#চোরাবালি_৫
রেশমা আক্তার
লানার ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। সে নিজেকে আবিষ্কার করল জোহারের বেডরুমের বিছানায়, একা। প্রথমে বুঝতে সময় লাগল। উঠে বসে, চোখ বন্ধ করে সে অনেক্ষণ কালকের ঘটনাগুলো ভাবল। কিছুটা অবাকও লাগছে যে, একটা পুরো রাত পার করে সকালে সে এখানেই জেগে উঠেছে। এমনটা আগে হয়নি।
চটপট উঠে লানা প্রথমে বাইরে উঁকি দিল। নিচে জোহার বা মুন কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। লানা কি ঘর থেকে বের হবে?
হঠাৎ মাথায় একটা ব্যাপার কাজ করল। লানা লাগোয়া ওয়াশরুমে ঢুকে একটু ফ্রেশ হয়ে নিল। তার কালকের সাজ পোশাক তেমনই আছে।
বের হয়ে সে জোহারের শোবার ঘরটা বেশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করল। সে যখন সোহা, তখন এটা তারও বেডরুম। লানা একটা ব্যাপার বেশ সহজভাবে মেনে নিয়েছে, আর তা হল, স্বপ্নদৃশ্য হোক বা অবচেতন মনের কারসাজি হোক। সে এখানে সোহা, আর জোহার তার হাজবেন্ড। নিশ্চিতভাবে তাহলে মুন তার আর জোহারের সন্তান। এটা তার নিজের বানানো জগত। কিন্তু তা বলে এখানে সবকিছু তো তার মনের মত করে চলছে না। এখানেও আলাদা কিছু চরিত্র, পারিপার্শিকতা, কিছু ঘটনা, জীবনধারা আছে। লানার সেটাই জানার আগ্রহ।
জোহারের ঘরের একদিকে তিন পার্টের একটা কেবিনেট। লানা উঠে গিয়ে পাল্লা খুলল। এটা সেটা নানান কিছু ঘাটতে থাকল। বিশেষ করে সেদিন সোহার ঘরের আলমারিতে দেখা ছবির এ্যালবাম, ডায়েরীর কৌতূহলটা আজও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সেগুলো পরে আর ওখানে ছিল না। তার মানে কেউতো সেগুলো সরিয়েছিল। আর সেটা জোহার হওয়াই স্বাভাবিক। তাহলে জোহারের কেবিনেটে সেগুলো কি পাওয়া যেতে পারে?
লানা তন্ন তন্ন করে খুঁজল, পেল না। তবে ভিন্ন কিছু পেল। কিছু পুরনো নিউজ পেপার। স্বনামধন্য দৈনিক পত্রিকা। যার কিছু কিছু মার্কার দিয়ে হাইলাইট করা। লানা বেশ কয়েকটা নিয়ে এসে বিছানার এক কোণে বসল।
‘রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় একটি তিনতলা ভবনের ছাদ থেকে দুই বছরের একটি শিশু পড়ে গিয়ে নিহত। শিশুটির নাম পিহু, সে প্রসিদ্ধ ‘ব্লু সি বিচ’ গ্রুপ অফ কোম্পানীর মালিক রায়হান আহমেদের নাতনী। শিশুটির মৃত্যু, দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত হত্যা তা নিয়ে তদন্ত করছে পুলিশ। স্বন্দেহ ভাজণ বাড়ির কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদে বেড়িয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।’
খবরটা এখানে শেষ। পরের পাতাটা নেই। আরেকটা খবরের কাগজে বলা হয়েছে
‘ নিজের সন্তানকে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার স্বনামধন্য ‘ব্লু সি বিচ’ কম্পানীর মালিকের একমাত্র মেয়ে সোহানা আহমেদ’
পত্রিকার হেডলাইন এটা এবং নিচে সোহার সাদাকালো একটা ছবি।
আরেকটা পত্রিকায় বড় বড় করে লেখা
‘ ধানমন্ডির ‘নীলকুঞ্জ’ নামে খ্যাত একটি বাড়িতে তিনতলা ছাদ থেকে পড়ে পিহু নামের একটি শিশুর রহস্যময় মৃত্যু’
লানা পত্রিকার তারিখ দেখল, একুশ, চার, দুই হাজার পনেরো।
দরজায় জোহারের চাপা গলা
– কি করছ তুমি সোহা?
