জীবন তরী,পর্ব:২

0
660

#জীবন_তরী

#২য়_পর্ব

এতো রক্ত কোথা থেকে আসছে, আমার কি পা কেটে গেছে নাকি কই নাতো পা কাটলে তো কাটা জায়গায় কষ্ট লাগতো আমার। ব্যাথা অনুভব করছি পেটে ভাবতে পারি নাই এভাবে রক্তক্ষরণ শুরু হবে আমার।
আমি যেখানে দাড়িয়ে আছি মুহূর্তের মধ্যে সেই জায়গাটায় রক্তের ছড়াছড়ি হয়ে গেছে , মা-বাবা বলে চিৎকার দিয়ে আয়নার পাশে রাখা চেয়ার টাতে বসতে গিয়ে রক্তের উপর পিছলে পড়ে ফ্লোরেই পড়ে আছি। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।

.

চোখ খুলে দেখি আমি একটা ক্লিনিক এর বেডে শুয়ে আছি। আম্মু-আব্বু, বাবা-মা সবাইকে চিন্তিত দেখা যাচ্ছে তাদের মুখে একটা ভয় আর হতাশার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পারছি আমি।
আমাকে চোখ খুলতে দেখে সবাই আমার কাছে চলে আসলো দ্রুত।

আমার বাচ্চাটা সুস্থ আছে তো মা?
আম্মু আর মা আঁচলে চোখ মুছাতে বুঝে গেলাম আমাদের অনাগত সন্তান টি পৃথিবীতে আসতে চেয়েও আসতে পারলো না। মিসক্যারেজ হয়ে গেছে আমার বাচ্চাটা।
আমি একমাত্র আমি তাকে আসতে বাধা দিলাম, আমি নিজে হত্যা করলাম নিজের পেটের সন্তান কে।
জোরে জোরে কেঁদে এসব কথা বলছি, সবাই আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
আমার কান্না থামছে না, দুই হাতেই ক্যানুলা পরানো আমার একহাতে ব্লাড অন্য হাত দিয়ে স্যালাইন যাচ্ছে।

.

এখন আয়ানের কথা মনে হলো আমার, কি জবাব দিবো আমি আয়ান কে যে আমি তোমার সন্তানকে মেরে ফেলেছি। এই মুহূর্তে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে আয়ানের সাথে, কিন্তু এখন ওর সাথে কথা বললেই তো আমি কান্নায় ভেঙে পড়বো সেটা কি ও সহ্য করতে পারবে। কথা না বলে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম থেকে উঠে শুনলাম এই দূঃসংবাদ আয়ান শুনেছে।
মায়ের হাত ধরে বললাম মা আমি আপনার ছেলের সাথে কথা বলবো।
একটু পর আয়ান এর সাথে কথা বলার সুযোগ হলো।
বেশ স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছে সে, মনেহয় কিছুই হয়নি। আমি কাঁদছিলাম নূন্যতম সান্ত্বনা পর্যন্ত দিলো না আমায় এতো বড় ক্ষতি হলো আমাদের তবুও।

আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না মা’কে মোবাইলটা দিলাম মা কথা বললো আয়ান এর সাথে।

.

পরদিন সকালে ক্লিনিক থেকে বাসায় ফিরে আসলাম সবাই। আয়নার সামনে যেতেই ভিতর টা কষ্টে হুহু করে উঠলো আমার, এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে নেই আমার জীবনের আর কিচ্ছু বাকী নেই সবকিছু শেষ ধ্বংস হয়ে গেছে আমার।
মাতৃত্বের স্বাদ যেন পেয়েও হারালাম আমি।

সবাই বলছে আল্লাহ যা করেন মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন তাই আমি যেন এতো দুশ্চিন্তা না করি।
আস্তে আস্তে সন্তান হারানোর কষ্ট কমে যাচ্ছে আমার।
আয়ানের সাথে ভালোই কথা হয় ইদানীং, ওর থেকে অনেক সাপোর্ট পেয়েছি এ ব্যাপারে।
আসলে এতো তাড়াতাড়ি আয়ান সন্তান চায় নি, তাছাড়া আমার একটা ক্যারিয়ার আছে এখন সন্তান হলে সব শেষ হয়ে যেত আমার এভাবে বুঝায় আয়ান আমায়। কিন্তু মায়ের মন, নিরবে চোখের পানি ঠিকই পরে আমার।

.

