#চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#পর্ব:-১৭
মাষ্টার বাড়ির ওঠানে বড় জটলা বেঁধেছে আজ। আশেপাশের বাড়ির সবাই এসে ভীড় জমিয়েছে সেখানে। আর সেই জটলার মাঝ থেকেই আসছে চেঁচামেচির আওয়াজ। এক মধ্য বয়স্ক পৌঢ় মহিলা তারস্বরে একাধারে চিৎকার চেঁচামেচি করেই যাচ্ছেন। যার আধো আধো কথা দোরগড়া থেকে বুঝতে পারছে চন্দ্রা। মধ্য বয়স্ক পৌঢ় মহিলাটি যে রোকেয়া বেগম এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই ওর। এই ভয়টাই পাচ্ছিলো চন্দ্রা। শেষ অব্দি সব কলঙ্ক না ওর গায়ে এসে লাগে। ভয়ে ভয়ে চন্দ্রা এগিয়ে গেল জটলা বাঁধা সেই লোক সমাগমের দিকে।
–“কেমন মাইয়্যা জন্ম দিছো যে বড় লোকের পোলা দেখলেই তার পিছ লাগে। আমার যদি এমন মাইয়্যা থাকত কবেই মাইরা ফেলতাম আমি।”
কথাগুলো শোনা মাত্রই ফুঁসে ওঠলেন বিলকিস বেগম। চেঁচিয়ে বললেন,
–” দেহেন আমার মাইয়্যার নামে এমনি এক কতা কইবেন না। আফনে আমার থাইকা বড় হের লাইগা এতোক্ষণ চুপ কইরা আছিলাম। কিন্তু ভাইবেন না আপনে এমনি এক কতা কইবেন আর আমি চুপ কইরা শুনমু, অত ভালা মানুষ আমি না।”
–” কি কইবা কি তুমি আমারে। আমারে কিছু কওনের মতো মুখ আছে নি তোমার? নষ্টা একটা মাইয়্যা জন্ম দিছো। ছি ছি ছি।”
–” দেখুন নানী আপনি কিন্তু এবার বেশি বেশি করছেন। আপনি সব দোষ শুধু চন্দ্রাকে দিচ্ছেন কেন? আপনি যদি দোষ দিতে চান তবে তুহিন মামাকেও দিতে হবে কেননা চন্দ্রাকে বিয়ের কথাতো তুহিন মামাই আগে তুলেছে।”
বিলকিস বেগমকে থামিয়ে দিয়ে চারু নিজেই বলে উঠলো কথাগুলো। রিতিমত রাগে ফুঁসছে ও। কথাগুলো বাড়ি বয়ে বলতে আসার কোন কারন খুজে পাচ্ছে না চারু। যেখানে দোষটা তার ছেলেরো ছিল সেখানে শুধু একজনকে ছোট করবে কেন ? আর তাছাড়া চন্দ্রাতো বিয়ের কথা বলে নি।
চারুর কথা শুনে কিঞ্চিৎ থেমে গেলেন রোকেয়া বেগম। চারুর দিকে ক্ষনকাল তাকিয়ে বলে উঠলেন,
–” তুমিই বুঝি চারু? কত বড় হয়ে গেছো। ”
চারু কোন উওর না দিয়ে চুপ করে রইলো। এই মহিলাকে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না ওর। যদিও মহিলাটি সম্পর্কে ওর নানী হয় তবুও ছোটবেলা থেকেই ওনার এমন অহংকারী ভাব দেখে ওনাকে মোটেও পছন্দ নয় চারুর।
ভীড় ঠেলে এগিয়ে এলো চন্দ্রা। চারুকে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো চন্দ্রা। চন্দ্রাকে দেখে রোকেয়া বেগম উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,
–” ঐ যে এতক্ষণে আইছে নাটের গুরু। তা কই থেইকা আইল্যা তুমি? আমার পোলার মাথাটা তো পুরাটাই খাইয়া লইছো।”
–” জেঠি কি বলছেন এসব? আমিতো কিছুই বুঝবার পারছি না।”
–” তুই তো শুধু আমার পোলার মাথাটা খাইতেই পারোছ। শোন তুই যদি ভেবে থাকিস তোরে আমি আমার ঘরে বউ করুম তাহলে তুই ভুল ভাবছিস। তোরে যদি আমার পোলার লগে আর একবার কথা কইতে দেখি তখন তোর কি অবস্থা করি দেখবি।”
–“আপনি আবারো ভুল করছেন নানী? এখানে চন্দ্রার….
