চোরাবালি পর্ব ১০

0
189

#চোরাবালি_১০
রেশমা আক্তার

দুঃসংবাদটা এলো খুব সকালবেলা। লানার দরজায় অনেকবার ধাক্কাধাক্কি করার পর ঘুমচোখে ধড়ফড় করে উঠে দরজা খুলে দিল লানা।
তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাবুন, ইমাদ আর অন্যরা পিছনে। সবাই কেমন তটস্থ আর ভয়ার্ত চোখে দেখছে লানাকে।

প্রথমত ঘুম ভেঙে আজ প্রায় পাঁচদিন পরে হোটেল রুমে জেগে উঠে লানা বিভ্রান্ত। তার ওপরে এদের দিশেহারা চোখের সামনে নিজেও কেমন দিশেহারা বোধ করল। যাক শেষ পর্যন্ত সে ফিরতে পেরেছে।

– কি হয়েছে?
বাবুনরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। বাবুন জিজ্ঞেস করল
– কাল রাতে তুই কোথায় ছিলি লানা?
কপালে ভাঁজ পড়ল লানার
– কেন বলতো?
ইমাদ বলল
– লানা, শাহের কোথায় তুমি জানো না?
– শাহের? কেন কি হয়েছে শাহেরের?

বাবুন ধরা গলায় বলল
– আজ সকালে… পাহারের নিচে, খাদে শাহেরের বডি পাওয়া গেছে লানা…
– হোয়াট…?
আর্তচিৎকার করে স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে আছে লানা
ইমাদ বলল
– বাবুন, শাহের এখনও বেঁচে আছে, বডি পাওয়া গেছে বলছ কেন?

বাবুন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল
– অত উঁচু থেকে পড়ার পর ওর কি আর বেঁচে থাকার কথা ইমাদ?

ইমাদ, বাবুনের পিঠে হাত রাখল। মিতা সবাইকে ঠেলে একদম সামনে চলে এলো। লানাকে রুমের ভেতরে ঢুকতে হল। মিতা বলল,
– কাল রাতে শেষবারের মত শাহেরকে তোর সাথে দেখা গিয়েছিল। রাত দশটা নাগাদ শাহেরের সাথে তুই বাইরে ছিলি, কোথায় গিয়েছিলি বল?

মিতার গলায় পুরো স্বন্দেহ। লানা খুব দ্রুত বোঝার চেষ্টা করল ব্যাপারটা। বলল
– হ্যা…ওইতো, শাহের আর আমি হাঁটতে হাঁটতে গিয়েছিলাম কিছুদূর…তারপর…

বাবুন জানতে চাইল
– তারপর…?
– তারপর… তারপর আর কি? আমি আার ও একটা ক্যাফেতে ঢুকে কফি খেলাম…
– তারপর ?

– তারপর… তারপর শাহের বলল, ওর নাকি সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে..। আমি বললাম, আমি আর তোর সাথে নেই। সিগেরেট খাবি বাইরে গিয়ে একা একা খা। আমি হোটেলে ফিরব।
তারপর আর কি, আমি ফিরে এলাম একা…

সবাই তীক্ষ্ণ, চোখে দেখছে লানাকে। লানা কি এদেরকে কথাগুলো বিশ্বাস করাতে পারেনি?

ইমাদ সবার দিকে তাকিয়ে বলল
– হ্যা, তুমি যে সিগারেট পছন্দ কর না, সেটা তো জানি আমি… কি বল বাবুন…?

বাবুন শিকারী চোখে তাকাল ইমাদের দিকে।
– হাউ লং হ্যাভ ইউ নোওন লানা? ওয়ানস শি ওয়াজ আ চেইনস্মোকার।

লানা বলল
– আগের কথা কেন টানছিস বাবুন? এখন শাহেরের কি অবস্থা সেটা বল। আমি সত্যি জানিনা, শাহেরর কিভাবে কি হল। মে বি, ইট ওয়াজ এ্যান এক্সিডেন্ট…

নওফা কাঁদতে কাঁদতে বলল
– সেটা তো শাহেরের জ্ঞান ফিরলেই জানা যাবে

বাবুন স্বান্তনার গলায় বলল
– ভালোয় ভালোয় শাহেরটার জ্ঞান ফিরুক। ওহ গড, হেল্প শাহের টু সারভাইভ…