মাস্টার্স এ ভর্তি হয়েছি কয়দিন হয়, কিন্তু পড়াশোনার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই এখন আমার।
অপেক্ষায় থাকি আয়ান কবে আসবে সেই সময়ের, ওকে আসার কথা বললেই এড়িয়ে যায় বিষয়টা।

আয়ান এখন আবার আমার সাথে কথা বলার অনিয়ম শুরু করেছে, চার/পাঁচ দিন পর একবার কথা বলে এর মধ্যে আমি হাজার কল কিংবা এসএমএস দিলেও তার কোনো রেসপন্স পাইনা।
এমনিতেই মন খারাপ তারউপর আয়ানের এমন আচরণে আরো খারাপ লাগে আমার।
ঢাকায় আছি মাস্টার্স এ ভর্তি হওয়ার পর থেকে, ছোট ভাই বোন দুটার সাথে ভালোই সময় কেটে যাচ্ছে। কিন্তু আমার মস্তিষ্কের সিংহভাগ স্থান সবসময় আয়ান আয়ান করে।

.

অনেকদিন কেটে গেছে আয়ানের সাথে সম্পর্ক টা খুব খারাপ হয়ে গেছে আমার, ভালো ভাবে কথা বলে না। আমি একদিন ওর বিদেশি কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা তাই বলে ঠাট্টা করছিলাম তারপর থেকে সে’কি খারাপ ব্যবহার আমার সাথে।
আমিও হাঁপিয়ে উঠেছি ভালো লাগে না আর এতো অপমান আর কথার খোঁটা।
নিজের পড়াশোনা টা মনোযোগ দিয়ে করছি এখন, পড়াশোনার তাগিদে এখন ঢাকায় আমাদের বাড়িতে আছি।

আজ তেত্রিশ দিন হয় আয়ানের সাথে কথা হয়না আমার, শেষ বার খুব ভালো ভাবে কথা বলেছিলো আমার সাথে ও, ক্ষমাও চেয়েছিলো নিজের অতীত আচরণের জন্য।
অনেক বেশি খুশি হয়েছিলাম সেদিন আমি, ভেবেছিলাম এবার আয়ান কে নিজের করে পাবো শুধু ও দেশে ফেরার অপেক্ষায় কিন্তু তারপর আর কোনো কথা হলো না মানুষটার সাথে আমার।
মায়ের সাথেও যোগাযোগ নেই ওর অনেকদিন হয়, ফেসবুক, ইমো,হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, ফোন নাম্বার সবকিছু বন্ধ কোথাও নেই ও।
আমার দুশ্চিন্তার শেষ নেই, আচ্ছা ওর যদি মোবাইল হারাইতো তাহলেওতো কোনো সমস্যা ছিলো না নিজস্ব ল্যাপটপ থেকে যোগাযোগ করতো আমাদের সাথে।
নাকি কোনো ছিনতাইকারীরা মেরে ফেললো ওকে, তওবা তওবা এসব কি ভাবছি আমি।

.

শ্বশুর বাড়িতে চলে এসেছি আমি, সবাই আয়ানের ব্যাপারে অনেক চিন্তিত।
ওর কাছের সব বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে কেউ যদি ওর কথা জানে তাই, না কেউ জানেনা ওর সম্পর্কে কিছুই।
মা অনেক ভেঙে পড়েছেন আর আমি তো চিন্তায় ঠিকভাবে নাওয়াখাওয়া পর্যন্ত করতে পারি না।
এভাবে আরো অনেক দিন কেটে যায়, হাজার চেষ্টা করেও ওর খোঁজ পাই নাই আমরা।
আমার মাস্টার্স পরীক্ষা শুরু হয়েছে, বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমাকে ইংল্যান্ডে পাঠাবেন ছেলের খোঁজে পরীক্ষা শেষ হলেই।

কিন্তু আমার স্টুডেন্ট ভিসা নেই তাই সমস্যা হচ্ছে পাসপোর্ট আর ভিসা পেতে, সহজে তো আর ওই দেশে কেউ প্রবেশ করতে পারে না।
আব্বু বিমানবাহিনীর সহকারী মেডিকেল সার্জেন্ট হওয়ার সুবাদে সুপারিশ করে আর বাবার বন্ধু জনাব খালেকুজ্জামান এর সহযোগিতায় সে দেশে যাওয়ার সুযোগ হলো আমার।

.

