চড়ুইপাখির বন্ধুত্ব .
মাইশাতুল মিহির [লেখিকা]
[০৩]
অর্পন আসার পরের তৃতীয় দিনের সকালটা অন্যান্য দিনের মতো সুন্দর ভাবে শুরু হয়নি অর্ষার। রাগে দুঃখে গাজর চাঁবাতে ইচ্ছে করছে তার। বাথরুমের টেপ ছেড়ে বসে আছে এখন। চুলে তার এক হালি ডিমের আস্তরণ। সেগুলো পরিষ্কার করতে করতে হাত ব্যাথা হয়ে গেছে প্রায়। ইচ্ছে করছে অর্পনের পা:ছা’য় দুইটা লা:থি মারতে। অশ্রাব্য ভাষায় অর্পনকে গালি দিল কয়েকটা। অন্যান্য দিনের মতোই ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়েছিলো অর্ষা। দরজা খোলে বাহিরে পা রাখতে দেড়ি; মাথার উপর চার চারটে ডিম ছুড়তে দেড়ি হয়নি। অর্ষা রুম থেকে বের হবার অপেক্ষায় ছিল অর্পন। যেই রুম থেকে বের হলো, সেই চারটা ডিম এক সাথে মাথায় ছুঁড়লো। তারপর দাঁত কেলিয়ে বললো, ‘তোকে হেব্বি লাগছে!’
আকর্স্মিক ঘটনায় অর্ষা তব্দা খেয়ে গেল। মুখ তার তাৎক্ষনাৎ ফাক হয়ে গিয়েছিল। ডিমের কুসুম মাথা থেকে বেয়ে বেয়ে পরছে অর্ষার কপালে। ডিমের রসে ভিজে চুঁপসে সে। রেগে গলার আওয়াজ দ্বিগুণ করে বলে উঠলো, ‘কু:ত্তা! এটা তুই কি করলি?’
‘কেন দেখতে পারছিস না? ডিম মেরেছি ডিম। মানে আন্ডা! চিনোস না?? ওয়েট আরেকটা এনে দেখিয়ে দিচ্ছি।’
রাগে অর্ষার শরির কাঁপছে। গিজগিজ করতে করতে কাটকাট গলায় বললো, ‘তোর সাহস তো কম না। তোরে আমি… তোরে তো। তুই এমন করলি কেন কু:ত্তা?’
বিরক্তিতে অর্পন মুখ দিয়ে ‘চ’ জাতীয় উচ্চারণ করে।
‘চেঁচাচ্ছিস কেন? তোর বাঁশ মার্কা গলার আওয়াজে বেল্ডিং ফেটে যাচ্ছে। আমার কান শেষ। আস্তে কথা বল।’
অর্ষা তার কথায় পাত্তা দিল না। বরং তাকে পাশ কাটিয়ে রান্না ঘরের দিকে ‘আম্মু’ ডাকতে ডাকতে গেল। কিন্তু হেনা সেখানে ছিল না। তাই সে ড্রয়িংরুমে এসে চেঁচাতে লাগলো, ‘আব্বু কোথায়? আব্বু?? আম্মু কোথায় তোমরা??’
ভ্রুঁ কুঁচকালো অর্পন। অর্ষার পিছু পিছু আসতে আসতে বললো, ‘মামা, মামি কে খুঁজছিস কেন?’