চারুকে থামিয়ে দিয়ে রোকেয়া বেগম বলল,
–“দেখো চারু তোমাকে একটা কথা কই ,কিছু মনে কইরো না । এইহানে আমাগোর বড়দের মধ্যে কথা হইতাছে । তোমার এত কথা কওনের কি আছে বুঝবার পারতাছিনা? শহরে বড় হইছো অথচ এখনো তোমার মধ্যে কোন শিষ্টাচার নেই । কখন, কোথায় কোন কথা কইতে হয় তা এখনো জানো না তুমি।”
রোকেয়া বেগমের কথা শেষ না হতেই আনোয়ারা বেগম বলে উঠলেন,
–“সে তো তোরও নেই । যদি তোর মধ্যে নূন্যতম শিষ্টাচার থাকতো না তাহলে এখানে এভাবে চেঁচামেচি করতিস না আর বাকি রইল তোদের ওই ধনাঢ্য পরিবারের কথা। তুই যে বিয়ের আগে গরীব কৃষানের মেয়ে ছিল তা মনে আছে তো?”
–” ভাবি এই ফকিন্নি মাইয়্যার জন্য আমারে এতগুলো কথা কইতে পারলা ভাবি ?”
–“না বলার কী আছে? তুই যদি বলতে পারিস আমি কেন বলতে পারব না?”
–” থাক তোমাকে আর কিছু কইতে হইবো না। তয় শুনে রাইখো এই মাইয়ার লগে জিন্দেগীতেও তুহিনের বিয়া আমি দিমু না।”
–“আরে যাও যাও আমরা মনে হয় তোমার পোলার লাইগা মইরা যাইতাছি। তুমি দিবা না তার আগে আমি আমার মাইয়্যারে তোমার পোলার লগে বিয়ে দিবো না।”
–” হ হ জানে হগ্গলে।”
–“দেখল রোকেয়া তুই তোর ছেলেকে কার সাথে বিয়ে দিবি না দিবি সেটা সম্পূর্ণ তোর উপর। তবে তার জন্য এত দূর অব্দি চেঁচামেচি করার কোন দরকার ছিল না। কারণ এখানে দোষটা সম্পূর্ণ চন্দ্রার একার নয় দোষ তোর নিজের ছেলেও রয়েছে। তাই নিজের ছেলেকে ঠিক কর তারপর অপরের মেয়েকে কথা শুনাতে আসিস। সে যাই হোক তোর কথা বলা যদি শেষ হয়ে থাকে তাহলে তুই এখন আসতে পারিস। সকাল-সকাল অনেকটা ঝগড়া হলো তো তাই এখন আর এসব ভালো লাগছে না ।”
আনোয়ারা বেগমের কথা শেষ হতেই রোকেয়া বেগম গোমরা মুখো ভাবে নিজ বাড়ির দিকে চলে গেলেন। এসেছিলেন চারুর সাথে তুহিনের বিয়ের কথাবার্তা পাকা করতে কিন্তু পরিস্থিতি তার উল্টোটা ঘটল।
রোকেয়া বেগম চলে যাওয়ার পর মাষ্টারবাড়ির আঙ্গিনায় লোকসমাগম ধীরে ধীরে কমতে লাগলো। বিলকিস বেগম কাঁদতে কাঁদতে আনোয়ারা বেগমের সাথে মাস্টার বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। চন্দ্রা লোকজনকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল পুকুরপাড়ের দিকে। চন্দ্রার পিছুপিছু চারুও চলে গেল সেদিকে।
পুকুর পাড়ের শান বাঁধানো সিঁড়িতে বসে আছে দুজনে। দুজনের দৃষ্টি সামনের ঘোলাটে পানির দিকে। দুজনের মাঝে যখন পিনপতন নীরবতা চলছে। নিরবতার রেশ কাটিয়ে বলল,
–” দেখলি বলছিলাম না আকাশ কুসুম কল্পনা না করাটা বোকামো। থাক এসব নিয়ে আর মন খারাপ করিস না। পরিক্ষার জন্য প্রিপারেশন নে। পরিক্ষা দিতে হবে নাকি?”
–” আমি পরিক্ষা দিবো?”
–” হ্যাঁ তোকে তো গতকালকেই বললাম আরো অনেকটা পথ চলতে হবে তোকে। তবে তার আগে তোর ভীতটা শক্ত করতে হবে বুঝলি?”
–” হুম।”
–” তুহিন মামার বিষয়টা আমার ওপর ছেড়ে দে। আমি সামলে নিবো এদিকটা।”
–” হুম কি করবি তুই?”
