চাঁদের কলংক পর্ব ১

0
2758

#চাঁদের_কলংক ( এক)
#রেহানা_পুতুল
মাঝরাতে মায়ের সামনে এসেই ক্ষিপ্ত স্বরে তর্জন গর্জন শুরু করলো শয়ন।

” কি করলে তোমরা এটা? তোমাদের একটা ভুল ডিসিশন আমার পুরো লাইফটাই নষ্ট করে দিল। আমি আমার সমাজে মুখ দেখাব কি ভাবে? ”

” আরেহ আল্লাহ! নতুন বউ শুনতে পাবে। গভীর রাতে এভাবে চেঁচিয়ে কথা বলছিস কেন? ঘুম থেকে বাকিরাওতো জেগে যাবে। আস্তে বলা যায়না?”

চরম উদ্বেগ নিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন শাহিদা বেগম।

” না যায়না। এটা আস্তে বলার মত ঘটনা?”

কথাটি বলেই টেবিল থেকে কাঁচের গ্লাসটি নিয়ে সঝোরে মেঝেতে ছুঁড়ে মারল শয়ন। শাহিদা বেগম নিজেই কেঁপে উঠল বড় ছেলের এমন রুদ্ররূপ দেখে।

” কি হয়েছে? সমস্যা কি? ”

গম্ভীর কন্ঠে চোখ লাল করে জানতে চাইলেন কামরুল মির্জা। তিনি মাত্রই নিদ্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ছেলের গলা শুনেই রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। শয়ন চুপ হয়ে গেল বাবার চোখের দিকে চেয়েই।

” কি আর হবে? আমরা সবাই মানা করেছি। আপনি শুনেননি আমাদের কথা। এবার দেখেন পরিণতি। বলেই আবারো কান্না জুড়ে দিল শাহিদা বেগম। ”

” এই মেয়েলোক। চোখের পানি এত সস্তা হয়ে গেলে বাইরে গিয়ে ঢালো। আমার চোখের সামনে এমন প্যাঁচপ্যাঁচ করবানা বলে দিচ্ছি। ”

” আমি কাঁদবোনা। আপনি এর একটা বিহিত করেন বলছি। কত করে বললাম ওকে সব খুলে বলি। এরপর যদি সে রাজি হয়। তবেই এই বিয়ে হবে। ”

” এই কিসের বিহিত করব? কি খুলে বলব? আমার ওয়াদা, আমার পছন্দ কি দুই আনার কড়ি? কারো ভালো না লাগলে আবজর্নার স্তুপে বা পানিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিব? নাকি আমি বাজার থেকে মাটির হাঁড়ি কিনে এনেছি? কারো ভালো না লাগলে ফেরৎ দিব বা ভেঙ্গে ফেলব? ”

রোষপূর্ণ গলায় বললেন কামরুল মির্জা ।

” বাবা আমি এই মেয়েকে নিয়ে একদিন ও চলতে পারবনা।”

দৃষ্টি অন্যদিকে তাক করে বলল শয়ন।

” কেন? বউ কি লুলা? কানা? ল্যাংড়া? বোবা? অন্ধ? কালো? খাটো? প্রতিবন্ধী? অশিক্ষিত? ”

” আমি এসব বলিনি বাবা।” নত মস্তকে বলল শয়ন।

” তাহলে? কত রূপবতী নম্র ভদ্র মার্জিত একটা মেয়ে। সেখানেও সমস্যা তোমার? ”

” বাবা সমস্যাটা যে কোথায় তা আপনিও বেশ জানেন। আর সুন্দর? দেশের বাইরে এমন সাদা চামড়া আমার পায়ের নিচে পড়ে পড়ে থাকে সিগারেটের ছাইঁয়ের মতন। ”

আর কথা বাড়ালেন না কামরুল মির্জা। ছেলের যুক্তির কাছে ধরাশায়ী হবেন বুঝতে পেরে থেমে গেলেন।

মোটা গলায় বললেন,
” তুমি রুমে যাও বলছি। আপাতত রাত্রি যাপন করো নিয়মানুযায়ী। কোন উচ্চবাচ্য যেন আমার কানে আর না আসে। কাল তোমার সাথে এ নিয়ে আলাপ করব।”

শাহিদা বেগম বারান্দায় চলে গেলেন। কি হবে এবার চিন্তা করেই, বুক ভাসিয়ে বিলাপ করতে লাগলেন বিরতিহীনভাবে। কামরুল মির্জা ঘোর ভাবনায় নিমজ্জিত হলেন। ভেবেছিলেন কি আর ঘটল কি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। শয়ন এত বেপরোয়া হয়ে যাবে সব শুনেই। তা ক্ষুনাক্ষরেও তিনি চিন্তা করেন নি।

