#চোরাবালি_৩
রেশমা আক্তার
দু’দিন যাবৎ লানার সময় কাটছে একটা চাঁপা দুশ্চিন্তার ঘোরে। নিজেকে ব্যস্ত রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টাই চলছে তার। ভার্সিটি, বন্ধু বান্ধব, আড্ডা, হৈ চৈ সব ছাপিয়ে স্বপ্নদৃশ্যের সেই চরিত্রগুলো প্রায়শই উঁকি দিয়ে যাচ্ছে মনের গহীনে। স্বস্তিও হয় না আবার অস্বস্তিও নেই।
সেদিন নিচে নেমে দেখল বাবুন আর মিতা বসে আছে ড্রইংরুমে। লানা যে ওদের দেখে খুব খুশি হল, তা নয়। কারণ, সেদিন রিসর্টে বাবুনের অফারটা নিয়ে বেশ বিপাকে পড়ে গিয়েছিল লানা। যদিও সমস্যাটা তার একারই হয়েছিল। তবে ঘটনাটা বিক্ষিপ্তও হতে পারে। আবার এই যে স্বপ্ন আর বাস্তবতার একটা অদ্ভুত সংঘাত শুরু হয়েছে তার মধ্যে, এটাওতো ওইদিনের পর ঘটছে। দুটো বিষয়ের মধ্যে কি কোন সংযোগ থাকতে পারে? সে যাই হোক, বাবুনকে বাসায় দেখে লানা খুশি হল না। তবু মুখে কৃত্তিম হাসি ফুটিয়ে নেমে এলো নিচে।
বেশ আড্ডা হল কিছুক্ষণ। বাবুনদের আসার হেতু জানতে পেরে মনের মেঘও কেটে গেল কিছুটা। একটা ট্যুরের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। দেশের ভেতরই, দর্শণীয় কিছু জায়গায় ঘুরবে তারা। সমুদ্র, পাহাড়, জঙ্গল। মোটামুটি সবার পছন্দকে প্রাধান্য দেয়া হবে। লানা তার এই একঘেয়ে, বিষণ্ণ জীবন থেকে মুক্তির একটা প্রশস্ত পথ দেখতে পেল এ প্রস্তাবে। বলল
– আমি রাজি, তোরা প্ল্যান কর। তবে নেক্সট উইকে নয়, ভার্সিটির প্রেশার আছে।
যাবার সময় গলা নিচু করে বাবুন তাকে সরি বলে গেল। বলল
– লানা, বিলিভ মি, আমি এই ভুল আর করব না। সেদিন ওই জিনিসটা ওখানে অফার করাই আমার ভুল হয়েছিল। তবে বিশ্বাস কর দোস্ত, ওটা হার্মফুল ছিল না। দেখলিইতো, আমরা বাকিরা সবাই ঠিক ছিলাম।
বাবুনের কথায় যুক্তি ছিল আর তার ওপরে নতুন ট্যুরে যাবার প্ল্যানটায় মনটাও ভাল হয়ে গিয়েছিল। লানা হেসে বলেছিল
– দেখিস, ট্যুরে আবার ওসব নিয়ে যাস না।
হাসল তিনজনেই। ওরা বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছিল।
এরপর কয়েকটাদিন লানা পড়াশুনার চাপে ছিল খুব। ক্লাস, প্রেজেন্টেশন, সব মিলিয়ে স্ট্রেসফুল একটা উইক।
প্রায় এক সপ্তাহ পর, লানার ক্লাস চলছিল ইউনিভার্সিটির ক্লাসরুমে।
শরীরটা ভালো ছিল না। ক’দিন রাত জেগে জেগে প্রেজেন্টেশনের প্রিপারেশন করতে গিয়ে শরীরের ওপর বেশ চাপ পড়েছে তার। দুটো ক্লাস পর, লম্বা হলরুমের ফাঁকা বেঞ্চিতে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল লানার। ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গেছে অনেকেই, আবার অনেকেই জটলা করে গল্প করছে বসে। লানার কথা বলতে ভালো লাগছে না একদম। এরপর একটা ক্লাস ব্রেক, তারপর শিখা ম্যামের ক্লাস। সুতরাং লানা একটু বিশ্রাম নিতেই পারে। ঘুমে জড়িয়ে আসছে তার চোখদুটি।
