জীবন তরী,পর্ব:৩

0
796

#জীবন_তরী
#শেষ_পর্ব

সেখানে পৌঁছানোর পর অফিসে খোঁজ নিয়ে যা শুনলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না আমি।
আয়ান ভর্তি হওয়ার পর কয়েকদিন অনিয়মিত ভাবে ক্লাস করে তারপর আর কখনো ক্লাসে আসে নাই সে এমনকি ভর্তি বাবদ পুরো টাকাও পরিশোধ করে নাই।

এমবিএ শেষ করতে তো এক বছর সময় লাগে
আয়ান সেখানে দুই আড়াই বছর ধরে আছে এ দেশে।
বসে পড়লাম সেখানকার একটা চেয়ারে কণাও আমার পাশে বসলো। চিন্তা করতে নিষেধ করলো কণা আর প্রিন্স দুজনেই কিন্তু আয়ান তো দিনের পর দিন প্রায় দেড়বছর বাবা-র কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়েছে।

.

— কণা ও বেচে আছে তো, আমি কিছুই বুঝতেছি না কি হচ্ছে এসব৷
— নুরী, তুই অযথা টেনশন করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে,এটা ইংল্যান্ড এখানে এসে সহজে কেউ মরতে চাইবে না। উনি নিশ্চয় বেঁচে আছেন আর কি জানিস তো পড়াশোনা করতে আসলেও কেউ কেউ এদেশের কিংবা দেশের মানুষের প্রেমে পড়ে নিজের জীবনের মুল লক্ষ্য টাই ভুলে যায়।

–এখন চলতো লাঞ্চ করি সবাই মিলে আমার প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে।
— আমি খাবো না রে, তোরা খাস এখন।
এই কথা বলে উঠে দাড়ালাম, সেখান থেকে লাঞ্চ সেরে আবার ব্রিস্টল শহরে আসলাম। আমি খেতে না চাইলেও কণা আর প্রিন্স মিলে জোর করে খাওয়ালো আমায়।

কণা সহ প্রিন্স দের বাসায় আসলাম, এসে দেখি আন্টি টেবিলে খাবার সাজিয়ে বসে আছেন সবাই মিলে একসাথে খাবে জন্য।
কিন্তু আমরা সবাই তো বাইরে খেয়ে এসেছি।
আন্টি কোনো কথাই শুনলেন না আবার ওনার সাথে সবাইকে একটু করে খেতে হলো।

কণা আমাকে ওর বাসায় নিয়ে আসলো আজ, প্রিন্স দের বাসা থেকে কণার বাসার দূরত্ব খুব বেশি নয়। আন্টি আসতেই দিচ্ছিলেন না তবুও গত দুই রাতের দরজায় ঠকঠক শব্দের জন্য আর কণাকে এই মূহুর্তে বেশি ভরসা করতে পারছি বলে কণার সাথেই চলে আসলাম।

তিনজন বান্ধবী মিলে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে কণা, কণার রুমেই থাকবো আমি।
সারাদিন অনেক ছুটাছুটি করাতে আমরা দুজনেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম, বিশ্রাম যেমন তেমন গল্পের শেষ নেই আমাদের। কণা খুব চেষ্টা করছে আমার মুখে হাসি ফুটাতে। সেই স্কুল কলেজের গল্প গুলো শুনে মনে হচ্ছে ওই জীবনটাই শ্রেয় ছিলো আমার কোনো কষ্ট ছিলোনা।
আর এ কেমন জীবন পার করছি আমি নিজের নিখোঁজ স্বামীকে খুজতে বাংলাদেশ থেকে সুদূর ইংল্যান্ডে এসে পাড়ি জমিয়েছি।
আয়ানের চিন্তা আমার মাথা থেকে যাচ্ছে না কিছুতেই আর আমার এদেশে আসার একমাত্র উদ্দেশ্যই তো আয়ানকে খুঁজে বের করা।

