চোরাবালি পর্ব ৪

0
234

#চোরাবালি_৪
রেশমা আক্তার

লানা শপিংএ বেড়িয়ে কিছুটা দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে। লিস্টে কয়েকটা জিনিসের নাম দেখে কেমন অদ্ভুত লাগছে। যে জিনিসগুলো লানার কোন প্রয়োজনই নেই সেগুলো সে লিস্টে কখন লিখল বা কেনইবা লিখল বুঝে উঠতে পারছে না। নিজের হাতের লেখাও বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। খুব মনে করার চেষ্টা করল, হয়ত তাড়াহুড়োয় লিখেছে। অন্য কেউ কি লিখেছে? রাতের বেলা সে ছাড়া ঘরে আর কে থাকবে?

সবচেয়ে অবাক কান্ড হল অষুধ কিনতে গিয়ে। লানার ওপর দায়িত্ব ছিল ট্যুরের জন্য একটা মেডিসিন বক্স নেয়ার। সেইমত প্রয়োজনীয় সমস্ত অষুধের লিস্ট করা হয়েছিল। কিন্তু এখন এমন কিছু অষুধের নাম পাওয়া গেল যেগুলো লিস্টে থাকার কোন কারণই নেই। তাছাড়া এসব অষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেউ দিতে রাজিই হল না।

লানা বাড়তি জিনিসগুলো কিনল। তবে অষুধ কিনতে ঘুরতে হল তাকে অনেক। লানার কেন যেন মনে হল, নামগুলো লানাই লিখেছে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে সে একটা সমাধানই পেয়েছে, সেটা হল, সে আসলে ডি আই ডি নামক একটা জটিল অসুখে ভূগছে। যে রোগের চরিত্র হল, নিজের মধ্য অনেকগুলো পারসনালিটির বিচরণ। স্বপ্ন সংক্রান্ত জটিলতার এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা। সোহাকে সে নিজেই নিজের মস্তিষ্কে জন্ম দিয়েছে। সুতরাং, ট্যুর থেকে ফিরে তার প্রধান কাজ হবে একজন ভালো সাইক্রিয়াটিস্টের সাথে এটা নিয়ে আলোচনা করা। আপাতত তাকে নিজেকেই অসুখটা নিয়ে একটু তথ্য উপাত্ত জোগাড় করতে হবে।

লানা বাসায় ফিরল। ব্যাগ প্যাক করল। তাদের প্রথম ফ্লাইট স্টেশন চিটাগং। সেখান থেকে বাই রোডে লোকাল গাড়িতে খাগড়াছড়ি, তারপর সাজেক। লানা দু’দিন থেকে নীলকে ধরতে পারছে না। যদিও নীল ট্যুরের বিষয়ে লানাকে অনেক উপদেশ ও নিষেধাজ্ঞা বেঁধে দিয়েছে। তথাপি লানা তার বন্ধুদের সাথে মজা করুক, ভালো কিছু সময় কাটাক এটাও চায় সে।

পাঁচজনের টিম, লানা, নওফা, মিতা আর ছেলে বলতে বাবুন আর শাহের। কিন্তু এয়ারপোর্ট গিয়ে লানার মাথাটা ঘুরে গেলো। ব্যাগপ্যাক নিয়ে হাস্যজ্জ্বল মুখে অপেক্ষা করছে ইমাদ। লানা বলল
– আরে ইমাদ, তুমিও যাচ্ছ নাকি কোথাও?
– হুম কর্পোরেট লাইফ থেকে একটু মুক্তি নিচ্ছি।, ইন ফ্যাক্ট আমি তোমাদের সাথেই যাচ্ছি…

লানা বন্ধুদের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। বাবুন তাকে একদিকে সরিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল
– লানা শোন, এটা নীলের প্ল্যান। মজার ব্যাপার হল, আমাদের পুরো ট্যুরটা নীল স্পন্সর করছে। আর ইমাদকে বন্ধু হিসেবে আমাদের ট্যুরে এক্সেপ্ট করতে বলেছে।