কে যেন ঠুনঠান শব্দ করছে। বিরক্ত হচ্ছে লানা। সে খুব চেষ্টা করছে সময়টা কাজে লাগাতে। একটু নিরিবিলি চোখ বন্ধ করে থাকতে পারলে একটু ফ্রেশ লাগত। তবে ক্লাসরুমের সকলের আড্ডার কথাবার্তার গুনগুন আওয়াজটা আর নেই। একই তালে ঠুনঠান আওয়াজটাই আসছে থেমে থেমে। হঠাৎ একটা হুইসেল এ চমকে উঠে বসল লানা।
ডাবল বার্নারের একটাতে প্রেশার কুকার হুইসেল দিচ্ছে। অন্যটাতে ভাতের মাড় উপচে পড়ছে পাতিলে। একটা কিচেন এপ্রন গলায় ঝুলিয়ে জোহার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবজি কাটছে। লানা চোখ রগড়ে ভালো করে দেখল চারিদিক। সেই বসার ঘর, ডাইনিং, মুনের ছড়িয়ে রাখা অজস্র খেলনা আর একদিকে ওপেন কিচেন। গত প্রায় এক সপ্তাহ এ স্বপ্নটা আর আসেনি লানার। তার স্পষ্ট মনে আছে সে এই একটু আগে ভার্সিটির ক্লাসরুমে অফ পিরিয়ডে একটু মাথা হেলিয়ে, চোখ বন্ধ করে বসেছিলো, পেছনের দিকে একটা বেঞ্চে। লানা এমন কোন গভীর ঘুমেও ছিল না যে এভাবে চোখের পলকে স্বপ্নদৃশ্যে চলে আসবে।
এখন রাত। জোহারের রান্না সম্ভবত হয়ে গেছে। সুদর্শন, লম্বা চওড়া, স্মার্ট একজন ভদ্রলোক গলায় এপ্রোন ঝুলিয়ে কিচেনে রান্না করছে, দেখতে কেমন বেমানান লাগছে। জোহার একটা বাটিতে করে কিছু একটা নিয়ে এসে দূর থেকে আড়ষ্ট হাতে ঠেলে দিল লানার দিক। এই প্রথম লানা খেয়াল করল, জোহারের মাথায়, কপাল জুড়ে মোটা ব্যান্ডেজ। লানার অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে জোহার বলল
– তোমার জন্য একটু স্ট্যু বানিয়েছি। খেয়ে দেখো।
লানা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জোহারের ব্যান্ডেজের দিকে। খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, ওখানে কি হয়েছে?
লানা জিজ্ঞেস করল না, তবে আঙ্গুলি নির্দেশ করে জানতে চাইল
– কি হয়েছে জানতে চাইছ?
জোহারও বিস্মিত। ইতস্তত হেসে নিজের কপালে হাত দিয়ে বলল
– কেন… তোমার কিছু মনে নেই…?
লানা না বোধক মাথা নাড়ল। অবিশ্বাস্য হাসল জোহার। বলল
– মনে যখন নেই, তখন মনে করার চেষ্টা না করাই ভালো। তুমি বরং দেখ, খাবারটা ঠিক আছে কিনা।
জোহার আবার কিচেনের দিকে চলে গেল। লানা বাটিটা টেনে নিল। চিকেন স্ট্যু থেকে ধোয়া উড়ছে। দারুণ গন্ধ বের হচ্ছে। লানার ভীষণ ক্ষুধা বোধ হচ্ছে। সে কি খাবে? স্বপ্নদৃশ্যে কি খাওয়া যায়? বা খাবারে টেস্ট পাওয়া যায়? চেখে দেখা যাক।
জোহার নিজের খাবার নিল প্লেটে, ভাত, মাংস,
সবজি। মুনের জন্য বাটিতে সিরিয়াল আর একটা বড় ফিডারে দুধ।
লানা চামচে করে খাবার মুখে দিল, অসাধারণ। চোখ বুজে এলো তার। জোহার তো দারুণ রাধে। কিন্তু তার জন্য আলাদা খাবার কেন? এ বাড়িতে ডাক্তার আসে সোহার ট্রিটমেন্ট করতে। সোহা আলাদা ঘরে শোয়, জোহার তার স্বামী হওয়া সত্বেও অনেক দিন তাদের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নেই, এ ব্যাপারগুলো এখন স্পষ্ট।
আজ জোহার একটু দূরত্ব বজায় রাখছে। সে খেতে বসেছে লম্বা টেবিলের অপর প্রান্তে। একটা বেবি চেয়ারে মুনকেও পাশে বসিয়েছে। চামচে করে মাঝে মাঝে খাবার তুলে দিচ্ছে মুনের মুখে।
আচ্ছা, কি হয়েছে সোহার? কি এমন অসুখ তার ?
