চড়ুইপাখির বন্ধুত্ব .
মাইশাতুল মিহির .
[১০]
আজকের সকালের শুরু টা অন্যরকম অনুভূতি দিয়ে শুরু হয়েছে অর্ষার। দিবাকরের স্নিগ্ধ আলোর রেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে ধরনীতে। গাছের পাতার ফাঁকে-ফাঁকে ঝিঁঝিঁপোকার কর্কষ ধ্বনি, ছোট ছোট পাখির কিচিরমিচির ডাক ভেসে আসছে। আজকের সকালটা বেশ শীতল। ভ্যাঁপসা গরম নেই তেমন। কিছুদিন আগেও সূর্যের প্রচন্ড উত্তাপ ছিলো। হয়তো গ্রীষ্মকাল শেষে বর্ষার আগমন ঘটছে। আজ অনেকদিন পর অর্ষার মন ভালো। অবশ্যই মন ভালো থাকার সম্পূর্ণ ক্রেডিট অর্পনকে দেওয়া উচিত। রিফাতের সাথে ব্রেক’আপের পর অর্ষার মন খারাপ ছিলো। তার মন ভালো করতে অর্পন অনেক কিছু করেছে। কোথাও ঘুরতে নিয়ে গেছে, এটা ওটা কিনে দিয়েছে, আরো কত কি। রিফাতের সাথে বিচ্ছেদের সময় আজ প্রায় নয় দিন। প্রথম দুই দিন মন খারাপ থাকলেও অর্পনের জন্য পরবর্তী দিন গুলো বেশ ভালো গেছে তার। আজ খুশি মনে তৈরি হয়ে নিলো। চুল গুলো আঁচড়ে বেনী করে একপাশে এনে রাখলো। রুম থেকে বেড়িয়ে দেখে অর্পন ডাইনিং টেবিলে বসে মোবাইল স্ক্রোল করছে। অর্ষা তার সামনের চেয়ারে বসলো। বললো, ‘কি বস! কি করছো?’
মলিন হাসলো অর্পন। শুধাল, ‘সকালে আম্মু কল দিয়েছে। কক্সবাজারে আজই যেতে হবে আমাকে।’
অবাক হয়ে গেলো অর্ষা। বললো, ‘সত্যি? হঠাৎ করে কি কাজ পরলো তোর?’
হেনা রান্না ঘর থেকে পরোটার প্লেট এনে অর্পনের সামনে রেখে আহাজারি করলো। বলতে লাগলো, ‘ছেলে টা এলো আজ দুইদিন। এর মাঝেই আবার কি কাজ পরলো কে জানে। বললাম আরো কিছুদিন থেকে যা। শুনে না আমার কথা।’
হাসলো অর্পন। পরোটার টুকরা মুখে দিয়ে বললো, ‘মামি আমি এসেছি ২২ দিন হয়েছে। দুই দিন কিভাবে? পরে আবার এসে লং টাইম থেকে যাবো।’
ক্ষুন্ন হলো অর্ষার মন। মনমরা করে বললো, ‘ভেবেছিলাম তোকে নিয়ে লালমাই পাহাড়ে যাবো। তা আর হলো না। আবার কবে আসবি?’
– ‘এখন আসা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস সামনের সাপ্তায় শুরু হবে।’
প্রতিত্তুর করলো না অর্ষা। এই কয়েকদিনে অর্পনের সাথে তার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছিল। বন্ধুত্ব দুজনের আরো প্রগাঢ় হয়েছিলো। যদিও সারাদিন ঝগড়া লেগে থাকতো। আর অর্পন চলে যাবে ভেবেই ক্ষুন্ন হলো তার মন। আবার কত দিন পরে আসে কে জানে? অর্ষার বাবা আসিফ আলির আর তার বড় ভাইয়ের পরিবার খবর পেয়ে বাসায় ফিরে আসে। অর্পন সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়। দূরের রাস্তা যেহেতু দেড়ি করায়নি কেউ। দীর্ঘপথ অতিক্রম করে অর্পন যাচ্ছে কক্সবাজার। সে ভেবে পায় তার বাবা মা দুইজনই তো কুমিল্লার সন্তান তাহলে তারা কক্সবাজারে গেলো কেন? সেখানে তার একদমই ভালো লাগে না। কারন তার সব কাজিন রা কুমিল্লা আর ঢাকায় থাকে। পড়াশোনা খালি শেষ হোক। কুমিল্লা কিংবা ঢাকায় পার্মানেন্ট হয়ে যাবে। দীর্ঘ সাড়ে সাত ঘন্টা সময় পর নিদিষ্ট গন্তব্যে পৌছালো অর্পন। কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুললো আফসানা। বললো, ‘বাবা এসেছিস? কোনো সমস্যা হয়নি তো?’
