#জল_নুপুর
#Sharifa_Suhashini
শেষ পর্ব [১০]
নবনী বোনের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে জবাব দেয়,
হ্যাঁ এক্ষুনি লাগবে? তুই কি দিবি? না হলে বল আমি আলাদা ব্যবস্থা করছি।
আচ্ছা দিচ্ছি দিচ্ছি বাবাহ,আমান ভাইয়ের জন্য এত মন আকুপাকু করছে তোমার।
একদম ফালতু কথা বলবি না তো আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে সবকিছু। মনটা বড্ড উতলা।তাই চোখে যা বাধছে তাই একবারে শিকড় অব্দি জানার চেষ্টা করছি শুধু।
রিতু বোনের মনের অবস্থা অনুধাবন করতে পারে।এই মানুষটা যে কত সংকোচের ভিতর দিয়ে নিজের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছে, তা তো ঋতুর চেয়ে অধিক কেউ জানে না।সে হটস্পট চালু করে নবনীর ফোনটা এগিয়ে দেয় নবনি লক খুলে দেখে আমান সুন্দর করে শেরওয়ানি পড়ে ছবি পাঠিয়েছে, সাথে লিখেছে-
আমি কিন্তু রেডি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার কাছে আসছি। এরপর আমি আর তুমি সারা জীবনের জন্য একটি মানুষ হয়ে যাবো। আর হ্যাঁ বাসর রাতে তোমার জন্য কিছু একটা গিফট আছে।
ক্যাপশন পরে নবনী সহায় ঠিক করে হেসে দেয়।সে মনে কি ভয় পেয়েছিল আর আমান কত চমৎকারভাবে তার মন ভালো করে দিলো।বোনকে এভাবে হঠাৎই হেসে উঠতে দেখে রিতুর ঠোঁটের কোটেও হাসির রেখা ফুটে ওঠে।মানুষের অনুভূতির এই এক সুন্দর চেইন কমান্ড।অন্যের মুখের হাসি দেখলে হাসতে ইচ্ছে করে।কাঁদতে দেখলে কাঁদতে ইচ্ছে করে।এ অনুভূতি মানুষের একান্ত স্বভাবজাত।সৃষ্টিকর্তা যাদেরকে সুন্দর সহজ মন দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন,তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই এই গুনটা অটোমেটিক চলে আসে। সে ভ্রু দুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
হঠাৎ মুখের ভঙ্গি পাল্টে গেল যে?
এই দেখ আমার কি কাণ্ড করে বসেছে।
বলে সে বোনের দিকে মোবাইলের স্ক্রিনে উঁচু করে ধরলো।ক্যাপশন পড়ে সেও যেন হাসিতে ফেটে পড়ছে। ভাইয়া যে এত চমৎকার মানুষ সে আফসোসের সুরে ভণিতা করে বলে উঠলো,
ইশশ,আমান ভাইয়াকে না বলে বিশাল ভুল করে ফেললাম আপা।এমন জীবন সঙ্গী কি হারিকেন দিয়ে খুঁজেও পাওয়া যায় নাকি?
নবনি আর চোখে চেয়ে মুচকি হাসে। পার্লারের মেয়েদের ডেকে বারবার করে সচেতন করে বিয়ে রিতু বলে দেয়,
আমার আপাকে কিন্তু সুন্দর করে সাজাবে তবে বেশি হাইফাই দরকার নেই সিম্পল এর মধ্যে গর্জিয়াস। বেশি সুন্দর দেখায় বিয়ের শাড়ি হাত ভরতে চুরি কপালের টিপ কানের ঝুমকো আর হালকা করে মেকাপের সাজ।আমি চেলেঞ্জ করে বলতে পারি আপার ঐ রূপ দেখলে এই শহরের সবকটি প্রেমিক নিশ্চিত আফসোস করবে।আর আমান ভাইয়া তো•••••
রিতু তোর মেয়ে না হয়ে ছেলে হয়ে জন্মানো উচিত ছিল। ভালো মেয়ে পটাতে পারতিস তাহলে এভাবে রং ঢং করতে ভালো লাগে সব সময়?এবার দয়া করে এত বকবক না করে চোখের সামনে থেকে সর।
রুতু সামান্য কৃত্রিম অভিবান দেখিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় তার বোন এখন সাজবে কতদিন পর এমন জমকালো সাজছে তার আপা।
জুতার নতুন বাক্স থেকে বিয়ের জুতা জোড়া পড়ে নিয়ে আমার আয়নার সামনে দাঁড়ালো।ঠিক বর বর লাগছে তো? নাকি ডাক্তারি দেখাচ্ছে? নাহ,ভালোই লাগছে আমাকে আরে বাহ ডাক্তাররা বর সাজলে সুন্দর দেখায় তো।
মনে মনে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে হাসে আমান।এরপর ড্রয়ের থেকে একটা চমৎকার আংটি পড়ে সে নিজেকে বলে,
এই উপহারটা নবনীর।এটা কি এখানেই রেখে যাবো?নাকি সাথে করে নিয়ে যাব? স্পেশাল মানুষের স্পেশাল উপহার অবশ্যই স্পেশাল ভাবে রাখা উচিত।
ভাবতে ভাবতে এসে শেরওয়ানির পকেট খোঁজে।কিন্তু পকেট তো নেই। অনেক ভেবে চিন্তে শেষমেষ শেরওয়ানির বুকের কাছের পকেট তাতেই রেখে দিল।অন্য ছেলেরা অবশ্য এই স্থানটিতে তাজা রক্ত গোলাপ রাখে।
নিতে সবাই অপেক্ষা করছে। অথচ সকাল থেকে তার কিছুই খাওয়া হলো না। আজ তার খাবার রুচি নেই। বন্ধুবান্ধব তো বলেই বসলো-
শশুর বাড়িতে খাবে বলে আমার বাড়ির খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।আবার নবনীর হাতে খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে কিনা কে জানে!