লানা আহত ও বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল
– আর তোরা সেটা মেনে নিলি?
– আরে আমরা তো কিছু বুঝতেই পারিনি। নীল আমাকে ফোনে বলেছিল, তোর প্রতি যেন বিশেষ খেয়াল রাখা হয়। কাল জানিয়েছে, আমাদের টিকেট কনফার্ম করা হয়েছে আর ইমাদের ব্যাপারে তোকে আগে থেকে যেন কিছু না বলি। এটা নাকি তোর জন্য একটা প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ হবে।
– প্লেজেন্ট মাই ফুট। আমার সমস্ত আনন্দটাই মাটি করে দিল।
– এখন আর কি করবি? তবে দলে একজন সিনিয়র ভাই থাকলে ভালই হবে। দেখ সবার কথা ভেবে মেনে নে। ছেলেটাকে ভালইতো মনে হচ্ছে…
লানার ইচ্ছে করছে এক দৌড়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যেতে। সে হতাশায় মাথার চুলে বিলি কাটল। নীলের ওপর ভীষণ রাগ লাগছে। তবে বন্ধুদের এতদিনের প্ল্যানটা নষ্ট করতেও মন চাইল না। লানা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বলল

– ওকে…
লানার উচ্চতায় হালকা ভয় আছে। প্লেনে নিজের আসনে চোখ বন্ধ করে বসে আছে সে। তার পাশে মিতা। ইমাদ এসে হাসিমুখে মিতাকে বলল
– ডিয়ার সিস্টার, এটা আমার সিট। তুমি অনুগ্রহ করে নিজের সিটে চলে যাও…

লানা চোখ বন্ধ করেই বলল
– ইমাদ, আমার কিন্তু যেকোন সময় বমি হয়ে যেতে পারে। সেজন্যই, তুমি বরং ওদিকটায় বস। মিতা এখানেই থাক।
ইমাদ খানিকটা দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। লানা হঠাৎ বমির ভাণ করে ‘ ওয়াক’ শব্দ করতেই ইমাদ দ্রুত পেছনের সিটে চলে গেল। লানা চোখ পিটপিট করে হাসল মিতার দিকে তাকিয়ে।

চিটাগং এয়ারপোর্টে নেমে তারা একটা ভাড়া গাড়িতে চেঁপে বসল। এখানেও মিতার পাশে বসল লানা। মিতা ফিসফিস করে বলল
– ছেলেটা তোকে দারুণ পছন্দ করে রে।
– আই ডোন্ট কেয়ার
– ইউ শ্যুড টেক হিম ইন ইয়র হার্ট
– নো ওয়ে… গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়তে বল, সেটা সম্ভব।
হাসল মিতা। পেছনে উঁকি দিয়ে বলল
– মুখটা কেমন কালো করে বসে আছে দেখ।
– তোর এত পিরিত থাকলে তুই গিয়ে সঙ্গ দে না..?

মিতা সিরিয়াস ভঙ্গিতে উঠে যাচ্ছিল। লানা টেনে বসাল তাকে।
– একদম পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিব কিন্তু..
হি হি হি করে হাসল মিতা।
পেছনে শাহের আর বাবুন কি নিয়ে যেন ব্যাপক আলোচনা করছে। তাদের সাথে অগত্যা জয়েন করেছে ইমাদ। নওফা ফোনে ব্যস্ত। লানাও চোখ বন্ধ করে থাকল কিছুটা সময়। লানার পাহাড়ে কিছুটা ভীতি আছে, তবু ভয় আছে বলেই ব্যাপারটা এক্সাইটিং হবে, বলেছিল বাবুন। এরকম ট্যুর লানার জন্য এই প্রথম। এসব যে তার খুব ভালো লাগে তা নয়। হৈ চৈ, লোকজন বরং সে খানিকটা এড়িয়ে চলে। তবে কেন যেন মনটা নিজেকে নিয়ে কোথাও পালাতে চাইছিল। বিশেষ করে ওই স্বপ্ন সংক্রান্ত জটিলতা থেকে মুক্তি নিতেই হুট করে বাবুনদের এই প্ল্যানে শামিল হয়ে গেছে সে। কিন্তু ইমাদের উপস্থিতি ট্যুরের এক্সাইটমেন্টে জল ঢেলে দিয়েছে। নীল যে কেন ইমাদকে তার সাথে জড়াতে চায় কে জানে। নীল খুব ভালো করে জানে, ইমাদকে পছন্দ করে না লানা। একমাত্র বিত্তবান হলেই তাকে মেয়েদের জন্য সুপাত্র ভাবাটা বোকামী নয় কি?