–” সে তুই আপাতত আমার ওপর ছেড়ে দে। চল এবার। এরপর এখানে থাকলে আপার গালি খেতে হবে তো।”
–” হ্যাঁ চল।”
চন্দ্রা ও চারু গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল মাষ্টার বাড়ির দিকে। হয়তো আগামীতে ওর নতুন দিনের সূচনা হবে।
এদিকে রোকেয়া বেগম মাষ্টার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে নিজ বাড়ির দাওয়ায় এসে বসলেন। স্বামী মারা যাবার পর তিনি নিজে একা এই সংসারটাকে এতদিন সামলিয়ে এসেছেন। কিন্তু আজ এক সামান্য মেয়ের জন্য তার সংসার ভেঙ্গে যাবে সে তিনি কখনো বরদাস্ত করবেন না। কিন্তু চারুকে নিয়ে তার চিন্তা-ভাবনা এখন বদলাতে হবে । আর যাই হোক চারুকে নিজের ছেলের বউ করা বোকামি হবে ওনার। যে মেয়ে সবার সামনে প্রতিবাদ করে সে মেয়েকে বাড়ির বউ বানানো যাবে না । এখন অন্য কিছু ভাবতে হবে ওনাকে। কিছু একটা ভেবে ওনার ছোট জা পারুলকে ডাক দিলেন তিনি।
–” পারুল রে এদিকটা একটু শোনে যা তো। কিছু কথা কইতাম ।”
রোকেয়া বেগম এর কথা শেষ হতেই বাড়ির ভেতর থেকে ক্ষীন স্বরে কেউ একজন বলে উঠল,
— ” আসছি ভাবি।”
পারুল এবাড়ির মেজো বউ। ওনার স্বামীর চালের আড়ত রয়েছে। যদিও আড়তটা ঠিক ওনার স্বামীর একার নয় বরং এই পরিবারের সবার । তবে ওনার শাশুড়ির মৃত্যুর পর এই পরিবারের প্রধান কর্তী এখন রোকেয়া বেগম। ওনার কথাতেই পরিবারের সব কাজ হয়। এ নিয়ে অবশ্য মনক্ষুন্ন পারুল। এত বড় সংসারে কম খাটনি খাটে নি সে তবুও চাবির গোছা ওর কাছে আনতে পারল না। এ বিষয়ে স্বামীকে বলেও খুব একটা পাত্তা পায় নি সে।
আঁচলে ভেজা হাত মুছতে মুছতে দাওয়ায় এসে দাঁড়ালো বছর ত্রিশেক এক মহিলা। মাথায় এক হাত ঘোমটা দেওয়া তার। এ অবশ্য গ্রামীন সংস্কৃতি। দেহের গড়ন মানানসই, গোলগাল মুখ আর সদা মিষ্টি হাসি । মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলেন
–” আমাকে ডাকছিলা ভাবি?
রোকেয়া বেগম পারুলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
–” সে তো ডেকেইছিলাম । কিছু কতা ছিল আর কি।”
–” কি কতা ভাবি?”
–” তুই যে কইছিলি তোর ভাইয়ের একখান পরির লাহান মাইয়্যা আছে । কি যেনো নাম হের?”
–” আশা ভাবি কিন্তু ওর কতা জিগাইতিছো ক্যান ভাবি?”
–” বলছিলাম কি ওর কি বিয়া সাদি হইছে নি?”
–” না ভাবি এহনো হয় নাই। কত্তো প্রস্তাব আহে কিন্তু ছেমড়ি তো না কইরা দেয় আমাগোর তুহিনের লাইগা।”
–” অই কি এহনো তুহিনরে ভালাবাসে নি?”
–” হ হের লাইগাই তো বিয়া দিবার পারতাছে না ভাইজান।”
–” যাক ভালা হইছে। তুই বরং একখান কাম করো।”
–” কি কাম ভাবি?”
–” তোর ভাইরে কইয়া দে যে আমারা মাইয়্যা দেখবার রামু সামনের দুই একদিনের মধ্যেই।”
–” কিন্তু তুহিন?”
–” ওরে নিয়া কোন চিন্তা করিস না । পোলা আর যাই হোক আমার কতা ফেলবার পারবো না । তোরে যা কইলাম তাই কর গিয়া।”
–“আইচ্ছা ভাবি।”
–” আর শোন সামাদ আইলে আমার লগে দেখা করবার কইবি।”
–” আইচ্চা। আমি এহন যাই তাইলে।”
–” হ তা।”
–” আমি একটু একা থাকুম একটু।”
–” আইচ্চা ।”
হাঁপাতে হাঁপাতে নিজের ঘরের বিছানায় এসে বসল পারুল। ওতো স্বপ্নেও ভাবে নি ওর ইচ্ছাটা কোনদিন সত্যি হবে। এতদিনে ওর স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। এবার আশারে এই বাড়িতে বউ করতে পারলেই ওর খেলা শুরু হবে। অনেক দিন ধরে এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ও। তাই আর সময় নষ্ট না করে ভাইকে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করতে লাগল পারুল।
চলবে