠেছে।কিন্তু ইয়ারাবী প্রচুর টায়ার্ড থাকায় যেতে পারেনা।মিসেস ইশানি ইয়ামিলাকে নিয়ে সায়নের বাড়িতে যান।ওখানে ইশানি ছাড়াও ওনার বোনেরা ছিলো।সবাই যখন ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলছিলো তখন সায়ন বলে সামান্য ব্যাথা কিছু হবেনা।পল্লবীর শ্বাশুরি ও একই কথা বলে।ইয়ারাবী রেড ক্রিসেন্ট এর সদস্য হওয়ায় ওর ভালো চেনাজানা আছে।তাই মিসেস ইশানি ইয়ারাবীকে ফোন করে কোনো পরিচিত ডাক্তারকে পাওয়া যাবে নাকী।ইয়ারাবী সব শুনে এক সেকেন্ডও দেরী না করে ওদের বাসায় আসে।নিয়ে যাওয়ার সময় সায়ন বাধা দিলে না পেরে সকলের সামনে থাপ্পর মারে।আর যখন দেখে মেয়ে হয়েছে পল্লবীকে অনেক কথা শুনায় সায়ন।সেটা দেখে ইয়ারাবী হাসপাতালের মধ্যেই ওকে মারে।আর এটাও বলে দেয় এই মেয়ের সাথে খারাপ কিছু হলে ওর দুঃখ আছে।সেদিন থেকে ইয়ারাবীকে ও যমের মতো ভয় পায়।

ইয়ারাবীর একটাই প্রশ্ন, “মেয়েরা কী এই সমাজের বোঝা?”
আজো কিছু মানুষ আছে যারা মেয়েদের বোঝা ভাবে।অথচ তারা একবারও ভাবেনা ওরা যার পেটে জন্ম নিয়েছে সেই একজন মেয়ে।মেয়েরা মায়ের জাত,তবুও কেন তারা ভুলে যায়।

#চলবে______

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here