চুপিচুপি ভালোবাসি পর্ব ৮

0
960

#চুপিচুপি_ভালোবাসি (পর্ব ০৮)
#আয়েশা_আক্তার
·
·
·
নিজের ঘরে আরাম করে বসে মনের সুখে আইস্ক্রিম খাচ্ছি আমি আর আমার ছোটবোন শাম্মী।এই একটা জিনিস আমাদের দুজনেরই অনেক বেশি পছন্দের। আদভিক আঙ্কেল এসেছেন তাই বাড়িতে বসেই আইস্ক্রিম খেতে পারছি, নাহলে বাড়িতে বসে আইস্ক্রিম খাওয়া মানে মা, বাবার এত্তগুলা বকা খাওয়া। হাতে আইস্ক্রিম দেখলেই যেন উনাদের গায়ে আগুন জ্বলে ওঠে। এক ধমক দিয়ে হাত থেকে আইস্ক্রিম তো নিয়ে নেবেই সাথে এক বালতি লেকচার ফ্রী! কিন্তু আদভিক আঙ্কেল এর ব্যাপারটাই আলাদা। ছোটবেলা থেকেই উনার সাথে যখন‌ই দেখা হয় তান‌ই একটা করে আইস্ক্রিম ফ্রি! ওয়াহ! তারপর আরাম করে খাওয়া। আব্বু আম্মু ও তখন কিছু বলতে পারে না। আজ ও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই মনের সুখেই খাচ্ছি। এদিকে শাম্মী নিজের আইস্ক্রিম শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর পর হাত চুলকাচ্ছে। আমি ওর দিকে পাত্তা না দিয়ে আমার মতো খেতে লাগলাম। এবার ও মুখে ইয়া বড় একটা হাসি ঝুলিয়ে আমার পাশে এসে বসলো। আমি আড়চোখে ওর দিকে তাকালাম। ও মুখ কাচুমাচু করছে। ও কেন এমন করছে সেটা খুব ভালো করেই জানি আমি। নিজের আইস্ক্রিম শেষ এখন আমারটাতে ভাগ বসাবে। এবার আমি সোজা হয়ে ওর দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম যার অর্থ, ‘লাইক সিরিয়াসলি বনু? এখন আমারটাও চাই তোর!’ বিনিময়ে একটা মিষ্টি হাসি দিলো সে। কিন্তু আমি তো আমিই! অন্যদিকে ফিরে আইস্ক্রিম খাচ্ছি। ওর দিকে আড়চোখে তাকাতেই দেখলাম মুখটা এইটুকু হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে এখনি কান্না করে দিবে। এবার আমি পরে গেলাম বিপদে। আইস্ক্রিম আমার অনেক বেশি প্রিয়। কিন্তু আমার পিচ্চি বোনটা তো আর সেটা বুঝবে না। ও চিৎকার করে কান্না করতে খুব বেশি সময় নিবে না। আর ওর কান্না আমার সহ্য হবে না। বিরক্তর সাথে অন্য একটা ফিলিংস যুক্ত হয়ে মিশ্র একটা অনুভুতি সৃষ্টি হবে যেটা আরো বেশি বিরক্তিকর। কিন্তু তাই বলে আইস্ক্রিম!! আমি আইস্ক্রিম টার দিকে দুঃখী দুঃখী ফেস করে তাকালাম। বোনের দিকে তাকাতেই দেখলাম চোখে পানি টলমল করছে। এখনি মনে হয় কেঁদে বন্যা বোইয়ে দিবে। আইস্ক্রিম এর দিকে তাকিয়ে নিজেকে বললাম, ‘ও তোর বোন হয়! তো কি হয়েছে আইস্ক্রিম এর জন্য নো সব চলে আর ও তো শুধু একটু কাঁদবে আর কি! কিন্তু ও তো একদমই বাচ্চা! সবে ক্লাস ৩ তে পড়ে! ওকে কাঁদানোটা কি ঠিক হবে।’ ধুরর ভাল্লাগে না! আরেকবার ওর দিকে তাকাতেই দেখি বেচারি উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে আছে। কি আর করার নিজের আইস্ক্রিম টা ওর সামনে ধরলাম। ও চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকালো। যার অর্থ, ‘তুমি সত্যি এটা আমাকে দিচ্ছ? নাকি অন্য কোন মতলব আছে?’ আমি ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই ও আমার হাত থেকে ছো মেরে আইস্ক্রিম টা নিয়ে নিলো। ওর কাজে আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না! সত্যিই!! ও মুখে বড় একটা হাসি ঝুলিয়ে বললো,,

–“থ্যাংক ইউ আপু! ইউ আর দি বেষ্ট!!”

আমি ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললাম,,
–“বেশি ঢং দেখাতে হবে না। ওটা আমি তোর জন্য দেই নি! আমার খেতে ইচ্ছে করছিল না তাই দিয়েছি। এবার এখান থেকে যা!”

–“কে কাকে যেতে বলছে?”

