#চাঁদের_কলংক (৮)
#রেহানা_পুতুল
তন্দ্রার অধর জুড়ে প্রষ্ফুটিত হলো প্রলম্ভিত হাসি। যে মানুষটার সাথে সময়ে অসময়ে কথা বলতো। হাসি ঠাট্টা করতো পাশের বাড়ির ভাই হিসেবে। আজ সেই মানুষটার অভিশপ্ত মৃত্যুতেও তন্দ্রার এতটুকু দুঃখবোধ হলনা। হলনা সামান্যতম অনুশোচনা। তার পরিবর্তিত হিং’ স্র রূপ সেই ভাবনার জায়গাটা ছিনিয়ে নিয়েছে। বানিয়ে দিয়েছে তন্দ্রাকে এক বি’ ধ্বং’ সী নারী।
নিজের সাহসী সত্তাকে দেখে নিজেই চমকে চমকে উঠছে। কি করে পারল সে এমন করতে। সেতো এতটা দুঃসাহসী ছিলনা। সে ছিল মা বাবার একান্ত অনুগত সন্তান। নরম কাদামাটির মতোই।
________
তন্দ্রা নামের উচ্ছ্বল মেয়েটির তারুণ্য ছিল পাখির কূজনের মতই চঞ্চল। ঝর্ণার মতো চপল ছন্দময়। সেই ছুটন্ত দূর্বার লাগামহীন সময়ে এলো শয়ন নামের এক সুদর্শন যুবক। ধীরে ধীরে সে তন্দ্রার কল্পনার আকাশে উড়ে এলো রঙিন ঘুড়ির ন্যায়। তন্দ্রা মুগ্ধ হয়। আবেশে হারায়। আকুলিবিকুলি করা মনটা হঠাৎ হঠাৎ আনচান করে বসে।বেলা পুরোয়। বসন্ত যায় বসন্ত আসে। সময়ের সারথি হয়ে তন্দ্রা ষোড়শী থেকে পৌঁছে যায় অষ্টাদশী অনূঢ়াতে। শয়নের বিসর্জন দেওয়া ব্যক্তিত্ব, প্রবল অনুরক্তি, নিবেদিত নয়নের চাহনি, তন্দ্রাকে আবেগের সায়রে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। হলো মন দেয়ানেয়া। চলতে থাকল প্রণয়ের লেনাদেনা। বিনিময় হয় সাদা কাগজের বুকে ছোট ছোট কালো হরফে অংকিত হৃদয়ের অব্যক্ত কথামালা। বুঁদ হয়ে থাকে দুজনে সেই শব্দের ঝাঁপিতে। এত সহজ সাধারণ শব্দগুলো। তবুও এ যেন আশ্চর্য কিছু পাওয়া। এ যেন অবারিত আনন্দের গিরিখাদ। সুখের ফল্গুধারায় ভেসে যাচ্ছে দুটি হৃদয়।
আহ প্রেম! আহ ভালোবাসা! জীবন যেন মধুর পেয়ালা।প্রতি চুমুকেই দারুণ স্বাদ।
অভিশাপ হয়ে এলো আদিল তন্দ্রার জীবনে। শার্দুলের মত তছনছ করে দিল স-অ-ব। ভেঙ্গে গেল তন্দ্রার স্বপ্নের সাজানো বাসর। শত পুষ্পপত্র দলিত মথিত হলো তার স্বপ্নপুরুষ শয়নের হাতেই। সন্দেহ,দম্ভ, রাগ,ক্ষোভ,ঘৃণা ও ভুল বোঝার যাঁতাকলে পিষ্ঠ হলো দুটো জীবন। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হয়ে গেল দুজন একাকী। মৌন পাহাডের মত হয়ে গেল নিশ্চল। নিঃশ্চুপ।
সময়,পরিবেশ,পরিস্থিতি ভীতুকেও সাহসী করে তোলে। দূর্বলকে করে তোলে মজবুত ও শক্তিশালী।
তন্দ্রাও তাই হয়েছে। একজন ধ’ র্ষ’ ক’ কে নিজ হাতে নির্মম শাস্তি দিতে পেরেছে বলে বুকের ভিতর শান্তি শান্তি লাগছে৷
