চড়ুইপাখির বন্ধুত্ব .
মাইশাতুল মিহির [লেখিকা]
[০৪]
কুমিল্লা শহর আজ ব্যস্ত নগরীর রূপে। যানবাহনের তীব্র হর্ণের আওয়াজ, মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ পরিবেশ। ফুটপাতের পাশে বসে থাকা তৃষ্ণার্ত কুকুরের ঝাঁঝালো কন্ঠ ভাস্যমান। আকাশের উল্কাপিণ্ড তাপ কমিয়ে পরিবেশে এনেছে শীতলতা। তবুও যেন গরমের কমতি নেই। সূর্যের তীব্র তাপের ভ্যাঁপসা গরমের ছোঁয়া শরিরে স্পর্শ করছে না। কেবলমাত্র রুমে থাকা এসির কারনে। এসির শীতল হাওয়ায় শরির করেছে ঠান্ডা। সোফার দুই দ্বারপ্রান্তে অলসতার ভঙ্গিতে বসে আছে দুজন। হাতে তাদের যান্ত্রিক যন্ত্র। ভীষণ ভাবে ব্যস্ত ফেসবুকিং করায়। অর্পন নিরবতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করলো, ‘তুই যে রিলেশন করছোস মামা জানতে পারলে? এখন নাহয় লুকাচ্ছিস। পরে কি করবি?’
মোবাইলের থেকে চোখ তুলে অর্পনের দিকে তাকালো অর্ষা। সোফার এক কোনায় পা তুলে বসে আছে সে। স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো, ‘আমি জানি না।’
অর্পন কিছুক্ষন নিরব রইলো। তারপর অর্ষার দিকে ঘুড়ে বসে বললো, ‘মামা মনে হয় না মেনে নিবে।’
অর্ষার মন কিছুটা ক্ষুন্ন হলো। চেহারায় মলিনতা এলো তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা দুলালো। অর্পন তীক্ষ্ণ চোখে অর্ষাকে পর্যবেক্ষণ করছিল। পুরো এক মাস ধরে তার মাথায় ঘুরতে থাকা প্রশ্নটা আজ করেই ফেললো। বললো, ‘ভাবিস না। সময় আসলে দেখা যাবে। আচ্ছা অর্ষা! তোর বয়ফ্রেন্ড লাষ্ট মান্থে কোথাও ঘুরতে গিয়েছিলো?’
অর্ষা প্রথমে অবাক হলো এমন প্রশ্ন করায়। পরে ভাবতে লাগলো কিছুক্ষন। তারপর বললো, ‘হুম! লাষ্ট মান্থে কক্সবাজার আর সীতাকুণ্ড পাহাড়ে গিয়েছিল।’
বিস্মিত চোখে তাকালো অর্পন। তার ধারনায় ঠিক ছিলো। সে ভুল দেখেনি। লাষ্ট মান্থের ১৮ তারিখ কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকতে সে অর্ষার বয়ফ্রেন্ড মানে রিফাতকে দেখেছিলো। যদিও অর্ষা রিলেশনে যাবার আগে অর্পনকে রিফাতের ছবি ম্যাসেজে দেখিয়েছিলো। সেই এক বার দেখেই অর্পন রিফাতকে সেদিন চিনতে পেরেছে। ওইদিন শুধু রিফাত একা না। তার পাশে একটা মেয়েকেও দেখতে পেয়েছিলো অর্পন। তাদের দুজনের ব্যবহারই বলে দিয়েছে তারা কোনো কমিন্টমেন্টে আছে। তার পরেও অর্পন সিওর হওয়ার জন্য বললো, ‘কক্সবাজারে যাবার পরে তোকে কোনো ছবি দেয়নি ওই ছেলে? মানে রিফাত। দেখা তো আমাকে।’
ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো অর্ষা। অর্পনের হাবভাব বুঝতে পারলো না সে। তাই জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই এইসব জানতে চাইছিস কেন?’
‘আরেহ্, কোনো কারন তো নিশ্চয় আছে। দেখা ছবি গুলো। হারি আপ!’