দড়জার দিকে তাকাতেই দেখি নির্ভীক ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। এই লোকটা আবার কখন এলো? কেন‌ই বা এলো! আঙ্কেল এসেছেন এটা তো জানি কিন্তু উনি তখন তো উনাকে দেখি নি! তাহলে? উফ বিরক্তিকর একটা লোক। আজকের দিনটা যে কোন ক্রমেই ভালো কাটবে না সেটা খুব ভালোই বুঝতে পারছি। আমার সুন্দর দিনটাকে খারাপ করতে এই চেহারাটাই যথেষ্ট। শাম্মী দৌড়ে গিয়ে নির্ভীক ভাইয়ার কাছে গিয়ে বলল,,

–“হেই সুপারস্টার আসসালামুয়ালাইকুম !!
কেমন আছো তুমি? আমার কথা তো তুমি ভুলেই গিয়েছো? এতো দিন পর কেন আসলে হু? তুমি জানো না আমি তোমাকে কত মিস করি!! যাও তোমার সাথে কথাই বলবো না!” (অভিমানী স্বরে)

বিনিময়ে নির্ভীক ভাইয়া একটা গা জ্বালানো হাসি দিলেন যেটা একেবারেই পছন্দ হলো না আমার। আর আমার বোনটাও হয়েছে তেমন! সারাদিন নির্ভীক ভাইয়া নির্ভীক ভাইয়া করতে থাকে। এই ছেলেটা আমার ছোট্ট বোনটার উপর কি জাদু করেছে কে জানে? উনি শাম্মী কে কোলে নিয়ে বললেন,,

–“ওলে বাবালে! আমার পরিটা রাগ করেছে দেখছি! এই দেখ কান ধরছি (এক হাত কানে দিয়ে) আর এমন হবে না। এই দেখ তোমার জন্য কত্ত গুলো চকলেট এনেছি।”

শাম্মীর হাতে অনেক গুলো ডেইরি মিল্ক দিলেন নির্ভীক ভাইয়া। শাম্মী তো মহা খুশি। চকলেটের নাম শুনলেই নাচানাচি শুরু করে দেয় মেয়েটা। নির্ভীক ভাইয়া, “তোমাকে তোমার আম্মু ডাকছে” বলে শাম্মীকে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর সোজা আমার বেডের উপর টান হয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি বেডের এক কোনায় বসে ছিলাম ওনার এরকম কান্ড দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। আশ্চর্য! বলা নেই কওয়া নেই হুট করে ঘরে ঢুকে ঠুস করে শুয়ে পড়লেন!! এটা কি ধরনের ব্যবহার? কপাল কুঁচকে ওনার দিকে তাকালাম আমি। তারপর বললাম,,

–“এটা কি ধরনের ভদ্রতা ভাইয়া! এইভাবে আমার বিছানায় শুয়ে পড়লেন কেন?”

–“সাট আপ শর্মি! এইটা কোন কথা হলো? আমি এতো দিন পর তোদের বাড়িতে এলাম কিসের কি একটু যত্ন আত্তি করবি তা না উল্টো প্রশ্ন করছিস? এই তুই এমন কেন রে! তোর বোনটা কত্ত সুইট! কি সুন্দর করে কথা বলে আর তুই যখনই মুখ খুলিস তখনই তিতা করোলার মতো মনে হয়। একটু ভালো করে কথা বলতে পারিস না তুই!”

আমারি বাড়িতে এসে আমাকেই এতো কিছু শোনাচ্ছে! ব্যাটা শয়তান! তোর কপালে কোনদিন ব‌উ জুটবে না আমি বলে দিলাম আর যদি জোটেও সে বাসরের আগেই পালিয়ে যাবে হুহ!! আমি ওনার দিকে চোখ গরম করে বললাম,,

–“কি বললেন আপনি! আমি তিতা করোলা! আমি??? আমি যদি তিতা করোলা হ‌ই তাহলে আপনিও জংলি বিড়াল হুহ!”

–“জংলি বিড়ালের মত কি করেছি আমি! বিড়ালের মতো তোর হাতে খামচি দিয়েছি নাকি কামড়ে দিয়েছি হ্যাঁ যে তুই এমন বলছিস হ্যাঁ? হুদাই উল্টাপাল্টা কথা বলে আমার মাথা কেন খাচ্ছিস বলতো? আমার মতো ভদ্র একটা ছেলেকে তুই জংলি বেড়াল বানিয়ে দিলি? এটা কিন্তু ঠিক না।”

উনার কথা শুনে পড়লো উনি আমার হাতে বেড়ালের মতো আচর তো দেননি কিন্তু!! কাঁমর অবশ্যই দিয়েছেন কিন্তু সেটা জংলি বিড়ালের মতো তার থেকেও ভয়ানক ভাবে। এই কথাটা কি করে ভূলে গিয়েছিলাম আমি! এখন উনি কামর দেওয়ার কথা না বললে তো সেটা মাথাতেই আসতো না। ব্যাপারটা মনে পড়তেই নিজেই নিজেকে কয়েক দফা বকে নিলাম। কারণ আমি একটা বিড়াট বড় ভূল করে ফেলেছি। বাট নো ওয়ারি সেটাকে এক্ষুনি শুদ্রে নিবো। আমি সোজাসুজি উত্তর দিলাম,,

–“ওহ সরি সরি! আপনাকে জংলি বেড়াল বলাটা একদমই উচিত হয়নি। আপনি তো ভ্যাম্পায়ার!! ভ্যাম্পায়ার দের মতো রক্ত খান।”

উনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
–“কি বললি তুই! আমি ভ্যাম্পায়ার!”