লানা খাওয়া শেষ করল। বাটি নিয়ে উঠতে যাবে এমন সময় বাঁধা দিল জোহার, বলল
– তুমি রাখ, আমি নিয়ে যাব। এক কাজ কর, তোমার ঘরে চলে যাও। টেবিলের ওপর মেডিসিন আর প্রেসক্রিপশন রাখা আছে। একটু মিলিয়ে খেয়ে নিও। মুন আগের মত, আমার কাছেই শোবে। ওর ফিডার নিয়েছি সাথে, আশা করি কোন সমস্যা হবে না।
লানা মনযোগ দিয়ে শুনল, কিন্তু কিচ্ছু বুঝতে পারল না। তবে আপাতত নিজের ঘরটা সে চিনতে পারল। প্রথম দিন ওই কোণার দিকের দরজাটা খুলে বের হয়েছিল লানা। যেদিন প্রথম সে সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে ওই ঘরে আবিষ্কার করেছিল সোহা হিসেবে।
লানা কোন আপত্তি বা প্রশ্ন না করে যন্ত্রের মত উঠে গেল সিঁড়ি দিয়ে।
নিজের রুম বলে যেটা দেখানো হয়েছে, সেখানে এসে লানা দরজাটা ভেজিয়ে দিল। লানা ভেবে নিয়েছে, আজ সে অস্থির হবে না। একটা বিষয় এখানে স্পষ্ট যে, লানাকে জোহার সোহা ভাবছে না। সোহাকেই সোহা ভাবছে। কোন বিচিত্র উপায়ে, স্বপ্নে হোক বা কল্পনায় লানা তার নিজের চেতনার উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছে সোহার মাঝে। সে বুঝতে পারছে সে সোহা না। তবে সোহা কে? আজ একটু খোঁজ নেয়া যেতে পারে।
লানা, সোহার প্রেসক্রিপশনটা টেনে নিল।
নাম সোহানা আহমেদ, বয়স সাতাশ, কেইস হিস্ট্রি : ডি আউ ডি, মাল্টিপল পারসনালিটি ডিসঅর্ডার।
অনেকগুলো মেডিসনের নাম, টেস্ট, সাজেশন। সাথে অনেকগুলো রিপোর্ট, ফাইল এ্যাটাচড্।
লানা টেবিলে রাখা ঔষধগুলো নেড়েচেড়ে দেখল। তারপর এগিয়ে গেল দেয়ালের কেবিনেটের দিকে। হাত দিয়ে টানতেই খুলে গেল পাল্লা। অনেক কাপড়, জিনিস, কাগজপত্র। লানা ড্রয়ার খুলল। অনেক ফাইল, এ্যালবাম, ডায়েরী। কি খুঁজবে, কি দেখবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। একটা পুরনো ময়লাধরা এ্যালবাম হাতে তুলে নিল। পাতা ওল্টালো। একটা পুরনো পারিবারিক ছবি। ছোট ছোট কিছু ছেলেমেয়ের ছবি। সেখানে বাদামী চোখের একটা ন’দশ বছরের মেয়েও আছে। এরপর কিছু পশু পাখির ছবি। ক্রমশ কিছু রক্তাক্ত জীবজন্তুর ছবি। কুকুর, বেড়াল, খরগোশের জবাইকরা বিশ্রি সব ছবি। এগুলো কি সংগ্রহে রাখার মত কিছু? লানা এ্যালবাম বন্ধ করতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে একটা মৃত শিশুর ছবিতে আটকে গেল চোখ। শিশুটির বয়স তিন বছরের মত, তার ঠোঁটগুলো কেটে রক্ত গড়াচ্ছে। মাথা ফাটা, রক্তাক্ত। লানা যন্ত্রের মত পাতা ওল্টালো। একজন মহিলার লাশের ছবি। তার চোখের তারা স্থির তাকিয়ে, মুখটা হা হয়ে আছে। এরপর পরপর আরও কয়েকটা মৃত মানুষের ছবি। লানা ছুড়ে মারল এ্যালবামটা ড্রয়ারের মধ্যে। এরপর সে হাত বাড়িয়ে একটা পুরানো ডায়েরি তুলে নিল। পাতা ওল্টাল, একটা হাতের ছাপ, কালচে রং এর। তারপর অনেকগুলো পাতায় কাটাকুটি। কিছু ইংরেজি, কিছু বাংলা কিছু অচেনা বর্ণে, লানার অজানা। খুব ছোট ছোট অক্ষরে…
