জীবন তরী,পর্ব:১

0
999

বাসায় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি একটা চাকরি না পাওয়া
পর্যন্ত বিয়ে করবো না আমি।
কেবল আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো
তাতেই বিয়ে’র কথা তুলছেন আম্মু। আম্মু নিজেই একজন স্কুলের শিক্ষিকা হয়ে কিভাবে তার বেকার মেয়ে কে বিয়ে দেবার চিন্তা করছে।

আমি দেখতে খুব বেশি একটা সুন্দর নই ময়লা গায়ের
রঙ কেউ কেউ বলে শ্যাম বর্ণের মেয়ে তবে বেশ লম্বা উচ্চতায়।
তাইতো আগে একটা ভালো চাকরি করতে চাই যাতে বিয়ের পর কেউ মুখের উপর আমার গায়ের রঙ চাপা সে কথা বলতে না পারে।

.

পরীক্ষা শেষ বাসায় অবসরে কাটলো কয়দিন ভাবছি একটা জবের কোচিং সেন্টারে ভর্তি হবো। এমন সময় খবর আসলো আমার বড় খালা খুব অসুস্থ ওনাকে ঢাকার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।

বড় খালার কথা শুনেই ওনার একমাত্র ছেলে আয়ান ভাইয়া কে খুব মনে পড়ছে এখন যদিও রোজ ঘুমাই আয়ান ভাইয়ার কথা ভাবতে ভাবতে আর ঘুম থেকে উঠার পরও ওনার কথা সর্বপ্রথম মনে হয় আমার।

আম্মু সহ গেলাম হাসপাতালে, খালার অবস্থা বেশ খারাপ। প্রথম পর্যায়ের ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে ওনার, কাউকে চিনতে পারছে না আপাতত। পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগবে, চার/পাঁচ দিন আমি হাসপাতালেই থাকলাম খালার পাশে। মানুষ চিনলেও স্পষ্ট ভাবে কথা বলতে পারেন না তিনি।

.

বারবার ওনার ছেলে আয়ান এর কথা বলছে, আয়ান ভাইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করে ইংল্যান্ডে গেছেন একবছর আগে সেখান থেকেও এমবিএ শেষ করতে।
এ বছর তার দেশে আসবার কথা, খালা অসুস্থ তিনি দ্রুত চলে আসবেন দেশে কিন্তু পরীক্ষার জন্য আসতে পারছেন না।
পরীক্ষা গুলো শেষ হলেই চলে আসবেন বেশিদিন বাকী নেই আর পরীক্ষা শেষ হতে, খালুর কাছে বিস্তারিত শুনলাম।

.
আয়ান ভাইয়া’র কথা মনে হলেই আমার বুকের ভিতর বিদ্যুৎ চমকায় থেকে থেকে, আমি যে ছোট বেলা থেকেই পছন্দ করি ওনাকে। সাহস করে একবার বলেওছিলাম যে আমি আপনাকে পছন্দ করি অনেক।
প্রতিত্তোরে উনি মাথায় একটা টোকা মেরে বলেছিলেন তুই আমার বোন এসব আজেবাজে চিন্তা ভুলেও মনে আনবি না আর মুখে তো দুরের কথা।
তবুও ভুলতে পারি নাই ওনাকে প্রায় স্বপ্নে দেখি ভাইয়াকে, একনজর দেখার জন্য আমি একাই দৌড়ে সাগর পাড়ি দিচ্ছি কিংবা মরুভূমির উত্তপ্ত বালিতে ছোটাছুটি করছি তবুও ওনার দেখা পাই না।

ডাক্তার নিয়মিত নির্ধারিত সময়ে প্রেসক্রিপশনের লিখিত ঔষধ গুলো খাওয়াতে বলেছেন খালাকে। পর্যাপ্ত সেবা’য় সুস্থ হয়ে উঠবেন তিনি এ যাত্রায় সে কথাও বলে দিয়েছে ডাক্তার।

