#চুপিচুপি_ভালোবাসি
(পর্ব ১৩+১৪)
#আয়েশা_আক্তার
·
·
·
খুব আয়েশ করে ঘুমিয়ে ছিলাম আমি। আজ শুক্রবার। তাই রিল্যাক্সড হয়ে ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু কে জানত আমার এতো শান্তির ঘুম মুহূর্তেই হারাম হয়ে যাবে। ফোনের রিংটোনে তুমুল শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। মুহূর্তেই হাজারো বিরক্তি এসে ভর করলো আমাকে। বিরক্তিটা আরো বেরে গেলো যখন ফোনে ‘নির্ভীক’ নামটা ভেসে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে বাম দিকে তাকিয়ে দেখলাম ভোর ৫ টা ৩২ বাজে। এতো সকালে আবার কেন ফোন করছে কে জানে? আচ্ছা এই ব্যাক্তির কি আমাকে জ্বালাতন করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই! খালি আমার পেছনে পরে থাকে। সকাল সকাল আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিলো। কোনরকম ফোনটা কানে নিয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে সালাম দিলাম। উনি উত্তর দিয়ে বললেন,,
–“তুই এখনও ঘুমোচ্ছিলি? এতো ঘুম কই পাস তুই?”
এবার মেজাজ বিগড়ে গেল আমার। ৫:৩২ এ কল করে বলছে আমি বেলা করে ঘুমাই। এতো ঘুম কই পাই। এতো সকালে তো মনে হয় কাকেরাও জাগে না। এই লোকটা আসলেই একটা খাড়ুস। বিরক্তি নিয়ে বললাম,,
–“কি বলছেন আপনি? সবে সারে পাঁচটা বাজে আর আপনি বলছেন এতো ঘুম কই পাই? এতো ভনিতা না করে কিসের জন্য ফোন করেছেন সেটা বলুন।”
–“এই এই এই তুই কি আমাকে ধমক দিচ্ছিস নাকি? একদম এরকম করবি না খবরদার! ১০ মিনিট সময় দিচ্ছি এরমধ্যে রেডি হয়ে বাইরে আয়। আর শোন একা আসবি বুঝেছিস। আই অ্যাম ওয়েটিং।”
–“মানে কি? আমি এখন কেন যাবো? আর নিলাকেই বা কি বলবো আমি এতো সকালে কোথায় যাচ্ছি জানতে চাইলে? আমি যেতে পারব না আপনি বরং চলে যান।”
আমার কথার পরিপ্রেক্ষিতে বড়সড় একটা ধমক খেতে হলো আমায়। ধুর বাবা সকাল সকাল এই খাড়ুসটার ধমক শুনলাম আজকের দিনটাই খারাপ যাবে আমার। আমার ভাবনার মাঝেই উনি বলে উঠলেন,,
–“বেশি কথা বলবি না একদম। নিলাকে কিভাবে ম্যানেজ করবি সেটা তুই জানিস।”
–“আপনি চলে যান। আমি যাবো না কোথাও আপনার সাথে।”
–“তুই নিজে থেকে আসবি নাকি গিয়ে আমি নিয়ে আসবো? দেখ তুই নিজে থেকে আসলে ভালো ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করার টাইম পাবি কিন্তু যদি আমি নিয়ে আসি তাহলে এখন যে অবস্থায় আছিস সেই অবস্থায়ই তুলে নিয়ে আসবো। সেটা কি খুব ভালো হবে? নাকি আমার কোলে উঠবি বলে এমন করছিস। বাহ্! আইডিয়া টা খারাপ না। কোলে উঠার নিন্জা টেকনিক।” (বাঁকা হেসে)
উনার কথা শুনে আমি হতবাক! কি সাংঘাতিক ছেলে! আমি নাকি উনার কোলে উঠার জন্য এমন করছি। আবার আমি না গেলে এখানে চলে আসবে? নাহ এই ছেলেকে বিশ্বাস নেই আমাদের রুমে আসতে দুবার ভাববে না এই ছেলে। তার থেকে যা বলছে তাই করা ভালো। আমি বললাম,
–“কি সব বলছেন আপনি? আমি নিজেই আসছি। আপনার কোলে ওঠার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার নেই।”
–“ইউ হ্যাভ অনলি সেভেন মিনিটস!”
