#চাঁদের_কলংক ( ২)
#রেহানা_পুতুল
” বৌমা…বৌমা…”
শাশুড়ীর ডাকে ধ্যান ভাঙ্গল তন্দ্রার।
” জ্বী মা। আসুন না ভিতরে। উনি নেইতো।”
শ্রদ্ধাবনত হয়ে বলল তন্দ্রা।
” ওই ত্যাঁদড়টা নেই দেখেইতো এলাম তোমার কাছে। রাতে কি ও তোমার সাথে মন্দ ব্যবহার করেছে মা ? ”
” না মা। উনি কোন বাজে আচরণ করেন নি। আমি ঠিক আছি। আপনি দুঃচিন্তা করবেন না। ”
শাহিদা বেগম দীর্ঘস্বাশ ছাড়লেন। তন্দ্রার পাশ ঘেঁষে বসে পিঠের উপর মমতার হাতখানি রাখলেন। গভীর পরিতাপের সুরে স্নেহময়ী কন্ঠে বললেন,
” চিন্তাতো এমনিতেই চলে আসেরে মা। আমিও একদিন তোমার বয়েসী ছিলাম। বিয়ের প্রথম রাতের অনুভূতি, স্বপন, কত রঙিন হয় সেটাতো আমি অনুভব করতে পারি। আর রঙিন স্বপনের যখন ভরাডুবি হয় অকল্পনীয়ভাবে। সেই দুঃখ বেদনা অসীম হয়ে যায়। ভার বহন করা খুউব মুশকিল হয়ে পড়ে। আমি জানিনা তুমি এই ভিতরে কি ভেবেছ বা কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ কিনা। আমি বলব তোমাকে সবর করতে।
কেননা সবরকারীকে আল্লাহতায়ালা উত্তম নেক দান করেন। ”
” আমি কোন সিদ্ধান্ত নিইনি মা। উনিই যেটা করবেন। আমি তা মাথা পেতে নিব।”
” শোন মা। হয়তো তুমিও জান। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ রয়েছে,
‘ পৃথিবীতে অথবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের ওপর যে বিপর্যয় আসে। আমি তা সংঘটিত করার আগেই লিপিবদ্ধ করেছি। ‘
(সুরা হাদিদ, আয়াত : ২২)
এবং পৃথিবী সৃষ্টির আগে রাসুলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেছেন ,
” নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সকল সৃষ্টির ত্বকদির, আসমান ও জমিন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে লিপিবদ্ধ করেছেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৯১৯)
” সুতরাং বুঝতেই পারছ আমি কি বোঝাতে চেয়েছি। ভাগ্যে হয়তো তোমার বিষয়ে এমনি লিখা রয়েছে। এভাবে বান্দার ঈমান ও পরিক্ষা করে দেখেন মালিক। সকল কিছুর ফয়সালাকারী একমাত্র তিনিই। ”
” মা আমিও এসব কিছু জানি এবং মানি। উনি না চাইলে আমি কিভাবে থাকব? ” আদ্র স্বরে বলল তন্দ্রা।
” সেটা তোমার শশুরের দায়িত্ব। আমি শুধু বলতে চাই তুমি নিজ থেকে আমাদের ছেড়ে চলে যেওনা মা। একদিকে তোমাকে আমরা পছন্দ করে পুত্রবধূর মর্যাদা দিয়েছি। হারাতে চাইনা তোমাকে। অপরদিকে তোমার স্বশুরের এত বছরের তিলতিল করে সঞ্চয় করা মানসম্মান ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। কেন বারবার বলছি মা। সেটা হলো তুমি এ যুগের আধুনিক মেয়ে। বলাতো যায়না অভিমান করে কি না কি করে বসো। আমার আত্মীয়ের ভিতরেই দেখেছি। ঠুনকো বিষয় নিয়ে মেয়েই স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে দিল। আর তোমার বিষয়তো আর কঠিন।”
তন্দ্রা মনোযোগের সাথে লক্ষ করে দেখল,
কথাগুলো বলার সময় শাহিদা বেগমের সারা মুখে দুঃচিন্তার গাঢ় প্রলেপ। শাহিদা বেগমের দুইহাত চেপে ধরে ক্ষীনকায় দৃষ্টিতে চাইল তন্দ্রা। স্মিত হাসির রেখা টেনে বলল,
” আপনি এত ভালো। কিন্তু উনি এত বদরাগী হলো কেমন করে মা?”
