#চিত্তবৃত্তি
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৫
আমাদের আশপাশে কিছু অসাধু মানুষ আছে৷ যারা সকলের চোখে নিজেকে সাধু রূপে দেখতে চায়। কিন্তু সে চাওয়া কখনো পূর্ণ হয় না। শুধুমাত্র অন্তরে অসততা পুষে রাখে বলে। ইভান সেই দলেরই একজন সদস্য। যে কিনা শিশু বয়স থেকে অসততা দিয়ে সকলের ভালোবাসা জয় করতে চেয়েছে। ভালোবাসা হলো সততার লড়াই। যাকে জয় করতে হয় সততা নামক অস্ত্র দিয়ে৷ যা সম্পর্কে ইভান শিশু বয়স থেকেই ভীষণ অজ্ঞ। নিজের চাচাত ভাই ইমনের সঙ্গে শিশুকাল থেকে ভালোবাসা নিয়ে দ্বন্দ্ব তার৷ ইমনের মা মারা যাওয়ার পর পরিবারের সবাই ইমনকে বিশেষ যত্ন নিতে শুরু করে। ইভান, ইমন সমবয়সী। তবু সবদিক থেকেই অধিক গুরুত্ব পেত শুধু ইমন৷ ইভান চাইত সবাই তাকে বেশি ভালোবাসুক। বেশি গুরুত্ব দিক। কিন্তু সে যখন বুঝতে পারে সবাই তার চেয়ে ইমনকে বেশি ভালোবাসে৷ তখন থেকেই ভেতরে প্রতিহিংসা সৃষ্টি হয়। সকলের মনোযোগ যখন ইমনের দিকে থাকে সে তখন চেষ্টা করে সেই মনোযোগ নিজের দিকে আনতে। অনেক সময় দেখা যেত সে নিজেই নিজেকে আঘাত করে বসত৷ যাতে ইমনকে ছেড়ে সকলে তার প্রতি মনোগ্রাহী হয়৷ হতোই তাই৷ কিন্তু সেটা দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়। যা তার প্রতিহিংসাকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিত৷ অবুঝ সে বয়সে ইভানের ধারণা ছিল ইমনের মা নেই৷ তাই সবাই তাকে এত ভালোবাসে, গুরুত্ব দেয়। এমন ধারণার কারণে একসময় সেও চাইত তার মা মরে যাক। মা হারা হোক সে। এরপর সকলে তাকেও ইমনের মতো ভালোবাসবে, গুরুত্ব দেবে। তার অপরিণত বুদ্ধি গুলো পরিণত হয় এক সময়৷ পরিণত হয় ভেতরের প্রতিহিংসাও। ইমন বড়ো হতে হতে তার দৃঢ় ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়ে ভালোবাসা, সম্মান অর্জন করতে থাকে। আর ইভান প্রতিহিংসার আগুন বুকে পুষে উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করে সকলের থেকে শুধুই ঘৃণা অর্জন করে। ইভানের মা উচ্চ শিক্ষিত বুদ্ধমতী মহিলা। তাই এক পর্যায়ে ছেলের মানসিক অস্বাভাবিকতা বুঝতে পেরে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। ইমনের প্রতি তার হিংসাত্মক মনোভাব, মুসকানের প্রতি অমার্জিত আচরণ সমস্তই খেয়াল করেছিলেন তিনি৷ এই পরিবারে থেকে দিনের পর দিন ইমনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ইভানের ভবিষ্যত অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে৷ মা হয়ে সন্তানের এতবড় ক্ষতি সে মেনে নিতে পারেনি। আজ এতগুলো বছর দেশের বাইরে থাকার পর দূর থেকে যতটুকু বুঝেছিলেন এতে চিন্তার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু দেশে ফেরার পর তার ছেলেটা যে আবারো সেই পুরোনো ইভানে পরিণত হবে ঘুণাক্ষরেও টের পাননি ইভানের জন্মদাত্রী।