লানা চমকে উঠল
জোহার দ্রুত এসে কেড়ে নিল পত্রিকাগুলো। বলল
– এসব কেন বের করেছ ?
জোহার দুমরে মুচড়ে কাগজগুলো তার লকারে ছুড়ে মেরে আলমারি লক করে দিল। কাছে এসে লানার হাতদুটি চেপে ধরে বলল
– কতদিন বলেছি, ওগুলো আর দেখবে না। ওসব আর মনেও করবে না। ওটা একটা দুর্ঘটনা ছিল, আমরা মেনে নিয়েছি। কে কি ভাবছে বা ভেবেছে তাতে আমাদের কিছুই যায় আসে না সোহা। আমরা পিহুর বাবা মা, এটাই সত্যি। তুমি আর ওসব নিয়ে ভেব না। পুলিশ, আইন, প্রশাসন সব টাকা দিয়ে আমি মুখবন্ধ করে দিয়েছি। পরিচিত জগত, লোকজন সব ছেড়ে তোমাকে নিয়ে চলে এসেছি শহর ছেড়ে দূরে, পাহাড়ের এই বাংলোতে। এখানে আমরা নতুন করে বাঁচব। আমাদের কোল আলো করে মুন আছে। ওকে নিয়েই বাকি জীবনটা আমরা এখানে কাটিয়ে দেব। তুমি অতীতের সব ভুলে যাও সোহা।
স্থির কিন্তু তীব্র কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে লানা, জোহারের দিকে।
লানার হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলো জোহার। টেবিলে বসিয়ে বলল
– আজ কি আমরা একসাথে ব্রেকফাস্ট করতে পারি না?
লানা মাথা হেলিয়ে সায় দিল। জোহার বাটিতে কর্নফ্লেক্স নিয়ে তাতে দুধ ঢালছে। লানা তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। আচ্ছা লানা কি জোহারকে তার স্বপ্নের ব্যাপারটা বলবে? যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, জোহার বেশ পরিষ্কার চিন্তার মানুষ। বললে যদি কিছুটা হলেও বুঝতে পারে। আর না বুঝলেও ক্ষতি কি? লানার তো এ সময়টা খারাপ কাটে না। সাজেক ট্যুরের চাইতেও এ ট্যুরটা অনেক বেশী রোমাঞ্চকর।
লানা চামচ দিয়ে খাবার মুখে দিচ্ছে। জিজ্ঞেস করল
– মুন কোথায়…?
জোহার একটু তাকিয়ে থাকল, বলল
– কেন তোমার মনে নেই, আমি মুনের জন্য একজন আয়া রেখেছি গত মাসে?
– ও…
– রুকমি, মুনকে নিয়ে লনে, দোলনায় খেলছে। তুমি লোকজন পছন্দ কর না, ওকে বলা হয়েছে। ও বাড়ির ভেতর প্রয়োজন ছাড়া ঢুকবে না। যদি মুনের দরকার হয় তখন আমাকে জিজ্ঞেস করে আসবে।
– ও…
জোহার লক্ষ্য করল, সোহার মুখে প্রতিদিনকার মত কাঠিণ্যটা আর নেই। বেশ সহজ ভঙ্গিতে সে খেয়ে নিল। খাওয়া শেষ হলে, জোহারকে অবাক করে দিয়ে কিচেনে গেল এবং নিজের জন্য কফি তৈরি করল। জিজ্ঞেস করল
– আপনি কফি খাবেন?
জোহার ভূতগ্রস্থের মত মাথা হেলাল।
– আমি কিন্তু র কফি খাই, উইদআউট শুগার।
আপনি?
– আমিও…
– ইন ফ্যাক্ট, আমি অন্য কোন কফি বানাতেও পারিনা..
– নো.. প্রবলেম…
জোহার হা করে দেখছে সোহাকে।
লানা টেবিলে দু’টো কফির কাপ এনে রাখল, একটা এগিয়ে দিল জোহারের দিকে।
জোহার কফি টেনে নিয়ে কাপে চুমুক দিল। তিক্ত স্বাদের ব্ল্যাক কফি।
লানা বসে আছে মুখোমুখি। সে বলল
– জোহার, আমি এখন আপনাকে কিছু কথা বলব। কথাগুলো শুনে হয়তো আপনার পাগলের প্রলাপ মনে হতে পারে। তবে যেটা বলব, সেটাই সত্যি।
– বলো.. শুনছি
– জোহার, আমি আসলে আপনার স্ত্রী সোহা নই।
– তাহলে তুমি কে?