তাদের গাড়িটা ক্রমশ শহুরে জানজট, লোকজন, ব্যস্ততা থেকে একটু একটু করে প্রকৃতির মধ্যে প্রবেশ করছে এখন। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে লানা।

দরজায় টক টক টক শব্দ হতেই মাথা তুলে চোখ খুলল লানা। সে বসে আছে একটা আয়নার সামনে। উস্কুখুস্কু ছোট ছোট চুল গুলো নেমে এসেছে ঘাড় পর্যন্ত। কেমন অদ্ভূত সাজ। চোখে মোটা করে দেয়া কাজল। ঠোঁটে ডার্ক ওয়াইন ম্যাট লিপস্টিক। কি বাজে লাগছে সোহাকে। দরজায় আবারও শব্দ হল। লানা উঠে গিয়ে দরজা খুলল।
জোহার তাকে প্রায় ঠেলে ভেতরে এসে দরজা ভেজিয়ে দিল। বলল
– এখনও তৈরি হওনি…?

ভালো করে তাকিয়ে দেখল লানাকে, আহত গলায় বলল
– এ কেমন সেজেছ সোহা…? আজ একটা বিশেষ দিন। অন্তত প্রেজেন্টেবল কিছু পর। একটা শাড়িটারি পর। দেখ গেস্টরা চলে এসেছে। এই পাহাড়ে, এতদূর যারা আমাদের কথা ভেবে এসেছে, তোমার কি উচিৎ না তাদেরকে একটু আপ্যায়ণ করা?

লানা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সে উঠে গিয়ে ভেজানো দরজাটা সামান্য খুলে দেখল নিচে আলো ঝলমল করছে। বেলুন টেলুন দিয়ে সাজানো। আট, দশজন নারী পুরুষ অতিথি। মুন একটা প্রিন্সেস ড্রেসে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

লানা দরজা বন্ধ করে তাকাল জোহারের দিকে।
জোহার বলল
– একটা শাড়ি পরবে?
লানা বাধ্য মেয়ের মত মাথা হেলাল
– এইতো, লক্ষ্মী মেয়ে। দাঁড়াও..
বলে জোহার আলমারি খুলল। একটা কেবিনেট ভর্তি শাড়ির মিছিল। জোহার হাতড়ে হাতড়ে একটা নীল রঙের সুন্দর শাড়ি বের করে আনল। শাড়ির সাথে আনুসাঙ্গিক সবকিছু নামিয়ে দিয়ে বলল। তুমি ওয়াশরুমে গিয়ে দ্রুত মুখটা ওয়াশ করে এসো, তারপর শাড়ি পর। আমি একটু বরং নিচে গিয়ে দেখি।

লানা কথা শুনল। সে মুখ ধুয়ে নিল। আয়নায় তাকিয়ে ভাবল। তারা এখন খাগড়াছড়ির পথে। অনেকটা পথ। সুতরাং এখানে এসে ভালই হল, সময়টা ভালো কাটবে।
ওয়াশরুম থেকে বের হতে হতে লানা ভাবল, আচ্ছা তার হঠাৎ এটা কেন মনে হল? এখানে এসে সে তো আর লানা থাকে না, সে হয়ে যায় সোহা। একজনের স্ত্রী, একটি বাচ্চার মা। তাহলে তার কেন মনে হল, এখানে এলে তার সময়টা ভালো কাটে? ভালো সময় কাটানোর কি আছে এখানে? এখানে কি এমন ভালো লাগে লানার…?

ব্লাউজ, পেটিকোট পরে, শুরু হল শাড়ি নিয়ে কসরত, কিছুতেই শাড়ি ম্যানেজ হচ্ছে না। একমাত্র লানাই বুঝি প্রথম মেয়ে, যে জীবনে কখনও শাড়ি পরেনি। প্রায় দশ মিনিট পরে আবার এসে উঁকি দিল জোহার। দেখল শাড়ি নিয়ে জুবুথুবু হয়ে টুলের ওপর বসে আছে সোহা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভেতরে এলো জোহার। বলল
– কি হচ্ছে বলতো? আর কত সময় নিবে?

লানা চট করে দাঁড়িয়ে আবার শাড়ি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বুঝে নিল জোহার ব্যাপারটা।
– তুমি কি শাড়ি টারি পরাও ভুলে গেলে সোহা…?
লানা চোখ তুলে তাকিয়ে বলল
– আসলে… পারছি না…

শ্লথ, কিছুটা হতাশ মুখে এগিয়ে এলো জোহার। লানার হাত থেকে শাড়ির দায়িত্বটা তুলে নিল নিজ হাতে। নিজের শরীরে, বুকের কাছে লানা চেঁপে ধরে আছে শাড়িটা। এত কাছ থেকে, একজন অচেনা মানুষ তার কাপড়ে, শরীরে হাত দেবে?