হঠাৎ মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল লানার। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আসছে। ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়ল সে। চারপাশে অন্ধকার নেমে এলো কেমন যেন। লানা জেগে থাকার চেষ্টা করল প্রাণপণ। সে আরও কিছু দেখতে চায় জানতে চায়। তাছাড়া এখন তার তেমন ঘুমও পায়নি বা সে ঘুমাতেও চায় না। তাহলে এমন লাগছে কেন? যেন বাধ্যতামূলক, অবধারিতভাবে তাকে ডুবিয়ে দেয়া হচ্ছে। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অবচেতনে।
টেবিলের ওপর ডাস্টারের শব্দে চমকে উঠল লানা। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে পেছনে একটা বেঞ্চে। শিখা ম্যাম তার ব্যাগ গুছিয়ে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে। বললেন
– আ’ম রিয়্যালি সরি টু সি দ্য প্লাইথ অফ ইয়র স্টাডি, লানা..। হোপ ইউ’র সর্ট ইয়রসেল্ফ আউট…
শিখা ম্যাম গটগট করে বেরিয়ে গেলেন ক্লাস থেকে। ক্লাসের সবাই ছত্রভঙ্গ। কিন্তু সবাই কেমন ঘুরে ঘুরে তাকিয়ে দেখছে লানাকে।
লানা বুঝতে পারছে, শিখা ম্যামের ক্লাস শেষ। অর্থাৎ ক্লাসসহ গত একঘন্টা সময় লারা ঘোরের মধ্যে ছিল। এখানে কি হয়েছে সে জানে না। সে এতক্ষণ ছিল সোহার বেডরুমে।
– কি হয়েছে আজ তোর বলত?
মিতা আর নওফা দু’দিকে এসে দাঁড়িয়েছে
– কেন…? কি করেছি আমি?
মিতা আর নওফার চোখাচোখি হল। মিতা বলল
– কি করেছি মানে? এত সহজ, এত জানা প্রশ্নের কিসব উল্টোপাল্টা জবাব দিচ্ছিলি ম্যামকে তুই? আফটার অল, তুই অনেক ব্রাইট, ট্যালেন্টেড। সবার কাছে অদ্ভূত লেগেছে ব্যাপারটা।
– আমি?
– তো কে, তোর ভূত?
মিতা আর নওফা হি হি হি করে হাসছে। লানাও হাসছে। তবে তার মাথায় দুটা শব্দ ঘুরছে, ডি আই ডি, মাল্টিপল পারসনালিটি ডিসঅর্ডার।
লানা ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পড়ল। মিতা জানাল আজ ক্লাসের পর ট্যুর নিয়ে একটা মিটিং আছে? লানা যেতে যেতে বলে গেল
– তোরা সবাই মিলে মিটিং কর, পরে আমাকে জানিয়ে দিস। গাড়িতে সারাটা পথ লানা তার ল্যাপটপ খুলে একটার পর একটা সার্চ দিয়ে দেখতে ও বুঝতে চাইল ডি আই ডি ডিসঅর্ডার ব্যাপারটা কি। খুব যে কিছু সুরাহা পেল তাও না। শুধু মনে হল তার পায়ের নিচে একটা সুবিশাল চোরাবালি। সে একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে।
লানা কিছুটা হতাশা বোধ করছে। কারণ বিগত জীবনের পাওয়া কষ্টটা সে সামলে উঠলেও ড্রাগ তার শরীর আর মনে যে ছাপ রেখে গেছে হয়তো এটা তারই ফল।
সন্ধ্যায় লানা নীলকে পেল তার স্টাডিতে। নীল একটা জরুরী মেইল সেন্ড করে ঘুরে বসল। বলল
– তোদের ট্যুরের কতদূর?
– তুমি জানলে কীভাবে?
– জেনে গেছি
আরে ওসব বাদ দাও। আমি তোমার সাথে একটা খুব জটিল আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলতে এসেছি
– বলে ফেল
– আচ্ছা তুমি কি ডি আই ডি ডিসঅর্ডার সম্বন্ধে কিছু জানো? মাল্টিপল পারসনালিটি ডিসঅর্ডার…?
– শব্দটা শুনেছি… পরিচিত লাগছে। কেন বলত…?
