ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব-৩
.
আফরা কোমরে হাত দিয়ে দাঁত কটমট করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
– ‘তাহলে আমাকে বিছানা থেকে তুলে তুমি চা জ্বাল দিতে পাঠালে কেন?’
– ‘মনে ছিল না আসলে। তাইতো বলছি রাগ না করতে।’
– ‘এখনও ঘুমানোর সময় হয়নি নাঈম। রাতের ভাত খাবে, তারপর না ঘুমাবে। এখন চা খেলে কিছুই হবে না, খাও।’
– ‘না সন্ধ্যার পর থেকে চা-টা খাওয়া বন্ধ রাখবো ভাবছি৷ ঘুম ইজ এ ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট পার্ট অফ এভরি হিউম্যান লাইফ। ঘুম…।’
আফরা থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘তুমি একদম চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে কথা বলবে না তো। দেখতে বিশ্রী লাগে।’
– ‘ও আচ্ছা, ঠিক আছে চশমাই খুলে নিলাম। তুমি প্লিজ এখানে বসো।’
– ‘কেন?’
– ‘কেন আবার নয়নভরে দেখবো তোমাকে।’
– ‘ঢং, আমাকে দেখার কি আছে নতুন করে? মাথায় কি শিং গজাইছে।’
– ‘এভাবে কথা বলো বলেই তো আমার ঘুম এখন আর ভয়ে আসে না।’
আফরা চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ টিপে হেঁসে বললো, ‘আচ্ছা শোনো, তুমি বলেছিলে না অনিককে বুঝাতে, যাতে জব করে, বিয়ে-শাদির কথা ভাবে।’
– ‘হ্যাঁ, আব্বা বলেছিলেন একথা তোমাকে দিয়ে বুঝাতে।’
– ‘আমি অনিককে অনেক বুঝিয়েছিলাম৷ তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই বিয়ে-শাদির, জবও করবে না।’
– ‘ভাবো তোমার দেবর কেমন পাগল? আরে ব্যাটা তোর ভাবির মতো একটা মিষ্টি মেয়ে বিয়ে করেই দেখ না জীবন কত সুন্দর।’
– ‘এহ হইছে, সে উলটো বলে বিবাহিত ব্যাটারা পাগল।’
– ‘সে তো বলবেই৷ অনার্স পাস করে বেকার ঘুরে বেড়ায় আর কিসব রঙ-ঢং লিখে। তার কথায় কি আসে যায়।’
আফরা বিছানায় বসে বললো,
– ‘অনিকের মনে হয় ইভাকে ভালো লেগেছে। একটু আগে ওর রুমের দিকে উঁকি মারছিল। এখন ওর রুমেই গিয়ে বসেছে। ভাবা যায়? অনিক কিন্তু এরকম না।’
নাঈমের মুখ খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেল। সে বই বিছানায় রেখে উঠে বসে আফরার হাত ধরে বললো, ‘দেখো পাগলটা সত্যিই যদি ওকে পছন্দ করে ফেলে তাহলে ভালো হয়৷ ইভাকে যতটুকু দেখলাম ভালোই তো। দেখতেও মাশাল্লাহ। তুমি জানো না আব্বা কেন যেন ওকে নিয়ে খুবই টেনশনে আছেন। যদি কোনো মেয়ের সাথে প্রেম-টেম হয় তাহলে ওর জব করার ইচ্ছাটাও হতে পারে। বিয়ে-শাদি করতে পারে।’
আফরা ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘তো আমাকে এভাবে কেন বলছো? আজব! আমার কি এখন ওদের প্রেম করিয়ে দিতে হবে না-কি?’
– ‘তুমি না, প্রথমেই সবকিছু হেঁসে উড়িয়ে দাও।’
– ‘আচ্ছা বলো কি করতে হবে?’