বাসায় ঢুকলো অর্পন। জুতা খুলতে খুলতে চেহারায় বিরক্তি এনে বললো, ‘এতো দূরে আসতে কে বলেছে তোমাদের? এতোক্ষণ জার্নি করে আমার হাড্ডি মাংস সব এক হয়ে গেছে।’
হাসলো আফসানা। বললো, ‘তুই ফ্রেশ হ গিয়ে যা। আমি খাবার বাড়ছি!’
অর্পন নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে রুমে যেতে যেতে বলল, ‘খাবো না এখন। গোসল করে ঘুমাবো। ডাক দিও না। তুমি রুমে গিয়ে মামিকে জানিয়ে দাও আমি এসেছি।’ রুমে চলে আসলো অর্পন। দরজা বন্ধ করে ডিরেক্ট ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল করে বের হলো। তোওয়ালে দিয়ে হাল্কা পাতলা গায়ের পানি মুছে নিলো। অর্ধ ভেঁজা শরির নিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো লাইট বন্ধ করে। চোখে হাজার টা রাজ্যের ঘুম এসে হানা দিলো। ঘুমিয়ে গেলো অর্পন।
কেটে গেলো প্রায় মাস দেড়-মাস। স্বাভাবিক ভাবে মানবজাতির জীবন চলমান। ব্যস্ত নগরীতে মানুষ আপন কাজে ব্যস্ততায় আড়ষ্ট। পিচ ঢালা রাস্তায় দ্রুততার সঙ্গে চলমান গাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রীর ঠিকানা অব্ধি। ফুটপাতের পাশে বসে থাকা ফেরিওয়ালারা কাঠফাটা রোদে ঘাম জড়িয়ে বিক্রি করছে পণ্য। যাবেই কেটে যাচ্ছে প্রত্যেকের জীবন যাত্রার সময়। এই ব্যস্ত সময়ের মাঝেই নিভৃতে প্রনয় আসে। অর্পনের জীবনেও তাই ঘটেছে। নিভৃতের এই প্রনয়ের নামকরন করতে পারেনি সে। আর যখন উপলব্ধি করেছিলো তখন বড্ড দেড়ি হয়েছিলো। কক্সবাজারে আসার পর অর্ষার সাথে তেমন যোগাযোগ হয়ে উঠেনি তার। আগে যেমন মাঝে মাঝে একবার দুইবার ম্যাসেজ কুষলবিনীময় ঘটেছিল। এখনো তাই। সম্পর্কে পরিবর্তন এসে বন্ধুত্বের রূপ নিয়েছে। অর্ষার সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো মনে করে অর্পন নিজে আপন মনে হেসে উঠে। এর কারন অর্পনের জানা নেই। মাঝে মাঝে সে নিজেকে প্রশ্ন করে। আসলেই কি সে অর্ষার প্রেমে পরেছে? ভালোবাসে অর্ষা কে? পরোক্ষনে মাথা ঝামটা মেরে এসব চিন্তা মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে ফেলে। অর্ষা তার ফুফাতো বোন হয়। এটা কিভাবে সম্ভব? আবারো ভাবে সে। ফুফাতো বোনের সাথে তো বিয়ে বৈধ। তাহলে? ধ্যাৎ! নিজের চিন্তাভাবনাকে কুৎসিত নাম দিয়ে অন্যদিকে মন বসায়। মনে মনে পণ করে নেয় এইসব আজব চিন্তা সে অর্ষাকে নিয়ে করবে না।