– আমার নাম এ্যালানা…। সংক্ষেপে আমাকে সবাই লানা বলেই ডাকে
– বাহ, বেশ ভালো নাম তো। একটা ওয়েস্টার্ন ভাইব আছে।
– হুম, আমার জন্ম হয়েছিল আমেরিকাতে। এক আমেরিকান দম্পতি আমার নাম রেখেছিলেন।
– এটা তো আমার জানা, সোহা। তোমার বাবা মা আমেরিকাতে ছিলেন। তবু তুমি মনে করে আবার আমাকে বলছ, জেনে ভালো লাগছে..
– জোহার, আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না?
জোহার আহত কন্ঠে বলল
– জানিনা সোহা, ইদানিং সত্যিই আমি বুঝতে পারি না, কোনটা আমার বিশ্বাস করা উচিৎ বা কোনটা উচিৎ নয়।
লানা বুঝতে পারছে, এই জটিল পরিস্থিতিটা আসলে কাউকে বোঝানো সম্ভব না। আসলে বাস্তবে তো এমন কোন ঘটনার অস্তিত্বই নেই।তবু কেন যেন বলতে ইচ্ছে করল জোহারকে।
জোহার ঝুঁকে এসে লানার আঙুল স্পর্শ করল, বলল
– তোমার ভেতর ক’জন সোহা বাস করে জানতে চাই না আমি। আমি শুধু জানি তুমি আমার স্ত্রী সোহানা, আমাদের একটা ছোট্ট বেবি আছে, মুন। এর বাইরে আমার আর কিচ্ছু জানবার নেই, চাইবার নেই সোহা। আমি শুধু এভাবে, এখন যেমন, তোমাকে সবসময় এমনই চাই। আজকের এই সোহাকেই আমি ভালোবাসি। আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই আমার।
লানা বিষয়টা সহজ করতেই বলল
– বিষয়টা আমি আপনাকে আরেকটু বুঝিয়ে বললে, আপনি হয়তো বুঝতে পারতেন
– আপাতত এই আপনি আপনিটা বন্ধ হোক। আর নিতে পারছিনা। এর চাইতে তুমি যখন মারমুখী হয়ে আমাকে আঘাত কর, সেও সুখকর।
– আঘাত করি…? আমি…?
জোহার খালি কাপ নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল
– তুমি বিশ্রাম নিতে চাইলে নিজের ঘরে চলে যেতে পার। আমি বরং দেখে আসি মুন, রুকমির সাথে কি করছে।
জোহার কাপগুলো কিচেনে রেখে চলে গেল বাইরে। লানা উঠে পড়ল। তবে সে নিজের ঘরের দিকে গেল না। তার হালকা দুশ্চিন্তা হচ্ছে যে, এই যে দীর্ঘ সময়ের জন্য সে সোহার জায়গায় আছে, ওদিকটায় কি হচ্ছে? বাস্তবে কি করছে লানা? বাবুনরা নিশ্চই এতক্ষণে পৌঁছে গেছে সাজেক। লানা ফিরে গেলে কিছুই মনে করতে পারবে না। এখন কি ঘটছে জানতেও পারবে না।
লানা নিজের ঘরে গেল না। সে ভাবছে, আজ পুরো বাড়িটা একটু ঘুরে দেখবে। এমন সুযোগ তো বারবার আসে না। যেকোন সময় ঘুমটাও ভেঙে যেতে পারে।
লানা ডানদিক ধরে এগোলো। যে ঘরটায় ঢুকল, সেটা সেদিনকার ঘরটা। থরে থরে বই সাজানো আলমারি। বেশ লম্বাটে ঘর। একদিকে একটা ডিভান। মাঝখানে গোল পড়ার টেবিল। বইয়ের আলমারি গুলো দেয়াল লাগোয়া তবে প্রতিটা আলমারির কোনা বের হয়ে আছে। মনে হচ্ছে একটার পেছনে আরেকটা। খুব সুন্দর পাজেলের মত। স্বপ্নদৃশ্যে এত বই কেন দেখছে সে, জানেনা। তারতো তেমন পড়ার অভ্যেস নেই।
আচ্ছা, এই যে জোহার আর মুনকে নিয়ে তার সংসার, লানা কি সত্যিই এমনটা চেয়েছিল? অবচেতনে সত্যিই কি লানা এমন একটা সংসার কল্পনা করত, যেখানে জোহারের মত একজন কেয়ারিং, লাভএবল হাজবেন্ড থাকবে। একটা পুতুলের মত সুন্দর মেয়ে থাকবে।