” এই আপা যাবি নাকি আদিল ভাইয়ের লা’ শ দেখতে? আমি আম্মু যাচ্ছি। বাড়ির সবাই যাচ্ছে। লাশ পথে আছে নাকি।”
তন্দ্রার হুঁশ ফিরে। কন্ঠকে খাদে টেনে টেনে উত্তর দিল ছোট বোনের।
” আমি যাবনা। তুই যা।”
আচ্ছা গেলাম বলে তনু চটপটিয়ে তিন পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
তন্দ্রা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। মৃত আদিলের কথা তার মনে পড়ছেনা। তার কেবলি মনে পড়ছে কেবলই শয়নের কথা। তার ভালোবাসার কথা। শয়নের সাথে তার প্রগাঢ় অনুভব ও অনুরাগের কথা।
______
সময়টা ঝিমিয়ে আসা শীতের এক বিকেল। পরিবেশজুড়ে বিস্তৃত হয়ে আছে মিষ্টি আমেজ। অফুরন্ত ভালোলাগায় আচ্ছন্ন শয়নের হৃদয়খানি। নিজেকে পৃথিবীর সুখী মানুষদের একজন মনে করল। দাঁড়িয়ে আছে তন্দ্রার কলেজের পাশেই। চাওয়া অল্পখানি। তবে পাওয়াটা বিশাল। তন্দ্রার মায়াবি মুখখানি একটু দেখা। পাশ ঘেঁষে খানিক সময় হেঁটে চলা। থেমে থেমে লাজুক স্বরে তন্দ্রার নেশাধরা কন্ঠ শোনা। হাতের মুঠোয় তন্দ্রার প্রিয় মিল্ক ক্যান্ডি চকোলেট, ম্যাংগোবার ধরিয়ে দেয়া।
এর পর ভোরের সোনালী রোদ্দুরের ন্যায় তন্দ্রার সারামুখচ্ছবিতে এক চিলতে দুষ্টমিষ্ট হাসির ঝুলিটা দেখা। এইতো।
বেলা পড়ে এসেছে। শীত ক্রমশ বেড়ে চলছে। তন্দ্রা বের হয়ে এলো কলেজ থেকে।
” কি ব্যপার। তোমার আজ এত দেরি হলো কেন? কলেজ ছুটি হলো সেই কখন। আমি কয়েক ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করে আছি? ”
কিছুটা অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো শয়ন।
” এত গরম দেখান কেন? আমি কি এমনি এমনি কলেজের ভিতরে বসে ছিলাম নাকি? ক্লাস শেষে কোচিং ছিল যে। ”
” ওহ সেটাতো আর আমি জানিনা। ”
” তাহলে না জেনে আন্দাজে রাগ দেখান কেন?”
” এহহরে। প্রেম করলে প্রেমিক রাগ দেখাতে পারবেনা। এটা নতুন ‘ ল ‘ নাকি?”
” আমি তা বলছি? ” বলেই তন্দ্রা তার টিংটিঙে পা দুটো চালিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলল।
” এইই বালিকা ধীরে চল। তুমি আমার অভিমানিনী। তুমি আমার জ্বালাময়ী। তুমি আমার প্রভাতের শিশির। তুমি আমার শাহজাদি। তোমায় এনে দিব পদ্মদিঘি হতে শত রক্তকমল। নয়তো এই পৃথিবীর সব বাগান হতে একশো সাতকোটি লালগোলাপ।”
তন্দ্রা ফিক করে হেসে ফেলল। বলল,
” এত পদ্ম, এত গোলাপ কি আপনি লাগিয়েছেন? ”
” নাহ আমি কেন লাগাব বালিকা। যাদের বাগান। তারা লাগিয়েছে। ”
” তো তাদের বাগান হতে,তাদের পদ্মদিঘি হতে কিভাবে আনবেন?”