ইমাদ বলল
– শোন সবাই, তোমরা দ্রুত প্যাক করে নাও। শাহেরকে এখান থেকে চিটাগং নেয়া হয়েছে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে। ওখানে ওকে প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট দিয়ে ডাক্তার সিধ্বান্ত দেবেন, ঢাকায় মুভ করবে কিনা। আমরা আগে চিটাগং যাই। পরে দেখা যাবে। এখন সবাই শাহেরের জন্য প্রে কর। ওর ফ্যামিলি খবরটা পেয়ে… বুঝতেই পারছ…?

সবাই যার যার মত চলে গেল। লানা নিজের মাথাটা চেপে ধরে বসে পড়ল বিছানায়। সেদিন শাহের তাকে বলেছিল, সে নাকি ইমাদকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চেয়েছিল খাদে। আজ এরা বলছে, কাল রাত অবধি সে ছিল শাহেরের সাথে, তাহলে কি সেই নিয়ে গিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে শাহেরকে?
যেন এই কথাটাই সবাই এতক্ষণ শুনতে চাইছিল লানার মুখে। উফ, কি ভয়ঙ্কর।

দরজা খুলে ইমাদ ঢুকল ভেতরে। দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিয়ে, একটা চেয়ার টেনে একদম মুখোমুখি বসল সে লানার। তীক্ষ্ণ নজরে পর্যবেক্ষণ করল যেন সে লানাকে। প্রমাদ গুনছে লানা। জিজ্ঞেস করল
– কি দেখছ অমন করে?
ইমাদ বলল
– লানা, আই রিয়্যলি কেয়ার এবাউট ইউ। তবু কেন যেন মনে হচ্ছে, একটা কিন্তু রয়ে যাচ্ছে কোথাও…

লানার চোখে যেন আলো ফুটল। বলল
– তুমি বুঝতে পেরেছ ইমাদ? একটা কিন্তু যে আছে এটা তুমি বুঝতে পেরেছ?

– হুম, তবে সেটা কোথায় ধরতে পারছি না। তুমি কাল আমার সামনে থেকে শাহেরকে নিয়ে চলে গেলে। আমি কিন্তু ডেকেছিলাম, শুনেও যেন শুনলে না। আমি তোমাদের ফলো করলাম। তোমরা কোন কফিশপে ঢোকনি। সোজা চলে গিয়েছিলে। প্রথমে আমার কিছুটা অভিমান হয়েছিল, পরে কৌতূহল। গত দু’দিন ধরে শাহেরের প্রতি তোমার আগ্রহটা যে আমার চোখে পড়েনি, তা নয়।
– তারপর?
– তারপর কি, সেটা তো তুমি বলবে লানা। তোমরা যখন অন্ধকারে ওদিকটায় চলে গেলে, আমি ফলো করা বন্ধ করলাম। মনে হল, সামথিং সিকরেট ইজ এবাউট টু হ্যাপেন বিটউইন ইউ।

– না, সেটা অসম্ভব…। কি বলছ তুমি ইমাদ। শাহের আমার খুব ভালো বন্ধু। ওসব অবান্তর।

– আমি ফিরে এসে, একটা দোকানের ছাউনিতে অপেক্ষা করছিলাম। প্রায় মিনিট বিশেক পরে ফিরতে দেখলাম তোমাকে, একা। আমি বেরিয়ে এসে তোমার সঙ্গ নিলাম। কিছু জানতে চাইলেই বললে, তোমার ভীষণ মাথা ব্যথা, তাই হোটেলে ফিরছ। তুমি এক প্রকার আমাকে রেখেই দ্রুত চলে এলে হোটেলে। আমি শাহেরের জন্যও অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু দেরী দেখে আমিও ফিরলাম হোটেলে।

– এসব কিছুই আমার মনে নেই ইমাদ
– মানে?
– সেটাইতো একটা মস্তবড় কিন্তু, ইমাদ..। আমি সবটা তোমাকে খুলে বলতে চাই। তবে প্লিজ, আমাকে অবিশ্বাস বা স্বন্দেহ কর না।