–“হু”
ফোন কেটে তরিঘরি করে বিছানা থেকে উঠলাম। দেখলাম নিলা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। যাক বাঁচা গেল। ওকে ডাকবো না থাক। এভাবেই ঘুমাতে থাকুক তারমধ্যে এসে পরবো নিশ্চয়ই। ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে ফোনটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। চুলটাও বাধার সময় পাইনি। তাই ওড়না দিয়ে ভালোভাবে মাথাটা ঢেকে নিলাম। তাড়াহুড়ো করে নিচে নেমে এলাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম একটা কাক পক্ষিও নেই। সবাই নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে। হাজার হলেও আজ শুক্রবার। এই দিনটাতে কেই বা এতো সকালে উঠবে? এসব ভাবছি আর গেইটের দিকে এগোচ্ছি। এই মুহূর্তে নিজেকে ঐসব মেয়েদের মতো মনে হচ্ছে যারা সবার চোখের আড়ালে লুকিয়ে চুড়িয়ে নিজেদের প্রেমিকের সাথে দেখা করতে যায়। কিন্তু পার্থক্য একটাই ওরা যায় নিজেদের বফদের সাথে দেখা করতে আর আমি যাচ্ছি আমার বরের সাথে দেখা করতে। বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। কেউ দেখলে কি ভাববে? তারা কি আর বুঝবে যে আমি আমার বরের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি কোন পরপুরুষের সাথে নয়। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে গেটের সামনে এসে সামনের দিকে তাকাতেই পা দুটো মনে হয় মাটির সাথে আটকে গেল। নির্ভীক বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছেন। আমি গুটিগুটি পায়ে উনার দিকে এগোচ্ছি আর চোখ দিয়ে উনাকে স্ক্যান করে দেখছি। পরনে সাদা রংয়ের টি শার্ট তার উপর আকাশি,কালো আর সাদা রংয়ের চেক শার্ট। শার্টের বোতাম গুলো খোলা, টি শার্ট এর গলার সাথে সানগ্লাস ঝুলছে, ব্লো জিন্স প্যান্ট আর হোয়াইট সুজ, হাতে ব্ল্যাক বেল্টের ঘড়ি। ফর্সা গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সিল্কি চুলগুলো কপালের উপর এসে পড়ছে বারবার। মাঝে মাঝে নিজের হাত দিয়ে চুলগুলো কে এলোমেলো করে দিচ্ছেন উনি। এই কাজটা মোটেও পছন্দ হচ্ছে না আমার। উনার চুল গুলো ওরকম থাকলে কি হতো? হুহ! উনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিজের দিকে তাকালাম আমি। এই মুহূর্তে উনার সামনে নিজেকে ফকিন্নি মনে হচ্ছে আমার। এতো সেজেগুজে ফিটফাট হয়ে আসতে কে বলেছিল উনাকে। উনি এতো স্টাইলিশ আর আমি! মুহূর্তেই মুখটা মলিন হয়ে গেছে আমার। আমি গুটিগুটি পায়ে উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর বারবার আড়চোখে আমার দিকে দেখছেন। ব্যাপারটায় চরম অস্বস্তি হচ্ছে আমার। আমি উনার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। আমি সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলাম। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছি না। কথাগুলো গলায় এসে আটকে যাচ্ছে। মাথার ভেতর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। হয়তো আমার অবস্থাটা বুঝতে পারলেন উনি। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,,
–“এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে বাইকে উঠে বস।”