” কেন চুরি করে আনব বালিকা।”
তন্দ্রা দাঁড়িয়ে গেল। গোল গোল পাকানো চোখে শয়নের চোখে চাইল। বলল,
” কিইই। আপনি চোর সাজবেন? আমি কোন চোরের সাথে কথা বলবনা। আড়ি আড়ি আড়ি। যাবনা আপনার বাড়ি। খাবনা আপনার ভাত। ধরবনা আপনার হাত।”
” তোমার জন্য সাজব চোর, আরো হবো ডাকাত।
আমার সঙ্গেই কাটবে তোমার অযুত লক্ষ রাত।”
দুজন চোখাচোখি হয়। হেসে উঠে। হারায় যুগল প্রেমের স্রোতে।
হঠাৎ টনটন করে তন্দ্রার মুঠোফোনটা বেজে উঠলো। তার বাবার ফোন।
” আব্বা কেমন আছেন? খবর তো জানছেন নাকি?”
” ভালো আছি মা। শুনলাম। তোর আম্মা ফোন দিয়ে সব বলছে। আমি তোকে ফোন দিলাম,
আদিল বেঁচে নেই। আর কিসের রাগ অভিমান। এবার না হয় শশুর বাড়িতে যাওয়ার কথাটা একটু ভেবে দেখ।”
” আব্বা আমি কি এতই বোঝা হয়ে গেলাম তোমাদের কাছে? একমাস না যেতেই এটা বলছ?”
” তুই আমার জ্ঞানী মেয়ে। অবুঝের মতো ভুল বুঝিস কেন? বিয়ের পরে স্বামীর সংসারে ডালভাত খেয়ে থাকলেও সেই জীবন আনন্দের, সম্মানের,গর্বের। সবাই ভাবে মেয়েটা সুখেই আছে। আর বাবার বাড়িতে কোর্মা পোলাও খেলেও সেই জীবনে আনন্দ নেই। সবাই ভাবে স্বামীর সংসারে মনে হয় অশান্তি বিরাজ করছে। তাই পড়ে আছে এখানে। বুঝলি মা। ”
” বুঝলাম বাবা। দেখি আরো কয়দিন যাক। আর তারাতো কেউ নিতে আসবে। তবেই না যাব।”
তন্দ্রা কথা বলার সময় আরেকটা ফোন আসল। ওয়েটিং পেল। এখন সে ব্যাক করল। কে বলতেই,ওপাশ থেকে শুনতে পেল কচি কোন কন্ঠস্বরের ফিসফিস করা আওয়াজ।
” হ্যালো ভাবি। আমি শায়না। তোমার ননদি রাই। কেমন আছ?”
তন্দ্রার মনটা ফুরৎ করেই ভালো হয়ে গেল। আনন্দে অন্তরটা নেচে উঠল। অফুরন্ত ভালোলাগায় ভরে উঠল হৃদয়ের সমস্ত অলিগলি। শয়ন ছাড়া তার পরিবারের অন্যরা ফোন দিলেও তন্দ্রার ভীষণ ভালোলাগে। সে কেবল শয়নকেই ভালোবাসেনি। শয়নকেই প্রিয়জন ভাবেনি। শয়নের পাশাপাশি তার পরিবারের সবাইকে ভালোবেসে ফেলেছে। সবাইকে প্রিয়জন ধরে নিয়েছে।
” কেমন আছো শায়না। মা কেমন আছে? বাবা কেমন আছে? শেফালি কেমন আছে?”