সেদিন ইমনের অনুরোধে থেকে যায় মুসকান। দাদুভাই বিনা দ্বিধায় অনুমতি দেন৷ দিহান, সায়রী আছে বলেই স্বস্তি সহকারে অনুমতি দিতে পারেন তিনি। এরপর একটা একটা করে চৌদ্দ দিন কেটে যায়। দিন-রাত এক করে পড়াশোনা করে ইমন৷ তিনবেলা মুসকানের হাতে রান্না খাবার খায়। এই চৌদ্দ দিনে মুসকানের সঙ্গে একাকী, নিভৃতে সময় কাটায়নি ইমন। সে শুধু চেয়েছিল মানুষটা চোখের সামনে থাকুক৷ থেকেছেও। রাত ছাড়া যখনি ইমন ডেকেছে তখনি সামনে এসে চুপচাপ বসেছে মুসকান। যতক্ষন না অনুমতি পেয়েছে ততক্ষণ সামনে থেকে চলে যায়নি। তাদের এই শান্ত, নরম প্রণয়ে অশান্তি হয়েছে দিহানের বুকে। বেচারা চৌদ্দ রাত ধরে বউ ছাড়া পড়ুয়া বন্ধুর ঘরে ঘুমুচ্ছে। দিহানের মুখের দিকে তাকাতে পারে না মুসকান৷ লজ্জায় সামনে যাওয়া থেকেও বিরত থাকে। ইমনের পাগলামির জন্য বউ পাগল দিহান আজ বউ ছাড়া! সায়রীর মনোভাব অবশ্য বোঝা যায় না৷ সে সকলের সম্মুখে ঠিকই দিহানকে ভেঙচি কাটে, মজা নেয়। কে জানে দৃষ্টির অগোচরে সেও হয়তো দিহানের মতোই কেঁদেকুটে একাকার।
একদিকে ইমন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অন্যদিকে চৌধুরী বাড়ির সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছিল তার আর মুসকানের বিয়ের। যা সম্পর্কে পুরোপুরি অজানা রয়েছে মুসকান। সে শুধু জানত পরীক্ষার পরপরই বিয়ে হবে তাদের৷ ইমন এবং পরিবারের সকলে মিলে যে তার জন্য সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করছে টের পায়নি
এদিকে নিজের কুবুদ্ধি কাজে লাগানোর পূর্বেই ইমন, মুসকান এক হয়ে যাচ্ছে দেখে মাথা খারাপ হয়ে যায় ইভানের। মুসকানের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল, এখনো আছে। ভবিষ্যতে এই দুর্বলতা থেকেই যাবে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ কারণ মুসকান ইমনের বউ হচ্ছে। মুসকান তারও কাজিন। ইমনেরও কাজিন৷ বউ যদি হবারি হয় তার না হয়ে ইমনের কেন হবে? ওদের মধ্যে ভালোবাসা আছে বলে? কেন থাকবে ভালোবাসা? ইমনের আগে সে মুসকানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। বিদেশ যাওয়ার আগে ইমনের হাতের সেই থাপ্পড়টা ভুলে যায়নি৷ যে ভুলে সে শাস্তি পেয়েছে সে একই ভুল ইমনও করেছে। তাহলে শাস্তি শুধু সে একা পেল কেন? এ বাড়ির সকলের ভালোবাসা শুধু ইমনের জন্য। যা দাঁতে দাঁত চেপে হজম করেছিল সে। কিন্তু আজ যেন ধৈর্যহারা হয়ে গেল। তার কেবল মনে হতে লাগল ইমন সব সময়ের মতো মুসকানের ভালোবাসাও ছিনিয়ে নিল তার থেকে। নিজের সঙ্গে নিজে যুক্তি, তর্ক করে যুক্তি, অযুক্তি মিলিয়ে ইভান সিদ্ধান্ত নিল, মুসকানকে সে তার মনের কথা জানাবে৷ এই সময়ে এসে এমন একটি সিদ্ধান্ত কতটুকু যুক্তিপূর্ণ বা গ্রহণযোগ্য সে হিসেব করল না ইভান৷ ত্যাড়ামি করে মুসকানকে কল করল নিজের মনে কথা জানাতে। পুঁথিগত শিক্ষা অর্জন করলেও জ্ঞানহীন ইভান নিজ মনেও স্বীকার করল না মুসকানের প্রতি তার চাহিদাটা দৈহিক। যার সঙ্গে মনের কোনো সংযোগ নেই। একটা মেয়ে কখনোই এমন পুরুষকে মন দিতে আগ্রহী হয় না। যেখানে ইমন চৌধুরী দফায় দফায় তাকে অনুভব করাচ্ছে সে তার চিত্তের প্রবৃত্তি। সেখানে ইভানের ঠুনকো অনুভূতি যা শুধুই দৈহিক এবং ইমনকে পরাস্ত করতে সৃষ্টি। তার প্রতি কীভাবে আগ্রহী হবে?