জোহার শাসনের চোখে তাকাল লানার দিকে। লানা ছেড়ে দিল নিজেকে। কি অদ্ভূত, লানার বাঁধা দিতে ইচ্ছে করছে না একটুও। কেমন অভিভূত, ঘোরের মধ্য ডুবে আছে যেন সে। জোহারের আলগা স্পর্শ, তার নিশ্বাসের ছোঁয়া, আর একান্ত মননিবেশে কেমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রইল লানা কিছুটা সময়। শাড়ি পরা হয়ে গেল। জোহার, লানার দু’ বাহু স্পর্শ করে নিয়ে এসে আয়নার সামনে বসাল। চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে প্রাসাধনগুলো এগিয়ে দিল। বলল,
– দু’ মিনিট টাইম
লানা বুঝে নিল।
চটপট সেজে নিল হালকা। জোহার পেছন থেকে একটা লাইট ওয়েট নেকলেস ঝুলিয়ে দিল গলায়। অপূর্ব লাগছে সোহাকে। কাছে টেনে, আয়না থেকে একটা টিপ নিয়ে এসে কপালে পরিয়ে দিল লানার। মুগ্ধ দৃষ্টিতে জোহার তাকিয়ে আছে লানার দিকে।
লানার ভেতর ভালোলাগা, লজ্জা আর অস্বস্তি মিলে একরকম মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। সে জানে জোহার লানাকে দেখছে না, জোহার দেখছে সোহাকে। হয়তো জোহার তার স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসে। কে এই সোহা? লানার কেন যেন মনে হল, সেই সোহা। সুতরাং হিসেবে জোহার তারই হাজবেন্ড। সোহা নামক চরিত্রটা যদি তার নিজের তৈরি হয় তবে এ সংসার, জোহার, মুন তো এক অর্থে লানারও। যদিও এটা স্বপ্ন, তবুও কিছু স্বপ্ন মধুর হয়, ভালোলাগে।

জোহার লানার একটা হাত ধরে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে সিঁড়িতে নেমে গেলো।

নিচে অপেক্ষমানরা হৈ হৈ করে উঠল। কেউ কেউ হাততালি দিল। দৌড়ে আসছে ছোট্ট মুন। লানার হাসিহাসি মুখ। সে মুনকে কোলে তুলে নিল। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক বয়স্ক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। বললেন
– ইট’স সো গুড টু সি ইউ ব্যাক…সোহা ডিয়ার..

লানা প্রশ্নবোধক তাকাল তার দিকে। জোহার এসে সহজ করে দিল। বলল
– সোহা আজ অনেকদিন পরে শাড়ি পরল।
ডক্টর পার্থ বললেন
– এজন্যই এত ভালো লাগছে।
জোহার তাড়া দিল, বলল
– সোহা, আর দেরী নয়। ক্যাটারিং এর লোকজন চলে যাবে, ওদেরকে অনেকটা পথ যেতে হবে। ডিনারটা দ্রুত সার্ভ করে দিতে বলেছি। এসো কেকটা কেটে ফেলি।

এরপর বেশ ভীড় এগিয়ে এলো। মুনকে কোলে নিয়ে জোহার লানাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরল। বেশ ফটোসেশন হল কিছুক্ষণ। কেক কাটা হল। জোহার লানাকে, কেক তুলে খাওয়াল। লানাও ইতস্তত হাতে খাওয়াল জোহারকে। যদিও সে এখনও উপলক্ষটা জানে না। কি জানি, আজ হয়তো মুনের বা সোহার অথবা জোহারের জন্মদিন। কিংবা সোহা আর জোহারের ওয়েডিং এনিভার্সেরি।