.
সন্ধ্যার পর কণা আমায় নিয়ে বসলো সব ব্যাপারে খোলাখুলি আলোচনা করবে।
শুরুতেই আয়ানের ছবি দেখতে চাইলো কণা আমাদের বিয়ে ঘরোয়া ভাবে হলেও বিয়েতে অনেক ছবি উঠানো হয়েছিল সব কণাকে দেখালাম।
আয়ানের একার কিছু ছবি চাইলো কণা নিজের মোবাইলে আমিও দিয়ে দিলাম।

কণার সুপরিচিত কয়েকজন বাঙালি বন্ধু-বান্ধবী যারা এদেশেই থাকে বর্তমানে, তাদেরকে আয়ানের ছবি পাঠালো কেউ চিনে কিনা।
দুর্ভাগ্য কেউ চিনে না আয়ানকে।
পরেরদিন কণার বয়ফ্রেন্ড নাজিম ভাইয়া জানালো আয়ানকে সে অনেকদিন আগে তার বন্ধুর বাসায় দেখেছিলো।
কণা খুব সাবধানে এ বিষয়ে এগুতে বললো ওর বয়ফ্রেন্ড কে যাতে আয়ান আগেই ওকে খুঁজার ব্যাপারে কিছু জানতে না পারে। সেদিন আর বাইরে যাওয়া হলো না কণার ক্লাস থাকার কারনে।

.

পরেরদিন সকালে কণা আর নাজিম ভাইয়া সহ গেলাম ওনার বন্ধুর দেখা করতে।
নাজিম ভাইয়ার সাথে অনেক ভালো সম্পর্ক ওনার সেই বন্ধুর আশা করা যাচ্ছে ঠিক পথে এগুচ্ছি আমরা।

ওনার বন্ধু সব শুনে প্রথমেই আমাকে শক্ত হতে বললেন তারপর বলেন, আয়ান এমবিএ শেষ না করে সেই টাকা দিয়ে ওর বিদেশি গার্লফ্রেন্ড প্রিস্টিনার সাথে যৌথ ভাবে একটা বড় রেস্টুরেন্ট দিয়ে ব্যবসা করছে।
আর সেই মেয়েকে বিয়েও করেছে আয়ান,
এই কথা শুনে গালের দুই পাশ ভারি হয়ে গেলো মুখ থেকে একটা কথাও বের হচ্ছে না আমার মনেহচ্ছে মাথার উপর আকাশ নেই পায়ের নিচে মাটিও নেই আমি কোনো জ্বলন্ত কুন্ডলীর ভিতরে পড়ে গেছি এই মুহূর্তে। এতটা যন্ত্রণা হচ্ছে আমার ভিতর বাহিরে।
কণা আমার অবস্থা বুঝতে পেরে কাঁধে হাত রাখলো তখনি কেঁদে ফেলি আমি উচ্চস্বরে। কণাসহ সবাই আমাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিতে থাকে সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু সত্যি তো এটাই কিছুই ঠিক হবে না সেটা আমি ঠিকই উপলব্ধি করতে পারছি।

.

আমি আয়ানের সাথে দেখা করতে চাইলে নাজিম ভাইয়ার বন্ধু সেখান থেকে দেড়ঘন্টা দূরের পথ যেখানে আয়ানের রেস্টুরেন্টে ওখানে নিয়ে গেলেন।
পথে আসতে আসতে শুনলাম আয়ানকে তার বন্ধুরা অনেক নিষেধ করলেও সে পড়াশোনা বাদ দিয়ে ওই সাদা চামড়ার মেয়েটার সাথে নিজেকে আলাদা করে নেয়, বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ ও বিচ্ছিন্ন করে।

আয়ান তার নাম পাল্টিয়ে রেখেছে আলফ্রেড প্রিস্টান সেই নামের ফেসবুক আইডি তে প্রিস্টিনার সাথে অনেক কাপল ছবি দেখলাম বুকের ভিতর অনবরত কেউ জ্বলন্ত আগুনের তীর দিয়ে আঘাত করছে আমায়। কলিজাটা ফুটো হয়ে রক্ত ঝরছে মনে হয় আমার সেই সাথে চোখের পানিও।
কিভাবে এতকিছু সহ্য করবো আমি, আমার যে সবকিছু শেষ হয়ে গেলো।
ছবি গুলো আমার মোবাইলে নিয়ে রাখলাম কাজে লাগবে জন্য।

.

