# চন্দ্রাবতী
#আমিনা আফরোজ
#পর্ব:-১৪
সময় দশটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। স্কুল ফিল্ডের ডান দিকের একটি শিউলি গাছের তোলায় দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রা আর চারু। গাছটির নিচে পড়ে আছে হাজারো শিউলি ফুল। সাদা রঙের ফুলগুলো দূর থেকে দেখলে মুক্তোর দানা বলে মনে হয়।
স্কুল ফিল্ডে উৎসুক নয়নে গ্রাম পঞ্চায়েতদের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই । প্রতিবার বিচারসভায় এভাবেই উৎসব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তারা । এই সময় সবার মনেই অন্যরকম এক উত্তেজনা বিরাজ করে। আজ শুক্রবার বিধায় স্কুল বন্ধ । তবুও স্কুল প্রাঙনে এসে ভীড় জমিয়েছে হাজারো স্কুল ছাত্ররা। বিচার সভাই কি হবে এই নিয়ে কিন্তু ওদের মনে কোন উৎসাহ নেই ওদের। ওরা কেবল বড়দের পিছু পিছু এখানে এসেছে। স্কুল ফিল্ডে যারা এসেছে তাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যায় বেশি ,মহিলা খুব একটা নেই।এর পেছনেও একটি কারন রয়েছে তা হলো গ্রামের প্রচলিত নিয়মে মহিলাগনদের বাড়ির বাহিরে আসার খুব একটা প্রচলন নেই ।
পাঁচজন পঞ্চায়েত প্রধান এবার একটু নড়েচড়ে বসলেন । এই বেলা থাকতে থাকতেই বিচারকার্য শেষ করতে চান উনারা । আজ যে আবার জুম্মার দিন। নামাজে যেতে হবে ওনাদের। তাই আর দেরি না করে মোঃ মোবারক হোসেন প্রথমে কেশে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেন। তারপর দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলেন,
–” সময় তো চইল্যা যাইতাছে। বিচার শুরু করা যাক এহন ।”
মোবারক হোসেনের কথা শুনে উপস্থিত গ্রামবাসীরা সবাই একসঙ্গে বলে উঠল,
–“হ হ বিচার শুরু করেন এহন।কহন থেইকা বইস্যা রইছি আমরা।”
সবার কথা শুনে মোঃ মোবারক হোসেন আবারো বলে উঠলেন,
–“ঠিক আহে সব্বার অনুমতি লইয়া বিচার কাজ শুরু করতাছি। প্রথমেই আমাগোর চারু মায়ের কাছে থেইকা জানবার চাই আসলে সেই দিন কি এমন হইছিলো যে চন্দ্রারে রায়পুর থেইকা নিয়া আসোন লাগলো?”
পঞ্চায়েত প্রধানের মুখে নিজের নাম শুনে চমকে উঠল চারু। তবে ও আগেই আন্দাজ করেছিল যে এই বিচার সভায় সবার আগে ওকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সে হিসেবে নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুত করেই এসেছে ও। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে এর আগেও লড়েছে সে। তাই নিজেকে যথাসম্ভব সামলিয়ে রেখে স্পষ্ট ভাষায় বলে উঠলো,
–” রূপগঞ্জ আসার একদিনের মাথায় জানতে পারি চন্দ্রা আমার আসার দিন ছয়েক আগে রূপগঞ্জে এসেছিল। তবে সেবার চন্দ্রার রূপগঞ্জে আসা স্বাভাবিক ছিল না। কেননা যেদিন চন্দ্রা রূপগঞ্জে আসে সেদিন ওর গায়ে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল হাজারো আঘাতের চিহ্ন। চন্দ্রার আসার দিন তিনেক পর রাশেদ আসে চন্দ্রাকে নিয়ে যেতে কিন্তু চন্দ্রা যেতে চায় না ওনার সাথে। তখন বিলকিস বেগম অথ্যাৎ নানী চন্দ্রাকে জোর করে রাশেদের সাথে পাঠিয়ে দেয়। ঘটনাটা যখন আমি জানতে পারি তখনি খটকা লাগে আমার । তাই সিদ্ধান্ত নেই চন্দ্রার শশুড় বাড়ি যাওয়ার। এতেও বাঁধ সাধেন চন্দ্রার মা। এক পর্যায়ে বেশ কথাকাটি হয় আমাদের মাঝে। তারপরেও হাল ছেড়ে দেই নি আমি। নানুকে রাজি করিয়ে তুহিন মামাকে নিয়ে চলে যায় চন্দ্রার শশুড় বাড়িতে। সেখানে গিয়ে দেখি চন্দ্রার জা মানে রাশেদের বড় ভাইয়ের স্ত্রী চন্দ্রাকে পিছন থেকে চন্দ্রার দুহাত সহ চন্দ্রাকে জাপটে ধরে আছে আর চন্দ্রার স্বামী রাশেদ ওর সামনে দাঁড়িয়ে ওকে মারধর করছে।”
চারুর মন্তব্য শুনে মোঃ মোবারক হোসেন এবার চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে বললেন,
–” চারু যা কইল তা কি সত্যি?”