তার ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসা নিজেদের সংসারটা তাকে কোন ভালো অনুভূতি দেয়নি। নিজের বাবা মায়ের দাম্পত্য কলহ দেখতে দেখতে ক্লান্ত বিতশ্রদ্ধ। বিয়ে, স্বামী সংসারের প্রতি তীব্র অনীহা তার। তারপরও প্রথম জীবনে একটু ভালোলেগে যাওয়া মানুষটা প্রতারণা করায় জীবন সম্বন্ধে দর্শনটাই পাল্টে গিয়েছিল লানার। তবু কোন ফাঁকে এমন সুন্দর একটা স্বপ্ন রচিত হয়েছিল মনের মধ্যে, কে জানে। তাও আবার এমন অদ্ভুত। যেন জেগে জেগে দেখা স্বপ্ন।
লানা বুকশেলফগুলোতে হাত বোলাতে বোলাতে হাঁটছে। প্রচুর ধুলোপড়া, কোথাও কোথাও মাকড়সার আদি বসতবাড়ি। শুরুতে এটা ছোট্ট একটা স্টাডি মনে হলেও আজ ভালো করে দেখে শুনে মনে হল, এটা বিশাল একটা লাইব্রেরী। লানা আর এগোবে কিনা ভাবছে। বাড়ির একটা পাশ ঘেঁসে লম্বা, টানা লাইব্রেরী এবং লনটা ঘুরে উঁচু হতে হতে দোতলায় উঠে গেছে। সারি সারি শেল্ফ। তবে অনেক শেল্ফই বইশূণ্য। মনে হচ্ছে সুদীর্ঘকাল এর কোন যত্ন বা দেখভাল হয়নি। সামনে পথটা বাঁক নিতেই কেমন অন্ধকার ঘুপচি, বড় বড় মাকড়সার জাল আটকে আছে পথ।
লানা থেমে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছুটা ফিরে আসতেই হাতের বা দিকে একটা চৌকোণা জায়গা। দেয়ালে আলগা কাঠের দরজার মত। তবে কোন নব বা হাতল নেই। লানা এগিয়ে গিয়ে কাঠের ওপর হাত রাখল। একটু চাপ দিতেই পাল্লাটা একদিকে ঢুকে গেল।
ভেতরে ফাঁকা জায়গা, অন্ধকার মত। কাঠের ফলকটি লানার নাক বরাবর, খাটো। সুতরাং ভেতরে কি আছে দেখতে হলে লানাকে নিচু হয়ে ঢুকতে হবে।
লানা উঁকি দিল। ভেতরে অন্ধকার। কেমন পুরানো ধূলোর গন্ধ। লানার কৌতূহল বাড়ল। বেশ রোমাঞ্চকর লাগছে। এটা কি কোন স্টোররুম বা কোন গুপ্তঘর?
নিচে ডাকছে জোহার, সোহা… সোহা নাম ধরে।
ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসছে লানার কানে। কাঠের ফলকটি ঠিক মত রেখে ফিরে এলো সে। ফিরে এসে লানা জোহারকে দেখতে পেল না কোথাও। লানা নিজের ঘরে গেল, শাওয়ার নিল। বেশ ফ্রেশ লাগছে এখন তার। হাতের কাটা আঙুলটা বেশ টনটন করছে। কাল অতটা খেয়াল হয়নি তবে আজ দেখল, কাটা বেশ গভীর। পানি লাগায় খুব জ্বালা করছে। লানার হঠাৎ ঘুমে কেমন দু’ চোখ জড়িয়ে আসছে। এ অসময়ে এমন ঘুম পাবারতো কথা নয়। তার মানে কি লানা ফিরে যাচ্ছে?
একটা ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়। সেই সাথে কাটা আঙুলে তীব্র জ্বালা। লানা ঢলে পড়ল ঘুমে। তীব্র যন্ত্রণাময় অবধারিত ঘুম।
বিকট একটা আওয়াজে ঘুম ভাঙল লানার। লাফ দিয়ে সে উঠে বসল বেডে। ঘরটা হালকা অন্ধকার। বারান্দার কাচের দেয়ালে আছড়ে পড়ছে বৃষ্টির ঝাপটা। সেই সাথে প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস আর থেকে থেকে বজ্রপাত। লানা ভীত চোখে চারিদিকে দেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করল, সে কোথায়?