রেস্টুরেন্টে পৌঁছানোর পর আয়ানকে দেখতে পেলাম একটা অতিমাত্রায় ফর্সা সোনালি চুল ওয়ালা মেয়ের সাথে বসে কি যেন গল্প করছে বেশ মনোযোগ দিয়ে।

বাকীরা রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার খেলেও আমি পানি পর্যন্ত স্পর্শ করলাম না।
সবাই আমাকে আয়ানের সামনে যেতে বললে সেখানে মোবাইলের রেকর্ড অপশন টা অন করে গেলাম ওদের টেবিলের সামনে।

আয়ান আমায় দেখে প্রথমেই একটু অপ্রকৃতস্থ হলেও স্বাভাবিক হয়ে গেলো পরে।
মেয়েটি আমায় জিজ্ঞেস করলো, এনি প্রব্লেম?
আমি নো বলে আয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা না করলেও পারতেন আমার আর আপনার পরিবারের সাথে।
সরি কি জাতা বলছেন কে আপনি, মেয়েটি আয়ানের দিকে তাকালে সে বলে উঠে আই ডোন্ট নো হার বিলিভ মি।
অনেক ভালো আছি আমি আমার জীবনে কোনো সমস্যা হোক তা চাইনা এক্ষুনি চলে যাও এখান থেকে হেসে বললো কথা গুলো বোকা প্রিস্টিনা কিচ্ছুই বুঝলো না বাংলা ভাষার।
বাবা মা কে কি বলবো গিয়ে আমার কথা বাদ দিলাম বলেই আমি কাঁদতে থাকি।
আমার কেউ নেই বাংলাদেশে, কান্না বন্ধ করে চলে যাও এটা পাবলিক প্লেস সিনক্রিয়েট করো না।
প্রিস্টিনা অবাক হয়ে দেখছে তার স্বামী কার সাথে এতো কথা বলছে।
তখন কিছু টাকা বের করে আয়ান আমার হাতে দিয়ে লেডি বেগার বলে প্রিস্টিনাকে বুঝালো যে আমি বেগার।
ছুড়ে মারলাম টাকা গুলো আর চলে আসলাম সেখান থেকে।

.
পুরো রাস্তা চোখের পানি আর নাকের পানি মুছতে মুছতে কণার বাসায় আসলাম।
গোসল করে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি, প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছিলো।
রাতে আয়ান প্রিস্টিনার সব ছবি ওর রেস্টুরেন্ট এর ছবি ওদের একসাথে বসে থাকার ছবি সেই সাথে কথা গুলোর রেকর্ড সবকিছু বাবার হোয়াটসঅ্যাপ এ পাঠায় দিলাম।
সব দেখে বাবা রাগে কান্নায় আয়ানকে অভিশাপ দিতে লাগলো, ওদিকে বাবা মা কাঁদে এদিকে আমি।
আব্বু আম্মু কে এখনো কিছু জানাইনি কাল জানাবো।

এখন আমি কি করবো কণা জানতে চাইলো, কিছুই বলতে পারলাম না বাংলাদেশে আসার জন্য অস্থির হয়ে গেলাম শুধু। এদেশে আর এক সেকেন্ড ও থাকতে ইচ্ছে করছে না আমার।
আরো সাতদিন কষ্ট করে থাকার পর ইংল্যান্ডে থেকে ফিরে আসলাম বাংলাদেশে।
কণা আমায় অনেক মানসিক সাপোর্ট দিয়েছে দেশে আসার পরও প্রতিদিন কথা হয় ওর সাথে। ওর একটাই কথা পিছনে ফিরে তাকাবি না জীবনটা শুধুই তোর একার তাই নিজেকে কষ্ট দিসনা ভালো ভাবে বাঁচিয়ে রাখ নিজেকে।

.