এইবার চন্দ্রা মুখ তুলে তাকালো । তারপর চারুর দিকে ক্ষনকাল তাকিয়ে দৃঢ় গন্ঠে বলল,
–“জি সত্যি । তবে সেইদিন শুধু প্রথম হাত তুলে নি বরং বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের জন্য নির্যাতন করে আমারে। কথায় কথায় মারধর করে । ”
–” কি ব্যপার রাশেদ মিয়া? তোমার ব্যপারে তো ভালো কথা শুনলাম না ? ”
একটু জোর গলায় জিজ্ঞেস করলেন হিন্দু পাড়ার নন্দন কুমার।
নন্দন কুমারের কথায় রাশেদ ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠলো,
–” বউয়ের যদি চরিত্র খারাপ হয় তবে তারে মাইরাই ঠিক করতে হয়। আর আমিও তাই করছি। আপনিই কন আপনি যদি জানেন আপনার বউ অন্য কারো লগে লটরপটর করে তাইলে কি আপনে ছাইড়া দিবেন তারে ?”
রাশেদের কথা শুনে উৎসুক জনতার মাঝে এক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। গুঞ্জন ওঠল সকলের মাঝে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই আমজাদ হোসেন জোর গলায় বলে ওঠলেন,
–” তুমি যে কথাগুলো বললে তার কোন প্রমান আছে তোমার কাছে রাশেদ ? আমরা ভিত্তিহীন কথায় বিশ্বাস করি না। তোমার কাছে প্রমান থাকলে দেখাও।”
আমজাদ হোসেন এর কথায় সকল জনাতার মাঝে আবারো নিরবতা ভর করল। চারু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাশেদের দিকে । তারপর চন্দ্রার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,
–” এখনি মক্ষম সময় ঐ জানোয়ারটার পরকিয়ার ঘটনাটা বলার। আর দেরি করিস না , বলে ফেল। ”
কিন্তু চন্দ্রাকে বলার সুযোগ না দিয়েই রাশেদ আবারো বলে উঠলো,
–” আমার কতা সত্যি মনে না হইলে তুহিন মিয়ারেই জিগান সত্য কথাটা কি?”
রাশেদের কথা শুনে এবার রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে যায় তুহিন। এতোক্ষণ স্কুল ফিল্ডের একপাশে চুপ করে বসে ছিল ও। কিন্তু রাশেদের এমন ঘৃন্য কথায় আর চুপ করে থাকতে পারল না সে। গর্জে ওঠে বলল,
–” মুখ সামলাইয়া কথা কও মিয়া। গেরামের কেউ কোনদিন আমারে আর চন্দ্রারে এক লগে দেখছে নাহি? জিগাও সব্বাইরে। ”
ভিড় ভাট্টার মাঝ থেকে ছিমছিমে গড়নের এক যুবক দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
–” হ হ এইডা ঠিক কইছে তুহিন । চন্দ্রা বড় ভালা মাইয়া । ওরে তুহিনের সাথে তো কি অন্য কোন পোলার লগেও কতা কইতে দেহি নাই কোনদিন।”
এইবার চারু রাশেদের সামনে এসে জোর গলায় বলতে লাগল,
–” আপনি যে এতটা নিকৃষ্ট তা আগে জানতাম না। নিজের দোষ ঢাকতে নির্দোষ এর ওপর মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন। আপনি তো অনেক চেষ্টা করলেন নিজের দোষ ঢাকতে দেখি এবার আর কি করতে পারেন আপনি?”