শয়ন নিজের রুমে চলে গেল। তার আগে কামরুল মির্জাকে বিড়বিড় করে ঝেড়ে নিল আচ্ছা করে । তোর সুন্দরের নিকুচি করি। শালার পুত কামরুল মির্জা। এবার ইলেকশনে আমিই তোকে পরাজিত করে ছাড়ব। তুই বাপ না কসাই। শয়ন ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল। দেখল শূন্য বিছানা। বউ নেই। তা নিয়ে শয়নের কোন ভাবান্তর হলনা। শয়ন দুইহাত দিয়ে টেনে টেনে ফুলসজ্জার সব ফুল ছিঁড়ে ফেলে দিল মেঝেতে। বেড সাইড় টেবিলে থাকা গ্লাসের সব পানি খেয়ে নিল। খালি গ্লাসটা আছড়ে ফেলল মেঝেতে। কাঁচের ঝনঝন শব্দটা অশরীরি আত্মার মতো দেয়াল ঘুরে ঘুরে বন্ধ রুমেই থেমে গেল। শয়ন ধপাস করে বিছানার মাঝ বরাবর উপুড় হয়ে শুয়ে গেল।

তন্দ্রা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পর্দার আড়ালে হাঁটুমুড়ে বসে আছে। সরু চাহনিতে লুকিয়ে সব দেখছিল। শয়ন ঘুমিয়ে গেলে সে বিড়াল পায়ে নিঃশব্দ গতিতে জড়সড় হয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। বধুসাজ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। কিন্তু কোন অশ্রুপাত করলনা। বের হয়ে এসে বারান্দা থেকে খুঁজে পুরনো একটা কাপড়ের টুকরো হাতে নিল। বেসিন থেকে ভালো করে ভিজিয়ে নিল। হাইভোল্টেজের বিদুৎতের আলো গোটা রুমে ছড়াছড়ি। তাই কাঁচের অনুসম গুঁড়িগুলোও পরিষ্কার করতে কোন বেগ পেতে হলনা তন্দ্রার।

আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে কানে। ঊষালগ্ন শুরু হতে চলছে। তন্দ্রা অযু করে নামাজ পড়ে মোনাজাতে অঝোরে কাঁদল এবার। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল জায়নামাজের উপরেই। শয়নের উপর তন্দ্রার কোন অনুযোগ বা অভিযোগ নেই। যত অভিযোগ তার বাবার উপরে। সে তার মাকে দিয়ে বাবাকে বারবার জিজ্ঞেস করিয়েছিল শয়নকে সব জানানো হয়েছে কিনা। বাবা মাকে জানাল, ইনশাআল্লাহ কোন সমস্যা হবেনা। এত দুঃচিন্তা করোনা। চেয়ারম্যান সাহেব আমার অন্তরের লোক। শয়ন ও আমাকে আমাকে অনেক শ্রদ্ধা করে।

বেলা হয়ে গিয়েছে। জানালার ফাঁক গলিয়ে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে তন্দ্রার অক্ষিদ্বয়ের উপরে। ঘুম ছুটে গিয়েছে। উঠে বসল তন্দ্রা। মিটমিট চোখে চারপাশে তাকাল। শয়ন রুমে নেই।

” ভাবি খালাম্মা নাস্তা খেতে ডাইনিংয়ে ডাকে আপনাকে। ”
কাজে সর্বদা সাহায্যকারি শেফালি এসে তাড়া দিয়ে বলল।

“আমি এখন খাবনা। ক্ষুধা নেই। একবারে দুপুরে খাব।”

শেফালী গিয়ে জানাল টেবিলে। শাহিদা বেগম ছেলের মুখপানে চাইলেন একপলক। যা বোঝার বুঝে নিলেন।

শয়ন নাস্তা খেয়ে নিজের রুমে গেল। বের হওয়ার জন্য শার্ট হাতে নিল। তন্দ্রা তা বুঝতে পারল।
কন্ঠকে খাদে নামিয়ে তরল গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি কি আমাকে ডিভোর্স দিতে চান?”

শয়ন ঘুরে দাঁড়াল। তন্দ্রার চোখের দিকে না চেয়েই উত্তর দিল,
“শত,হাজার,অযুত,লক্ষবার চাই।”

” তাহলে আপনি যতদ্রুত সম্ভব দিয়ে দেন। ”

” এতে কি তোমারও কোন সুবিধা আছে?”