খালা আর খালু ছাড়া ওনাদের বাসায় অন্য কেউ নেই ভাইয়াও তো ইংল্যান্ডে। ফ্রি আছি আমি তাই খালার দেখাশোনা করার জন্য আমি ঢাকা থেকে চুয়াডাঙ্গা গেলাম ওনাদের সাথে।
বাসার আসার পর তাড়াতাড়ি খালা সুস্থ হয়ে উঠেন।
আয়ান ভাইয়া রোজ দুবার করে ভিডিও কলে কথা বলে খালার সাথে, বেশির ভাগ সময় খালা আমার কথাই বলে ছেলেকে, আমি না থাকলে নাকি উনি মরেই যেতো এটাসেটা।

কথা বলার সময় ডেকে ডেকে আমাকে মোবাইলের সামনে এনে ভাইয়াকে দেখায়, আমার সাথে দুই একটা কথা বলে ভাইয়া আবার খালার সাথে কথা বলেন।

.

ভাইয়ার রুমে গিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেই আমি বেশ ভালো লাগে তখন প্রিয় মানুষের বাসস্থান বলে কথা।

দেখতে দেখতে প্রায় একমাস হতে চললো খালার বাসায় আছি, আয়ান ভাইয়া এসেছে কাল। আমি লজ্জায় ওনার সামনে দাঁড়াতে পারছি না।
আড়াল থেকে শুনেছিলাম খালা-খালু বলছিলো আমাকে পুত্রবধূ হিসেবে এ বাড়িতে রেখে দিবেন ওনারা। কথা গুলো শুনেই আমার শ্যামা মুখটা মনে হয় লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল।
সেদিন থেকে আয়ান ভাইয়া কে নিয়ে আরো বেশি ভাবনা শুরু হয়েছে আমার।

.

আয়ান ভাইয়া আমাকে যথেষ্ট এড়িয়ে চলেন।
কয়দিন পর আম্মু-আব্বু আমার ছোট ভাই-বোন সবাই খালার বাসায় আসলো।
আয়ান ভাইয়া কে আমায় বিয়ে করার কথা বললে উনি অনেক রাগ করে বলেন নুরী আমার বোনের মতো ওকে বিয়ে করতে পারবো না আমি। ওইদিন রাতে খুব কষ্ট পাই আমি স্বপ্ন ভাঙার ফলে।
খালাও ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নন, ভাইয়ার সামনে কেঁদে কেঁদে অসুস্থতার দোহাই দিয়ে শেষ পর্যন্ত ঘরোয়া ভাবে আমাদের বিয়েটা দিয়েই দিলেন।

.

আয়ান হয়তো বাধ্য হয়ে নিজের অমতে এ বিয়ে করছে তাই বিয়ের পর আমাকে মেনে নিলো না। কিন্তু সবার সামনে অভিনয় করতো বেশ ভালোই।
মন থেকে আমায় গ্রহণ না করলেও শরীরের জন্য কাছে টেনে নিতেন রোজ রাতে।

ওর প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা আমার, তাই হয়তো স্ত্রীর কোনো অধিকার না পেয়েও নিজেকে জড়বস্তুর মতো সঁপে দিই তার কাছে।
সারাদিন ভালোভাবে কথা বলে না আমার সাথে কোনো প্রয়োজন ব্যতীত।
আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে বসে আল্লাহর কাছে ওনাকে আপন করে ভিক্ষা চাই ওনার মঙ্গল কামনা করি।

.
বাবা-মা’র সামনে বেশ ভালো মানুষ হয়ে থাকেন কিন্তু আমায় একলা পেলেই আকার ইঙ্গিত এ বুঝিয়ে দেন আমি ওনার যোগ্য নই।সে অতিমাত্রায় ফর্সা আমার থেকে, আরো অনেক ভালো মেয়ে বিয়ে করতে পারতো ও চাইলে শুধুমাত্র অসুস্থ মায়ের জন্য বিপাকে পড়ে এ বিয়ে করেছে।
আমি বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকি, ঠিকভাবে বুঝলেই তো কষ্ট পাবো আমি তারচেয়ে অবুঝ এই থাকি।
তবুও দিনশেষে রাতে হাজারো প্রশ্ন মাথায় উঁকি দেয়। যে আমি জীবনের লক্ষ্যে না পৌঁছানোর আগে বিয়ে করবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, পছন্দের মানুষ কে পেয়ে কিছু না ভেবেই বিয়েটা করে ফেললাম।
হুট করে আয়ানকে বিয়েটা করে কি ঠিক করলাম আমি।

.