পরীক্ষা শেষে পারি দিলাম ইংল্যান্ডের পথে, সেখানে পৌঁছে ব্রিস্টল শহরে বাবা-র সেই ডাক্তার বন্ধু খালেকুজ্জামান আংকেল এর বাসায় উঠলাম আমি।
আংকেল আন্টি আর ওনাদের এক ছেলে সহ এ বাসায় থাকেন, আন্টি অনেক আন্তরিক ভাবে কথা বলছেন আমার সাথে।
দেশ থেকে যে কেউ আসলে এনারা অনেক বেশি খুশি হয় কথা বলে বুঝলাম , আরো বেশি খুশি হয় যদি দেশের মানুষের কোনো উপকার করতে পারে এদেশের মাটিতে থেকে।
আংকেল আন্টি আয়ানের ব্যাপারে সব শুনে মৌখিক ভাবে দুঃখ প্রকাশ করলো।
রাতে আমার থাকার ব্যবস্থা হলো আন্টিদের পাশের রুমটাতে, একলা থাকতে ভয় পাবো কিনা সেটাও জেনে নিলেন আন্টি আমার কাছে।
বাংলাদেশ থেকে সবাই খোঁজ নিচ্ছেন আমার
ঠিকভাবে পৌঁছাতে পারছি কিনা, কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাকি আমার এখানে আর আয়ানের খোঁজ পেলেই যেনো জানাই তাদের ।

সব ঠিক আছে তবুও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না আমার, এনাদের ছেলেটার দৃষ্টি একটু কেমন যেন ভালো ঠেকছে না আমার কাছে।
অচেনা জায়গায় ঘুম আসে না আমার বিছানার এপাশ ওপাশ করছি শুধু, শরীরটাও একটু ক্লান্ত।
হঠাৎ রুমের দরজায় কে যেন কড়া নাড়লো আস্তে আস্তে আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলাম কে আন্টি এসেছেন।
কিন্তু কোনো কথার জবাব পেলাম না, কিছুক্ষণ পর আবারো একই ভাবে কড়া নাড়লো দরজায়।
এবার আমার ভয় হচ্ছে আন্টির ছেলেটা নয় তো। দোয়া পড়তে শুরু করলাম ভয়ে তারপর কখন ঘুমিয়েছি মনে নেই।

ঘুম থেকে উঠলাম সকাল দশটার পর, রাতের কথা আন্টিকে বলতে গিয়েও বললাম না কি-নাকি ভাববেন তাই।
সেদিন আর কোথাও বের হলাম না বাসায় বসে শুয়ে কাটালাম, পরদিন রাতেও একই কান্ড ঘটলো এবার অনেক বেশি ভয় পেলাম কে এভাবে মধ্যরাতে দরজার কড়া নাড়বে। কাল সকালেই আন্টিকে ব্যাপারটা জানাবো ঠিক করলাম।

.

সকালে উঠেই আন্টি আমাকে তৈরি হতে বললেন ওনার ছেলে প্রিন্স এর সাথে ঘুরতে যাব বাইরে, আমি রাজি ছিলাম না পরে ভাবলাম একটু ঘুরেই আসি বাইরে থেকে বাসার ভিতর থেকে থেকে বোর লাগছে।
এই সময় ছেলেটার সাথে আয়ানের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করবো সে যদি কোনো সাহায্য করতে পারে আমায়।

ছেলেটা আমার থেকে বয়সে ছোটই হবে, তার নিজস্ব গাড়ি আছে। আমি গাড়ির পিছনে বসলে প্রিন্স বলে,
আপু সামনে এসে বসেন কোনো সমস্যা নেই, আমাকে আপনার ছোট ভাই মনে করবেন।
না আমি এখানেই ঠিক আছি বলে পরে কি ভেবে যেন গাড়ির গিয়ে সামনে বসলাম।

.