– ঠিক আছে, কি বলতে চাইছ বল।
– ইমাদ, আমার সাথে অদ্ভূত কিছু ঘটছে। আমি মাঝে মাঝে আর আমার মাঝে থাকছি না। অন্য কারো শরীরে ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছি।

– কি যে বল, লানা। এখন এসব পাগলামী কতাবার্তা বলার সময় নয়।

– ইমাদ বিলিভ মি। আমি তোমাকে খুলে বলছি বিষয়টা। আমি হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমি অন্য কারো শরীরে জেগে উঠছি। মেয়েটির নাম সোহা। তার একটা দু’ আড়াই বছরের মেয়ে আছে, হাজবেন্ড আছে। সেখানে এমন স্বাভাবিক জীবন যে, মনেই হয়না স্বপ্ন দেখছি। মনে হয়, সেটাই বাস্তব, সত্য। তখন এখানে এইদিকে কি হয় বা আমি কার সাথে কি করি কিছুই মনে থাকে না….

ইমাদ নিশ্চল চোখে তাকিয়ে আছে। লানা কাতর গলায় বলল
– প্লিজ বিলিভ মি ইমাদ।
ইমাদ স্থির গলায় বলল
– তার মানে, এ ক’দিন তুমি এখানে আমার সাথে কখন কি বলেছ, করেছ তোমার কিছুই মনে নেই?

– না, সত্যিই মনে নেই…
– তুমি বলতে চাচ্ছ, এ ক’দিন তুমি সোহা নামের কারো শরীরে জেগে উঠেছ অন্য কোথাও, আর এখানে তোমার শরীরে জেগে উঠেছে ওই সোহা নামের অন্য মেয়েটি?

লানা স্থির হল। বলল
– দাঁড়াও দাঁড়াও, কি বললে তুমি? সোহা তখন আমার শরীরে? এটাতো আমার মাথায় আসেনি।

লানা সিরিয়াসলি বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করলেও, হো হো করে হেসে উঠল ইমাদ।
পরক্ষণেই হাসি থামিয়ে বলল
– লানা আমি বুঝতে পারছি, তুমি শাহেরের ব্যাপারটা শুনে ঘাবড়ে গেছ। তাই উল্টোপাল্টা বকছ। দেখ, ঘটনা যাই ঘটুক না কেন আমি তোমার ফরেই থাকব। নীল আমাকে তোমার দায়িত্ব দিয়ে এখানে পাঠিয়েছে। সো, ডোন্ট ওরি..

লানা যেন কিছু শুনতে পাচ্ছে না। তার সামনে একটা বড় পথ তৈরি হল যেন ভাবনার। এতদিন এতগুলো ঘটনার মধ্যে একটাবারও তার সোহা চরিত্রটার কথা মনে হয়নি। সে ভেবেছে, সে স্বপ্ন দেখছে। যেখানে সোহা নামের অন্য কারো শরীরে জেগে উঠছে। কিন্তু এমনটাও তো হতে পারে যে, সোহা নামেরও কেউ চলে আসছে তার ভূমিকায়। কিন্তু এমনটা কেন হবে? এসবের ব্যাখ্যা কি? যা যা হয়েছে, তবে কি তা স্বপ্ন নয়? কোন প্রকারে কি এসবের কোন বাস্তব ভিত্তি আছে? এতটা অদ্ভূত ঘটনা কি আদৌ ঘটে পৃথিবীতে?

কিন্তু কাল পাহাড় থেকে নামতে না পারার ব্যাখ্যা কি হতে পারে? ব্যাপারটায় যদি সত্যিই কোন বাস্তবতার ছোঁয়া থাকত, তবে লানা কেন লোকালয়ে পারল না যেতে?