উনার কথা শুনে উনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি বাইকে বসে আছেন। আমিও গিয়ে উনার পেছনে বসে পড়লাম। আমি উঠতেই বাইক ছুটালেন উনি। কিছুক্ষণ পর আমি উনার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম,,
–“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
–“একটুপর দেখতেই পাবি। এই তুই এমন ভাবে এসেছিস কেন রে? এভাবে আর কখনো বেরোবি না। বলা তো যায় না তোকে এই রূপে দেখে কত শত ছেলে হার্ট অ্যাটাক করে বসবে। তখন তো তোর জেল হয়ে যাবে রে পেত্নি। সেটা তো আমি হতে দিতে পারি না। নোপ! তাই এমন শাকচুন্নী সেজে বাড়ি থেকে বের হবি না এই আমি বলে দিলাম।”
উনার কথা শুনে উনার উপর ই রাগ হচ্ছে আমার। নিজেই তো বললো ১০ মিনিটের জন্য বেরোতে। আর আমিও এলোমেলো হয়েই চলে এসেছি। আমার যে পঁচা মার্কা চেহারা তার উপর এই গেটআপ নিশ্চয়ই খুব বাজে দেখতে লাগছে আমায়। নিজের মনে এসব আওড়ে মুখ ফুলিয়ে বললাম,,
–“আমাকে দেখে কত শত ছেলে হার্ট অ্যাটাক করবে,,!! তাহলে আপনি এখনও ঠিক আছেন কি করে? এই আপনার জন্যেই তো এইভাবে আসতে হলো। যেভাবে বললেন ১০ মিনিটের মধ্যে নিচে আয় নাহলে আমি গিয়ে তুলে নিয়ে আসবো তাতে তো আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যদি সত্যি সত্যি চলে যেতেন।”
উনি শব্দ করেই হেসে উঠলেন। আশ্চর্য আমি হাসার মতো কি বললাম। আমি চোখ ছোট ছোট করে উনার দিকে তাকালাম। উনি হাঁসি থামিয়ে বললেন,,
–“আমার হার্ট বাকি দের মতো এতো দূর্বল নয় বুঝেছিস। অ্যা’ম আ স্ট্রং হিউম্যান। এতো সহজে হার্ট অ্যাটাক করবো না। আর তাছাড়া আমি একজন ডক্টর সো নিজের হৃদয় কে সামলে রাখতে খুব ভালো করেই জানি।”
এ্যাটিটিউড এর ডিব্বা একটা। আপনার এই এ্যাটিটিউডের গুষ্টির তুষ্টি হুহ! ভদ্র শয়তান কোথাকার। আমার ভাবনার মাঝেই উনি বললেন,,
–“আমাকে এভাবে মনে মনে বকে কোন লাভ নেই।”
উনি আমার মনের কথা বুঝলেন কি করে? এখন কি মনে মনেও কিছু ভাবতে পারবো না আমি। উনি বাইক থামিয়ে বললেন,,
–“ভাবতে পারবি না কেন? পারবি তো কিন্তু তোর ভাবনাগুলো আমার থেকে লুকাতে পারবি না। এবার নাম। আমরা এসে গিয়েছি।”
আমি বাইক থেকে নেমে গেলাম। সামনে একটা নদী। উনি নদীর দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি উনার যাওয়ার দিকে চেয়ে আছি। ভাবছি উনি আমার মনের কথা গুলো বুঝছেন কি করে। উনি কি এলিয়েন নাকি? কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে দৌড়ে উনার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম,,
–“আচ্ছা আপনি কি এলিয়েন!”
–“হুয়াট! এই তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে নাকি হ্যাঁ? আমি এলিয়েন কেন হতে যাবো?”
–“তাহলে আপনি আমার মনের কথা বুঝছেন কি করে?”
–“আমি তো আন্দাজ করে বলেছিলাম ওগুলো! তুই ও না!”
আন্দাজ করে কেউ এমন কিছু বলবে যেটা একদমই আমার ভাবনার সাথে মিলে যাবে সেটা একদমই ধারণার বাইরে ছিলো আমার। আমি সামনের দিকে দৃষ্টি দিলাম। আর তাতেই আমি মুগ্ধ হয়ে গলাম। জায়গাটা কত সুন্দর! চারিদিকে গাছপালায় ভরা। এইখানে এতো সুন্দর একটা জায়গা আছে সেটা জানা ছিলো না আমার। আমি চারিদিকে ভালো করে দেখে নিয়ছ উনাকে বললাম,,
–“আমরা এখানে কেন এসেছি?”
উনার দ্রুত জবাব,,
–“প্রেম করতে!”