অর্পনের অস্থিরতা দেখে ধাতস্ত হলো অর্ষা। মোবাইল থেকে অনেকক্ষণ ঘেটে একটা ছবি দেখালো সে। ছবি দেখে অর্পন আবারো বিস্মিত হলো। বলে উঠলো, ‘ওহ ইয়েজ! আমি ভুল দেখিনি। ওইদিন এই ছেলেই ছিলো।’
অর্ষা অর্পনের হাত থেকে মোবাইল ছু-মেরে নিয়ে নিলো। বললো, ‘সো হুয়াট? তুই যেহেতু কক্সবাজার থাকিস সেহেতু দেখতেই পারিস।’
অর্পন কন্ঠস্বরে অস্থিরতা এনে বললো, ‘হ্যা ওইদিন তোর বয়ফ্রেন্ড কে আমি দেখেছিলাম। তোকে আগেই বলেছি ব্যাটা আস্তো লু’ই’চ্চা। দেখ এখন তাই বের হলো।
বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ উচ্চারণ করলো অর্ষা। চেহারায় বিরক্তি ফুটিয়ে বললো, ‘হইছে তোর ঘ্যানঘ্যানানি? বাল যা এনতে ভাল্লাগতেছে না।’
অর্পন বললো, ‘আগে শুন আমার কথা। ওইদিন তোর বয়ফ্রেন্ডের সাথে একটা মেয়ে ছিলো। আর দুজনে খুব ক্লোজ ছিল। আই’ম ড্যাম সিওর তাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক আছে। তোকে ঠকাচ্ছে রিফাত। আগেই বলেছি ব্রেকআপ করে ফেল।’
অর্ষার বিরক্তি এবার ক্রোধে পরিণত হলো। সোফা থেকে ঠাঁস করে উঠে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বলে উঠলো, ‘তোর সমস্যা কি বলবি? তুই সবসময় রিফাতের পিছে পরে থাকিস কেন? রিফাত তোর কি ক্ষতি করেছে? আর একটা কথা ভালো করে শুনে রাখ রিফাত আমাকে অনেক ভালোবাসে। ঠকানো তো দূরে থাক সে আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। ফারদার তুই রিফাত কে নিয়ে কিছু বলবি না আমার সাথে। নাহলে ভুলে যাবো তুই আমার ফুফাতো ভাই হস।’
আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না অর্ষা। রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। রাগে তার শরির কাঁপছে। কি পেয়েছে অর্পন? যা খুশি তা বলবে? রাগ হচ্ছে তার। অর্পনের উপর ভিষন ভাবে রাগ হচ্ছে। মনে মনে ঠিক করে নিলো অর্পনের সাথে আর কথা বলবে না। জাহান্নামে যাক।
হতভম্ব হয়ে বসে আছে অর্পন। সে একশত পারসেন্ট শিওর সেটা রিফাত ছিল। ছবিও তুলেছিলো সে কিন্তু দূর্ভাগ্য-বশত সেই মোবাইলটা চুরি হয়ে যায়। মনে মনে নিজেকে শ-খানেক গালি দিলো। মুখ দিয়ে বিরক্তির উচ্চারণ করলো। এভাবে প্রমান ছাড়া কথা বলা উচিত হয়নি। তাছাড়া অর্ষা এই রিলেশনশিপ নিয়ে বেশি সিরিয়াস। এই ছেলে অর্ষাকে ঠকাচ্ছে। কিভাবে কি করবো? অর্ষা তো বিশ্বাস করছে না। তাহলে? আচ্ছা অর্ষা এখন রেগে আছে? আগে ওর রাগ ভাঙ্গাতে হবে। পরে যা করার করা যাবে। অর্ষার রুমে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায় অর্পন। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বিকেল প্রায় চারটা ছুঁই ছুঁই। তখুনি কলিংবেল বেজে উঠলো। অর্থাৎ অর্ষার বাবা মা আর অর্জন এসে গেছে। অর্পন এগিয়ে দরজা খুলে দিলো। হেনা ব্যস্ত হয়ে ভিতরে ঢুকে আফসোস করতে লাগলো।
‘আহারে ছেলেটা আমার এতোদিন পর বাসায় এসেছে বেড়াতে। তাকে ফেলে চলে গেলাম। কি খেলো আল্লাহ জানে। অর্পন তুই খেয়েছিস তো? অর্ষা সব দিয়েছে তোকে?’
অর্ষার বাবা আর অর্জন ভিতরে ঢুকে সোফায় বসলো। অর্পন হেসে উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ মামি! আপনি যা যা রান্না করে দিয়ে গেছেন সবই খেয়েছি আমরা।’
হেনা বোধহয় এতোক্ষনে টেনশন মুক্ত হলেন। বেড়াতে গিয়েছে তো কি হয়েছে? বাসায় থাকা দুই সন্তানের জন্য মনটা বেকুল হয়ে ছিলো তার। কি করছে, কি খেয়েছে, অসুবিধা হয়নি তো ভেবেই দুশ্চিন্তায় সারাদিন পার করেছে। অর্পনের কথায় প্রসন্ন হয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। অর্ষার বাবা বললেন, ‘সারাদিন বাসায় ছিলে নাকি? বাহিরে যাও নি?’