__
ইমনের পরীক্ষা শেষ। গোছগাছ শুরু হয়েছে রাত থেকেই। প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে শাওয়ারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল মুসকান৷ এমন সময় সায়রী ঘরে এলো কয়েকটা শপিং ব্যাগ নিয়ে। মুসকানের হাতে সবগুলো ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ম্যাডাম আপনাকে শাড়ি পরতে হবে। স্যারের অর্ডার।’
মুসকান শীতল দৃষ্টিতে তাকাল। শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘এই গরমে শাড়ি!’
কণ্ঠ ঈষৎ বিস্ময়ে ভরপুর। সায়রী ওর কাঁধ চেপে ধরে বলল,
‘কী আর করবে, পুরুষ মানুষের মন। কখন কী করে, কী চায় বোঝা দায়।’
কিয়ৎক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শপিং ব্যাগ গুলো নিয়ে বিছানায় বসল মুসকান। দেখতে পেল, কালো একটি রঙের শাড়ির সঙ্গে প্রয়োজনীয় সবকিছুই রয়েছে। এত আশা নিয়ে পাঠিয়েছে না পরলে কেমন দেখায়? দ্বিমত না করে ঝটপট গোসল সেরে শাড়ি পরে নিল। সাজগোজের ইচ্ছে একেবারেই ছিল না। সায়রীর অনুরোধে চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক আর হালকা জুয়েলারি পরল। সায়রী ফটাফট নিজের ক্যামেরায় বন্দি করে ফেলল কৃষ্ণবর্ণ শাড়ি পরিহিত শ্যামলিমা রমণীকে। প্রথমে কথা ছিল ইমন আর মুসকান চলে যাবে। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলো। দিহান আর সায়রীও যাবে। দাদুভাই ফোন করে বলেছেন ওদের যাওয়া বাধ্যতামূলক। তাই ওরা দু’জন গোছগাছ করে তৈরি হচ্ছে। এদিকে ইমনের কফির প্যারা ওঠেছে। রুম থেকে চ্যাঁচিয়ে ডাকছে,
‘মুসকান কফি নিয়ে এসো।’
শাড়ি পরে সাজগোজ করে এমনিতেই লজ্জায় নেতিয়ে ছিল মুসকান৷ ইমনের ডাক পেয়ে হৃৎপিণ্ড লাফাতে শুরু করল৷ কৃষ্ণবর্ণ শাড়িটা তার উজ্জ্বল শ্যামলা ত্বকে দারুণ মানিয়েছে। ইমনের পছন্দের রঙ বলতেই সাদা, কালো। তাই প্রেয়সীর জন্য শাড়ি নির্বাচনে কালো রঙকেই প্রাধান্য দিয়েছে। সেই রঙে যে প্রেয়সী তার স্বর্গের অপ্সরা রূপেই ধরা দেবে৷ টের পেয়েছিল আগেই৷ তাই ছল, কৌশল করে কাছে টানার চেষ্টা করল ইমন। মুসকানের আর কী করার? মানুষটা কফি চাইছে আর সে দেবে না? শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে মুহুর্তেই কফি বানাতে রান্নাঘরে চলে গেল। ইমন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কখন মুসকান আসবে। আর সে চোখভরে দেখবে। পাক্কা গিন্নির মতো সামনে এলো মুসকান। কফির মগ বাড়িয়ে দিল। ইমন তার কাজল কালো চোখে তাকাল প্রগাঢ় চাহনিতে। হাত বাড়িয়ে কফি নিতে নিতে বলল,
‘ঘেমে করুণ অবস্থা হয়ে গেছে দেখছি! ফ্যানের নিচে বসো গিয়ে৷’
কথামতো বাইরে যেতে উদ্যত হয় মুসকান। একহাতে কফি নিয়ে অন্যহাতে মুসকানের হাত টেনে বাঁধা দেয় ইমন৷ শান্ত, গভীর কণ্ঠে বলে,