ঢাকায় এসে কয়দিন পর ডিভোর্স পেপারে সাইন করে আয়ানদের বাড়িতে পাঠায় দিলাম।
খালা খালু দুজনেই ঢাকায় আসে আমায় ও বাড়ির মেয়ে হিসেবে নিয়ে যেতে আমি রাজি হইনি এটা কোনো ভাবেই সম্ভব ছিলো না।
কিছুদিন পর শুনলাম খালু তার সমস্ত সম্পত্তি তাদের মৃত্যুর পর দুইটা এতিমখানায় দান করে যাবার উইল করে রাখছেন।

আমার মনের কোথাও এতটুকু শান্তি নেই, পড়াশোনা ঠিক ভাবে করতে পারি না আমি।
সারাদিন ছোট ভাইবোন দুটোর সাথে কাটালেও রাতে কষ্ট এসে বুকে বাসা বাঁধে।
ধীরে ধীরে কষ্ট গুলো কমে যাচ্ছে আমার সেটা নিজেই বুঝতে পারছি আমি, আয়ান তো একটা বিশ্বাসঘাতক, মিথ্যুক, প্রতারক ওর জন্য অনেক খারাপ সময় পার করেছি আমি। জীবনে আর কখনো কোনো ছেলে মানুষ কে বিশ্বাস করবো না আমি আর বিয়েও করবো না সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

.

অনেক হয়েছে আর নয় আমাকে নিজের মতো করে বাঁচতে হবে নিজেকে ভালোবাসতে হবে অনেক বেশি তাহলেই আমি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবো।
পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করে দিলাম, কোচিং এর পরীক্ষা গুলোতে শুরুতে অনেক খারাপ ফলাফল করলেও আস্তে আস্তে ভালো করতে লাগলাম নিজের ভিতরের আত্নবিশ্বাস বাড়লো আমি পারবো কিছু করতে সত্যি পারবো।
আম্মু সবসময় আমার পাশে থেকে সাহস জোগায় মনে আমায় ভেঙে পড়তে হতাশ হতে দেয় না।

চাকরির অনেক পরীক্ষা দিয়ে ভাইভা পর্যন্ত যাওয়ার পর আর সাফল্য আসে না আমার, তবুও হাল ছাড়ি নাই এদিকে চাকরির বয়সও আর বেশি দিন বাকী নেই শেষে সোনালি ব্যাংকের অফিসার পদে যোগদান করি ঢাকার শাখায়।
গোছানো জীবন আমার এখন অনেক কিছু থেকেও যেন কিছুই নেই আমার জীবনে।

আব্বু বদলি হয়ে চট্টগ্রাম এ গিয়েছে
আমার অফিস, আম্মুর আর ছোট ভাই বোন দুটার স্কুল কলেজের জন্য ঢাকাতেই আছি আমরা।
বাসা পাল্টিয়েছি কয়েকদিন হয়, নতুন বাসায় ভালোই লাগে আমার ছাদে অনেক ফুলের গাছ আমিও কয়েকটা গাছ লাগিয়েছি টবে।
সন্ধ্যার পর ক্লান্ত শরীরে সিড়ি ভেঙে উপরে উঠছি পঞ্চম ফ্লোরে থাকা হয় আমাদের এখানে।
চতুর্থ ফ্লোরে এসে ওয়াল ধরে একটু দাড়িয়ে আছি হঠাৎ সামনে দেখি একটা ছোট্ট পিচ্চি মেয়ে সিড়িতে বসে খেলছে, মেয়েটা পরে যেতে ধরলো দ্রুত ধরে ফেলি মেয়েটাকে আর কোলে তুলে নিই।
কি সুন্দর মেয়ে গলুমলু লাল গোলাপি চেহারা, কোলে নিতেই আমার পানে এমন করে তাকাচ্ছে মনে হয় কত যুগের পরিচিত আমি তার।
আম্মু কোথায় তোমার মা, একা বাইরে বের হয়েছো কেনো তুমি আম্মু বকবে তো তোমায়।
বয়স দুই বছর হবে হয়তো অনুমান করলাম, ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না মেয়েটা চুপ করে আছে।
হঠাৎ আমার মিসক্যারেজ এর কথা মনে হলো আমার বাচ্চাটা বেঁচে থাকলেও এতো বড় হতো আজ।

.