ইমাদ তাকে দু’মিনিটে তৈরি হতে বলে বেড়িয়ে গেল। লানা দ্রুত তার লাগেজ খুলে বিছানায় ঢালল। সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে আছে। কাপড়চোপড় গোছাতে গোছাতে নিজের নোটবুকটা চোখে পড়ল। একটা পেনও আটকানো আছে সেখানে। পেনটা অচেনা। এমন পেন লানা কখনও ব্যবহার করেনি। লানা বেড়াতে এসে কিছু জায়গা, দরকারী জিনিসের নাম লিখবে বলে নোটপ্যাড রেখেছে সাথে। তবে সেটা ছুঁয়ে দেখা হয়নি এখনও। অপরিচিত পেনটাই অন্যমনস্ক করে দিল তাকে। হাত বাড়িয়ে লানা নোটবুকটা নিল এবং যেখানে পেন লটকানো আছে সেই পেজটা খুলল।

কিছু উল্টোপাল্টা শব্দ। বিভিন্ন হরফে লেখা। আরবি, উর্দু, চাইনিজ ভাষা। তারমধ্যে সে বাংলায় কয়েকটা শব্দ দেখতে পেল। যেমন, শাহের, ইমাদ, নওফা। এখানে শুধু শাহেরের নামটা ক্রস চিহ্ন দেয়া।
বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠল লানার। এ হাতের লেখা তো চেনা তার। এতো সেই জোহারের স্টাডির গোপন কক্ষে লুকানো নোটবুকের হাতের লেখা। এমন একটা হিজিবিজি লেখা ডায়েরী লানা সোহার লকারেও দেখেছিল।

স্তম্ভিত লানা মনে মনে অনেকগুলো হিসেব মেলানোর চেষ্টা করল। সে এতদিন নিজেকেই লানা ও একইভাবে সোহা ভেবেছে। কিন্তু আজ ইমাদের একটা কথায় চোখের ওপর থেকে যেন পর্দা সরে গেল। আর এই নোটপ্যাডটা তার প্রমান। সোহা নামের আরেকজনের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে এখানে। যদি সোহা তার জায়গায় এসে থাকে তাহলে তো সমুহ বিপদ এদিকে, ওদিকেও। শাহেরের খাদে পড়ে যাওয়াটাও তার প্রমান।

লানারা গাড়িতে উঠল দশটা নাগাদ। গাড়ি ছুটছে পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে। অসাধারণ নৈসর্গিক দৃশ্য। ইমাদ তার পাশেই বসে আছে। যদিও ইমাদের ওপর তার আগের সেই বিরক্তিভাবটা আর নেই। ইমাদ চোখ বন্ধ করে আছে। ভাবছে নাকি ঘুমাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে না।
লানারও কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে সেও ভাবছে নতুন একজন মানুষের কথা, সোহা। কে সোহা? কি চায় সে? লানা তন্দ্রাচ্ছন্ন হল। সেখানে ভেসে উঠল সুন্দর, বাদামী চোখের একটি মেয়ের মুখ, সোহা।

চিটাগাং পৌঁছে তারা সবার আগে হসপিটালে দেখতে গেল শাহেরকে। শাহেরের বড় ভাই আর বাবাকে দেখা গেল সেখানে। শাহের নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছে। তাকে দেখা গেল না। তবে ডাক্তাররা বলেছেন বাহাত্তর ঘন্টার আগে কিছু বলা যাবে না। শাহেরকে এই মুহূর্তে মুভ করানো আরও বিপজ্জনক হতে পারে।

শাহেরের বাবা ও ভাই ঘটনা জানতে চাইলে তারা শাহেরের পরিবারের লোকদের সাথে সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলল। জানানো হল, আসলে একা একা হাঁটতে গিয়ে, পাহাড়ী পথে অন্ধকারে শাহের হয়ত পা পিঁছলে খাদে পড়ে গেছে।

বাবুন কেমন আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছিল লানার দিকে। বাবুন কি লানাকে স্বন্দেহ করছে? কিন্তু কোন লজিকে বাবুন ভাবছে এসব? শাহের তো লানারও বন্ধু। লানা কেন ধাক্কা মারবে শাহেরকে?

