#চিত্তবৃত্তি
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৪
প্রেমিক পুরুষটির শরীরী অনলে তপ্ত তরুণী প্রেমিকা। তীব্র উত্তাপিত সে আলিঙ্গন থেকে ছাড় পেয়ে নিঃশব্দে ওঠে বসল মুসকান। পরিহিত ওড়না ঠিকঠাক করে নিল। কাত হয়ে শুয়ে ভারি নিঃশ্বাস ছাড়তে শুরু করল ইমন। নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়ার পর আবারো জলপট্টি দিতে এলো মুসকান। ইমন বাঁধা দিল। ওর হাতের কব্জিতে আলতো স্পর্শ করে ঘাড় বাঁকা করে তাকাল পূর্ণ দৃষ্টিতে। দৃঢ় স্বরে বলল,
‘প্রেমিকদের শরীরে আগুন লুকিয়ে থাকে জানো? কিছু মুহুর্ত আগে সে আগুনের এক চিলতে দিয়েছি তোমায়। যে আগুনের একটু তাপ সইতেই হিমশিম খাচ্ছ, সে আগুনে পুরোপুরি গ্রাসিত হলে পরিণতি কী হবে কল্পনা করতে পারো?’
বুকের খুব গভীরে সংগোপনে কথাটি খামচে ধরল যেন৷ সচেতন মুখে ঢোক গিলল মুসকান। ভুলে গেল চোখের পলক ফেলতে। স্থির নয়নে চেয়ে রইল ইমনের বাঁকা ঠোঁটের এক চিলতে হাসিতে। তাকে স্বাভাবিক করতে ইমন পুনরায় বলল,
‘হয় পুরোপুরি আমার হয়ে যাও। নয়তো একদম দূরে সরে যাও। গলায় বিঁধা কাটার মতো প্রেমিকা আমার চাই না। আমার বউ প্রেমিকা প্রয়োজন। লিসেন, বউ, প্রেমিকা যুক্ত আমার একজন বৌমিকা প্রয়োজন।’
হৃৎস্পন্দন ঝড়ের গতিতে বেড়ে গেল মুসকানের। ইমন কথাগুলো বলে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে। সে কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ বসে নিজের হৃৎস্পন্দনের গতি বুঝল। এরপর বোঝার চেষ্টা করল ইমনের বলা কথাগুলো। একজন পুরুষ কতটা ধৈর্যশীল হতে পারে তার নিদারুণ উদাহরণ ইমন৷ নিখুঁতভাবে তাকে নিয়ে ভাবতে গেলে সবদিক দিয়েই সঠিক মানুষটা। নিজেকে পুরোপুরি বেঠিক ভাবতে পারে না মুসকান৷ তারপরও আজ সায়রী আর ইমনের কথা শুনে নিজেকে কিছুটা বেঠিক মনে হচ্ছে। সত্যিই তো সে কি পারত না তার ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে এক হয়ে নিজের এবং তার স্বপ্ন পূরণ করতে? দূরে সরে গিয়ে যে স্বপ্ন পূরণ করতে চাইছে সে স্বপ্ন কাছে এসে পাশে থেকে পূরণ করলে দোষ কী? ক্ষতিই বা কী? হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল মুসকান। যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল,
‘শুনছেন?’
‘হু?’
ডাকার সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পেয়ে অস্বস্তি, জড়তা নিমিষেই দূর হয়ে গেল। স্বস্তি ভরে নমনীয় কণ্ঠে বলল,
‘কিছু কথা আছে আমার।’
‘বলে ফেল।’
এক মুহুর্ত ভাবল মুসকান। বলল,
‘তার আগে আপনাকে খাবার খেয়ে ওষুধ খেতে হবে।’
‘খাবারটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তাছাড়া এসব খেতে ইচ্ছে করছে না।’
ঘাড় ঘুরিয়ে ঢাকনা দেয়া খাবারটা দেখল মুসকান। মনে পড়ল জ্বর মুখে ছোটো সাহেব তরকারি দিয়ে খেতে পছন্দ করে না৷ এই ভাতটাও এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা খাবার তো তার দুচোখের বিষ। ঠোঁট কামড়াল সে। ইমনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে অনুনয়ের সুরে বলল,
‘আমি কিছু করে আনব?’