– ‘না থাক লাগবে না৷ ওদেরকে নিজেদের মতো থাকতে দাও। এমনিতেই ভালো লাগা তৈরি হতে পারে।’
– ‘আচ্ছা চশমা সাহেব। আপনি বই পড়ুন, আমি তাহলে ওদের কাছে যাই।’
– ‘আমি বই রেখে দিয়েছি তো। তুমি বসো, বউ পড়া থেকে তো বই পড়া ইম্পর্ট্যান্ট না।’
– ‘হইছে, মহিলাদের মতো ঢং করতে হবে না। আমি ওদের কাছে গেলাম।’
নাঈম তাকে শুনিয়ে শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বইয়ে মনযোগ দিল।
ইভার অস্বস্তি লাগছে। এ্যাশ কালারের মেগি হাতা গেঞ্জির সঙ্গে শর্ট প্যান্ট পরে উনি বসে আছেন। কি অদ্ভুত! স্বাভাবিকভাবে চা এনে দিলেন। একটুও লজ্জা নেই। সন্ধ্যায় তো সে দরজা খুলে দিতেও যেতে চায়নি। গিয়েছিল আফরা আপুর কারণে৷ তারপর যা করেছে তার সবই নিজের স্বভাব বিরোধী কাজ। ইভার যথেষ্ট লজ্জা আছে। সচরাচর সে এভাবে ছেলেদের সঙ্গে কথাও বলে না। মাদ্রাসা থেকে এইচএসসি দিয়েছে সে। ছেলেদের সঙ্গে খুব একটা মেলা-মেশার অভ্যাস নেই। সন্ধ্যায় যা হয়েছে তা হয়ে গেছে। তালতো ভাই হিসাবেও মজা করে কথা বলেছে। তাই বলে শর্ট প্যান্ট পরে তার রুমে চলে আসবেন? আর এই যে মেগি হাতা গেঞ্জি। এটা পরেই বা আসার কারণ কি? এই বস্তু পরলে বগলের দিকে হাতা টাইট হয়ে থাকে। ফলে পেশি বড়ো দেখায়। বুক টানটান থাকে। সুন্দর দেখায়। ছেলেদের তো আবার নিজের বডি প্রদর্শনের একটা স্বভাব থাকে। নিজের মাসল, থাইসেপ, চেস্ট এগুলো যত ছোটই হোক না কেন কিছু ছেলে তাদের এগুলো অনেক বড়ো এবং সুগঠিত ভাবে। প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে দেখিয়ে বেড়ায়।
উনার কি সেরকম কোনো উদ্দ্যশ্য? একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখানোর লক্ষ্য?
একা একটা মেয়ের রুমে এভাবে এসে বসে থাকতে লজ্জা করছে না! কখন যাবে লোকটা। ইভা তাকাতে পারছে না। বিছানায় শুয়ে সে ইয়ারফোন কানে গুঁজে গান শুনছিল। এখন উঠে বসে চা’য়ে চুমুক দিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে৷ উনি বসে আছেন সোফায়। বারবার তাকাচ্ছেন। চায়ে চুমুক দেয়ার সময়ও চোখ সরছে না।
অনিক মনে মনে ভীষণ মজা পাচ্ছে। সন্ধ্যায় মেয়েটিকে যত চঞ্চল মনে হয়েছিল। এখন তা লাগছে না। লজ্জা পাচ্ছে। অস্বস্তির ছাপ চেহারায় স্পষ্ট। সে অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দেয়ার জন্য তাকিয়ে আছে। মেয়েটি কোনদিকে পালিয়ে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করবে বুঝতে পারছে না। কিছু মানুষকে কেবল তাকিয়ে থেকে বিব্রত করা যায়। হাঁটার সময় এদের দিকে কেউ তাকিয়ে থাকলে এরা ঠিকঠাক মতো আর হাঁটতে পারে না। এসব দুষ্টামি বুদ্ধি অনিক ছোটবেলায়ই অর্জন করে নিয়েছে। এখন যদি মেয়েটিকে সে বলে, ‘আহা আপনি এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন’ তাহলে সে আরও বেশি নার্ভাস হয়ে যাবে। সেদিকে গেল না। এখন তার অন্তর্ভেদী চোখ দিয়ে মেয়েটিকে পড়ে নিচ্ছে। আচ্ছা তার সকল পড়া কি সঠিক হয়? তা মোটেও নয়। সঠিক হওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ না৷ বেশিরভাগ মানুষই প্রথম দেখেই অন্যকে নিয়ে একটা চিত্র-কল্প তৈরি করে ফেলে। এই মানুষটা এরকম-সেরকম হবে বলে একটা ধারণা করে বসে। তার সবই যে ঠিক হয় তা না, তবে বেশিরভাগ মানুষেরই খানিকটা কাছাকাছি হয়। তার হয়তো সেই ক্ষমতা আছে৷ তার প্রথম উপন্যাসই ছিল মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। সেটা মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস লিখতে বসেছি ভেবে লেখেনি সে। হয়ে গেছে। বেশ সাড়া ফেলেছিল পাঠক মহলে। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণগুলো মানুষকে চমকে দিয়েছে। নিজের সঙ্গে অন্যের কথা মিলে গেলে মানুষ ভীষণ মুগ্ধ হয়। সে প্রথম বই দিয়েই মুগ্ধ করেছিল। ইভা মেয়েটাকে নিয়ে সে যা বলবে তা কি ঠিক হবে? বলা যায় না। ঠিক উলটোও হতে পারে। সবাইকে বুঝে ফেলা এত সহজ না। যেমন পদ্য আপু। ছোট্ট থেকে এক সঙ্গে বড়ো হলো যার সঙ্গে, তাকে সে আজও বুঝতে পারে না। এক রহস্যময় রমণী। তাকে ভালো না বাসলে মেয়েটি এখনও বিয়ে করছে না কেন? সে আসলেই জানে না। মানুষ মূলত জটিল প্রাণী। সে নিজেকেই নিজে চিনতে পারে না। ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে নিজেকে চিনতে খরচ হয়ে যায় পুরো একটা জীবন। তবুও লেখকদের একটা সম্মুখ ধারণা নিতে হয় মানুষদের মনোজগত সম্পর্কে। সেটা সঠিক না হলেও খুব একটা যায় আসে না৷ সে ইভাকে নিয়েও সম্মুখ ধারণা নিয়ে নিচ্ছে। মাথার ভেতর হেঁটে বেড়াচ্ছে ইভা। কোন পরিস্থিতিতে ইভা কি করতে পারে তা কল্পনায় দেখতে শুরু করেছে সে।
– ‘কিরে তোমরা চুপচাপ বসে আছো কেন?’
আফরার আগমনে অনিক ভাবনা থেকে বের হয়। ইভাও এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। আফরা গিয়ে বিছানায় বসলো। তারপর অনিককে বললো, ‘তা লেখক সাহেব, আপনার মতলবটা কি?’
সে ভ্র-কুঁচকে বললো, ‘মতলব কি মানে?’
– ‘না মানে চা দেয়ার সময় আমার সাথে এক্সট্রা খাতির জমাচ্ছিলে মনে হলো, কারণ কি?’
– ‘কি যে বলো না ভাবি। আমি কি সব সময় মতলব নিয়ে থাকি না-কি।’
– ‘আমার চেনা আছে তোমরা দুই ভাইকে। নিশ্চয় কোনো নতুন উপন্যাস আমাকে দিয়ে পড়িয়ে যাচাই করার মতলব আছে।’
– ‘না না, তেমন কিছু না।’
ইভা দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘উনি কি লেখক? উনি উপন্যাস লিখেন?’
আফরা হাসতে হাসতে বললো, ‘দেখলে তো অনিক। তালতো বোনও জানে না তুমি লেখালেখি করো। তোমার ভাইয়ের কথাই ঠিক। সে কি বলে জানো? বলে কি ভংচং করে। শুনি তার বই একেকটা কয়েক মুদ্রণ বিক্রি হয়। এই চ্যানেল ওই চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দেয়। কই তাকে তো কেউ চিনেই না।’
– ‘ভাবি তালতো বোনের সামনে আমাকে পচানোর চেষ্টা করো না। বইয়ের এত খবর রাখবে, বাংলাদেশের মানুষের রুচি এখনও এত উন্নত হয়নি। তাছাড়া তালতো বোন হয়তো বই পড়েনই না। তাই তার চেনা না চেনা নিয়ে আমার কিছু যায় আসে না।’
ইভা ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘আপনি কি মিন করতে চাইছেন। আমার রুচি কি উন্নত না?’
অনিক ইচ্ছা করেই খোঁচা দিয়েছে, মেয়েটা চুপচাপ বসে থাকলে হবে না। তাকে নড়াচড়া করাতে হবে। ওকে নিয়েই উপন্যাস শুরু করবে। সময় হাতে কম। বইমেলা অতি নিকটে।
সে উত্তরে বললো, ‘আপনার রুচি উন্নত না-কি? তাহলে বই পড়া হয়?’