–“হুহ! আপনি সেদিন আমার হাতে কামড়ে রক্ত বের করে দিয়েছিলেন মনে নেই আপনার? তাহলে তো আপনি ভ্যাম্পায়ার ই হলেন। যত্তসব!”

উনি আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি ওখান থেকে উঠে বাইরের দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু যেতে আর পারলাম না। তখনই আমার সামনে আমার আব্বাজান এসে হাজির। আব্বুকে আসতে দেখে উনি শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আব্বু এসেই নির্ভীক ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন,,

–“কি খবর মাই চাইল্ড! কেমন আছো?”

নির্ভীক ভাইয়া চেহাড়ায় একটা দুংখী দুঃখী ভাব এনে বললেন,,
–“কিভাবে ভালো থাকি আঙ্কেল! আপনার বড় মেয়ে বলেছে আমি নাকি নাক উঠিয়ে এই বাড়িতে চলে আসি। আমার নাকি এতো ঘনঘন এই বাড়িতে আসা উচিত নয়। এটা নাকি বেহায়াদের পরিচয়!”

আমি অবাক হয়ে গেলাম। এই ছেলে বলে কি? আমি কখন উনাকে এসব বললাম? এতো সুন্দর করে গুছিয়ে মিথ্যা কি করে বলতে পারে কেউ? হাউ? কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো আব্বু আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। তারমানে আব্বু উনার কথাটা বিশ্বাস করেছেন!কেন? আব্বু উনার কথা শুনে আমাকে কি করে অবিশ্বাস করতে পারে! এই দুনিয়ায় আমি আমার আব্বুর রাগকে সবথেকে বেশী ভয় পাই। রেগে যাওয়া রক্তলাল চোখগুলো কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে দেয়। অনেক যন্ত্রনা দায়ক কথা লুকিয়ে থাকে এই দৃষ্টির আড়ালে! মুখে কিছু না বললেও মনের অনেক কথাই বুঝিয়ে দেয় এই রাগ! ভয় আর কষ্ট দুটোর মিশ্র অনুভূতি টা যে কতটা ভয়ানক সেটা আব্বু রেগে গেলেই বুঝতে পারি আমি। তাই কখন এমন কিছু করি না যাতে আব্বু রেগে যায়। কিন্তু আজ শুধু এই ছেলেটার কথা শুনে আমার উপর এতো রেগে গিয়েছে আমার আব্বু!! এই রাগী চোখদুটো অনেক কষ্ট দিচ্ছে আমায়? সাথে জমা হচ্ছে অভিমান। আব্বু রেগে গেলে কখন ‌ই ওনার সামনে দাড়াতে পারি না আমি। খুব বেশি ভয় লাগে আমার। আজ ও এর ব্যতিক্রম নয়। আমি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। কিন্তু হঠাৎ ই পেছন থেকে ডাক পরলো নির্ভীক ভাইয়ের। হয়তো আমার অবস্থাটা বুঝেছিলেন তখন। তাই হয়তো আমাকে বাঁচানোর জন্যেই বলেছিলেন,

–“আঙ্কেল আমার মনে হয় ও কোন একটা বিষয় নিয়ে খুব টেন্সড তাই এমন বলে ফেলেছে। যদি কিছু মনে না করেন আমি ওর সঙ্গে একটু বাইরে থেকে হেঁটে আসি? এতে করে আমার আপনাদের গ্রামটাও ঘুম দেখা হয়ে যাবে আর বাইরের হাওয়া খেয়ে ওর মনটাও ফ্রেশ হয়ে যাবে!”

আব্বু কিছুক্ষণ চিন্তা করে রাজি হয়ে গিয়ে ছিলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন,,
–“ওকে আমাদের এলাকাটা ঘুরে দেখাও আর একটু ভদ্রতা শিখ।”

বলেই আব্বু চলে গেয়েছিলেন আর আমি তখনও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। খারাপ লাগছে খুব। অনেক কষ্টে নিজের চোখের পানি আটকে রেখেছি‌। যখন তখন গড়িয়ে পড়তে পারে এই অবাধ্য কান্না নামক বস্তুটা। তাই হয়তো মাথা নিচু করে রেখেছি যাতে চোখের ভেতরকার পানিগুলো কারো চোখ না পরে। একটা ছেলের সামনে নিজের অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো নিয়ে তাকিয়ে নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করার কোন মানেই হয়না।
·
·
·
চলবে…………………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here