সে তো আমাকে কোনো সময় দেয়না বাইরে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ব্যস্ত, পথ চেয়ে বসে থাকি কখন আসবে কখন তাঁর মুখখানা দেখতে পাবো আবার।
বাসায় আসলে তাঁর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতে হাতে দিই আমি সেটাও নিষেধ করে দিলো আজ।
নিজের কাজ নিজেই করতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে এই বলে, আর আমি যেন সবসময় ওর পাশে ঘুরঘুর না করি। মুখটা অন্ধকার হয়ে গেছে আমার এ কথা শুনে, বুকের ভিতর এক অজানা ব্যাথার সৃষ্টি হলো।

অনেক চেষ্টা করছি ওর মনে একটু জায়গা করে নেওয়ার জন্য কিন্তু পারিনি আমি। কাউকে আমাদের বৈবাহিক সম্পর্কের গোপন কথা গুলো বলতে মন সায় দেয় নাই আমার। আম্মু সবসময় বলে মা তুই ভালো আছিস তো, আমি প্রত্যেক সময় বলি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আমি মা।

আয়ান আর কয়েকদিন আছে দেশে তারপর চলে যাবে আরো ছয় মাসের জন্য ইংল্যান্ডে।
এই কথা মনে হতেই চোখ ভিজে যায় আমার। খুব চেষ্টা করছি একয়দিন ওকে আপন করে পেতে, সম্পর্ক টাও আগের থেকে একটু ভালো হলো বেশ কথাও বললেন আমার সাথে কিন্তু কথার ভিতর থেকে সেই বিরক্তি ভাবটা গেলো না।
পরিপূর্ণ ভাবে আপন করে পেলাম না ওনাকে চলে গেলেন নিজের অসমাপ্ত এমবিএ শেষ করতে।
যাবার সময় মায়ের (শ্বাশুড়ি) খেয়াল রাখতে আর মন দিয়ে পড়াশোনা করতে বলে গেলেন।
আমি সেটাই করবো মনোযোগ দিয়ে মনস্থির করলাম।

.

ভেবেছিলাম দুরে গেলে হয়তো সম্পর্ক টা ভালো হবে, কিন্তু বারবার আমাকেই নিজে থেকে ওর খোঁজ খবর নিতে হয়। কিছু বললে পড়ালেখার অজুহাত তার তৈরি থাকে। আমিও আর অহেতুক কথা বাড়াই না, ও যা বলে তাই মেনে নিই।
ওর সাথে ভিডিও কলে কথা বলার জন্য আমি কাঙ্গালিনী হয়ে থাকি কিন্তু ভিডিও কলে কথা বলা ওর নাকি পছন্দ নয়। সেটাও মেনে নিয়েছি আমি, অথচ মায়ের সাথে ঠিকই ভিডিও কলে কথা বলে ও।
মনের ভিতর প্রশ্ন আসলেও পাত্তা দেইনা আমি।