অর্ষা সোফা থেকে কুষন কভার তুলে অর্পনের দিকে ছুঁড়ে ফেললো। তারপর বলল, ‘তাদের জানাতে হবে না? তাদের অতিশয় ভদ্র পোলা ঠিক কি পরিমানের উগান্ডার বান্দর। সাতসকাল একটা মেয়ের শরিরে ডিম ছুঁড়ে মারে। শয়:তান পোলা।’
অর্পন এক গাল হেসে কুশন কভারটি বুকে জড়িয়ে ধরে শুধাল, ‘যা গিয়ে বল! তাতে আমার কি? আমিও বলবো তাদের অতিশয় ভদ্র মেয়ে মোবাইলে প্রেম করছে। যা! তুই বললে আমিও বলবো। মামা মামি ইকবাল মামাদের বাসায় গেছে। আয় একসাথে তাদের কাছে যাই।’
অর্ষা রাগে দাঁতে দাঁত পিষে কটমট চোখে তাকালো। দুই হাত উঠিয়ে অর্পনের গলা টিপে দেওয়ার ভঙ্গিতে তাকালো। গটগট পায়ে রুমে চলে গেলো। অর্পন হেসে ফেললো উচ্চস্বরে। হাসতে হাসতে সোফায় পরে তার গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। বাথরুমে বসেও এখন অর্পনের হাসির আওয়াজ পাচ্ছে অর্ষা। দাঁতে দাঁত পিষে চুল পরিষ্কার করে গোসল করে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে নিল। এতো সকালে গোসল করার কারনে নিজেকে কেমন বিবাহিত লাগছে অর্ষার। অর্পনকে শায়েস্তা করতেই হবে! শয়:তান ছেলে বুঝাতে হবে অর্ষা তার থেকে কোনো অংশে কম নয়।
ড্রয়িংরুমে টিভি চলছে। খেলার আওয়াজ ভেসে আসছে সেখান থেকে। হাতে রিমোট নিয়ে খুবই মনোযোগের সাথে খেলা দেখছে অর্পন। কিছুসময় পর অর্ষা হেলেদুলে এসে তার পাশে বসলো। অর্পন একপলক তার দিকে তাকিয়ে আবারো খেলায় মনোযোগী হলো। অর্ষা চুল গুলো পিছে ঠেলে ভাব নিয়ে টেনে টেনে সুরালো গলায় ডাকলো, ‘অ..র্প..ন?’
ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো অর্পন। একবার ভালো করে অর্ষার আপাতমস্তিষ্ক ভালো করে দেখে টিভির উপর চোখ রাখলো। অর্ষা আবারো ডাকলো, ‘অর্পন বেবি? এই দিকে তাকাও?’
সামনে তাকিয়েই অর্পন শুধাল, ‘হুম বল!’
অর্ষা আবারো বললো ‘আমাকে কেমন লাগছে জান?’
অর্পন অর্ষার দিকে তাকালো। তারপর সোফায় হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজল। সন্দেহ লাগছে প্রচুর। সকালে এতো বড় কান্ড ঘটনোর পরেও অর্ষা এতো শান্ত কিভাবে? সেতো ভেবেছিল ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়েই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে ফেলবে। আর সে জন্য অর্পন নিজেও প্রস্তুত ছিল। কিন্তু হলো টা কি? এত্ত আদর আসছে কোথা থেকে? না ব্যাপার টা সহজ ভাবে নেওয়া যাবে না। সাবধানের মান নেই। অর্পন উত্তরে বললো, ‘প্রতিদিনকার মতোই শয়তান লাগছে।’
রাগে শরির রিনরিনিয়ে উঠলো অর্ষার। কিন্তু উপরে উপরে মোটেও রাগলো না। বরং মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ‘জি না! তুই নিজের অজান্তেই অনেক উপকার করলি। দেখ দেখ আমার চুল গুলো কত্ত সিল্কি লাগছে। এমনিতেও সাপ্তায় একবার ডিম দেই চুলে। উফফ ইয়ার মাঝে মাঝে এমন উপকার করতেই পারিস। ভালো করে দেখ চুল গুলো। কত্ত সিল্কি সিল্কি লাগছে। উফফ লুক লাইক নায়কা নায়কা নায়কা।’