চারুর কথা শেষ না হতেই এবার চন্দ্রা বলে উঠলো,
–” আমার চরিত্র নিয়া কি বলবার আগে আফনের চরিত্র ঠিক করেন। আফনি পরকিয়া করেন বইলা অন্যরাও যে ওমন হইবো এইবার ভুল ধারনা হইবো। আপনি তো আপনার বড় ভাইয়ের বউয়ের লগেই……ছি ছি ছি কইতেই ঘৃনা করছে হামার।”
চন্দ্রার কথা শেষ হতেই গর্জে ওঠল রাশেদ। বলল,
–” চুপ একদম বাজে কতা কইবি না। তুই তো একটা ব্যাশ্যা । নিজের শরীর বিলাইয়া দেশ অন্যরে। তুই আমারে কি জ্ঞান দিতাছোস । তোরে তো……….
রাশেদের কথা শেষ না হতেই সজড়ো চড় পড়ল ওর গালে। চড়টা অবশ্য দিয়েছেন আকলিমা বেগম নিজেই। নিজের ছেলের বিষয়ে বেশ ভালোভাবেই অবগত তিনি। নির্দোষ চন্দ্রার অপবাদ আর শুনতে পারছিলেন না । তাই শেষ অব্দি হাত ওঠালেন ছেলের গায়ে। অতঃপর রাগি গলায় বললেন,
–“চুপ আর একটাও বাজে কতা কইবি না তুই। তোর মতো একটা জানোয়ার ছেলের লগে ওমন ফুটফুটে নিষ্পাপ মাইয়ার বিয়া দেওয়াটাই ভুল হইছিল আমার। তয় ভুল যহন আমি করছি প্রায়াশ্চিত্তটাও আমিই করুম। আইজ এহন এইহানে তুই চন্দ্রারে তালাক দিবি।”
আকলিমা বেগমের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল রাশেদ। বড় বড় চোখে তাঁকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। তারপর মিনমিনে স্বরে বলল,
–” এইডা আমি করতে পারুম না । ”
–“কেন পারবি না?”
–” কারণ কইতে পারুম না কিন্তু এইডা আমি পারুম না করতে।”
–” তুই করতে বাধ্য। এহনই তুই চন্দ্রারে তালাক দিবি।”
আকলিমা বেগমের কথা শেষ হতেই মোঃ মোবারক হোসেন বলে উঠলেন,
–” সমাধান তো হইয়াই গেলো । তয় চন্দ্রারে তালাক দেওনের আগে ওর দেনমোহর শোধ কইরা দেওন লাগবো। তারপর এতদিন যে আমাগোর মাইয়ারে মারছে তার ক্ষতিপূরন দেওন লাগবো বিশ হাজার টাকা। কি কন আপনারা?”
–” হ হ ঠিক কইছেন আপনে। ”
–” তাইলে ঐ কথাই রইল। আপনাগোর সাত দিন সময় দিলাম। হের ভিত্তর টাহা পয়সা যোগাড় কইরা আহেন। পরবর্তী শুক্রবারে তালাকের কাজ হইবো ।”
পঞ্চায়েত প্রধানের কথা শুনে আকলিমা বেগম ও রাশেদ আরকোন প্রতিউত্তর না করে নিরবে চলে গেল সেখান থেকে। আকলিমা বেগম অবশ্য যাওয়ার আগে চন্দ্রার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। চারু আর চন্দ্রাও ততক্ষণে ফিরে এসেছে মাষ্টার বাড়িতে। বিলকিস বেগমের বাড়িতে এখনো চন্দ্রাকে যেতে দেই নি চারু। আপাতত আরো সাত দিন অপেক্ষা করতে হবে ওদের। তারপরেই ঐ জানোয়ারের হাত থেকে মুক্তি পাবে চন্দ্রা। আবারো শুরু হবে নতুন করে পথ চলা।
চলবে