মনে মনে এটাই চাইছিল ইমন। ভালো লাগার আবেশে বুকের ভেতর মৃদু দুলুনি দিয়ে ওঠল তার। তবু কণ্ঠে গম্ভীরতা নিয়ে জবাব দিল,
‘ইচ্ছে।’
মুসকান বুঝে গেল ইমন তার হাতেই কিছু খেতে চাচ্ছে। তাই আর সময় নষ্ট করল না। ঢাকা দেয়া খাবারগুলো নিয়ে ত্বরিত রান্না ঘরে চলে গেল। সে রান্না ঘরে যাওয়ার পর থেকে ছটফট শুরু করল ইমন৷ এ বাসায় কোথায় কী আছে জানে না মুসকান। তাছাড়া একা একা এ মুহুর্তে কীই বা করবে? তার অন্তত পাশে থাকা উচিত। কিন্তু যাবে কীভাবে? সে তো মেয়েটার ওপর রেগে আছে। তাদের মধ্যে কোনোকিছুই তো স্বাভাবিক নেই। পরোক্ষণেই ভাবল, এসবের জন্য এভাবে মুখ বুঝে শুয়ে থাকবে সে? আর মেয়েটা একা একা কাজ করবে? নানারকম চিন্তা করতে করতে এক সময় ওঠে বসল ইমন৷ ঠিক সে সময়ই দরজার সামনে এসে দাঁড়াল মুসকান৷ সে তাকাতেই বলল,
‘আলু সিদ্ধ দিয়েছি। ফ্রিজে কি মাছ আছে?’
ইমন বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। জ্বরে সমস্ত শরীর ব্যথায় টনটন করছে তার। তবু ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘ইলিশ আছে বোধহয়।’
চোখদুটো চকচক করে ওঠল মুসকানের৷ আবদারি সুরে বলল,
‘দু’টো পিস ভাজি করি?’
আচমকা কথায় ইমনের চোখ গাঢ় হলো। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
‘হু।’
মাথার ঘোমটা পড়ে যাচ্ছিল। চটপট তুলে নিয়ে মুসকান চলে গেল। ইমনও পিছু নিল কিন্তু রান্না ঘরে গেল না। সে গিয়ে বসল ড্রয়িংরুমের সোফায়। যেখান থেকে মুসকানকে স্পষ্ট দেখতে পারবে সে।
দু পা তুলে আধশোয়া হয়ে বসে আছে ইমন। একটি বাটিতে দুপিস ইলিশ মাছ ভাজা আর একটি বাটিতে সেদ্ধ আলু নিয়ে মুসকান এলো। ইমন তাকাতেই বলল,
‘খুব গরম এখানে রাখি ফ্যানের বাতাসে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’
কথাটা বলেই টি-টেবিলের ওপর রাখল। এরপর দ্রুত পায় চলে গেল রান্না ঘরে। শুকনো মরিচ সরিষার তেলে ভেজে নিয়ে এলো। সঙ্গে পেঁয়াজ, রসুন আর ধনিয়া পাতা কুঁচি। ইমন ডাবল সোফায় শুয়ে। মুসকান তার পাশের সিঙ্গেল সোফা টেনে টি টেবিলের সম্মুখে বসল। আস্তে ধীরে শুকনো মরিচ পেয়াজ, রসুন, সরিষার তেল আর লবণ দিয়ে ভর্তা করল৷ শুকনো মরিচ ভর্তার ঘ্রাণ নাকে যেতেই যেন জ্বর সেরে যাচ্ছিল ইমনের। অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে ওঠল তার৷ যত্নময়ী এক নারী মুসকান৷ এই যে সামনে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে, যত্ন নিয়ে তার জন্য স্পেশাল ঝালঝাল ভর্তা আইটেম করছে। তাই যেন সাধারণের মাঝে এই অসাধারণ করে ফুটিয়ে তুলেছে মেয়েটাকে। যেই অসাধারণত্বতে বরাবরই মুগ্ধ সে। মরিচ ভর্তা শেষে আলু মেখে নিল মুসকান। ইলিশ মাছ থেকে কাটা