প্রথমে যাব ইউনিভার্সিটি অফ দ্যা ওয়েস্ট অফ ইংল্যান্ড যেটা ব্রিস্টল শহরেই অবস্থিত আর প্রিন্স সেখানেই এলএলএম করছে।
রাতে প্রিন্স ফাজলামো করে আমি যে রুমে ছিলাম তার দরজার কড়া নেড়ে আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছিলো কিনা তা জিজ্ঞেস করলাম।
আমার কথা শুনে প্রিন্স হো হো করে হেসে উঠলো, মা আপনাকে তাহলে কিছু বলে নাই এ ব্যাপারে আব্বুর ঘুমের ঘোরে হাঁটার অভ্যাস আছে সেই সাথে দরজার কড়া নাড়ারো, এই জন্য ঘুমের সমস্যা হয় আমার খুব তাইতো আমি আমার রুম চেঞ্জ করছি আগে আব্বু আর মা’য়ের পাশের রুমটা আমার ছিলো, মধ্য রাতে আব্বুর অত্যাচারে নিজের রুমটাই ছেড়ে দিয়েছি।
এবার থেকে এমন হলে ভয় পাবেন না, দুই /তিনবার কড়া নেড়ে চলে যাবে আব্বু।
প্রিন্স এর কথা শুনে আপাতত ভয় টা কেটে যায় আমার। কয়েকমিনিটের ভিতরে আমরা ওর ভার্সিটিতে পৌঁছালাম।
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে প্রিন্স ওর ক্যাম্পাসের সবকিছু আমায় এখানে বাংলাদেশ থেকেও অনেকে পড়তে আসে সেটা আগে থেকে জানতাম আমি।

.

হঠাৎ চমকে উঠি কে যেন আমার চোখ দুটো বন্ধ করে ধরে তার দুহাত দিয়ে, কে চিনবে আমায় এই অচেনা দেশে ভেবে পাচ্ছি না। এ হাত তো আয়ানের নয় অনেক নরম হাত কোনো মেয়ের হবে হয়তো, আয়ানের স্পর্শ আমার অনেক চেনা তা কখনো ভুলবো না আমি।
চোখ মুখ থেকে হাত সরিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো আমার স্কুল-কলেজের বান্ধবী কণা।

নুরী তুই এদেশে হঠাৎ, একটুও বদলাসনি তুই আগের মতোই আছিস মনে হচ্ছে আগের থেকে শুকিয়ে গেছিস অনেকটা কথাগুলো কণা বললো প্রায় এক নিশ্বাসে।

জড়িয়ে ধরলাম দুই বান্ধবী দুজনকে, এইচএসসি পরীক্ষার পর আর যোগাযোগ হয়নি কণার সাথে আমার।

কথা বলে জানতে পারলাম গত বছর এলএলএম করার জন্য ইংল্যান্ডে এসেছে কণা এই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে সে।

হঠাৎ আমার ইংল্যান্ডে আসার কারন জানতে চাইলে আয়ানের সমস্ত কথা খুলে বলি কণা কে, পাশে প্রিন্সও সব শুনলো।
কণা আমাকে চিন্তা করতে নিষেধ করে বললো সে আমায় আয়ানকে খুঁজতে পুরোপুরি সাহায্য করবে।
তার আগে জানতে হবে সে কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করছে।
বললাম কার্ডিফ মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি থেকে।
আমরা তাহলে আজকেই সেখানে যাব এখান থেকে প্রায় চুয়াল্লিশ কিলোমিটার দূরে সেই ক্যাম্পাস যেতে পঞ্চাশ মিনিট লাগবে গাড়িতে , প্রিন্স ও তৈরি আমাদের সেখানে নিয়ে যেতে তিনজন মিলে গাড়ি করে রওনা দিলাম।
একান্ন মিনিট পর সেখানে পৌঁছালাম আমরা।

চলবে,,,

লেখা :হাবিবা হাওয়া

(ভুল ক্রটি মার্জনীয়)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here