আমার চোখ থেকে চশমা টা খুলতে চাইছে মেয়েটা আমিও খুলে দিলাম, হাতে নেওয়ার পর হাত থেকে চশমাটা ফ্লোরে পড়ে ভেঙে গেলো।
সাথে সাথে মেয়েটার গালে একটা চড় এসে পড়লো, আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম এই ভদ্রলোক তাহলে মেয়েটার বাবা চেহারায় মিল আছে অনেক।

–কি মানুষ আপনি এতো ছোট মেয়েকে কেউ এভাবে মারে?

–ও তো আপনার চশমা টা ভেঙে অপরাধ করছে ওর শাস্তি পাওয়া উচিত।
–ছোট মানুষ ও কি বুঝে ভাঙা গড়ার, তাই বলে থাপ্পড় কাজটা আপনি মোটেও ঠিক করেন নি।

মেয়েটা আমাকে জড়িয়ে এবার কেঁদে উঠলো, বুকে শক্ত করে জড়িয়ে নিলাম আমার ভিতরের মাতৃত্ব জেগে উঠলো। সকল ক্লান্তির অবসান ঘটলো আমার, কেঁদেই যাচ্ছে মেয়েটা।
আমি নিয়ে যাচ্ছি আপনার মেয়েকে উপরেই থাকি আমরা নতুন এসেছি দিয়ে যাব একটু পর উনি আর একটা কথাও বললেন না।
আমি চলে আসলাম বাসায় মেয়েটাকে নিয়ে।
মাইশা মনি এসেছে বলে আমার বোন ছুটে আসলো একটু পর আম্মুও।
–তাহলে তোমরা আগে থেকেই চিনতে একে?
–হ্যা রে নুরী আসার প্রথম দিন থেকেই ভাব হয়েছে নিসার(বোন) সাথে ওর।
— কই আমি তো জানলাম না।
— তুই বাসায় থাকিস কতক্ষণ যে জানবি।
তাও ঠিক বলছো মা তুমি।
মাইশার সাথে খুব ভাব হয়েছে আমারো, ছুটির দিনগুলো ওর সাথেই কাটে আমার এখন।
অনেক বেশি খারাপ লাগছে যখন শুনি ওর মা হঠাৎ হার্টঅ্যাটাক করে মারা গেছে ওর জন্মের পর পরেই।

.

আম্মু এখন প্রায় বিয়ের কথা বলে, আমি রাগ হয়ে না করে দিই যদিও দিন শেষে আমি সম্পূর্ণ একা, নিঃসঙ্গ।
আম্মুর আব্বু আছে, ছোট ভাই বোন দুটা ওদের স্কুল কলেজ নিয়ে ব্যস্ত ওদেরো জীবন সঙ্গী হবে উপযুক্ত সময়ে।
কিন্তু আমি সত্যি অনেক একা, একজন আপন মানুষের বড়োই অভাব আমার যে মানুষটা হবে শুধুই আমার।
আমার এ মন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তাই ভালোবাসা ভালোলাগা উঁকিও দেয় না এ মনে আর। বিশ্বাস করতে পারবো না আমি আর কাউকেই।