আয়ান চলে গেছে প্রায় একমাস হয়, আজ আমি পৃথিবীর সবথেকে বেশি খুশি।
কারণ আমি যে মা হতে চলেছি, এবার নিশ্চয় আয়ান তার সন্তানের জন্য আমায় আপন করে নিবে। এমন অনেক গল্প শুনেছি বাচ্চা হওয়ার পর বদলে যায় পিতা ভালো হয়ে যায় পুরোপুরি।
আল্লাহর কাছে দোয়া করি আমার আয়ানও যেন এমনটাই হয়।
সন্ধ্যার পর আয়ানের সাথে কথা বলার সিডিউল আছে, তখন এই খুশির সংবাদ টা জানাবো ওকে।
এখন ও ঘুমিয়ে আছে ডিসটার্ব করা উচিত হবে না কিন্তু আমার মন মানছে না, এই সুখবর ওকে না দিয়ে শান্তিতে নিশ্বাস ও নিতে পারছি না আমি এখন।
সবাই অনেক খুশি আমি অন্তঃসত্ত্বা এই কথা শুনে, আম্মু কাল সকালেই চলে আসবে আমার কাছে।
কিন্তু আমি মিস করছি ওকে খুব বেশি মিস করছি, অনেক অপেক্ষার পর ওর সাথে কথা বলায় সময় আসলো। আমি পাঁচ মিনিট আগেই কল দিলাম দুই বার কল কেটে দিলো, কিছুক্ষণ পর নিজেই কল দিলো।

.

–হ্যালো নুরী, তোমার কি কান্ডজ্ঞান লোপ পাচ্ছে দিন দিন?নির্ধারিত সময়ের আগেই কল দিচ্ছো।

— হ্যাঁ লোপেই পাচ্ছে, কারণ আমি যে আমাদের সন্তানের মা হতে চলেছি। ওড়নায় নিজের অজান্তেই লজ্জায় মুখ লুকালাম যদিও এ ঘরে আমি ছাড়া কেউ নেই তবুও।
— কি বলছো তুমি, এইকয়দিনেই তুমি প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে। আচ্ছা ঠিক আছে নিজের যত্ন নিও এখন রাখছি।

.

এ খবর শুনে আয়ান যে খুশি হয়নি সেটা বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি আমি, কেঁদে ফেললাম আয়ানের বিরক্ত নিয়ে বলা কথাগুলে শুনে। আবার সেই ওড়না দিয়েই চোখের আর নাকের পানি মুছতে লাগলাম।

আয়ান কি করে এতো নিষ্ঠুরের মতো আচরণ করতে পারলো আমার সাথে অন্য সময়ের কথা বাদ দিলাম কিন্তু আজ। বাবা হতে চলছে সে এটা জানার পরও ওর কোনো ভালো প্রতিক্রিয়া দেখলাম না, শুনে বেশ অখুশি হয়েছে মনে হলো।
অর্ধেক রাত পার হলো আমার চোখের পানি মুছতে মুছতে, শেষে প্রচুর মাথার ব্যাথা শুরু হলে ঘুমিয়ে পড়ি।

.

আগে আয়ান প্রতিদিন দুইবার করে আমার সাথে কথা বললেও এখন একবার করে বলে কখনো আবার একবারো কথা বলে না।
কিছুদিন এভাবে কেটে গেলো, আমি আশায় বুক বেঁধে রাখি এই বিশ্বাসে যে ও হঠাৎ একদিন আমায় কল দিয়ে বলবে খুব মিস করছে ও আমায় কিন্তু সেদিন আর আসে না আমার মাঝে।

ইদানীং আয়ানের কথা বেশ উদাসীন লাগছে আমার,
আমাদের সন্তানের ব্যাপারে কখনো কিছু বলে না। আমিই আগ বাড়িয়ে যত কথা বলি ও শুধু হু,হ্যা, আচ্ছা এসব বলে।

গোসল করে আয়নার সামনে দাড়িয়ে মাথায় চুল আছড়াচ্ছি, চিরুনীটা রেখে পেটের ওপর ডানহাত টা আলতো করে রাখলাম আমাদের অস্তিত্বের উপস্থিতি বুঝার বৃথা চেষ্টা করছি।
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমার পায়জামার নীচ দিয়ে দুপায়ের ভিতর থেকে টকটকে লাল রক্ত গড়িয়ে ফ্লোরে পড়ছে।

চলবে,,

#জীবন_তরী

#প্রথম_পর্ব

লেখা : হাবিবা হাওয়া।

(ভুল ক্রটি মার্জনীয়)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here