উনার করা শুনে আপনাআপনিই আমার চোখ বড়বড় হয়ে গেল। আমি চমকিত দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম। উনি আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,
–“এমন রিয়্যাক্ট করার কি আছে? এমন বিহ্যাভ করছিস যেন আমি তোর সাথে বাসর করতে এসেছি। নিজেকে নরমাল রাখ। এখানে মানুষ বসে থাকতে আসে নাকি স্টুপিড! তোর বান্ধবী আর আমার ভাইয়ের ঝগড়া ঠিক করতে এসেছি। আর এর থেকে বেটার প্লেস আমার যাথায় আসে নি।”
শেষের কথাগুলো একটু রাগী ভাবে বলেই একটা বেঞ্চের উপর গিয়ে বসলেন উনি। আর আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু হঠাৎ এমন রেগে কথা বললেন কেন? আমিও গিয়ে উনার পাশে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর সেখানে মারুফা আর আয়াত ভাইয়া ঝগড়া করতে করতে আসলো। আয়াত ভাইয়া আগে আগে আসছে আর পেছনে মারুফা রেগে বেগুন হয়ে জোরে জোরে হেঁটে আসছে। এই ম্যাডাম এতো রেগে আছে কেন। আমি নির্ভীকের কানে ফিসফিসিয়ে বললাম,,
–“কাহিনী কি? এই দুইটার আবার কি হলো? কালকেই তো মনে হয় এদের ঝগড়া ঠিক হলো রাতের মধ্যেই আবার সিচুয়েশন চেন্জ্ড! দিস ইজ ভেরি স্ট্রেন্জ!”
–“বুঝিনা এদের এতো কিসের ঝগড়া লাগে। এই তোর বেষ্টু এমন কেন রে! সবসময় আমার ভাইটার সাথে এমন ঝগড়া করে। কোন ভাবে তুই ওকে এসব শিখাস না তো ঠিকই আছে যেমন শিক্ষক তেমন শিষ্য!”
–“মানে! কি বলতে চাইছেন আপনি? আমি ওকে ঝগড়া করা শিখিয়েছি? এই আপনার কোন দিক দিয়ে মনে হয় যে ঝগড়া করি?”
–“আরে থাম! তুই খালি আমার সাথেই ঝগড়া করিস? আর আমি কখন বললাম যে তুই ওকে ঝগড়া শিখাস? তুই ই তো বললি। যাই হোক এসব ছাড় ওদের ব্যাপার টা মিটা আগে।”
আমি চুপ করে রইলাম। মারুফা এসেই আমাকে বলতে লাগলো,
–“দোস্ত এই আহাম্মক টাকে বোঝা যে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করাটা ঠিক হবে না। সবে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পরছি আর এখনি বিয়ে করে নিবো? ওকে বল পড়াশোনা শেষ করে তারপর বিয়ে করবো ততদিনে সেও ভালো একটা পজিশনে চলে আসবে।”
এর মাঝেই আয়াত ভাইয়া বলে উঠলেন,,
–“তুমি কি বলতে চাও আমি ভালো পজিশনে নেই! আমি একজন ডক্টর ওকে?”
মারুফা আয়াত ভাইয়ার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকালো তারপর বলল,,
–“তুমি চুপ থাকো! আর নির্ভীক ভাইয়াও তো ডক্টর! কই উনি তো তোমার মতো বিয়ে করার জন্য লাফাচ্ছে না। তাহলে তুমি এতো লাফাচ্ছো কেন?”
কথাটা শুনেই নির্ভীক বিষম খেলো। আমিও আবলার মতো বসে আছি। মারুফা তো আর জানে না তার নির্ভীক ভাইয়ার দেখাদেখিই তো আয়াত ভাইয়া বিয়ে করার জন্য লাফাচ্ছে। মারুফা নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে বলল,,
–“ভাইয়া আপনি তো কিছু বলুন আপনার ভাইকে!”
সাথে সাথে আয়াত ভাইয়া বলে উঠলেন,,
–“আরে বেবী ও কি বলবে? ওর কাছ থেকেই তো আমি ইন্সপায়ার্ড হয়েছি। আর তুমি বললে ও বিয়ে করার জন্য লাফাচ্ছে না? আরে ওর লাফানোর কি দরকার ওর তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে তাই আর বিয়ের জন্য লাফাতে হচ্ছে না।”
আয়াত ভাইয়ার কথা শুনে মারুফা একবার নির্ভীকের দিকে তাকালো তারপর আয়াত ভাইয়ার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,,
–“ধাপ্পা মারার জায়গা পাও না! নিজে বিয়ে করবে বলে ভাইয়ার নামে মিথ্যা বলছো?”
সাথে সাথে প্রতিবাদি স্বরে আয়াত ভাইয়া বলে উঠলেন,,
–“আমি মিথ্যে বলছি না। সত্যি নির্ভীকের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। যাও প্রায় ১৫-২০ দিন আগে। আমি একদম সত্যি বলছি।”
এবার মনে হয় আয়াত ভাইয়ার কথা একটু একটু বিশ্বাস হলো তার। ও বলল,,
–“মিথ্যা বলা অফ করো। আর যদি ভাইয়ার বিয়ে হয়েই থাকে তাহলে কার সাথে বিয়ে হয়েছে বলো? আর এ বিষয়ে কেউ কিছু জানে না কেন? আমাকে তো কেউ কিছু বললো না। আর শর্মির তো জানার কথা। এই শর্মি তুই কিছু জানিস?”