মাইশার বাবা-র উপর আমার প্রায় রাগ উঠে যখন শুনি উনি মাইশা কে মেরেছে আবারও।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মাইশার বাবা তবুও ওনার এতো বদমেজাজ এতটুকু মেয়ের উপর শুনছিলাম বাংলার শিক্ষকরা অনেক রসিক মনের মানুষ হন।
কিন্তু মাইশার বাবা আলাদা সবসময় মুখ গোমড়া করে থাকেন, যতবার কথা হয়েছে ততবারই একি অবস্থা কখনো হাসে না মনে হয় উনি।
আমার আসার সময় মাইশা ওদের দরজা খুলে কখনো দাড়িয়ে কখনো বা বসে থাকে চেয়ারে আমি কোলে তুলে নিয়ে আসি ওকে।
ফুপি বলতে পারে না ফুমা বলে ডাকে মাইশা আমায়, এই ডাকটা কলিজায় গিয়ে লাগে আমার।

.

মামা অসুস্থ আম্মু নিসা সহ মামাকে দেখতে গেছে ফিরতে সময় লাগবে কয়েকদিন অনেক দূরের পথ।
আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে হঠাৎ করে আমার আর ছোট ভাই নুর এর প্রচন্ড জ্বর আসে।
মাইশা এসে ডেকে গেছে অনেকক্ষণ আগে এতটাই অসুস্থ যে দরজা খুলে দিতে পর্যন্ত পারি নাই।
নুর ঔষধ খেয়ে শুধুই ঘুমাচ্ছে কিন্তু আমার জ্বর আসলে দুই চোখের পাতা এক করতে পারি না ঘুম আসেই না আমার তখন, আম্মু টেনশন করবে বলে জানাইনি আমরা অসুস্থ।

এবার কলিং বেল বেজে উঠলো মাইশা ফুমা ফুমা বলে চিৎকার করছে জোরে জোরে।
মাথা খুব ভারি হয়ে আছে, শরীরে কোনো শক্তি নেই কিচ্ছু খেতে পারি নাই কাল থেকে।
তারউপর ঘন ঘন বমি করেছি, শরীরে ব্যাথাও আছে মাথাও ঘুরছে।
অনেক কষ্ট করে দরজাটা খুলে দিলাম, মাইশা দাড়িয়ে আছে ওর বাবা সহ ওদের এক পলক দেখেই মাথা ঘুরে পড়ে যেতে ধরলে মাইশার বাবা ধরেন আমায়।
কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলেন আমায় কপালে হাত দিয়ে দেখে বললেন জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে আপনার।
ওনার কথা কান দিয়ে শুনছি কিন্তু আমি যেন পড়ে আছি ওনার কোলেই এমন অনুভূতি প্রথম কাজ করলো আমার ভিতর, জ্বরেও সারা শরীর ও মন কেঁপে উঠছিলো তখন। জল পট্টি দিয়ে দিলেন কপালে অনেকক্ষণ আমার আর নুরের তিনি।

.

সে রাতে মাইশার বাবা জেগে ছিলেন আমার সাথে বিছানার পাশের চেয়ারে বসে আর নুর,মাইশা ঘুমাচ্ছিলো আমার পাশে।
আমি বার বার ওনাকে বাসায় গিয়ে ঘুমাতে বললেও আমার কোনো কথা শুনলেন না তিনি এই অসুস্থ দুটো মানুষকে ছেড়ে যেতে পারবেন না কিছুতেই।
শেষ রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, সকালে সুজি রান্না করে জোর করে খাওয়ালেন তিনি তিনজনকেই।
আমি হঠাৎ বমি করলে সেই বমি নিজেই পরিস্কার করলেন তিনি নিষেধ করার পরও, এবার খুব লজ্জায় পড়ে গেলাম আমি।
ওনার আচরণে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি আমি এতটা দায়িত্বশীল মানুষ তিনি।
পুরোপুরি সুস্থ হতে আরো তিনদিন সময় লাগলো প্রতি দিন খোঁজ নিতেন মাইশা সহ এসে সেই সাথে খাবার রান্না করে নিয়ে আসতেন। রান্নার হাত বেশ ভালো ওনার ছেলে মানুষ হলেও। ভালো একটা বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়েছে ওনার সাথে আমার।

আজ আম্মু আর নিসা এসে সব শুনে আমাকে বকতে লাগলো ওদের খবর দেই নাই কেনো তাই।

.