“খুউব আছে। আপনাকে দেখলেই আপনার আগের কথাগুলো মনে পড়বে। তখন খারাপ লাগবে বেশী। একই মানুষের দুইরূপ নেওয়া যায়না। ”

” এসব আগে ভাবনি কেন?”
বিরক্তিকর গলায় বলল শয়ন।

” ভেবেছি। আমাকে মিথ্যে ইনকফরমেশন দিয়েছে বাবা। বলল আপনাকে নাকি আপনার পরিবার সব জানিয়েছে। আর আমিও বোকার মতো দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিয়েছি। কিন্তু গতকাল বধু হয়ে আসার পর টের পেলাম দৃশ্যপট ভিন্ন। যা কিনা আততায়ীর ছুরিকাঘাতের চেয়েও হৃদয়টাকে বড় বেশী ক্ষত বিক্ষত করার ক্ষমতা রাখে। ”

“তুমি না বললেও আমি ডিভোর্স দিয়ে দিতাম এজ আরলি এজ পসিবল। ”

কথাটা বলেই শয়ন ভারি ভারি পা ফেলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
তন্দ্রা পিছন দিয়ে শয়নের যাওয়ার দিকে নির্বিকারভাবে একবার চাইলো। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। সহসাই তার মনে পড়ে গেল শয়নের আগের কথাগুলো।

———-

তখন ছিল বর্ষাকাল। তন্দ্রা মাত্রই নবম শ্রেণিতে উর্ত্তীণ হলো। উচ্ছল বয়স। দুরন্ত ঘোড়ার মতো লাগামহীন বেপরোয়া অনুভূতি। চারপাশে যা দেখে তাই ভাললাগে। ফুল, পাখি,গাছপালা সবকিছু। সেদিন নাদুসনুদুস শরীরটাকে দুলিয়ে দুলিয়ে মেঠোপথের পাড় ধরে স্কুলে যাচ্ছিল।

হঠাৎ পিছন থেকে কেউ ডেকে উঠে,
“এই বালিকা একটু দাঁড়াও বলছি। ”

তন্দ্রার পা থেমে যায়। পিছন ফিরে চায়।
” কে ভাইয়া আপনি? ”

“বলছি। এই নাও একগুচ্ছ কাঠগোলাপ। তোমার জন্য।”

হাত বাড়িয়ে দুষ্টমিষ্ট হাসি দিয়ে কাঠগোলাপগুলো নিয়ে নেয় তন্দ্রা। ফুল দেখলেই সে নেশাঘোরে চলে যায়। আর কিছুই মনে থাকেনা তার। ফুলগুলোকে নাকের সান্নিধ্যে নিয়ে নেয়। সুবাস নেয় নিঃশ্বাস ভরে। পরক্ষণেই কচি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” কে আপনি? আমাকে কেন ফুল দিলেন? ”

” তোমার বয়েসী একটা মেয়েকে আমার বয়েসী একটা ছেলে ফুল কেন দেয় বুঝনা বালিকা?”

তন্দ্রার সরল স্বীকারোক্তি।
” হুম বুঝি। আপনি কি আমাকে চিনেন? ”

” অবশ্যই চিনি। আর আমি কে জান?”

” নাতো”
মাথা ডানে বামে দুলিয়ে জানাল তন্দ্রা।

“আমি শয়ন। চেয়ারম্যান কামরুল মির্জার বড় ছেলে। ”

” ওমাগো! ধরেন আপনার ফুল আপনি নেন। ভাইয়া প্লিজ আপনি আমার পিছনে ঘুরবেন না। ”

ফুলগুলো শয়নের হাতে গুঁজে দিয়েই তন্দ্রা স্কুলের দিকে পা বাড়াল।

শয়ন তন্দ্রার হেলেদুলে হেঁটে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। মাথার ঘনকালো লম্বা চুলগুলোর ভিতরে হাত বুলিয়ে নিল। মনে মনে আওড়ালো। ওহে বালিকা,
” জানবে আকাশ,জানবে মাটি,
জানবে এই ধরনী।
আজ হোক কাল হোক,
তুমিই হবে এই শয়নের ঘরনী।
সাক্ষী রবে ফুল পাখি,
সাক্ষী রাতের চাঁদ।
আর কারো হবেনা তুমি,
যতই করো ফাঁদ।”

#চাঁদের_কলংক ( এক )
#রেহানা_পুতুল
চলবে…১
(মন্তব্য ও শেয়ার দিয়ে প্রেরণা দিবেন আশাকরি। আপনাদের আশানুরূপ রেসপন্স পেলেই কেবল কাহিনি গতি লাভ করবে।শুভকামনা অন্তহীন। 🌹💗)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here