#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#পর্ব:-১৯
মোল্লা বাড়ির উঠোনে টিমটিম করে জ্বলছে কুপ বাতি। সন্ধ্যা গড়িয়ে এখন রাতের আটটা বাজে। চারিদিক শুনশান, নিস্তব্ধ। গ্রামের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে কুয়াশার আস্তরন। পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে এতক্ষনে। গ্রামে রাত আটটা মানে অনেক রাত তখন। সাধারণত গ্রামের লোকেরা একটু দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ে। পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে পড়লেও হেমন্তের এই শীতে বারান্দায় ঠাঁই বসে আছেন রোকেয়া বেগম। মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে এখানে বসেছিলেন তিনি আর ঘরে ফিরে যান নি । এর মূল কারণ অবশ্য ওনার একমাত্র ছেলে তুহিন।
বিকেলের গোধূলি লগ্নের কিছু আগে মধুগন্জ থেকে ফিরেছিলেন রোকেয়া বেগম। বাড়িতে ফিরেই বিয়ের কথাটা বলতে চেয়েছিলেন ছেলেকে কিন্তু তুহিনের কোন খোঁজ না পেয়ে বাড়ির কাজে নেমে পড়েন তিনি। অতঃপর দিনের আলো ফুরিয়ে রাতের নিকষ কালো অন্ধকার নেমে এলো ধরনীতে। তবুও ছেলের কোন খোঁজ না পেয়ে উৎকণ্ঠায় ঘরের ভেতর থেকে বাহিরের দাওয়ায় পাইচারি করতে লাগলেন। এক সময় থাকতে না পেরে বাড়ির চাকর আনিসকে পাঠালেন তুহিনের খবর আনতে। কিন্তু আনিস সেই যে সন্ধ্যারাতে বেরিয়েছে এখনো ফিরে নি। তাই তখন থেকেই বারান্দার একপাশে কাঠের উঁচু পিড়িতে বসে রয়েছেন রোকেয়া বেগম।
প্রায় মিনিট ত্রিশের মাথায় মোল্লা বাড়ির টিনের গেট দিয়ে দাওয়ায় ঢুকল তুহিন। আনিসকে অবশ্য তুহিনের সাথে দেখতে পেলেন না রোকেয়া বেগম। তুহিন এই হিম শীতের রাতে বাড়ির দাওয়ায় মাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বলল,
–” কি ব্যাপার মা, এখানে এই শীতের মধ্যে এভাবে বসে আছো কেন? আর কোথায় গিয়েছিলে?”
রোকেয়া বেগম ক্ষনকাল ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলের মতিগতি বুঝার চেষ্টা করলেন। তারপর গম্ভির স্বরে বললেন,
–” কয়টা বাজে এহন? এতক্ষণ কই আছিলি?”
মায়ের প্রশ্ন শুনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো তুহিন। আপাতত চারুর সাথে দেখা করার কথা বলতে চায় না ওর মাকে। এতে হয়তো হিতে বিপরীত হয়ে যাবে আর তাছাড়া ওর মা যদি কখনো চন্দ্রার মা না হওয়ার দুর্বলতার কথা জানতে পারে তবে কখনোই চন্দ্রাকে ছেলের বউ করবেন না তিনি। তাই মায়ের প্রশ্নের জবাবে উত্তর না দিয়ে ভাবতে লাগল কি বলা যায়।
এদিকে তুহিনকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোকেয়া বেগম বলে উঠলেন,
–” কি রে কতা কস না কিল্লাই? কিছু জিগাইছি তোরে?”
–” মা ঐ পাড়ার পোলাগোর লগে আড্ডা দিতেছিলাম এতক্ষন।”
তুহিনের উওর শুনে রোকেয়া বেগম ভ্রু-কুঁচকে জিঙ্গাসা করলেন,
–” হাচা নি?”
–” হ । ক্যান আমার কতা বিশ্বাস হয় না তোমার। কোন দিন দেখছো তোমারে আমি মিছা কথা কইছি।”
–” আগে তোর কতা বিশ্বাস হয়তো তয় আজকাল আর হয় না। যাই হোক ঘরে চল। কিছু খেয়ে নে ,তারপর জরুরী কতা আছে তোর লগে।”
–” কি কতা মা?”