” ওই যে রক্তের দোষ। তার বাবার ও এমন
র’ গ’ চ’ টা মেজাজ। তবে মানুষ হিসেবে উনি যথেষ্ট ভালো। শয়ন ও ভালো ছিল শান্ত দিঘির জলের মতো। কিন্তু কেন যে এমন উত্তাল ঢেউ হয়ে উঠল ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা। শেফালিকে দিয়ে নাস্তা পাঠাচ্ছি আমি। খেয়ে নাও এক্ষুনি। চোখ দুটো কেমন মরামাছের মতো হয়ে আছে। আর এই জামাকাপড় চেঞ্জ করে একটা সুন্দর দেখে শাড়ি পরে তৈরি হয়ে নাও। ঘরভর্তি অতিথি। বাইরের থেকেও লোকজন দেখতে আসবে তোমাকে। চেয়ারম্যান কামরুল মির্জা সাহেবের পুত্রবধূ বলে কথা।”
বলেই শাহিদা বেগম মুচকি হাসি দিলেন। তার হাসির সাথে তাল মিলিয়ে চাপা হাসি হাসতে হলো তন্দ্রাকেও।
শাহিদা বেগম চলে গেল। তন্দ্রার কাছে এখন একটু হালকা লাগছে। শাশুড়ীর বিগলিত কথাগুলো শ্রবণ হতেই পাথরচাপা যন্ত্রণাগুলো পশমিত হয়ে গেল খানিকটা।
আপন মনে বলল তন্দ্রা,
এমন একজন মায়ের কথার শক্তির ভারে চুম্বকের আকর্ষণ শক্তিও দূর্বল হয়ে পড়বে। শয়নের বাবাও একজন খাঁটি মানুষ। মহৎ হৃদয়ের মানুষ। যেন একখণ্ড হিরে। নয়তো তিনি সব জেনেও কিভাবে তাকে পুত্রবধূরূপে ঘরে তুললেন।
তন্দ্রার মনে পড়ে গেল,
যেদিন প্রথম তাকে শয়নের বাবা নৌকায় দেখেছে। তখন সে কলেজে ভর্তি হয়েছে সবে। বয়সে অষ্টাদশী ছিল। তখনই তিনি তাকে পছন্দ করে ফেলেছেন শয়নের জন্য। সেদিন আবদুল মাঝি তার বাবাকে বলছিল নৌকায় তাদের কথাবার্তাগুলো।
______
ভরা বর্ষার পানিতে খালবিল ডুবে থইথই। তন্দ্রার শখ জেগেছে নৌকায় চড়ে শাপলা তুলবে। বাবাকে না জানিয়ে মাকে বলে চুপিচুপি বের হয়ে পড়ে চাচাতো বোন পালিকে নিয়ে। বাড়ির পাশের বিলেই বাঁধা ছিল খবির মাঝির নৌকা। সেই নৌকা চালিয়ে বেশ কিছুদূর চলে গেল তারা শাপলা তুলতে তুলতে । আশেপাশে আরো অনেক নৌকা ছিল। এক নৌকায় ছিল চেয়ারম্যান কামরুল মির্জা। তিনি মায়াভরা পলকহীন নয়নে ছুটন্ত তন্দ্রাকে দেখলেন । তিনি একাই ছিলেন নৌকায়। কেননা তিনি চড়লে সেই নৌকায় দ্বিতীয় কেউই উঠেনা। কেউ উঠেনা ভয়ে। কেউ উঠেনা শ্রদ্ধায়।
” এই মেয়েটা কে? চেনো আবদুল?”
মাঝিকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
“এখানে তো দুইটা মেয়ে কাকা। ”
” যেই মেয়েটার হাতে বৈঠা। ”
” তাহের উদ্দিনের মাইয়া মনে হয় কাকা। কি বেত্তুর্মিজ মাইয়া দেখছেন। ব্যাটাছেলের মতন নৌকা বাইতে শুরু করছে।”
” এভাবে বলছ কেন আবদুল। সুন্দর নজরে দেখ। এখন গোটা দুনিয়াতে যুগ বদলের হাওয়া বইছে। ছেলেমেয়ে বলে আলাদা করে দেখা বন্ধ করো। এসব বৈষম্য। মানুষ হিসেবে দেখ মেয়েদের। যেকোন মানুষ যেকোনো কাজই করতে পারে। আর ওরাতো শাপলা তুলছে। হয়তো শখ করেই। ”
” আইচ্ছা কাকা। ঠিকাছে।”
” নৌকাটা তাদের দিকে ভিড়াও।”
আবদুল নৌকা নিয়ে গেল সেই নৌকার কাছে।
” আসসালামু আআলাইকুম চেয়ারম্যান আংকেল। ”
” ওয়ালাইকুম আসসালাম। এই মেয়ে তোমার নাম কি?”