” সবাই ভালো আছে৷ শোন যে জন্য কল দিলাম। আদিল তো বিদায় নিল। এবার তো সব ঝামেলাই চুকে গেল। তুমি এবার চলে আসনা লাভলি। তুমি ছাড়া কাটেনা প্রহর। কাটেনা দিবস রজনী। ”
তন্দ্রা আলতো হেসে দিল।বলল,
” আসব অবশ্যই। তুমি এসে নিয়ে যেও আমাকে সুইটি।”
” উমমম! আসব! তোমার জামাইর থেকে অনুমতি নিয়ে দুই একদিন পর আসব।”
বাই কিউটি। বাই। বলে শায়না ফোন রাখল।
তন্দ্রার মনটা আবার বিষন্ন হয়ে গেল। সে ভাবল শয়ন শায়নাকে দিয়ে ফোন দিয়েছে । নিজে হয়তো সংকোচে দিতে পারছেনা। কিন্তু শায়না বলল, তার থেকে অনুমতি লাগবে। তার মানে এখন শায়নাই কল দিয়েছে তাকে।
যদিও শয়ন নামের পাতাটা তার জীবন থেকে সে চিরতরে ছিঁড়ে ফেলেছে। যে বাসর রাতেই ভুল বুঝে উপেক্ষিত করল। তার উষ্ণ আলিঙ্গন পাওয়ার সাধ যে মিটে গিয়েছে সে রাতের গহবরেই। তবুও অবুঝ মন। মাঝে মাঝে উচাটন হয়ে যায়। এক আকাশ শূন্যতা গ্রাস করে তাকে।
আবারো মুঠোফোনটা বেজে উঠল। আজ এত ফোন আসে কেন। বিরক্তি নিয়ে স্ক্রিনে তাকাল তন্দ্রা। দেখল শয়নের বাবার ফোন। রিসিভ করেই তন্দ্রা নমনীয় গলায় শ্বশুরকে সালাম দিল।
তিনি সালামের জবাব দিয়েই জানতে চাইলেন,
” বৌমা তুমি কোথায়?”
” বাবা আমি আমাদের ঘরেই আছি।”
শান্ত স্বরে জবাব দিল তন্দ্রা।
” তুমি কি আদিলের মৃ’তদেহ দেখতে যাবে?”
” না বাবা। কিছুতেই যাবনা।”
” নাহ! তুমি অবশ্যই দেখতে যাবে সবার সাথে সবার মত করেই।”
নিরস রাশভারি কন্ঠে তিনি আদেশ দিয়ে বললেন তন্দ্রাকে।
তন্দ্রা স্তম্ভিত হয়ে গেল শুনে। বিস্ময়ের সপ্তাকাশে উড়ে গেল সে। কি শুনল এটা। তার শ্বশুর চেয়ারম্যান কামরুল মির্জা ঠিক আছেতো।
” বাবা মানেএএ..আমিই যাব? ”
তোতলানো স্বরে জিজ্ঞেস করল তন্দ্রা।
ফোনের ওপাশ থেকে শুনতে পেল আবারো কড়া নির্দেশ।
” মন দিয়ে শোন। তুমি তোমাদের পাশের বাড়ির ছেলে আদিলের লা’শ আগে হলে যেভাবে দেখতে যেতে। এখন ও ঠিক সেভাবেই যাবে। এবং তোমার অভিব্যক্তি ও প্রতিক্রিয়া সেভাবেই দেখাবে। যদি এর ব্যতিক্রম ঘটে তুমি সমস্যায় পড়ে যাবে। ছেলেটার স্বাভাবিক মৃত্যু তার পরিবার মেনে নিচ্ছেনা।”
শুনেই তন্দ্রা ঘাবড়ে উঠে। বুকের ভিতর ধুকপুকানি শুরু হয় নৃত্যকারে। চোয়াল কুঞ্চিত হয়ে উঠে । বুকের উপরের অংশে ডান হাতটা চেপে ধরে। লম্বা করে স্বাস ছাড়ে। নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়। স্পষ্ট গলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে জিজ্ঞেস করলো,
” আমি কেন সমস্যায় পড়ব বাবা? সে বাইক এক্সিডেন্ট করেছে। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ আর কি কারণে যেন মারা গেল। তাইতো সবাই বলাবলি করছে।”
” আমি এখন আর বেশি কিছু বলতে চাইনা। তুমি যেমন সাহসীনি তেমনি বুদ্ধিমতীও বটে। এবার চিন্তা করে দেখ। বাকিটা তোমার অভিলাষ। ”
তিনি মোবাইল রাখলেন। তন্দ্রা অবোধ শিশুর মতো মোবাইলের দিকে হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।
চলবেঃ ৮( মন্তব্য ও শেয়ার হোক।)