একটা জিনিস স্পষ্ট বুঝতে পারছি মাইশার প্রতি আমার অনেক মায়া ভালোবাসা সেই মায়া তার বাবার প্রতিও সৃষ্টি হতে শুরু করেছে দিনের পর দিন ওনাকে যত দেখছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি।
ওনার সাথে ভালো বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়েছে আমার, আর আমি ওনাকে পছন্দ করতে শুরু করেছি। ছি ছি এসব কি ভাবছি আমি।
মাইশার কাছে আসা মানে ওর বাবারও কাছে আসা কিভাবে যে মুক্তি পাবো এই বেড়াজাল থেকে।
শেষ পর্যন্ত ওদের কিছু না জানিয়ে বাসা চেঞ্জ করলাম, নতুন বাসায় মন টিকছে না আমার মাইশাকে খুব মিস করছি সেই সাথে ওর বাবাকেও তবে হালকা।
মাইশার বাবার মনে হয়তো এসব কিছু নেই বন্ধুত্ব ছাড়া আর আমি অযথা মাঝখান থেকে ওনার প্রেমে পড়তেছিলাম।

আজকের ছুটির দিনটা কাটতেই চাচ্ছে না আমার, বিষন্ন মনে বেলকনির গ্রিল ধরে বাইরের বড় বড় অট্টালিকা দেখছিলাম।
হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো খুলে দিবে এখন কেউ বাসার। একমনে তাকিয়েই আছি হঠাৎ মনে পড়লো সবাই বাইরে গেছে আমি একাই বাড়িতে।
ওরা ফিরলো নাকি দ্রুত পায়ে হেঁটে দরজা খুলে দিলাম, মাইশা কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর বাবা।

.

আমি কিছু বলার আগেই মাইশা আমায় মা বলে ডাকলো, কোলে তুলে নিলাম ওকে।
— আমার মেয়েটার মা হিসেবে আপনাকেই প্রয়োজন ও আপনাকে অনেক ভালোবাসে সেই সাথে ওর বাবাও, দূরে চলে আসার পর ভালো ভাবে বুঝতে পারলাম সেটা। আর আমার তো অনেক সময় সারাজীবন আপনাকে রান্না করে খাওয়ানোর দায়িত্বটাও নিতে চাই।
উনি হাত বাড়ালে মাইশাকে কোলে নিয়েই ওর বাবার বুকে মাথা রাখলাম।

.
তিন বছর পার হলো বিয়ের তিনদিনো ঝগড়া হয়নি আমাদের। অনেক সুখে আছি আমরা, অতীতের কোনো পিছুটান নেই আমার আর ভুলেও কখনো কিছু মনে পড়ে না আমার।
বিয়ের একবছর পর আমাদের ছেলেটা হওয়াতে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছি আমি ওসব অতীতের কথা ভাবার সময় নেই আমার তারউপর অফিসে যেতে হয় প্রমোশন ও হয়েছে আমার।

ছেলে মেয়েকে নিয়ে ওদের বাবা ছাঁদে গেছে।
টিভি দেখছিলাম চ্যানেল চেঞ্জ করতে গিয়ে চোখ আটকে গেলো।

“ইংল্যান্ডে এক বাংলাদেশীর আত্মহত্যা, বিদেশি বউ এর প্রতারণার স্বীকার হয়েছিলেন সেই ব্যক্তি অনেকদিন জেলেও কাটিয়েছেন অজানা কোনো অপরাধে।
বুকের ভিতর টা কেমন করে উঠলো চোখের কোনে পানি জমলো টিভি বন্ধ করে শুয়ে আছি।
ছেলে এসে মা বলে ডাকতেই সব ভুলে ছুটলাম ওদের সাথে।

(সমাপ্ত)

লেখা: হাবিবা হাওয়া
(ভুল ক্রটি মার্জনীয়)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here