হতাশ মুখে তারা বেরিয়ে এসেছিল হসপিটাল থেকে। ইমাদ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল। দেখ, শাহের আর ওর পরিবারকে এখানে ফেলে আমাদের ঢাকায় ফেরাটা অমানবিক হবে। আমরা বরং থেকে যাই।

সবাই সন্মত হল। একটা হোটেলে উঠল সবাই। যার যার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল তারা। বিকেলের দিকে লানা, ইমাদকে নিয়ে বের হল। তারা একটা গাড়ি নিয়ে চিলমাই এর উদ্দেশ্য রওয়ানা হল। ইমাদ হাজারটা প্রশ্ন করছে, লানা চুপচাপ।
লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে লানাদের গাড়িটা চিলমাই গিয়ে যখন পৌঁছল তখন সূর্য ঢলে পড়েছে। লানা পাহাড়টা খুঁজে পেল শেষ পর্যন্ত। তাদের গাড়িটা ধীরে ধীরে উঠে এলো ওপরে। লানা খুব তীক্ষ্ণ চোখে নজর রাখল একটু দূরে দূরে বসানো মাইলফলকগুলোর ওপর। অবশেষে উঠতে উঠতে নজরে পড়ল সেই মাইলফলকটা। লানা গাড়ি থামিয়ে নিচে নামল। ইমাদও নামল। লানা বলল
– ইমাদ শোনো, তোমাকে আমি যে স্বপ্নের ব্যাপারে বলেছিলাম, সেটা যে সত্যি তার প্রমান দিব এখন তোমাকে।
– মানে?
– মানে আমি স্বপ্নে, এই পাহাড়ের চূড়ায় যে বাংলোটা আছে, সেখানে আসি। তবে লানা হিসেবে নই। আমি অন্য কারো শরীরে জেগে উঠি। দেখ, বাস্তবিক আমি কখনও এর আগে এখানে এসেছি? আসিনি। কিন্তু আমি তোমাকে একটা প্রমান দিচ্ছি যে গতকালও আমি এই জায়গাটাতে এসেছিলাম।
– কি বলছ লানা?
– দেখ, ওই যে মাইলফলকটা। ওখানে গতকাল আমি একটা ক্রস চিহ্ন দিয়েছিলাম। তোমাকে দেখাব, এসো।

লানা ইমাদের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ফলকটির কাছে। কিন্তু কোথাও ক্রস চিহ্নটা দেখতে পেল না। সে খুব ভাল করো খুঁজল, পেল না। তার হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝি ইমাদের মায়া হল।

ইমাদ, লানার কাঁধে হাত রাখল। বলল
– লানা, একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। চল এবার ফেরা যাক। হোটেলে ফিরে আমি শুনব তোমার সব কথা।

লানা ফিরে এসে গাড়িতে বসল। বলল ড্রাইভার, আপনি ওপরে যান। এতটা যখন এসেছি, শেষটা দেখেই যাই।

ইমাদের আপত্তি না শুনেই গাড়ি উপরে উঠল। একটু পরেই দেখা গেল সেই বাংলোটা। উত্তেজনায় কাঁপছে লানা। গাড়ি থেমেছে, কিন্তু নামতে পারছে না সে। তার নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না যে, সত্যিই এই বাংলোটা এখানে আছে। তার মানে সে স্বপ্নে নয়, সত্যিই আসে এখানে। আর সোহা? তাহলে সোহা কোথায়? সে নিশ্চই এখন এখানে আছে? লানার কি এখন দেখা হবে তার সাথে? আর জোহার? কীভাবে দেখবে সে জোহারকে? জোহার কি চিনতে পারবে তাকে? কাল জোহারের সাথে সেই অন্তরঙ্গ কয়েকটা মুহূর্ত? পারবে কি, মনে করতে জোহার?
অসম্ভব রোমাঞ্চ অনুভব হচ্ছে লানার
– কি ভাবছ লানা? নামবে?

লানার সম্বতি ফিরল। সে নেমে গেল ধীরে ধীরে। ইমাদও নামল। হেঁটে হেঁটে তারা এসে দাঁড়ালো প্রাচীর ঘেরা লোহার উঁচু গেটের সামনে। চারিদিকে শান্ত প্রকৃতি। কেবল পাখিদের ঘরে ফেরার কলতান। লানা বিস্মিত চোখে গ্রিলের ভেতর থেকে দেখছে বাংলোটা। ওইতো বাগানের পাশে লোহার ঝুল দোলনাটা। শেডের নিচে শ্বেত পাথরের টেবিল আর রডের কারুকার্যময় চেয়ার। থাই গ্লাসের দরজা ভেদ করে দেখা যাচ্ছে ভেতরের আসবাব। কেউ কি নেই বাড়িতে। মুন? ছোট্ট মুন কোথায়?