‘অর্ষা বাসায় একা তাই বাহিরে যায়নি। খেলা ছিলো বসে বসে তাই দেখেছি।’ অর্জনের পাশে বসে বললো অর্পন। অর্জন প্রফুল্লিত হয়ে বললো, ‘অর্পন ভাই তুমি ছিলে বলেই কিন্তু আমি কাকাদের বাসায় যেতে পেরেছি। নাহলে অন্য সময় খালি বাসা বলে ফকিন্নিটার সাথে আমাকে রেখে যায়। আর সারাদিন বাসায় বসে ঘোড়ার ঘাস কাটতে হয়।’
অর্পন ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মুখের সামনে এনে হাল্কা কেশে নিচু গলাগ বললো, ‘সাবধানে কথা বলো। মামা এখানেই আছে।’
মুহূর্তেই হাসি-মাখা মুখ-খানি গায়েব হয়ে গেলো অর্জনের। ভয়ার্ত চোখে অর্জন তার বাবার দিকে তাকালো। আসিফ আলির গম্ভীর মুখে কিছুক্ষন অর্জনের দিকে তাকিয়ে নিশব্দে উঠে চলে গেলেন। অর্পন আছে বিপাকে। ওইদিকে অর্ষা তার উপর রেগে আছে। অস্থিরতায় ভরে আছে মন। অর্ষার রাগ ভাঙ্গাতে হবে। যেভাবেই হোক!!
রাত্রীর আকাশে থালা ন্যায় চাঁদটা আলোকিত করে রেখেছে। ফাঁকে ফাঁকে কালো মেঘ ভেসে উড়ে বেড়াচ্ছে। ঝিঁঝিঁপোকার ডাকের ধ্বনি চারপাশে। কুমিল্লা শহর রাত্রীর অন্ধাকারে জ্যোৎস্নায় মুখরিত। ল্যাম্পপোস্টের আলো রাস্তায় পরে আলোকিত করেছে। নিজের বারান্দায় বসে ব্যস্ত নগরীর চলমান গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে অর্ষা। পাঁচ তলা বাসা থেকে রাস্তার গাড়ি গুলো ছোট ছোট পিঁপড়ার মতো লাগছে। কানে তার হেডফোন। যেখানে বেজে চলছে বাংলার ‘অর্থহীন-এপিটাফ’ ব্যান্ডের ‘আনমনে’ বিমুখীত গানটি। গানের রিলিক্সের সাথে সাথে সে নিজেও ঠোঁট নাড়াচ্ছে। আপন মনে গুন-গুন করছে..
আবার খুঁজে যাই তোমার সেই হাসি আনমনে
কত রাত নির্ঘুম কাটে তোমায় ভেবে
আকাশে যখন মেঘের ঘনঘটা তাকিয়ে থাকি আমি
হয়তো বৃষ্টি আজ ছোঁবে তোমার শরীর
মেঘের ওই দেশে কি হারাও আনমনে?
বৃষ্টির ওই ছোঁয়াতে কি আমায় খোঁজো এখনও?
কোলাহলপূর্ণ অলিগলিতে যান্ত্রিক যন্ত্রের তীব্র ধ্বনিতে গুনগুন করে উঠা গানটা মুখরিত। মৃদু বাতাসে চুল গুলো উড়ছে। আকাশের তারার পাশাপাশি চাঁদটা মোহনীয় লাগছে। চোখ বন্ধ করে মন ভরে নিশ্বাস নিলো অর্ষা। তার মন ভালো নেই। চিন্তায় বিষন্নতায় ছেঁয়ে আছে হৃদয়। রিফাতের উপর তার নিজেরও সন্দেহ হচ্ছে। ফোন ওয়েটিং থাকা, তাকে সবসময় ব্যস্ততার দেখানো। রিফাতের দিক দিয়ে রিলেশনশিপের ব্যাপার টা লুকানো। লেইট রিল্পাই, ইগনোর। আবার অর্পনের বলা কথা গুলো। সব মিলিয়ে মাথা ধরে এলো তার। চিন্তা করতে পারলো না আর। সে রিফাতকে বিশ্বাস করে। রিফাত কখনো তাকে ধোকা দিবে না। কখনোই না!