অর্ষার ঢং দেখে মৃদু হাসলো অর্পন। এই মেয়ের স্বাভাব গুলো বরাবরই হাস্যকর লাগে তার কাছে। অনার্সে পড়ুয়া এতো বড় মেয়ের এমন বাচ্চা সুলভ আচরন। এখানে আসলেই তা অর্পন দেখতে পায়। যদিও অর্পনের সাথেই অর্ষা এমন ব্যবহার করে। নাহলে অন্যদের সাথে বেশ ভদ্র আর মিচিউরড সে। অর্ষার সঙ্গে ঝগড়া করার মাঝে এক অন্যরকম আনন্দ আছে। অর্পন কে হাসতে দেখে অর্ষাও আনমনে হেসে ফেললো। অতঃপর সোফায় হেলান দিয়ে বসে টিভি দেখতে লাগলো।বেশ কিছুক্ষন খেলা দেখার পরে বিরক্ত হয়ে গেল অর্ষা। রাগে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘কি ম:রা খেলা দেখতাছোস? বাল! রিমোট দে।’
বলেই এক হাত এগুলো রিমোট নিতে। অর্পন রিমোট দূরে সরিয়ে বললো, ‘ইম্পসিবল। খেলার আসল মজা টা এখন। পরে নিস।’
তেঁতে উঠলো অর্ষা। তেঁড়ে এলো অর্পনের হাত থেকে রিমোট নিতে। অর্পন তড়িঘড়ি করে উঠে সোফার অপর পাশে চলে গেল। অর্ষা চেঁচাল, ‘রিমোট দে আমি স্টার প্লাস দেখবো।’
‘আরেহ কি প্লাস দেখবি। দুই বছর আগে যেই প্যাঁচানো কাহিনী দেখছি এখনো সেটাই চলতেছে। ওই আরেক বেডির সংসারের কাহিনী দেখে তুই কি করবি? তার চেয়ে ভালো আয় দুজন মিলে পপকর্ন খাই আর খেলা দেখি।’
‘নেবার! এই ঝিমাইন্না ম:রা খেলা দেখি না। তুই রিমোট দে সিরিয়াল দেখবো আমি। এখন এই ম:রা খেলা চলবে না। রিমোট দে কইতাছি অর্পইন্নার বাচ্চা।’
অর্পন তার জায়গায় অটল। সে কিছুতেই রিমোট দিবে না। তর্ক হলো দুজনের মাঝে। অর্ষা এগিয়ে টিভি বন্ধ করে দিল। সুইচের পাশে দাঁড়িয়ে রইলো যেন অন করতে না পারে। অর্পন অনেকক্ষন অনুরোধ করার পরেও অর্ষা টিভি অন করলো না। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে অর্পন বললো, ‘তোর কি লাগবে বল রিমোট বাদে।’
অর্ষা কিছুক্ষন ভাবলো। এমনিতেও টিভি তে দেখার মতো কিছু নেই। হুদাই এমন করছে। লাভ যেহেতু হচ্ছে সেহেতু কিছু চেয়ে ফেলাই ভালো। বেশ কিছুক্ষন ভাবার পর বললো, ‘সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। ক্ষিদে লাগছে খুব। তোর মোবাইল দে ফুটপান্ডা দেখি।’
‘জি না। মামি রান্না করে দিয়ে গেছে। ওই গুলার কি হবে? বাহিরের খাবার খাওয়া যাবে না। ঘরের রান্না খাবি এখন।’
‘ওকে ফাইন। খেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে, দেখার ইচ্ছে করছে তোর, করুক! তাতে আমার কি? আমি তো টিভি অফ রেখে খেলা দেখতে না দেওয়ার লোক।’
বলেই লম্বা হাই তুলল অর্ষা। অর্পন বিরক্তিতে দাঁতে দাঁত পিষলো। কিছু না বলে রাগে কটমট করতে করতে চুপচাপ মোবাইল এগিয়ে দিল। অর্ষা মোবাইল হাতে নিয়েই খুশিতে গদগদ করতে করতে ফুটপান্ডা এপ ওপেন করলো। অর্পন টিভি অন করে সোফায় বসলো। অর্ষার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে একপলক তাকিয়ে খেলা মনোযোগ দিলো।