অপরদিকে কুমিল্লায় অবস্থি অর্ষার দিন ভালোই চলছে। বাসা, ভার্সিটি, ফ্রেন্ড বলতে গেলে সব মিলিয়ে সে এখন খুব ভালো দিন কাটাচ্ছে। রিফাত নামে কোনো ব্যক্তি তার জীবনে ছিলো সেটা ভুলেই গেছে একদম। ভুলেও রিফাতের কথা তার শরণে আসে না। ভুল গুলোকে মনে রাখার কোনো প্রশ্নই আসে না। তবে ভুল থেকে মানুষ শুধরে যায়। অর্ষা তার জীবনের এমন চরম ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে। কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে নেই। অর্জনকে খুব করে সময় দেয় অর্ষা। বিজ্ঞান বিভাগের বিষয় গুলোতে অর্জন কাঁচা। এই বিষয় গুলোই অর্ষা তাকে টিউটরের মতো বুঝানোর চেষ্টা করে। অর্জন প্রথমে পড়ার প্রতি অনীহা প্রকাশ করলেও ধীরে ধীরে আগ্রহ বাড়ে তার। বিজ্ঞান বিভাগের বিষয় গুলো এমনই হয়। যতোই পড়বে ততোই আগ্রহ বাড়বে। আজ অর্জনের ক্লাস নাইনের অর্ধবার্ষীক পরিক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে । অর্ষা তার গার্ডিয়ান হিসেবে স্কুল থেকে মার্কশিট আনতে গিয়েছে। রেজাল্ট ভালোই করেছে অর্জন। বেশিরভাগ সাবজেক্টে ৬০+ মার্কের উপরে পেয়েছে। যদিও খুব ভালো রেজাল্ট না তবে অর্জনের জন্য তা চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা। যেই ছেলে কোনো রকমে টেনে টুনে পাশ মার্ক উঠাতো তার থেকে এমন রেজাল্ট পেয়ে অর্ষার বাবা মা দুজনই খুশি। হেনা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বিরিয়ানির আয়োজন তুলেছে। অর্ষার বাবা অর্জনের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘মাশা’আল্লাহ ভালো করেছো তুমি। ভালো করে পড়াশোনা করো। এসএসসি তে ভালো রেজাল্ট করতে হবে।’
আরো কিছুক্ষন উপদেশ দিলেন মোঃ আসিফ আলির। এক পর্যায়ে অর্জন রুমে চলে আসে। অর্ষা নিজেও রুমে আসার জন্য পা বাড়াতেই আসিফ আলির ডাক দিলেন।
‘তুমি আমার সিদ্ধান্ত কে সম্মান করো তো? বিশ্বাস আছে আমার উপর?’
প্রথমে বাবার এমন প্রশ্নে অবাক হলো অর্ষা। পরোক্ষনে ঠোঁটে হাসি টেনে শুধাল, ‘অবশ্যই সম্মান করি। আমি অনেক বিশ্বাস করি আপনাকে।’
‘তাহলে আমি তোমার বিয়ের ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নিবো তুমি মেনে নিবে তো? তুমি কি কাউকে পছন্দ করো? বলতে পারো আমাকে। তোমার নিজস্ব মতামতের অধিকার আছে।’
‘না আব্বু! আমার পছন্দ নেই। আপনি যা সিদ্ধান্ত নিবেন আমি তাতেই খু্শি। আমি জানি আপনি কখনো আমার খারাপ চাইবেন না।’
প্রসন্ন হলেন আসিফ আলির। সন্তুষ্টির হাসি দিলেন। অর্ষাও প্রতিত্তুরে হাসলো। অতঃপর পা চালিয়ে রুমে চলে আসলো। তার বাবা মা যেখানে বিয়ে ঠিক করবে সে সেখানেই করবে।কোনো প্রকার বিরুদ্ধতা করবে না।
চলবে??
নোট : ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত। একটু সমস্যা ছিলাম তাই বড় করতে পারিনি। ভুলত্রুটি মার্জনীয়। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ। হ্যাপি রিডিং।