অতিথিরা খাবারের জায়গায় চলে গেল। প্রায় ত্রিশ, চল্লিশ জনের আপ্যায়ণের আয়োজন। বাড়ির সামনে আলোকিত লনে টেবিল সাজানো। সেখানে অপেক্ষমান আরও কিছু অতিথি। ফুলের তোড়া আর উপহারের প্যাকেট হাতে এগিয়ে এলেন অনেকেই। বোঝা গেল আজ সোহা আর জোহারের এনিভার্সেরি। খাবার সার্ভ করা হয়েছে সেখানেই। লানা এই প্রথম বাড়ির বাইরেটা দেখতে পেল। রাতের বেলা হলেও বুঝে নিল এটা একটা বাংলো টাইপের বাড়ি। চারিদিকে ঘন গাছপালা। তবে বাড়ির প্রধান ফটক পর্যন্ত আলোর সুব্যবস্থা। কেমন তাজা বাতাস। নিশ্বাসে স্বস্তি। বাতাসে একটা অচেনা ফুলেল সৌরভ।

লানা দূর থেকে তাকিয়ে দেখছে। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা রেলিংএ ভর দিয়ে। তারও কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন ডক্টর পার্থ আর জোহার, কিছুটা অন্ধকারে, চিন্তিত মুখে।
জোহার নিচু গলায় বলল
– কি ভাবছেন ডক্টর..?
– হুম, দিস্ ইজ্ ভেরি আনইউজুয়াল। এতটা শান্ত, এতটা স্বাভাবিক…
– এটা আবার কোন নতুন সমস্যার ইঙ্গিত নয়তো?
– হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। তবে ক্যারেক্টারিজেশনে সোহার এই রূপটা একদম নতুন লাগছে
– আমারও..। সেদিনও এমন সহজ, সাবলীল ছিল। মনে হয়েছিল অনেকদিনপর আমি এক নতুন সোহাকে দেখছিলাম। কিছুটা কাছে যাবার চেষ্টাও করেছিলাম। আর তারপরতো দেখলেনইতো। হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই ভারী ফুলদানী দিয়ে আমার মাথায় এমন আঘাত করল…। সত্যিই আমি বাঁচব আশা করিনি।

– হুম, দুঃখজনক..
– কিন্ত, আর কত.. ডক্টর? কয়েকটা দিন মুনকে দিয়েছিলাম ওর কাছে, ইদানিং ওই ঘটনার পর আর দিতে সাহস করিনি
– হুম, ভালো করেছ।
– আপনিতো জানেন, আমাদের প্রথম বাচ্চাটার দুর্ঘটনার পর আমি এখন সবসময় মুনকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকি।
– আহা জোহার, সেটা ছিল একটা দুর্ঘটনা।
– কি জানি ডক্টর, আপনি আমার কাছের মানুষ বলেই বলছি। আজকাল কেন যেন মনে হয়, পিহুর দুর্ঘটনাটা কোন সাধারণ দুর্ঘটনা ছিল না।
– কি বলছ তুমি জোহার? আফটার অল শি ইজ আ মাদার…
– তাতো অস্বীকার করছি না ডক্টর। কিন্তু পরপর এতগুলো দুর্ঘটনা কবলিত মৃত্যু…
– তুমি ঠিক কি বলতে চাইছ জোহার, বলতো?

সম্বতি ফিরে পেল যেন জোহার। বলল
– না, না তেমন কিছু না। বলতে চাইছি সোহার কথা। ওর ওই শান্ত, সহজ মুখাবয়বের আড়ালে আবার কোন কুটিল, হিংস্রতা লুকিয়ে নেইতো?

চিকন চোখে, চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকল ডক্টর পার্থ, দূরে দাঁড়ানো হাস্যজ্জ্বল লানার দিকে।

লানা অতিথিদের কারও কারও সাথে ভদ্রতাসূচক হাই, হ্যালো করছে। যদিও সে এদেরকে চেনে না। তথাপি এ ধরণের পার্টিতে একটা কমন এটিকেট থাকে। আর লানা এসবে অভ্যস্ত।

জোহার দূরে দাঁড়িয়ে আছে ডক্টর পার্থর সাথে। ওদের মধ্যে কি কথা হচ্ছে কে জানে। তবে জোহারকে আজ দারুণ সুপুরুষ লাগছে। ফর্মাল পোশাকে এর আগে কখনও দেখেনি সে জোহারকে। চোখ আটকে যাচ্ছে লানার বারবার। নিজেকে কেমন হ্যাংলা লাগছে। ভীষণ হাসিও পাচ্ছে। এই যে এতকিছু, এসব লানার স্বপ্নদৃশ্য। তবে সাধারণ স্বপ্ন থেকে এটা অনেক অনেক ব্যতিক্রম।
খাওয়া দাওয়া মিটল সবার। কিছুক্ষণ আড্ডা হল জটলা করে করে। বেশ রাত করে
অতিথিরা চলে গেলেন বিদায় নিয়ে। ক্যাটারিং এর লোকজনও সব গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল।
ড্রয়িংরুমে অনেকগুল গিফটবক্সের সামনে বসে আছে লানা। জোহার এখন ক্যাজুয়াল পোশাকে। সে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে লানাকে। মুন হঠাৎ কোত্থেকে একটা চাকু হাতে নিয়ে এলোমেলো পায়ে এগিয়ে আসছে। একইসাথে শংকিত লানা আর জোহার। বেশ সতর্কভাবে লানা খপ করে ধরে ফেলল মুনের হাতটা। যদিও লানার এমন সচেতনতায় আপ্লুত জোহার তবু কিছুটা শংকিতও, মুনকে নিয়ে, মুনের মমকে নিয়েও।