না, এটা তো সোহারই ঘর। তার মানে সে এবারও ফিরতে পারেনি। বাইরে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। বেলা বোঝা যাচ্ছে না। জোহার কোথায়?… মুন?
লানা তারাহুড়ো করে নামল বেড থেকে। রুম থেকে বের হয়ে নামল নিচে। পুরো বাড়িটা কেমন অন্ধকার হয়ে আছে। একটা ঝকঝকে চার্জার লাইট জ্বলছে এবং ঝুলছে ডাইনিং স্পেসে। কোথাও কোন জানালা কপাট খোলা আছে হয়তো। ঝড়ো বাতাস ঢুকছে ঘরে। বাতিটা দুলছে বিপজ্জনকভাবে।
ঝড় বৃষ্টি খুব ভয় পায় লানা। জোহার কোথায় গেল? সারাদিন নিজের ঘরে ঘুমিয়ে কাটাল সে, কেউ ডাকল না?
– জোহার.. জোহার….? মুন…?
লানা বেশ কয়েকবার ডেকেও সারা পেল না কারও। একটু ভয় ভয় লাগছে তার। হঠাৎ খেয়াল করল সদর দরজাটা হাট করে খোলা। বাতাস আর বৃষ্টির দাপট আসছে ওখান থেকেই।
লানা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। বাইরে বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী।
লানা দরজা বন্ধ করল। জোহার আবার বাইরে যায়নি তো?
ফিরে এসে মুনের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল লানা। জোহারের ঘর থেকে ভেসে আসছে কান্না। লানা প্রায় দৌড়ে গেল জোহারের ঘরে। ঘর অন্ধকার। লানা ঘরের মাঝখানে রাখা একটা বেবি কটে দেখতে পেল মুনকে।
দৌঁড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিল তাকে। মুন হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিল। এ ঘড়েও নেই জোহার। লানা নিচে নামল মুনকে কোলে নিয়ে। মুনের সম্ভবত ক্ষুধা পেয়েছে। লানা মুনকে জোর করে কার্পেটে নামিয়ে দিয়ে কিচেনে এলো। সেখানে সমস্ত সরঞ্জামাদি ছিল। লানা চটপট মুনের ফিডার তৈরি করল। ফিরে এসে কোলে তুলে নিল তাকে। খাবার পেয়ে লানার কোলে ঢুলতে ঢুলতেই আবার ঘুমিয়ে পরল মুন। ঠিক এমন সময় বাইরের দরজায় কড়া নাড়ল কেউ।
লানার ভয় লাগছে খুব। তবু একটা বিশাল সম্ভাবনা আছে, এটা হয়ত জোহার। বুকে সাহস সঞ্চার করে তাই এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
দরজা খুলতেই আপাদমস্তক রেইনকোটে ঢাকা জোহার ঢুকে পড়ল। তবে সামনে দেখা দৃশ্যটা ছিল তার জন্য চমকপ্রদ, বিস্ময়কর। সোহা নিজের হাতে খাবার তৈরি করে খাওয়াচ্ছে মুনকে?
– কোথায় ছিলেন আপনি জোহার?
বৃষ্টির শব্দে লানার গলার স্বর জোহার শুনতে পেল কিনা বোঝা গেল না। সে অপলক তাকিয়ে দেখছে মুনকে, সোহার কোলে।
জোহার ভেতরে এসে ভেজা কাপড় ছাড়ল। বলল
– সেই বিকেল থেকে ঝড়বৃষ্টি সোহা, তুমি একটুও টের পাওনি? দু, দু’বার তোমার ঘরে গিয়ে ডেকে এলাম। কোন সাড়া নেই। এদিকে বজ্রপাতে বৈদ্যুতিক লাইন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আলো আসবে না আজ। চার্জারের আলো থাকতেই রাতের কাজ সেরে শুয়ে পড়তে হবে, বুঝলে?