এবার আমি কি করবো? আজ আমি শেষ। আজ পর্যন্ত ওর কাছে কোন কথা লুকাইনি কিন্তু এই বিয়ের ব্যাপারটা! ওহ শিট এখন যদি আয়াত ভাইয়া ওকে সব বলে দেয় নিশ্চিত আমার বারোটা বাজাবে এই মেয়ে। নানা শুধু এটুকু করে শান্ত হবে না ইমোশনাল ড্রামাও করবে। আমি অসহায় মুখ করে নির্ভীকের দিকে তাকালাম। উনি আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। উনি কিছু বলবেন তার আগেই আয়াত ভাইয়া বললেন,,
–“আরে শর্মি কি বলবে? ঐ তো আমার ভাবী মানে নির্ভীকের বউ। নির্ভীক তো ওকেই বিয়ে করেছে।”
যাস হয়ে গেল। মারুফা আমার দিকে রসগোল্লার মতো চোখ বানিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি আর নির্ভীক একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছি। চোখের ইশারায় কথা বলছি। আজব ব্যাপার হলো আমরা একে অপরের ঈশারা বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি। আমাদের দুজনের কথাই হলো এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালা। একটু ফাঁক ফোকর পেলেই পালাবো।😶
·
·
·
চলবে………………………..
#চুপিচুপি_ভালোবাসি (পর্ব ১৪)
#আয়েশা_আক্তার
·
·
·
মারুফার ঘরে খাটের উপর পায়ের উপর পা তুলে বসে আছি আমি। আমার সামনেই রাগী লুক নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মারুফা। ম্যাডাম এর এতো রাগ যে পুরো ৮ দিন আমার সাথে একটা কথাও বলে নি। এমনকি কলেজ ঈদের ছুটি হওয়ার পর বাড়িতে আসার সময়ও একাই এসেছে। আমাকে একবার জানায়নি পর্যন্ত। তাই আর কি করা বাড়ি ফিরেই সোজা বেস্টুর বাড়িতে চলে এসেছি। এতো রাগ কি মানা যায় নাকি? কিন্তু এখানে এসে তো দেখি আরেক কাহিনী। মারুফা শাড়ি পড়ে ভালোই সেজে গুজে বসে আছে। আমি তো শকড, মারুফা আর শাড়ি! আমার যেন বিশ্বাস ই হচ্ছিলো না। কিন্তু পরক্ষণেই ওর ছোট বোন জান্নাতের কথা শুনে বিশ্বাস করতে হলো। জান্নাতের কথা অনুযায়ী আজ মারুফাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। আর তারা পাশের ঘরেই আছে। এই কথা শুনে আমি কি রিয়্যাকশন দিবো বুঝতে পারছিলাম না। আজ যদি মারুফা কে পাত্রপক্ষ পছন্দ করে নেয় তাহলে আয়াত ভাইয়ার কি হবে? আর যদি পছন্দ হয় কেন বলছি? ওকে যে পছন্দ হবে সেটা আমি ১০০% শিওর।ওকে দেখতে তো মাশাআল্লাহ পছন্দ না হয়ে পারবেই না। তাহলে আয়াত ভাইয়া কি তাহলে এবার দেবদাস হয়ে যাবে? যেভাবে সেজেগুজে বসে আছে তাতে তো মনে হচ্ছে ও বিয়েটা করেই নিবে। এসব ভাবতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। এই মাইয়া কি এবার আয়াত ভাইয়াকে ছ্যাঁকা দিয়ে আরেকজন কে বিয়ে করে নিবে নাকি? কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে দড়জার কাছে গিয়ে পাশের রুমে একটু উকি দিলাম। কিন্তু উনারা সব উল্টোদিকে ফিরে বসে আছেন। মুখ দেখতে পাচ্ছি না। কিছুক্ষণ এমন উঁকিঝুঁকি দেওয়ার পর একজন কে দেখতে পেলাম। উনি আর কেউ নন আয়াত ভাইয়ার মা রোকসানা চাচি। এবার জ্বিভ কামরে ধরলাম আমি। তারমানে আয়াত ভাইয়ার পরিবার ই এসেছে আর আমি কিনা কি ভাবছিলাম। আমি যে আসলে কত বড় বোকা সেটা আজ আবার ও প্রমাণিত হয়ে গেলো। আমি গিয়ে খাটের উপর বসলাম। মারুফা একবার তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এখনও রেগে আছে। তাতে কি আমি তো ব্যাপক খুশি। ছোটবেলায় আমরা একে অপরকে বলতাম এমন কাউকে বিয়ে করবো যার আর একটা ভাই থাকবে। একজন ক আমি বিয়ে করবো আর অন্যজনকে মারুফা। কিন্তু কথাটা যে এইভাবে সত্যি হয়ে যাবে ভাবতেই একটা গান মাথায় আসছে। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে!! এসব ভাবতে ভাবতেই মারুফাকে নিয়ে যাওয়া হলো। ঐ রুমে কি হলো জানি না খানিক বাদে মারুফা এসে আমার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো। কিন্তু আমি তো আরো আরাম করে বসে আছি। কাকিমা এসে মিষ্টি দিয়ে গেলো। তাতে বুজলাম বিয়ে পাকা! আহা কি মজা। আমি ওকে দেখিয়ে মিষ্টিটা মুখে পুরে নিলাম। এমনভাবে খাচ্ছি যেন এর থেকে ভালো কোনো মিষ্টি হতেই পারে না। ও রাগে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। কত রাগ এই মেয়ের! তাতে আমার কি? ওর রাগ দেখার টাইম আছে নাকি আমার।এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার মারুফার দিকে তাকালাম। ও এখনও রাগী চোখেই তাকিয়ে আছে। বাট হু কেয়ারস? আমি ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে ওর জান্নাতের দিকে তাকালাম। ও বেশ আয়েশ করে পেয়ারা খাচ্ছিলো। আমি তাকাতেই মুচকি হেসে বলল,,
–“আপু পেয়ারা খাবা? অনেক টেষ্টি!”
আমি ও একটা হাসি দিয়ে বললাম,,
–“না গো এখন খাবো না। তুই বরং তোর বোনকে খাওয়া। ভালো করে খাওয়া! কিছুদিন পর তো চলেই যাবে বেচারি! এখানে আর কয়দিন ই বা আছে বল। ও এখন কয়েকদিনের মেহমান মাত্র! একটু ভালো মন্দ খাওয়া!”
জান্নাত চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর মারুফার দিকে তাকিয়ে আবার আমার দিকে তাকালো। আমি ওকে এক চোখ টিপে একটা হাসি দিলাম। ও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হুহা করে হেসে উঠলো। আমদের হাসি দেখে মারুফার রাগ আরো বেড়ে গেল। এই মুহূর্তে ওকে একদম টমেটোর মতো লাগছে। রাগের কারনে ফর্সা গোলগাল মুখটা একদম লাল হয়ে গিয়েছে। বেশ লাগছে ওকে এমন টমেটো হতে দেখে। ওকে আরো একটু রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম,,
–“জান্নাতিই! তোর বোনকে দেখ কেমন লাল টমেটো হয়ে গিয়েছে। একটা ছবি তুলে রাখ তো! আয়াত ভাইয়া কে দেখাবো। এমন অবস্থায় দেখলে আয়াত ভাই নিশ্চয়ই হা হয়ে যাবে।”
মারুফা আমাকে মারার জন্য তেড়ে এলো। আমাকে আর পায় কে আমি তো ভো দৌড়! দৌড়াতে দৌড়াতে কখন পাশের ঘরে চলে গিয়েছি টের ই পাইনি। আমি দৌড়ে গিয়ে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পরলাম। মারুফা দৌড়ে আসতেই আয়াত ভাইয়ার সঙ্গে খেলো এক ধাক্কা। ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলেই আয়াত ভাইয়া ধরে ফেললেন। ওয়াহ্ হোয়াট আ সিন! সেই লেভেলের হাঁসি পাচ্ছে আমার। হঠাৎ কেউ আমার হাত টেনে অন্য। রুমে নিয়ে এলো। আমি চিৎকার দিবো এমন সময় কেউ আমার মুখ চেপে ধরলো। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছি। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলেই দেখি নির্ভীক! উনাকে দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তারপর মুখ থেকে উনার হাত সরিয়ে বললাম,,
–“কি হচ্ছে কি? এভাবে আমাকে এখানে নিয়ে আসার মানে কি?”