মুন হঠাৎ প্রতিবাদী হল। শক্ত করে ধরে থাকল চাকুটা। লানা কেড়ে নিতে চাইল। সামান্য কসরতে খুলে পড়ল মুনের হাত থেকে। দৌড়ে এসে কুড়িয়ে নিল জোহার। পরাজয়ে কেঁদে উঠল মুন। লানা তাকে শান্ত করতেই তুলে নিল কোলে।
কোলে নিয়ে পিঠে আদর করতে করতে গুনগুন করল লানা। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জোহার। লানা সারা ঘরে হাঁটছে মুনকে কোলে নিয়ে। কি সাধারণ অথচ অপূর্ব এবং দুর্লভ দৃশ্য।
মুন কেমন স্থির হয়ে এসেছে। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত তো অনেক হল।

হঠাৎ চোখ আটকে গেলো লানার হাতে। লানার আঙুল গড়িয়ে পড়া রক্ত মেখে যাচ্ছে মুনের সাদা জামায়। জোহার এগিয়ে এসে ধরল লানার হাতটা। টেনে নিয়ে দেখল, কেটে গেছে অনেকটা। কিছুটা ব্যস্ত হল জোহার। লানার বাঁধা সত্বেও দ্রুত কটন, এ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল আঙুলটা। লানা ইঙ্গিতে বোঝাল, মুন ঘুমিয়ে পড়েছে, জোহার যেন শব্দ না করে। জোহার কৃত্তিম তর্জনী টিপল নিজের ঠোঁটে।
লানা ইশারায় জানতে চাইল, মুন কোথায় শোবে?
জোহার নিতে চাইল মুনকে। লানা বাঁধা দিল, ফিসফিস করে বলল
– আমাকে বলুন, আমি শুইয়ে দিয়ে আসছি…
জোহার আঙ্গুলিনির্দেশ করল নিজের ঘরের দিকে। লানা, মুনকে নিয়ে চলে গেলো জোহারের ঘরের দিকে।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জোহার, তার ধারণাই ঠিক। সোহা আসলে ঠিক নেই। কারণ, সোহা আজও তাকে আপনি আপনি সম্বোধন করছে। ইদানিং প্রায়ই এটা করছে ও। তার মানে সোহার মাল্টিপল পার্সনালিটি ডিসঅর্ডার এখনও সক্রিয়। এতটুকুও ইমপ্রুভ হয়নি।
অনেক রাত পর্যন্ত নিচে সোফায় বসে থাকল জোহার। আকাশপাতাল অনেক চিন্তা করল। কোন সুরাহা পেল না।
সোহা এখনও নামছে না কেন? ও ঘরে তো ওর থাকার কথা নয়। সোহার শোবার ঘর আলাদা। সোহা তার নিজের ঘরে একা থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে ।
জোহার ক্লান্ত পায়ে উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল নিজের ঘরে। সেখানে গিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল জোহার। বিশাল বিছানায় মুনকে জড়িয়ে ধরে একপাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সোহা। জোহার কি ডেকে তুলে দেবে সোহাকে? কেন যেন ইচ্ছে করছে না। বহু বছরের কাঙ্খিত এই দৃশ্য মিথ্যে করে হলেও আজ সত্যি ভাবতে ইচ্ছে করছে জোহারের। একটা সুখী, সুন্দর, ছোট্ট পরিবার।
জোহার ধীরে ধীরে এসে মুনের অন্য পাশটাতে শুয়ে পড়ল। একটা হাত সন্তপর্ণে স্পর্শ করল ঘুমন্ত সোহার একটা হাতকে।

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here