– ‘না পড়ি না, তাই বলে ঢালাও ভাবে আপনি বলতে পারেন না বই পড়ুয়া ছাড়া সবাই রুচিহীন। বই এখন মানুষের পড়ার সময় আছে না-কি? ক্লাসের বই পড়ার টাইম পাই না আবার আউট বই। বসে আছে মানুষ এখন বই পড়ার জন্য। সবাই আধুনিক হচ্ছে। কতকিছু আছে। আপনি পড়ে আছেন বই নিয়ে।’
তাচ্ছিল্য করেই শেষের কথাগুলো বললো ইভা। তবে প্রথম কথাগুলো অনিকের অনেক পছন্দ হয়েছে। ঢালাও ভাবে রুচিহীন বলা যায় না। সে শেষের কথাগুলো ধরে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো,
– ‘আপনার ধারণা কিন্তু ভুল ইভা৷ মানুষ আধুনিক হলে আরও বেশি বই পড়ার কথা৷ আমরা কি ইউরোপ আমেরিকা থেকে উন্নত? আপনি কি জানেন বিদেশি রাইটারদের একেকটা উপন্যাস মিলিয়ন মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়ে যায়। একেকটা বই লিখে তারা শীর্ষ ধনীদের তালিকায় চলে আসে। তাহলে সেসব দেশের মানুষ কি বেকার? তাদের কি সময়ের গুরুত্ব নেই? আমাদের ষোল কোটির এই দেশে দুই তিন হাজার কপি বই কোনো লেখকের বিক্রি হলেই হইচই পড়ে যায়। তুমুল জনপ্রিয় লেখক বলা হয়।
যাইহোক, আমাদের ঝগড়া লাগিয়ে দিয়ে কিন্তু ভাবি চুপচাপ মজা দেখছে। এবার বলুন শুনি, আপনি তাহলে অবসর সময় কিভাবে কাটান?’
ইভা অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘গেইম খেলি, ফেইসবুকে যাই, মুভি দেখি, এইতো এগুলো।’
– ‘বাহ ভালো৷ আচ্ছা মানুষ এখন আধুনিক হচ্ছে যে বলেছিলেন সেটা কোন অর্থে?’
ইভা হেঁসে বললো, ‘কোন অর্থে আবার। আমি বুঝাতে চাইছি এখন তো মানুষ অনেক স্মার্ট, যুগোপযোগী, শিক্ষিত, উন্নত।’
– ‘তাহলে আপনার কথার মানে এটা ছিল শিক্ষিত উন্নত এই মানুষেরা বই পড়বে কেন। তাদের এসবের টাইম নেই। এটাই তো? আপনি যে একটু আগে বললেন অবসর সময়ে মুভি, গেইম, ফেইসবুক ইত্যাদিতে থাকেন। তারমানে দাঁড়ায় সেগুলো আধুনিক মানুষের বিনোদনের মাধ্যম? আপনি নিজেই আজ থেকে খুঁজে দেখবেন, ভেবে দেখবেন, এগুলো কারা দেখে বেশি। যারা রিডিংই পড়তে জানে না তারাও দেখে। ফেইসবুক ভিডিয়োতে কেন ভিউ বেশি জানেন? কারণ যারা বাংলাও রিডিং পড়তে জানে না। তারা ফেইসবুক খুলে ভিডিয়োতে পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে নিজের ছবি আপ্লোড দেয়। কিন্তু বই যারা পড়ে, সেই অল্প সংখ্যক মানুষ কারা এবার ভাবুন। তারপর বলবেন এখন আধুনিক যুগ, বই পড়বে কেন, টাইম আছে না-কি মানুষের৷ তাছাড়া আপনি তো অনার্সে পড়েন। আপনি রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণদের বই খুলে পড়ে দেখুন কিছুই বুঝবেন না। ঘুমিয়ে যাবেন। অথচ এই বইগুলো কিছু মানুষ কিনে পড়ে। তারা মজা পায়। বুঝতে পারছেন পার্থক্যটা? কিছু মানুষ যেটা থেকে রস আস্বাদন করে। আপনি সেটা বুঝেনই না। মনে রাখবেন অনেক অনার্স মাস্টার্স পাস করা মানুষও আছে পড়ে আনন্দ নেয়ার ক্ষমতা রাখে না। সময়ের কথা বলবেন না, তুমুল ব্যস্ত মানুষও ফেইসবুক, ইউটিউব কিংবা গেইমে খেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটায়। ক্রিকেট খেলা, ফুটবল খেলা দেখে সময় কাটায়। এত সময় তাহলে কোথায় পায়? আবার তুমুল ব্যস্ত মানুষ প্রতিদিন ঘুমানোর আগে অল্প অল্প বই পড়ে। কল্পনার জগতে হারিয়ে যায়। একটু গুগল করেও দেখে নিন বিজ্ঞানও বলে