উত্তেজনায় লানার দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। সে দু’হাতে শক্ত করে ধরে আছে গ্রিল। গেটে বিশাল এক তালা ঝুলছে। লানা গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঝাঁকানোর চেষ্টা করল লোহার দরজা, পারল না। ইমাদ এসে কাঁধে হাত রাখল তার।
লানা জোরে জোরে ডাকল
– জোহার…. জোহার….? মুন….মুন…?
ইমাদ জিজ্ঞেস করল
– কাকে ডাকছ তুমি লানা?
লানা কাঁদছে। সে বোঝাতে চাইল ইমাদকে
– জোহার… জোহার… আমার হাজবেন্ড…! আমার মেয়ে…. ছোট্ট… মুন…! এখানে থাকে ওরা…
লানা আবার চিৎকার করে ডাকল
– জোহার… জোহার…?
স্তম্ভিত ইমাদ।
একজন সিকিউরিটি গার্ড বেরিয়ে এলো গেটের ডানদিকে পেলেস্তারা খসে পড়া একটা ছোট্ট কুঠুরি থেকে। কাছে এসে জানতে চাইল, কারা আপনারা? কাকে চান?
লানা বলল
– জোহার… জোহার কোথায়?
– সাহেব তো তার ফ্যামিলি নিয়ে আমেরিকায় চলে গেছেন।
– চলে গেছেন মানে?
– হ্যা চলে গেছেন। এখানে এখন আর কেউ নাই।
– একেবারে চলে গেছে?
– সেইটা তো আমি বলতে পারব না।
– আর… আর.. ‘ব্লু সি বিচ’ কম্পানী?

– অফিসের কথা আমি বলতে পারব না। আমি আগে অফিসের গার্ড ছিলাম। অফিস বন্ধ হয়ে যাবার পর এখানে ডিউটি দিই।

– ও… ওদের কোন কনটাক নাম্বার আছে…?
সিকিউরিটি গার্ড স্বন্দিহান চোখে দেখল তাদের। তারপর বলল
– আপনারা কারা? আমার কাছে কোন নাম্বার টাম্বার নাই। এখন যান।

লোকটা ভেতরে চলে গেল।

লানা ধীরে ধীরে যন্ত্রচালিতের মত এসে গাড়িতে উঠল। গাড়ি ঘুরল। সন্ধ্যা নামছে দ্রুত। অন্ধকার হওয়ার আগে ফিরতে হবে লোকালয়ে।
ইমাদ আর কোন প্রশ্ন করেনি লানাকে। তার শুরুতে সব কিছু অবান্তর লাগলেও, লানার আবেগ, তার সাথে গার্ডের কথোপকথন, সব মিলিয়ে কেমন দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে সে। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে পারছে না, আবার এই মুহূর্তে লানাকে জিজ্ঞেস করতেও পারছে না।

রাতে হোটেলে ফিরে লানা বলল
– ইমাদ, আমি রুমে গেলাম। এখন একটু একা থাকতে চাই। আমাকে ডিনারে ডেকো না প্লিজ। তুমি বরং শাহেরের একটা খোঁজ নিও।

ইমাদ সন্মতি জানাল। যেকোন কারণেই হোক, লানা খানিকটা ডিস্টার্বড, তাতে স্বন্দেহ নেই। তাই সে লানাকে একটু সময় দিল।

রুমে ফিরে লানা ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গেল। তার এখন আর কোন স্বন্দেহ নেই যে, যা ঘটেছে তা স্বপ্নের মত হলেও, স্বপ্ন নয়। তবে সাথে জেগে উঠছে তীব্র একটা ব্যথাবোধ। একটা পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা। আর কি দেখা হবে না জোহার আর মুনের সাথে?

দুস্বপ্ন ভেবে যে ছোট্ট মুনকে স্তন পান করিয়েছিল সে। মা না হয়েও মম্ হয়েছিল মুনের। সুন্দর স্বপ্ন ভেবে স্বামী হিসেবে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল যে জোহারকে। যদিও সে শরীরটা ছিল সোহার, তবু অনুভূতিটা তো ছিল লানার! তারা এখন বাস্তবেও বর্তমান। কি আশ্চর্য! কিভাবে সম্ভব!
( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here