– আমি ইদানিং একটা স্বপ্ন দেখি….। খুব গভীর আর স্পষ্ট সে স্বপ্ন…
– সে তো আমরা সবাই দেখি।
– না তেমন নয়, স্বপ্নে আমি প্রতিবার একই জায়গায় যাই, একই রকম মানুষদের সাথে দেখা করি আর…..
– আর কি…?
– আর সবচেয়ে বড় কথা, আমি… আমি আর তখন আমি থাকি না। আমি হয়ে যাই অন্য কেউ…।
– মানে….?
– মানে… আমি অন্য কারও শরীরে বিচরণ করি।
নীল একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে পরক্ষণেই ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠল। লানা অপ্রস্তুত তাকিয়ে আছে কেমন। নীল নিজেকে স্বংবরণ করে বলল
– সুতরাং তোর ধারণা হয়েছে তুই মাল্টিপল পারসনালিটি ডিসঅর্ডারে ভুগছিস?
– একজ্যাক্টলি ….! বিষয়টা হাসির নয়। এমন কি যখন আমি স্বপ্নে অন্য কোথাও বিচরণ করি, তখন বাস্তবে যা কিছু করি তা ভুলে যাই।
– হুম সেটাইতো স্বাভাবিক। কারণ, আমরা ঘুমিয়ে গেলে জানব কিভাবে, কোথায় কি হচ্ছে?
– না, বিষয়টা অমন নয়।
– কেমন…?
– আমি স্বপ্নে বিচরণ করেও বাস্তবে নিজের কাজ করে যেতে পারি। কিন্তু ঘুম ভেঙে ফিরে আসার পর সেসব কিছুই আর আমার মনে থাকছে না।
নীল সিরিয়াস মুখে কথা শুনলেও ভেতরে যে তার একটা হাসি লুকিয়ে আছে বোঝা গেল। সে বলল
– হুম মনে হচ্ছে খুব জটিল অসুখ…। আচ্ছা এক কাজ কর, তুই তোর বন্ধুদের নিয়ে যে ট্যুরটা প্লান করছিস, সেটা দ্রুত কার্যকর করে ফেল। আমার মনে হয় তোর একটু চেঞ্জ দরকার।
– তার মানে ব্যাপারটা তুমি সিরিয়াসলি নাওনি…? ভাবছ আমি মনগড়া কথা বলছি?
– মোটেই না। শোন, আসলে সত্যি কথা বলতে কি, আমরা সবাই কমবেশি ওরকম একটা অসুখে ভূগছি। মাল্টিপল পারসনালিটি ডিসঅর্ডার, এই যে আমরা কল্পনা করি, ভাবি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করি। নিজেকে বিভিন্ন রূপে দেখতে চাই, এটাও তো সেরকম। একটা মানুষের মাঝে অনেকগুলো পারসসনালিটি অবস্থান করে। বিষয়টা ডিপলি ভাবলেই মনে হবে ওটা ডিসঅর্ডার। শোন, ওসব ভুলে যা। মনকে অতটা প্রশ্রয় দিস না। তুই কোন ডিসঅর্ডারে ভূগছিস না। বাইরে যা, মানুষের সাথে মেলামেশা কর, আনন্দ কর। সব ঠিক হয়ে যাবে।
– এত সোজা..?
– একদম সোজা।
লানা, নীলের সাথে আলোচনায় কিছুটা হতাশ হলেও নীলের কথায় যুক্তিও খুঁজে পেল। অনেকগুলো দিন সে নিজেকে সবকিছু থেকে আলাদা করে রেখেছিল। শরীর আর মন তাদের ইচ্ছেমত বয়ে গেছে। সে বয়ে যাওয়ার গতিবিধি সত্যিই তার নিয়ন্ত্রণে ছিল না।
নিজের ঘরে ফিরে এসে লানার বেশ হালকা লাগল নিজেকে। কিছুদিন যাবৎ স্বপ্নের ব্যাপারটা একটা চাপ হয়েছিল মনের ওপর। নীলের সাথে কথা বলে কিছুটা হলেও ভার নেমে গেছে। আসন্ন ট্যুর নিয়ে ফোনে অনেক রাত পর্যন্ত গ্রুপ কনফারেন্স হল তাদের। সময় বেশি নেই। লানা একটা লম্বা লিস্ট বানালো, ট্যুর প্রিপারেশন শপিং এর। কিছু ব্যবহার্য জিনিসপত্র, কিছু মেডিসিন, কসমেটিস।
অনেক রাতে ঘুমাতে গেল লানা।
বিছানায় চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠল কিছু বিকৃত মৃত মানুষ আর জীবজন্তুর ছবি। আচ্ছা স্বপ্নদৃশ্যে যে এ্যালবাম বা ডায়েরীগুলো সে দেখেছে, বাস্তব জীবনে কোথাও কখনও কি ওসবের সাথে তার কোন লিংক ছিল? ডায়েরীটা আরেকটু ডিটেল দেখতে ও পড়তে পারলে আন্দাজ করা যেত। লানা ভাবনাটা দূরে সরিয়ে ঘুমাতে চাইল।
ঘরের মধ্যে কেউ হাঁটছে। ডোনা কি? কিন্তু রাতে তো ডোনা এ ঘরে থাকে না। তাছাড়া ডোনার পায়ের শব্দ মানুষের পায়ের শব্দের মত হবে কেন?