” তন্দ্রা।” আড়ষ্ট হয়ে বলল তন্দ্রা।
” আমাকে দেখে ভয় লাগছে?”
” নাতো। ” ডানে বামে মাথা নেড়ে উত্তর দিল তন্দ্রা।
“শাপলা তোলা শেষ? ”
” জ্বী আংকেল। ”
” আচ্ছা ঠিকাছে।” বলে চেয়ারম্যান চলে গেল।
তন্দ্রা ছিল ভীষণ ভয়ে ভয়ে। না জানি বাবাকে বলে দিবে কিনা। বাবা শুনলে আচ্ছা ধোলাই খেতে হবে।
” ভাবিজান বেলা কত হইলো। এবার তো নাস্তা খান। ক্ষুধা লাগেনাই? মরার পেট হইল আমার। সারাদিন খালি পেটে মোচড় মারে খাওনের জন্য। পেটের ভিতরে মনে হয় আমি জোড়ায় জোড়ায় হাঁস পালি।”
তন্দ্রার ভাবনার সূতো ছিঁড়ে যায় শেফালির গজগজে। চাপা হাসি হাসল তন্দ্রা। বলল,
” রেখে যাও। আমি খেয়ে নিব। ”
তন্দ্রা নাস্তা খেয়ে ঝটপট তৈরি হয়ে নিল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কমলা রঙের একটা নতুন শাড়ি পরে নিল। মুখে
হালকা ভারী মেকাপ করে নিল। অধর রাঙিয়ে নিল লাল খয়েরি লিপিস্টিক দিয়ে। শাড়ির সাথে ম্যাচ করে একহাত ভর্তি চুড়ি দিল। বাকি হাতে সোনার মোটা বালা। গলায় কানেও পরে নিল সোনার গহনা। কপালের মাঝখানে ছোট্ট করে একটা টিপ দিল।
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল শয়নের ছোটবোন শায়না।
” হেই মাই ডিয়ার সুইট ভাবি। রেডি তুমি? আম্মু বলল তোমাকে তাড়া দেওয়ার জন্য। ”
” এইতো সুইটি। সকাল থেকে কোথায় ছিলে তুমি?”
” যেখানে থাকার কথা সেখানেই ছিলাম।এদিকে আসিনি সুনামির ভয়ে। পরে আমাকে উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরু খুঁজেও পাওয়া যেতনা। ”
” ভাইকে খুব ভয় পাও বুঝি?”
” একটু আধটু তো পেতেই হয়। কেন তুমি ভয় পাওনা?”
” সেইম টু ইউ বেবি।”
“তাহলে আসো চিমটি কেটে সই হই দুজনে।”
গলাগলি করে শায়না ও তন্দ্রা দুজন দুজনের হাতে চিমটি কেটে নিল। হাসিখুশিভাবেই তন্দ্রা সবার সাথে মিশে কথা বলছে। বুকের ভিতর জ্বলতে থাকা একশো দোযখের আগুনের উত্তাপ কাউকেই টের পেতে দিলনা তন্দ্রা। সে এখন চেয়ারম্যান পরিবারের একজন। সুতরাং এই পরিবারের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার দায়িত্ব তার উপরেও বর্তায়।
ভর দুপুরে শয়ন বাসায় ঢুকল। ঘেমে নেয়ে একাকার। রুমে ঢুকেই শার্ট খুলে নিল। এসি অন করে দরজা চাপিয়ে দিল। তন্দ্রা বারান্দায় ছিল। রুমে পা দিয়েই খালি গায়ের শয়নকে দেখেই অপ্রস্তুত হয়ে গেল।
শয়ন ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে ঘৃণামিশ্রিত
দৃষ্টিতে চাইলো তন্দ্রার দিকে। অবজ্ঞার সহিত হুংকার দিয়ে বলল,
” নিলজ্জ, বেহায়া কোথাকার! এসব রঙঢংয়ে আমাকে ভোলানো যাবেনা। মাইন্ড ইট। গেট আউট। রাবিশ! ”
দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই কথাগুলো শুনে গেলেন কামরুল মির্জা। সপাটে দরজা খুলে ফেললেন। কটমট দৃষ্টিতে চাইলেন শয়নের দিকে।
কড়া শাসনের সুরে বললেন,
” পাপকে ঘৃণা করো পাপীকে নয়। তুমি দ্রুত আমার রুমে আসো বলছি। ”
চলবে ঃ ২