‘এ ঘরেও ফ্যান চলছে।’
হকচকিয়ে তাকায় মুসকান। ইমনের সুগভীর চোখজোড়ার কবলে পড়ে হৃৎস্পন্দন থেমে যায়। ভুলে যায় ঢোক চিপে শুকিয়ে ওঠা গলাটা ভেজাতে। অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয় ঠাঁই। ইমন বুঝতে পারে তার অনুভূতি। গাঢ় চোখে আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখে একবার৷ সহসা চোখে ইশারা করে কিছু। মুসকান বুঝতে পেরে দম আঁটকে দাঁড়িয়েই রয়। একটুখানি নড়ার সাহস বা শক্তি কোনোটাই পায় না৷ তার শোচনীয় এই অবস্থা দেখে আনমনে হাসে ইমন। ধরে রাখা হাতটায় টান দেয় নরম করে। মুসকানের চোখ দু’টো বড়ো বড়ো হয়ে যায়৷ পলক ফেলতে ভুলে যাওয়া সে প্রিয়তমের সম্মুখে দাঁড়িয়ে হাসফাস করতে থাকে৷ পাতলা মসৃণ ঠোঁট দু’টি কেঁপে ওঠে তির তির করে। সে দৃশ্য দেখে ইমনের ঠোঁট দু’টো বাঁকা হাসে। ধরে রাখা প্রেয়সীর বাহু ছেড়ে আচমকা পেঁচিয়ে ধরে কোমর। পেশিবহুল শক্ত হাতের নরম বাঁধনে আটকা পড়ে চোখ দু’টি খিঁচে বদ্ধ করে নেয় মুসকান। তার বদ্ধ চোখের পাতাজোড়ার কম্পমান দৃশ্য দেখে ইমনের অনুভূতি গুলো টগবগিয়ে ফুটতে শুরু করে। অবাধ্য হয় বেঁধে রাখা ইচ্ছেরা। এক হাতেই ধীরে ধীরে শূন্যে তুলে নেয় প্রিয়তমাকে। কৌশলে হেঁটে চলে যায় বিছানার সাইট টেবিলের সামনে। বা’হাতে ধরে রাখা কফির মগ আলগোছে টেবিলে রেখে হাতটা আলতো ছুঁয়ে দেয় মুসকানের নরম গালে। নিমেষেই চোখ খুলে তাকায় মুসকান। ধীরে ধীরে বিস্ময় চাপে তার দৃষ্টিতে। ছিল দরজার কাছটায় চলে এসেছে রুমের ভেতরে কীভাবে এসেছে? প্রশ্নের উত্তর মিলতেই গা শিউরে ওঠে। তার চোখে বিস্ময় দেখে আবারো চোখে ইশারা করে ইমন৷ কেন জানি তীব্র কাঁপুনি জাগে দেহে৷ সীমাহীন লজ্জায় আরক্ত হয় গাল দু’টো। ইমন হাসে তার লজ্জা দেখে। প্রেমিকাকে কারণে, অকারণে লজ্জা পেতে দেখলে প্রেমিকরা হাসে। প্রাণখোলা হাসি। এই প্রাণ খোলা হাসি যে হাসে সে যেমন ভাগ্যবান। এ হাসির পেছনে কারণ যে হয় সেও খুব ভাগ্যবতী৷ তার হাসি দেখে ঢোক গিলল মুসকান। দৃষ্টি নত করে বারকয়েক বড়ো বড়ো শ্বাস নিল। খেয়াল করে মুখ নিচু করল ইমন৷ সহসা মস্তক উপরে তুলতেই চোখে চোখ পড়ল দু’জনার। ইমন সন্তর্পণে ওর কপালে কপাল ঠেকাল। নাকে নাক ঠেকতেই মুখ ফেরাতে চাইল মুসকান৷ কোমর প্যাঁচানো হাতটা দৃঢ় করল ইমন। অন্যহাতটি উঁচিয়ে আলতোভাবে স্পর্শ করল কাঁপতে থাকা প্রেয়সীর অধর। ফের হৃৎস্পন্দন থমকে গেল মুসকানের। ইমনের ধারাল দৃষ্টির কবলে পড়ে যেন খু ন হয়ে গেল সে। অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রেমিকের দৃষ্টিতে শতসহস্রবার খু ন হতে থাকা প্রেমিকাটিকে তখন ফিসফিস করে প্রেমিক বলল,
‘চোখের ইশারায় যদি হৃৎস্পন্দন থেমে যায়। মন তো এই ঠোঁটে প্রেম ছোঁয়াতে চায়।’
চলবে.।