–” আগে চারডা ভাত খা ,তারপর কমু নে। ”
তুহিন বুঝল এখন মাকে হাজার জোর করলেও ওকে কিছু বলবে না। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” আইচ্ছা চলো।”
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে তুহিন ওর মায়ের ঘরে এলো। রোকেয়া বেগম তখন বিছানায় বসে তসবি পাঠ করছিলেন। ছেলেকে ঘরে আসতে দেখে বললেন,
— ” ঐখানে দাঁড়িয়ে না থাইকা বিছানায় আইয়্যা বস।”
তুহিন ওর মায়ের কথামতো বিছানার একপাশে বসে পাতলা কম্বলের ভেতর পা দিলো। এতোক্ষণে শীতের হাত থেকে কিছুটা রেহায় পেলো ও। নিজেকে কোন রকমে সামলিয়ে নিয়ে বলল,
–“কি জন্য ডেকেছিলে বললে না তো?”
রোকেয়া বেগম তসবী পড়া শেষ করে ছেলের মুখোমুখি বসে বললেন,
–” তোর চাচির সাথে আজ মধুগঞ্জে তার ভাইয়ের বাড়িতে গেছিলাম। অনেকদিন হলো কোথাও বেড়াতে যায় না, তাই ভাবলুম ছোটোর সাথে একটু ঘুরে আসি। তো সেখানে যাইয়্যা ওর ভাইয়ের মেয়েকে দেখলাম । জানিস তো মেয়েটা বড্ড ভালো। যেমন তার রূপ তেমন তার গুন।”
–” তো?”
–“আমি তো বুড়ো হইয়া গেছি আর কদিন বা বাঁচমু বল। তাই বলছিলাম কি তুই যদি একবার মেয়েটাকে দেখতিস তাইলে ভালা হতো।”
–” মা আমি আগেও বলেছি যে আমি চন্দ্রাকে পছন্দ করি তবুও তুমি অন্য মেয়ে দেখছো কেন?’
–” দেখ ছোট থেকে তোরে আমি মানুষ করছি । তোর ভালো মন্দ সব আমি বুঝি । ঐ বিয়াত্তা মাইয়্যা তোর যোগ্য না।”
–” মা তুমি একটিবার আমার কথা……..
–” তোর কোন কথা হুনমু না আমি। তুই যদি মাইয়া দেখবার না যাস তাইলেও তোর বিয়ে হইবো আর ঐ মাইয়্যার সাথেই হইবো। আমিও পাকা কথা দিয়ে আইছি । আগামী শুক্রবার বাদ আসর তোর বিয়া।”
–” মা আমি এই বিয়া করবার পারুম না। তুমি না কইরা দাও ওদের।”
–” তুই যদি এই বিয়া না করোস তাইলে আমার মরা মুখ দেখবি এই আমি কইয়া দিলাম। বাকিটা ভাইবা দেখ কি করবি। ”
–“মা….
তুহিনকে থামিয়ে দিয়ে রোকেয়া বেগম আবারো বলে ওঠলেন,
–” এহন তুই যা। আমি ঘুমামু। সকালে ওইঠ্যা আমারে তোর সিদ্ধান্ত জানাবি।”
তুহিন ওর মায়ের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ও জানে ওর মাকে এখন হাজার বুঝালেও কিছুই বুঝবে না। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলো নিজ ঘরের দিকে।
নিশুতি রাত, ঘড়িতে তখন হয়তো দুটো বাজে। অর্থ্যাৎ রাত্রের দ্বিপ্রহর চলছে এখন। চারিদিক নিস্তব্ধ। শুধু একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। চারিদিক কুয়াশার শুভ্রতার চাদরে মুড়ে আছে। ঝোপঝাড়ের আড়ালে ক্ষনে ক্ষনে জ্বলে ওঠছে জোনাক পোকার মিটিমিটি আলো।
হঠ্যাৎ এই নিস্তব্ধতার রেস কাটিয়ে চন্দ্রাদের দক্ষিনা কাঠের দরজায় মৃদু টোকার আওয়াজ শোনা যায়। ঠিক সেই সাথে শোনা যায় পুরুষালী মৃদু স্বর। জানালা বরাবর শুয়ে ছিল চন্দ্রা। ওর পাশেই গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে চারু। আগামীকাল চারু শহরে চলে যাবে তাই আজ শেষ রাতটা চন্দ্রার কাছেই থেকেছে ও।
বাহির থেকে মোট তিনবার টোকা পড়ল কাঠের দরজায় । ঠকঠক আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল চন্দ্রার। চোখ মেলে তাকিয়ে শব্দের উৎস বোঝার চেষ্টা করল। কারো চাঁপা স্বর শুনে চকিতেই জানালার দিকে তাকালো ও তারপর জানালা খুলে পরিচিত মুখটি দেখে চমকে ওঠল চন্দ্রা। উৎকণ্ঠাস্বরে ফিসফিসিয়ে বলল,
–” তুমি এইহানে ক্যান আইছো তুহিন ভাই?”