–“চুপ! তোকে না সেদিন বললাম এরকম এলোমেলো ভাবে বাড়ি থেকে বের হবি না! তাহলে কেন বের হয়েছিস?এই তুই কি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিস যে সবগুলো নিরীহ ছেলেকে মেরেই ছারবি? না জানি রাস্তায় তোকে দেখে কত ছেলে হার্ট অ্যাটাক করেছে?”
এবার আমি নিজের দিকে তাকালাম। কাঠালি রংয়ের থ্রি পিস পড়েছি। কোনরকম গোসল করেই দৌড়ে এদিকে চলে এসেছি চুল গুলো ও আচরাই নি। এইরে!! কিন্তু আমি বুঝি না উনি এমন কেন বলেন যে আমাকে দেখলে ছেলেরা হার্ট অ্যাটাক করবে! আচ্ছা আমাকে কি এতোটাই বাজে দেখতে লাগছে নাকি? আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি বললেন,,
–“কি হলো কথা বলছিস না কেন?”
–“আপনিই তো বললেন চুপ থাকতে!”
উনি কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে তার পর বললেন,,
–“বেশ ভালোই কথা বলা শিখেছিস দেখছি। যাই হোক এবার চল। নইলে সবাই কি না কি ভাববে।”
আমিও আর কথা বাড়ালাম না। চলে এলাম ড্রয়িং রুমে। আমাকে দেখেই তো রোকসানা চাচি খুশিতে গদগদ হয়ে গেলেন। উনি হাসি মুখেই বললেন,,
–“আরে বউমা যে! তুমি এখানে? নির্ভীক ডেকেছে নিশ্চয়ই?”
উনার কথা শুনে আমি চোখ বড়বড় করে তাকালাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম এখানে মারুফাদের বাড়ির কেউ নেই। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চাচিকে বললাম,,
–“না চাচি আমাকে উনি ডাকেন নি। আপনি হয়তো জানেন না যে মারুফা আমার বান্ধবী। আমি তো ওর সাথেই দেখা করতে এসেছিলাম। আমি তো জানতাম ও না যে আপনারা এখানে আসবেন।”
একটু হাসার চেষ্টা করে কথাগুলো বললাম।চাচিও আর কিছু বললেন না। বিয়ের কথা পাকা করার পর সবাই চলে যেতে চাইলে আমি উনাদের আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলাম। ওনারা প্রথমে আসতে চাইছিলেন না। কিন্তু নির্ভীকের কথায় সবাই রাজি হলেন। আর যাই হোক আব্বুর সাথে দেখা না করে কেউ যাবে না সেটা আমি নিশ্চিত। কিন্তু বাড়িতে আসতেই নির্ভীকের জ্বালাতন বেড়ে গেলো। যেমন, সবাই একসাথে গল্প করছি সেই সময় সবার আড়ালে কখনও বা আমার উড়নার এক কোনা নিয়ে হাতের আঙ্গুলে পেচাচ্ছেন। আবার কখনও বা চুল ধরে টানছেন। একেক সময় চোখ টিপছেন। বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি আমি। সবার সামনে কিছু বলতেও পারছি না আবার সহ্যও করতে পারছি না। চুপচাপ বসে আছি। ঠিক এমন সময় ব্যাপারটা আয়াত ভাইয়ার নজরে পরে গেল। উনি আমাদের দিকে তাকিয়ে মামনি কে বললেন,,
–“জেঠিমনি! মনে হয় এবার তোমার ছেলের বউকেও ঘরে তোলা উচিত। বিয়ের পরেও বেচারা আমার ভাই কতদিন বউ ছাড়া থাকবে বলো!”
উনার কথা শুনে উপস্থিত সবাই আমাদের দিকে তাকালো। আমি চোখ বড়বড় করে একবার সবার দিকে তাকালাম তারপর নির্ভীকের দিকে তাকালাম। তারপর ঠোক গিলে দৌড়ে ওখান থেকে চলে আসলাম। বাইরে আসতেই সবার হো হো শব্দের হাসি কানে এসে লাগলো। কি লজ্জাজনক ব্যাপার। মনে মনে নির্ভীক কে হাজারো গালি দিচ্ছি।
·
·
·
চলবে……………………….