ছাড়িয়ে নিল ঝটপট। এরপর মাছ আলু আর মরিচ একসাথে মিশিয়ে খুব সুন্দর ভঙ্গিমায় আঙুল চালাল। শেষে ধনিয়া কুঁচি গুলো ভর্তার ওপরে ছড়িয়ে দিয়ে খ্যান্ত হলো৷ নিখুঁত সে কাজ দেখে আড়ালে মৃদু হাসল ইমন। এরপর আবারো নির্নিমেষে তাকিয়ে দেখতে লাগল প্রেয়সীকে। কাজের ফাঁকে মুসকান আড়চোখে তাকিয়ে খেয়াল করল ইমন তাকে অপলকে দেখছে৷ বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম করে ওঠল তার। অদ্ভুত প্রশান্তিও ঠেকল। মানুষটা তাকে ভালোবাসে। তার ভালোবাসার প্রগাঢ়তা এতটাই তীব্র যে একটুক্ষণ কাছাকাছি থাকাতেই কঠিন ক্রোধ, সীমাহীন অভিমান গলে পড়ছে। ভালোবাসা ঠিক যেন ঐশ্বরিক ক্ষমতা। যার উত্তাপের কাছে রাগ, জেদ, অভিমান খুবই ঠুনকো।
ইলিশ মাছ দিয়ে আলু ভর্তার এই স্পেশাল মেনুটি ইমনের খুবই প্রিয়৷ জ্বরমুখে এই ভর্তার সঙ্গে গরম গরম ভাত খেতে ভালোবাসে সে৷ জানে মুসকান৷ বহুবার করে দিয়েছে সে। তাই আজো করল। পার্থক্য এটাই পূর্বে প্রচণ্ড জ্বরে নাজেহাল অবস্থা থাকলেও নিজ হাতে খেয়ে নিত৷ কিন্তু আজ সে নিজ হাতে খাবে না৷ মুসকান লাজ, লজ্জা ভুলে গিয়ে নিজে থেকেই আবদার করল,
‘আমি খাইয়ে দিই?’
এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টিপাত ঘটল৷ ইমনের ঠিক বুকের মধ্যিখানে বিনা নোটিশে বর্ষণ। হৃদয়ে জাগল দুলুনি। মনের খুশি, চোখের তৃপ্তি আড়াল করতে টিভি অন করল সে। মুসকান তার পাশে এসে বসে ভর্তা দিয়ে গরম গরম ভাত মেখে খাইয়ে দিতে শুরু করল। খাইয়ে দেয়ার ফাঁকে ইনিয়েবিনিয়ে কথা তুলল বিয়ে নাকোচ করার বিষয়টি। বলল, তার মা ইরাবতী চৌধুরীর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের কথাও। জানাল হবু শাশুড়ির স্বপ্নই আজ তার আবদার। সবটা মন দিয়ে শোনার পর বিস্মিত হলো ইমন। অবাক চোখে তাকাল মুসকানের পানে। মুসকান তার দিকে তাকাল না৷ একইভাবে কথা বলতে বলতে তাকে খাইয়ে দিল শুধু। সাতাশ বছরের জীবনের সবচেয়ে সেরা দিন বুঝি আজি? ঠিক যেন তার বিয়ে করা বউ মুসকান। মেয়েটা এত বোঝদার, এত আদুরে! কী সুন্দর যত্ন নিচ্ছে তার৷ পাশাপাশি রাগ, অভিমান গুলো দূর করার চেষ্টা করছে। ভুল ভাঙিয়ে দিচ্ছে যত্ন সহকারে। তার মা চাইত সে বড়ো হয়ে মাজিস্ট্রেট হবে। সে নিজেও ছোটো থেকে এই স্বপ্ন দেখেছে। সে স্বপ্ন পূরণের সময় শেষ হয়ে যায়নি বরং শুরু। একজন নির্বাহী মাজিস্ট্রেট হওয়ার স্বপ্ন বুকে লালন করে সে। কিন্তু ভালোবাসা নামক অনুভূতিতে জড়িয়ে পড়ে ক্ষণকালের জন্য আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। আজ এ মুহুর্তে প্রিয়তমার চোখে চোখ রেখে সে নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হলো। মায়ের স্বপ্ন, মুসকানের আবদার পূরণ করবে সে। শর্ত একটাই পাশে থাকতে হবে প্রেয়সীকে। শর্ত শুনে মৃদু হাসল মুসকান। মৃদু গলায় লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