মুন কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
লানা নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে দেকল মুন ঘুমন্ত। জোহার বলল
– ওকে শুইয়ে দিয়ে এসো, রাতের খাওয়াটা সেরে ফেলা দরকার।
– উপরে তো আলো নেই…
– কিছু করার নেই সোহা, কারেন্ট নেই, জেনারেটর নষ্ট। এখন এই একটা বাতিই আজ রাতের ভরসা। তুমি যাও, বাতিটা আমি এমন জায়গায় রাখছি যাতে উপরে কিছুটা আলো যায়।
জোহার আলো নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। লানা বলতে পারল না, তার খুব ভয় লাগছে, সে একা মুনকে নিয়ে যেতে চায় না উপরে। কিন্তু বলতে পারল না।
কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠলেই জোহারের ঘর। লানা শুইয়ে দিল মুনকে
টেবিলে নিস্তেজ হয়ে পড়া চার্জের আলোয় কোন রকম খাওয়া মিটল তাদের। জোহার হাঁচি দিচ্ছে বারবার। সে তেমন কিছু খেতে পারল না। কেমন লালচে লাগছে তার চোখগুলো। জোহার বলল
– তুমি কি অন্ধকারে একা যেতে পারবে নিজের ঘরে?
এমন প্রশ্নে লানা দু’ দিকে তীব্র মাথা নাড়ল। জোহার দ্বিধান্বিত। সোহা কী তার ঘরে থাকতে চায়?
জোহারের মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে তার জ্বর আসছে।
সে ধীরে ধীরে উঠে গেল নিজের ঘরে। লানাও ভয়ে ভয়ে অনুসরণ করল তাকে। তার কি করা উচিৎ বুঝতে পারছে না সে। অন্যদিন হলে কি হত জানা নেই। তবে আজ এই ঝড়বৃষ্টির অন্ধকার রাতে একা ঘরে থাকার প্রশ্নই আসে না। অথচ জোহার একজন অচেনা পুরুষ তার জীবনে। অযাচিত ও অনিচ্ছাতেই সে জোহারের স্ত্রী আর মুনের মম্। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে তার কি করা উচিৎ? স্বামী সন্তান নিয়ে সুখী সুখী ভাব নেয়া উচিৎ? নাকি সে যে সোহার শরীরে লানা, সেকথা তীব্র চিৎকার আর প্রতিবাদে বারবার জানিয়ে দেয়া উচিৎ জোহারকে। কি প্রমাণ দেবে সে? স্বপ্নদৃশ্যে প্রমান দিয়েই বা লাভ কি?
জোহার ঘরে এসে একবার মুনের কটের দিকে তাকাল। তারপর বিছানায় এসে ধপাস করে বসে পড়ল। সে সোহার দিকে তাকাতে পারছে না। সে সোহাকে চলে যেতেও বলতে পারছে না বা বলতে চাইছেও না। আবার সোহাকে নিজের কাছে আমন্ত্রণ জানাতেও পারছে না। তবে তার মন তীব্রভাবে চাইছে সোহা থাকুক। আজকাল সোহাকে বড্ড ভালো লাগে। মনে হয়, এমন সোহার জন্যই প্রতীক্ষা ছিল তার।
লানা বুঝতে পারছেনা, মুন কি সাধারণত কটেই ঘুমায়? জোহার তো তার ব্যাপারে বলল না কিছু। লানা তাহলে কোথায় শোবে? জোহারের বিছানায়?
জোহার শুয়ে পড়েছে। লানা ধীরে ধীরে এসে বসে পড়ল বিছানার অন্যধারে। কতক্ষণ বসে আছে জানে না সে। এ কেমন অদ্ভূত সময় পার করছে লানা। কোথায় এসে আটকে গেল তার সময়? জীবনটা আসলে সবটাই কি সত্যি বা বাস্তব? নাকি এই যা যা ঘটে, সম্পর্ক, ঘটনা, দুর্ঘটনাটা, এসবই আমাদের স্বপ্নদৃশ্য? কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা বাস্তব, সত্যিই কি জানি আমরা?
জোহার বিড়বিড় করে কি যেন বলছে।
লানা একটু এগিয়ে এসে শোনার চেষ্টা করল।
ভীষণ কাঁপছে জোহার।
– সোহা… সোহা… প্লিজ, আমাকে ধরো। আমি নিচে পড়ে যাচ্ছি সোহা…
লানা আড়ষ্ট হাতে জোহারের কপাল স্পর্শ করল। যা ভেবেছিল তাই। জ্বর এসেছে জোহারের। লানার স্পর্শে কাছে চলে এলো জোহার। দুহাতে লানার কোমড় জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। জ্বরে থরথর করে কাঁপছে জোহার।
কাঁপছে লানাও…।
( চলবে)