–“চলদি বাইরে আসো,কতা আছে তোমার লগে।”
–” তুমি খারাও , আমি আইতাছি।”
কথাটা বলেই চন্দ্রা ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে চাদর গায়ে টিনের বেড়া দেওয়া দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে এলো চন্দ্রা। তারপর মৃদু স্বরে বলল,
–” কি কইবা কও?”
–” এইহানে না পুকুর পাড়ে চলো।”
–“ক্যান?”
–” আরে এইহানে কতা কইলে সব্বাই হুইনা ফেলবো। তুমি চলো তো আমার লগে।”
কথাটা বলেই তুহিন ওর বলিষ্ঠ হাত দিয়ে চন্দ্রার হাত টান দিয়ে ওকে নিয়ে এলো শান বাঁধানো পুকুর পাড়ে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক এখন বেশ স্পষ্ট ভাবেই শুনতে পাচ্ছে দুজন। হেমন্তের শিরশির বাতাসে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে চন্দ্রা। কাঁপতে কাঁপতেই বলে ওঠল,
–” তোমার কি মাথাডা পুরোডাই খারাপ হইয়া গ্যাছে তুহিন ভাই?”
–” হ তোর লাইগ্যা আজ আমি পাগল হইয়া গেছি।”
–” কি কইতাছো এইসব তুহিন ভাই।”
চন্দ্রার মুখে ভাই ডাক শুনে তুহিন রেগে গিয়ে চন্দ্রার চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরে আক্রোশ কন্ঠে বলল,
–” আমি তোর কোন জনমের ভাই লাগি হু। তুই যতবার ভাই কইরা ডাহোস ততবার কোন বোন তার আপন ভাইরে ডাহে না।”
–” ছাড়ো আমারে। কেউ দেইখ্যা ফেললে সর্বনাশ হইয়া যাইবো।”
–” যাক। তহন সব্বাই তোর লগে আমার বিয়া দিবো।”
–” বাস্তবতা এতোটা সহজ না তুহিন ভাই। একবার কলঙ্ক লাগলে সে কলঙ্ক এতো সহজে তুইল্যা ফেলন যায় না ।”
–” এই চন্দ্রাবতী তুই কি কোনদিনও আমারে বুঝবি না। আমার কষ্টে কি তোর কষ্ট হয় না। আমার কান্দনে পানি আহে না তোর চোখে?”
–” তুহিন ভাই…….
—” চল আমরা পালাইয়া যাই যেহানে কেউ আমাগোর আলাদা করবার পারবো না। সেইখানে আমাগোর একটা ছোট্ট চড়ুই পাখির মতো সংসার হইবো। ”
–” যেই স্বপ্ন কখনো সত্যি হইবো না সেই স্বপ্ন দেহায়ো না তুহিন ভাই। তুমি চইল্যা যাও। কেউ দেহোনের আগেই চইল্যা যাও।”
–” এই চন্দ্রাবতী তুমি এতো পাষান হইল্যা কেমনে? আমার চন্দ্রাবতী তো এমন আছিল না।”
–” সময় আর পরিস্থিতি মানুষরে বদলাইয়্যা দেয় । আমিও বদলাইয়্যা গেছি। জেঠীমা যে মাইয়্যারে পছন্দ করে তারেই বিয়া করো।”
–” আমি বিয়া করলে তুমি সহ্য করবার পারবা তো?”
–” হ পারুম।”
–” ঠিক আহে আমিও দেহুম তুমি কতটা সহ্য করবার পারো। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই বিয়া করুম আমি। তয় বিয়ার আগ পর্যন্ত আমি তোমার অপেক্ষায় থাকুম ।”
কথাগুলো বলে তুহিন সামনের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। চন্দ্রা সেই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
–” তুমি সুখি হও তুহিন ভাই,সুখি হও। আল্লাহ তোমাগোর দুহাত ঢাইল্যা সুখ দিক। আমি অভাগি সারাজীবন না হয় দুঃখ লইয়্যাই থাহি।”
দুই মানব মানবি যখন নিজেদের সুখ-দুঃখের স্মৃতিকথায় মসগুল ঠিক সেই সময়ে মধুগন্জের মোদক বাড়ির বাঁদিকের বড় ঘরটাতে এক কিশোরী এক প্রানবন্ত যুবকের সাদা কালো ছবির সঙ্গে প্রেম আলাপনে ব্যস্ত। ধীরে ধীরে রাতের ফিকে হয়ে আসছে রাতের নিকষ কালো অন্ধকার। কি জানে পরের দিনের প্রভাতের সূচনা কার জন্য কি বার্তা বয়ে নিয়ে আসছে।
চলবে