চোখে আলো লাগছে। ঘরের আলোটা তো নেভানো ছিল। হঠাৎ কি মনে হতে, চোখ খুলল লানা। ঠিক যা ভেবেছিল তাই। সোফার এক কোণায় মাথা হেলিয়ে বসে আছে সে। হাঁটাহাঁটি করছে জোহার। তার মাথায় ব্যান্ডেজ আছে এখনও। জোহার একটা ট্রেতে করে পানি আর ওষুধ রেখে বলল
– তোমার ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে খেয়াল করলাম, গত দু’দিন কোন মেডিসিন নাওনি তুমি। আচ্ছা , এটা কি ঠিক বলতো?
লানা চারিদিকে তাকাল। অপ্রস্তুত মুখে হাসল। জোহার অষুধ আর পানি এগিয়ে দিল। লানা স্পষ্ট চোখে তাকাল তার দিকে
– জোহার…
চমকে তাকাল জোহার। সোহা তাকে কখনও নাম ধরে ডাকেনি এভাবে
– জোহার, আমি আপনাকে একটা কথা জানাতে চাই
কথাগুলো বলে লানা নিজেই হতভম্ব। কারণ, গলার স্বরটা লানার নয়।
জোহার সম্বোধন শুনে অবাক চোখে প্রশ্নবোধক তাকিয়ে আছে তার দিকে
লানা গলা পরিষ্কার করে বলল
– জোহার শুনুন, আমি আসলে.. সোহা নই…
– মানে…?
– মানে আমি আপনার স্ত্রী বা মুনের মম্, সোহা নই
জোহারের মুখাবয়বে কৌতূহল নয় বরং বেদনা ফুটে উঠল। বলল
– অষুধটা ঠিকমত না খেয়ে কাজটা কি ভালো করলে সোহা..? দেখ, কি সব উল্টোপাল্টা বকছ।
লানা কিছু বোঝাতে চাইল। জোহার শুনতে চাইল না। বলল
– এক মুহূর্তও দেরী নয়, এখনই খেয়ে নাও। আজ আমাকে মারো, আঘাত কর, আমি কিচ্ছু বলব না। তবু প্লিজ কোন অনিয়ম কর না। আমার জন্য না হোক, মুনের জন্য তোমাকে সুস্থ হতেই হবে সোহা।
লানা তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। তার মানে জোহারকে, সোহা মেরেছে? তার মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করেছে নিশ্চই। জোহারের ব্যান্ডেজ দেখলেই ধারণা করা যায়, আঘাতটা কতটা গভীর।
কিন্তু জোহারকে এসব কথা বলে কোন লাভ নেই। নীল যেমন এককথায় বোঝেনি, জোহারও বুঝবে না। কিন্তু এ অষুধতো লানা খেতে পারবে না। তাকে এখন কৌশলে এড়িয়ে যেতে হবে। লানা ট্রে টা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল
– আপনি ঠিক বলেছেন, আমার নিয়ম মেনে চলা উচিৎ। আমি বরং ঘরে গিয়ে অষুধটা খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিই।
জোহার বাঁধা দিল না। অবাক হয়ে লানার চলে যাওয়া দেখছে।
লানা ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। ঘড়ির দিকে তাকাল। এখন বেলা তিনটা বাজে। তারিখটা জানতে পারলে ভালো হত। তাকে অনেকগুলো বিষয় জানতে হবে। লানা দ্রুত কেবিনেট খুলল। আগের ড্রায়ারগুলো হাতাল। কিন্তু আশ্চর্যকথা হল, কোথাও কোন ডায়েরী বা ছবির এ্যালবাম পাওয়া গেল না। গেলো কই সব?
( চলবে)