গল্প-উপন্যাস পড়ার বৈঙানিক উপকারিতার কথা। মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করেও দেখা হয়েছে। গল্প-উপন্যাস পড়লে মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়। কার্যক্ষমতা বাড়ে। মানুষকে বুঝার ক্ষমতা বেড়ে যায়। ২০০৯ সালে আমেরিকায় এক গবেষণায় দেখা যায় মানুষের স্ট্রেস কমাতে ইয়োগার মতোই বই পড়া মানুষের ব্লাড প্রেশার, হতাশা, দুশ্চিন্তা কমিয়ে মনের অশান্তি দূর করে। এগুলো তো সামান্য বিষয়ে বললাম। আরও অনেক উপকারিতা আছে।
আর আপনি বললেন ক্লাসের বই পড়ার টাইম পাই না আবার আউট বই পড়তে বসে আছি। শুনুন, বিনোদন হচ্ছে মানুষের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। বই পড়ুয়া কাউকে যখন বলে এগুলো পড়ার সময় কোথায় পাও? যে বলছে সে কি ঘুম-খাওয়া বাদে সারাদিন নিজের ক্লাসের বই পড়ে কাটায়? কেউ কি নিজের অফিসে চব্বিশ ঘণ্টা শুধু কাজই করে? যদি না করে অবসর সময় সে কি করে আসলে? এটা ভেবেছেন? মানুষ বিনোদন নিতে চাইবেই। কোনো সুস্থ বিনোদন মাধ্যম না থাকলে একটা ছেলে রাস্তায় গিয়ে ইভটিজিং করে আনন্দ নিবে৷ ম*দ-গাঁ*জা খাবে। সেভাবে যে বই পড়ে না সেও যেকোনো কিছুতে আসক্ত আছে৷ যেমন আপনি বই না পড়লেও কিন্তু ফেইসবুকে যান, গেইম খেলেন, মুভি সিরিয়াল দেখেন…। অথচ বইয়ের কথা আসতেই আপনার ক্লাসের বইয়ের কথা মাথায় চলে এসেছে৷ সেটা মুভি দেখার সময় আসবে না। ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে সিরিয়াল দেখবে। কিন্তু কেউ বই পড়তে দেখলেই বলবে সময় নষ্ট হয়। এগুলো পড়ে কি লাভ?
আসলে সময় নেই বলে বইকে এড়িয়ে গিয়ে লাভ নেই। বইকে এড়িয়ে ঠিকই অন্যকিছু থেকে বিনোদন নিচ্ছেন।’
ইভার মুখটা মলিন হয়ে গেল। সে এতো ভেবে কথাগুলো বলেনি। কথায় কথায় বলে ফেলেছে। উনি এতটা সিরিয়াসলি নিবে সে বুঝতে পারেনি। লোকটা প্রচণ্ড খা*টাশ। একটা মেয়ের সঙ্গে কিভাবে আচরণ করতে হয় তাও জানে না। আবার সে না-কি লেখক না ছাঁই। লজ্জায় ইভার কান দিয়ে গরম ভাপ বেরুচ্ছে। কতগুলো কথা শুনিয়ে দিল লোকটা। তাকে কেউ কখনও এরকম কথা শোনায় না৷ নিজেও কখনও এত কথা বলতে যায় না৷ অথচ এই লোকটার সঙ্গে দুইবারই তর্কে জড়িয়ে গেছে। কেন যে বলতে গেল এসব। এখন জবাবে কি বলবে? সে বলার আগেই আফরা বললো, ‘অনিক তুমি এভাবে কথা বলছো কেন আমার বোনটার সাথে? যাও তো, নিজের রুমে যাও।’