বরযাত্রীর গাড়ি প্রস্তুত তিনটি একটাতে এমন বসলো। ছেলের পাশে তার বাবা আরমান খান বসতে চাইলেও আমানের বন্ধুদের কারণে আর পাত্তা পেলেন না।একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা!কিন্তু কে শোনে কার কথা বন্ধুদের চাপাচাপিতে আমানের নিজেরই জায়গা ছেড়ে দেবার উপক্রম। ঠেলতে ঠেলতে সে গিয়ে পড়লো গাড়ির ডান দিকের এক কোণে।
অন্যদিকে ফু দিয়া তার বাবা এবং হোসনেয়ারা খালা বসলেন দ্বিতীয় গাড়িতে বরযাত্রী গাড়ি চলল সবার আগে আগে।
বরের গাড়িতে এতোটুকু গাড়ির মধ্যে এত এত মানুষের ভিড়, এত গরমে অল্প জায়গায় ভ্যাপসা গরম আর গন্ধে আমানের পেটের মধ্যে কেমন যেন পাক দিয়ে ওঠে।সে ড্রাইভারকে ডেকে বলে দেয় সামনে কোন ফার্মেসি পেলে যেন অবশ্যই গাড়ি দাঁড় করায়।
কিন্তু আমাদের পেটের ভিতর ফার্মেসীর জন্য আর তা আর তর সইলো না।একেবারে ঠেলে বমি আসতে শুরু করলো বমি করলে নির্ঘাত সবার গায়ে পড়বে আর তাছাড়া তার দেখাদেখি বন্ধুদেরও তার সাথে গা গলিয়ে বমি শুরু হবে।পেটে চাপ সহ্য করতে না পেরে তাড়াহুড়ো এসে দ্রুত গাড়ির জানালা খুলে বমি করতে শুরু করলো।ঠিক সেই মুহূর্তে দিক থেকে একটা ট্রাক তাদের কেউ ওভারটেক করতে ছুটে বেরিয়ে যায়।ট্রাকের থেকে শুরু করে বড় চাকায় বারি খেলো আমাদের মাথা।মুহূর্তেই থেতলে যায় তার মুখের সমস্ত অংশ, ভেঙ্গে যায় চোয়ালের শক্ত হাড়ও।গ্লাসভেঙে বেরিয়ে এলো শরীরের অর্ধেকেরও বেশি অংশ।পিছন থেকে দ্বিতীয় গাড়ির সামনে বসে আরমান খান চমকে উঠে সামনে তাকালেন।কে ওটা?কে এক্সিডেন্ট করেছে?আরে তোমরা গাড়ি থামাও।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক নিমিষে সব থেমে গেল যেন। গাড়ি থামিয়ে ছুটে এসে আরমান খান দেখলেন- তারই একমাত্র ছেলে আমাদের শরীর গ্লাস ভেঙে ঝুলছে।
আমান এই আমান কথা বলনা বাপ।
কিন্তু আমানার কথা বলে না বরযাত্রীর জন্য যারা বেরিয়েছিল ছল ছল চোখে চিৎকার করছে এম্বুলেন্স দেখো এম্বুলেন্স।রাস্তার চারপাশ থেকে নানান শ্রেণী নানান বয়সের মানুষ ছুটে এসেছে।
কে জানি আফসোস করে বলে উঠলো-
হ্যাঁ আর ছেলেটার বিয়ে ছিল?বিয়ে করতে যাচ্ছিলোআরে বিয়ের পরই এক্সিডেন্ট করে বসলো। যে মেয়েটার সাথে ওর বিয়ে হবে কি কপাল পড়লো রে!
হোসনে আরা বেগম হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।ফৌজিয়া কাদতে পারছে না। হতভম্ব হয়ে এসে আমাদের দিকে চেয়ে আছে এইতো তার ভাই ঠিক উঠেই নবনীকে নিয়ে পাগলামি করবে।উঁহু কিচ্ছু হয়নি।
মিনিট ১৫ এর মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স এবং রাস্তার পাশের ক্লিনিকের একজন ডাক্তার এগিয়ে এলেন।আমানের শ্বাস আর টের পাওয়া গেল না।ডাক্তার মুখ ভার করে উঠে দাঁড়ালেন।সরকারি হাসপাতাল পাঠাতে হবে তাকে। অ্যাম্বুলেন্সে তার বডি তোলার সময় শেরণের বুক থেকে নবনীকে উপহার দেবার জন্য বানানো আংটিটা রাস্তায় পরে ঠুং করে শব্দ হলো।
উচ্চ জনতা সেই আংটির ঘূর্ণনের দিকে চেয়ে রইলো।
বর জাতি আসতে কতক্ষন লাগবে আর পরিদর্শন বারবার গেটের দিকে উঁকি দিয়ে দেখছেন,এই বুঝি চলে এলো।একবার রিতুকে দেখে ডেকে বললেন,
নবনীর রেডি হওয়ার কতদূর দেখি আয় তো।
রিতুবনের ঘরে ফিরে দেখে, নবনীকে পার্লারের মেয়েগুলো চমৎকারভাবে বউ সাজিয়েছে।লজ্জায় আধা হাত ঘোমটা দিয়ে সে অপেক্ষা করছে তার আমানের জন্য।কখন তার আমান আসবে সবাই চিৎকার করে বলবে
“বর এসেছে!”
“সমাপ্ত “