‘কিরে পুচকোনি? কি করছিস এখানে?’
অর্ষার বারান্দার রেলিং’এ হেলান দিয়ে বললো অর্পন। বেশকিছু সময় পরও অর্ষার সাড়াশব্দ না পেয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো তার দিকে অর্পন। দেখলো অর্ষা কানে হেডফোন লাগিয়ে রেলিং’এ দুই হাতের রেখে তার উপর থুতনি রেখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। অর্পন হেডফোন টান মেরে খুলে বললো, ‘লতা লাগিয়ে রাখা কি ধরনের অভ্যেস তোর? এতো সাউন্ড দিয়ে রাখিস কেন? মাথা ব্যাথা করবে পরে।’
প্রতিত্তুর করলো না অর্ষা। হেডফোন খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। অর্পনের ভালো লাগলো না। সে ভেবেছিল অর্ষা রাগবে। চেঁচাবে তার উপর। কিন্তু অর্ষার চুপচাপ সয্য হলো না তার। অস্থির হলো হৃদয়। বললো, ‘তুই এখনো আমার উপর রেগে আছিস?’
অর্ষা ক্ষুন্ন মনে শুধাল, ‘আরেহ্ না! ভালো লাগছে না আমার।’
‘কি হয়েছে আমাকে বল?’
চোখ তুলে তাকালো অর্ষা। ফুঁপিয়ে উঠতে চাইলো তার মন। চোখ লাল হয়ে এলো তার। নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। এক এক করে রিফাতের উপর থাকা তার সকল প্রকার অভিযোগ তুলে ধরলো অর্পনের কাছে। অর্পন শুধুমাত্র মলিন চোখে দেখছিলো অর্ষাকে। রুমের লাইট অন। সেখানের কিছু আলো এসে পরেছে বারান্দার কিছু অংশে। এই আবছা আলোতে অর্ষার পানি জমে থাকা লাল চোখ জুড়া স্পষ্ট দেখলো অর্পন। বুকে ধাঁরালো তীরের ন্যায় কিছু একটা বিঁধে উঠলো। রিফাতের উপর রাগ উঠলো তার। অর্ষার মতো হাসিখুশি চঞ্চল একটা মেয়েকে কাঁদানোর অধিকার কারোর নেই। অর্ষা শুধু প্রাণ খুলে হাসবে! মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়াবে নীল আকাশে।
অর্পন কিছু বললো না। নিরব থেকে অদ্ভুত রকমের এই দহনটা সয্য করতে লাগলো। আপাতত অর্ষার অভিযোগ ভুলে সে ভাবছে অন্য কিছু। তার এমন অনুভব হচ্ছে কেন? বা-পাশটা কাঁপছে। কেন? অর্ষার মন খারাপে তার নিজের মনও কেন ক্ষুন্ন হলো? উত্তর নেই তার কাছে। এই প্রথম এক প্রকার নতুন অনুভূতি আবিষ্কার করলো নিজের মাঝে। যার নামকরণ সে করতে পারেনি। তাই সেই অনুভূতিটা অহেতুক ধুলোই চাপা পরে রইলো।
‘ফুচকা এনেছি তোর জন্য। আমি জানি ফুচকা খেলে তোর মন খারাপ থাকবে না। খাবি?’
চোখের কোণে পানি থাকলেও মুখে মুচকি হেসে উঠলো অর্ষা। ডান হাতের উল্টো পিঠে চোখের নোনাজল মুছে অর্পনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ফুচকা এনেছিস আগে বলবি না? এতোক্ষনে সময় হলো বলার? গাদা! তাড়াতাড়ি আয় ফুচকা খেতে।’
খুশিতে গদগদ করতে করতে চলে গেলো অর্ষা। অর্পন এখনো আগের মতো রেলিং’এ হেলান দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। এক মনে তাকিয়ে রইলো অর্ষার যাওয়ার দিকে। আজ নিজেকে বড্ড বেখাপ্পা লাগছে। অর্ষার মন খারাপে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছিলো। কেন? উত্তর মিললো না তার। উত্তর থাকুক আর না থাকুক! সে চাই অর্ষা সবসময় হাসিখুশি থাক। ভালো থাক। মন খারাপ নামে কোনো শব্দ যেন অর্ষার মনের ডিকশনারি তে না থাকে।
চলবে ??