অনিক উঠে বাইরে এলো। মেয়েটি কষ্ট পাবে হয়তো৷ এত কথা বলতে চায়নি। কিভাবে যেন উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটির নীরবতা ভাঙতে গিয়ে সে নিজেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। নিজেকে সান্ত্বনা দিল, মানুষ তো ফুটবল খেলা নিয়েও অনেক যুক্তি-তর্ক করে, খু*নাখু*নি করে। সে না হয় সাহিত্য নিয়ে করলো, সে তো সাহিত্যেরই মানুষ৷ কেউ ভুল কথা বললে জবাব দিতেই পারে। তাছাড়া তার উপন্যাসটা৷ মেয়েটিকে নানানভাবে নাচাতে হবে। রাগাতে হবে, হাসাতে হবে, ঝগড়া করতে হবে। মোটকথা ঘটনা ঘটতে হবে সারাক্ষণ। না হলে তার উপন্যাস জমে উঠবে কিভাবে? এই যে ঝগড়ার কারণেই তো সে জানতে পেরেছে মেয়েটি অবসর সময়ে কি করে। তার চিন্তাভাবনা কেমন৷ রুমে এসে দরজা ভেজিয়ে অনিক ল্যাপটপের সামনে উবু হয়ে বসে যায়। শব্দের ঝড় উঠে তার কিবোর্ডে।
আফরা চলে যেতেই ইভার কান্না পেয়ে গেল। কেন যে এমন একটা বেরসিক ছেলের সঙ্গে কথা বলতে গেল। কেন যে গেল! অন্য আট-দশটা সাধারণ মেয়েদের মতোই সে রাজনীতি বা সাহিত্যের মতো জটিল বিষয় নিয়ে তর্ক করতে মোটেও পছন্দ করে না। সব-সময় এসব এড়িয়ে চলে। অথচ আজ এত কথা শুনতে হলো। থমথমে মুখে বসে রইল ইভা। চোখ ছলছল করছে।
রুমে গিয়েই আফরার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সিগারেটের গন্ধে ম-ম করছে৷ নাঈম বিছানায় শুয়ে-শুয়ে সিগারেট টানছে। কি বিচ্ছিরি কাণ্ড। আফরা এগিয়ে গিয়ে হাত থেকে সিগারেট নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে বললো, ‘আশ্চর্য! এটা তুমি কি করলে? নিজেই তো বলেছিলে আর সিগারেট খাবে না। এখন রুমে বসেই টানছো!’
নাঈম উঠে বসে বললো, ‘আহা, সামান্য বিষয় নিয়ে এত রাগারাগির কি আছে বলো তো আফরা।’
– ‘সামান্য বিষয়? এটা সামান্য বিষয় মনে হলো তোমার কাছে?’
– ‘তো কি? সিগারেট খাওয়া কি খুব বেশি গুরুতর অপরাধ?’
– ‘তোমার সাথে কথা বলাই ভুল হয়েছে। আজ থেকে রাতে আমার কাছেই আসবে না তুমি। এখন টেবিলে খাবার দিচ্ছি খাও এসে।’
– ‘না, আমি খাব না। ভালো লাগছে না।’
‘না খেলে নাই, সিগারেটের ধোঁয়ায় পেট ভরে গেছে নিশ্চয়’ কথাটা বলেই আফরা হন-হন করে বাইরে গিয়ে টেবিলে ভাত দিয়ে ইভা আর অনিককে ডাকলো। খাওয়ার টেবিলে বসে তিনজন তিনটা কারণে একেবারে চুপচাপ। ইভা খানিক আগের ঘটনায় মর্মাহত। আফরা নিজের স্বামীকে সিগারেট খাওয়া ছাড়াতে ব্যর্থ হয়ে হতাশ। অনিক তার শুরু করা প্রেমের উপন্যাস নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে আছে। খাওয়া শেষে তিনজনই যার যার রুমে চলে যায়। ইভা দরজা ভেজিয়ে বিছানায় শুয়ে মনে হলো উনি কি এমন লেখক একটু দেখা দরকার। সে অনিকের নাম বাংলায় এবং ইংলিশে লিখে সার্চ দিয়ে ফেইসবুক, ইউটিউব এবং গুগলে ঘাটাঘাটি শুরু করলো।
অনিক পুনরায় এসে ল্যাপটপে উবু হয়ে লিখতে বসেছে। ইভার চোখ, ঠোঁট, কথা বলার ভঙ্গি, প্রতিক্রিয়া, বিব্রত চেহারা সবই তার গল্পের নায়িকার মধ্যে বসিয়ে দিল।
নাঈম শুয়ে-শুয়ে বই পড়ছিল। আফরা রুমে ফিরেই বাতি নিভিয়ে ডিমলাইট জ্বেলে দেয়। নাঈম আহত নয়নে তাকিয়ে বললো, ‘এ কি আফরা আমি পড়ছি তো।’