‘পাশে আছি, থাকব।’
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল ইমন। বুকের ওপর থেকে যেন হিমালয় পর্বত নেমে গেল তার। খাইয়ে দেয়া শেষ হলে ওঠে দাঁড়াল মুসকান। সে জানে পয়তাল্লিশ তম বিসিএস পরীক্ষার জন্য আবেদন করেছিল ইমন। তাই বলল,
‘আমি চাই পয়তাল্লিশ তম বিসিএস পরীক্ষায় আপনি অংশগ্রহণ করুন।’
এক মুহুর্ত ভেবে ইমন বলল,
‘মাত্র চৌদ্দ দিন সময় আছে। প্রিপারেশন খুব খারাপ।’
‘আপনি পারবেন।’
অধর কামড়ে চিন্তান্বিত গলায় ইমন বলল,
‘চৌদ্দটা দিন এ বাসায় থেকে যাও।’
মুসকান কিছু বলল না। ওঠে যেতে উদ্যত হলো। ইমন ওর ওড়না টেনে ধরল। হকচকিয়ে ঘাড় ফেরাল মুসকান। ইমন সন্তর্পণে ওড়নার কোণা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
‘মানসিক অশান্তিতে থাকলে লাইফে আগানো যায় না।’
‘দাদুভাই অনুমতি দিলে থাকব।’
‘আমিয়ো পরীক্ষায় বসব।’
আলতো হেসে কথাটা বলল ইমন। মুসকান ওড়না ছাড়িয়ে যেতে যেতে বলল,
‘ছোটোদের মতো করে ফেললেন ছোটো সাহেব।’
ইমন গলা উঁচিয়ে বলল,
‘ছোটো সাহেব বড়দের মতো কেন করবে?’
ততক্ষণে মুসকান রান্নাঘরে চলে গেছে। তবু শুনতে পেল কথাটি। মনে মনে লজ্জা মিশ্রিত হাসল সে। বিড়বিড় করে বলল,
‘অনেকদিন পর আপনার মাঝে আপনাকেই খুঁজে পেলাম ছোটো সাহেব।’
মেডিসিন নেয়ার পর জ্বর কমে এলো৷ সায়রী, দিহান এলো দুপুর করে। ইমন তখন গভীর ঘুমে। মুসকান ড্রয়িং রুমে বসে একটি বই পড়ছে। সবকিছু ঠিকঠাক আছে দেখে স্বস্তি পেল সায়রী। ইমন ঘুমাচ্ছে শুনে মুসকানকে বলল,
‘আমরা ফ্রেশ হয়ে আসি। তুমি ইমনকে ডেকে তুলো গিয়ে। বিরিয়ানি এনেছি সবার জন্য। ও ওঠলে লাঞ্চ করব আমরা।’
সায়রীর কথা শুনে ইমনকে ডাকতে গিয়ে বিপাকে পড়ল মুসকান। এতবার করে ডাকল অথচ ওঠলই না। শেষে না পেরে কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিল। ঘুম ভেঙেছিল আগেই শুধু এইটুকু ছোঁয়া পাবার অপেক্ষায় ছিল ইমন। সুযোগ পেতেই চট করে ওর হাত টেনে বুকের বা’পাশে চেপে ধরল। চোখ বুজে ভারি নিঃশ্বাস ছেড়ে মাতাল মাতাল কণ্ঠে বলল,
‘আর কত ধৈর্য ধরব। আর কত অপেক্ষার ফলসরূপ বৌমিকা রূপে পাবো তোমায়? কবে পূরণ হবে আমার তুমি নামক চিত্তবৃত্তি?’
মুসকান ভাবল ইমন ঘুমের ঘোরে তার মনের কথা বলছে। তাই আনমনেই উত্তর দিল,
‘আর ধৈর্যের পরীক্ষা নিব না ছোটো সাহেব। আর না দীর্ঘ করব আপনার অপেক্ষাকে। খুব শিঘ্রই ধরা দিব আপনার বৌমিকা হিসেবে। পূরণ করব আপনার আমি নামক চিত্তবৃত্তিকে।’
চলবে…।
পরবর্তীতে একটি সুন্দর রোমান্টিক পর্ব চাই তো সবার?