দীর্ঘ চল্লিশ মিনিট পর ফুটপান্ডা থেকে অর্ডারকৃত খাবার এলো। কলিংবেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে গিয়ে দরজা খুললো অর্ষা। তারপর খাবার প্লেটে সাজিয়ে টেবিলে বসলো দুইজন। এক সাথে সকালের নাস্তা শেষ করলো বেলা দশ-টায়। খাওয়ার সময় কোনো প্রকার কথা বলেনি। চুপচাপ খেয়ে নিল দুজন। খাওয়া শেষে অর্ষা রুমে চলে গেলো আর অর্পন সোফায় বসে খেলা দেখতে লাগলো।
অর্ষা রুমে এসে হেনাকে কল দিলে হেনা বললো, ‘শুন, আমাদের আসতে দেড়ি হবে। বিকেলে আসবো। আমি রান্না করে দিয়ে আসছি। দুপুরে গরম করে খেয়েনিস তোরা। অর্পনকে ভালো করে প্লেটে খাবার দিবি নাহলে অর্পন নিজে থেকে নিবে না। ছেলেটা বেড়াতে এলো ভালো করে যত্ন আপ্যায়ন করতে পারছি না। খেয়াল রাখিস ওর।’
বিরক্ত হলো অর্ষা। বললো, ‘দুধ আর ফিডার কই রাইখা গেছো? বলো অর্পনকে দুধের ফিডার খাওয়াই। বাচ্ছা ছেলে যত্ন নিতে হবে।’
‘চর লাগাবো মেয়ে। যা বলছি মনে রাখিস। দুপুরে না খেয়ে থাকিস না।’
আরো কিছুক্ষণ উপদেশ দিল হেনা। তারপর কল কেটে দিলো। অর্ষা যেন এবার হাফ ছেঁড়ে বাঁচলো। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে ফেসবুকে লগ ইন হলো। রিফাত কে অনলাইন দেখলো। তারপর সাথে সাথে রিফাতকে কল দিলো। কয়েকবার রিং হবার পর রিফাত কল রিসিভ করলো। অপর পাশ থেকে ভেসে আসলো পুরুষ-নালীর প্রসন্ন কণ্ঠস্বর।
‘হ্যালো ম্যাডাম! কেমন আছেন?’
রিফাতের কন্ঠে ম্যাডাম ডাক শুনে লাজুক হাসলো অর্ষা। উত্তর দিলো, ‘ভালো! তুমি?’
‘ভালো! নাস্তা হয়েছে? নাকি ভুলে গেছো?’
‘না খেয়েছি। কোথায় তুমি? কাল রাতে কল দিলাম ধরলে না যে? ব্যাকও করলে না।’
‘আব্ আসলে কাল একটু ব্যস্ত ছিলাম। আই’ম সরি জান। তবে আজ সারা দিন-রাত তোমাকে দিবো প্রমিস।’
ঠোঁট চেপে হাসলো অর্ষা। বিছানার হেড সাইডে হেলান দিয়ে ফোনালাপ করতে লাগলো। প্রথম দিনের মতোই অজানা ভালো লাগা কাজ করছে তার মনে। তাদের সম্পর্কের বয়স ছয় মাস চলমান। লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপ তাদের। এখনো কেউ কারোর সাথে সামনা-সামনি দেখা করে নি। রিফাতের বাড়ি রাজশাহী। বর্তমানে সে ঢাকায় পড়াশুনা করছে। অর্ষা বর্তমানে অনার্স প্রথম বর্ষে পরিক্ষা দিয়েছে। দ্বিতীয় বর্ষে কিছুদিন পর ভর্তি হবে। রিফাত তার থেলে চার বছরের বড়। ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে পরিচয় হয় তাদের। প্রথমে শুরুটা অন্যান্য মানুষের মতো কুষলবিনীময়ের মাধ্যমে হলেও পরে বন্ধুত্ব, তারপর প্রনয়।
চলবে. ??
নোট : গল্পটা কারোর পছন্দ হয়নি? রেসপন্স এতো কম কেন? হ্যাপি রিডিং ??