কোনো জবাব এলো না। বিছানায় এসে শুয়ে গেল আফরা। নাঈম বই সরিয়ে কোমল গলায় বললো, ‘আচ্ছা তুমি শাড়ি পরো না কেন বলো তো, এখন পরো একটু।’
– ‘ঢং করবে না আমার সাথে। রাত-বিরেতে ঢং আমার একদম পছন্দ না।’
– ‘অফিসেই তো থাকি সারাদিন। রাতে ছাড়া দেখবো কখন তোমাকে? তাও যদি ফিরে এসে দেখতাম শাড়ি পরনে তাও একটা কথা ছিল।’
– ‘আমি ঘুমাব এখন। বিরক্ত করবে না আমাকে।’
নাঈম বিছানায় কনুই ঠেকিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘আচ্ছা ঘুমাও।’
আফরা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে বললো, ‘আমাকে স্পর্শ করবে না বলে দিলাম।’
‘আচ্ছা তাহলে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যাই’ বলে সে জড়িয়ে ধরতে গেলেই পুনরায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল আফরা।
– ‘জড়িয়েও ধরতে পারব না? তাহলে ঘুমাব কিভাবে?’
কোনো জবাব পেল না। নাঈম পুনরায় ঘনিষ্ঠ হয়ে বললো, ‘তাহলে একটা চুমু খাই? তারপর ঘুমিয়ে যাব।’
ঠোঁট এগিয়ে গালের কাছে নিতেই আফরা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললো, ‘কোনো সিগারেটখোর আমাকে স্পর্শও যেন না করে। চুমু তো বহুদূর।’
– ‘আচ্ছা আর খাব না। আজকের মতো ক্ষমা করে দাও।’
– ‘না কোনো ক্ষমা নেই।’
– ‘তাহলে যে ঘুম আসবে না।’
– ‘না এলে নাই।’
– ‘এত নির্দয় হইয়ো না বউ।’
– ‘কোনো সিগারেটখোরের প্রতি আমার দয়া নেই।’
‘আচ্ছা আজকের মতো মাফ করো আর খাব না তো। আমি বাথরুমে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে দাঁত ব্রাশ করে আসছি। সিগারেটের গন্ধই পাবে না।’ কথাটি বলে সে চলে যাচ্ছিল। আফরা হাতটা ধরে রেখে বালিশে মুখ গুঁজে রইল। নাঈম প্রশ্রয় পেয়ে ওর মাথায় হাত রেখে বললো, ‘কি হলো আঁটকে দিলে যে?’
– ‘এত ভালোবাসো কেন তুমি?’
– ‘বাসবো না? এত প্রেম বুকে, অথচ একটা মাত্র বউ।’
আফরা বালিশ থেকে মুখ তুলে ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,
– ‘জড়িয়ে ধরবে না?’
নাঈম তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। আফরা আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বুকে মিশে গিয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘শাড়ি পরতে হবে চশমা সাহেব?’
– ‘না থাক, এখন কষ্ট করে পরা লাগবে না।’
– ‘তুমি এত ভালো কেন নাঈম।’
– ‘তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি তাই।’
– ‘মাঝ মাঝে ভাবী, সকলের কথায় ওই বড়লোক ব্যাটাকে যদি বিয়ে করে নিতাম। কি যে হত। লুকিয়ে বিয়ে করতেও অনেক ভয় পাচ্ছিলাম। এখন মনে হয় খুবই ভালো সিদ্ধান্ত ছিল৷ জীবনে ভালোবাসা আর মনের সুখ থেকে তো কোনো কিছুই বড়ো নয়।’
– ‘ইমোশনাল কথাবার্তা বলো না তো। তোমার মুখে ঝাল ঝাল কথাই ভালো লাগে।’
– ‘কেন জ*ল্লাদ বউ পছন্দ বুঝি?’
– ‘সেই জ*ল্লাদ বউটা তুমি হলে পছন্দ।’
আফরার বুকটা শিরশির করে উঠে। মানুষটার এত ভালোবাসা দেখে মাঝে মাঝে চোখটা ভিজে যায়।
__চলবে…..
লেখা: জবরুল ইসলাম