চন্দ্রাণী ২৬

0
61

#চন্দ্রাণী (২৬)

অস্তমিত সূর্যটার মতো নিয়াজের অবস্থা। কিছুক্ষণ পরেই বিলীন হয়ে যাবে।এই নশ্বর পৃথিবীতে ধীরে ধীরে মুছে যাবে নিয়াজের নাম।
খাটিয়ার উপর পড়ে আছে নিয়াজের লাশ।শর্মীর দুই চোখে শ্রাবণ ধারা।শর্মী দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে লাশের খাটিয়ার দিকে।
কি এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আছে শর্মী!
যাকে বিশ্বাস করেছে,বিয়ে করেছে অথচ তার মৃত্যুতে শর্মী একটু শোক প্রকাশ করে মন খুলে কাঁদতে পারছে না।
তাকে শেষ দেখা দেখতে পারবে না।সে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ হতে পারে কিন্তু তবুও আজ মন বলছে শেষ বার যদি তাকে এক নজর দেখতে পারতো। মন এতো বেহায়া কেনো,কে জানে!
নয়তো যেই মানুষ শর্মীর সাথে এতো অন্যায় করেছে,এতো কষ্ট দিয়েছে শর্মীকে তাকে দেখার জন্য কি-না মন উতালা হয়ে আছে।
কেনো বারবার সেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে!
নিয়াজের আদর,নিয়াজের ভালোবাসা সব কেমন মনে পড়ছে বারবার।
কি ভীষণ ভালোবাসা নিয়ে বুকের মধ্যে ঝাপটে ধরত ধরতো নিয়াজ।চুমুতে চুমুতে শর্মীকে অস্থির করে তুলতো।

এতো আদর করার মানুষ কিভাবে শেষে এসে এভাবে ধোঁকা দেয়!
কিভাবে সব শেষ করে দিলো!

চন্দ্র এসে শর্মীর কাঁধে হাত রেখে বললো, “এতো ভেঙে পড়িস না শর্মী।আমি জানি তোর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বোন।কিন্তু যেটা ধ্রুব সত্যি সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় তো নেই।তুই এভাবে কান্নাকরলে সবার সন্দেহ হবে কিন্তু। ”

শর্মী কি উত্তর দিবে জানে না।সে জানে সবাই দেখলে সন্দেহ করবে কিন্তু সে যে সহ্য করতে পারছে না।

চন্দ্র শর্মীকে একা ছেড়ে দিয়ে সরে গেলো সেখান থেকে। কাঁদুক ও,নিজের ভেতরের সব যন্ত্রণা নিয়াজের লাশের সাথে সাথে দাপন করে দিক।

ভেতরের দিকে কান্নার রোল উঠেছে। আত্মীয় স্বজন সবাই এসেছে।
চন্দ্র বাবাকে খুঁজতে গেলো।কিছুক্ষণ পর দেখতে পেলো শাহজাহান তালুকদার সোফায় বসে দেয়ালে থাকা আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।
চন্দ্র আড়াল থেকে আয়নাতে লক্ষ্য করলো।মিষ্টি কালার শাড়ি পরনে একজন মহিলা বসে আছে একটা রুমে। নিরবে চোখের পানি মুছে চলেছে। শাহজাহান তালুকদার পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখছে।
চন্দ্র এসে বললো, “আব্বা।”

চমকে উঠে শাহজাহান তালুকদার বললো, “হ্যাঁ মা।বল।”

চন্দ্র কিছু বললো না। চলে গেলো সেখান থেকে। তার হঠাৎ করে মনে পড়লো টগর এখানে থাকতে পারে কোথাও হয়তো।
চন্দ্র চলে যেতেই শাহজাহান তালুকদার উঠে দাঁড়ালো। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে করতে সবে মাত্র রুম খালি হয়েছে। এখন আর ওই রুমে কেউ নেই। আজ আর ভয় পেলো না শাহজাহান তালুকদার। যা হারানোর তা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন বহু বছর আগেই।
আজ আর হারানোর কিছু নেই। কিন্তু অতীতের সেই বিচ্ছেদের যন্ত্রণা তিনি আজও ভুলেন নি।

শাহজাহান তালুকদার এসে দাঁড়াতেই রুমে থাকা মহিলাটি আতঙ্কিত হয়ে গেলো। অস্ফুটস্বরে বললো, “তুমি এখানে!”

মুচকি হেসে তালুকদার বললো, “তোমার জন্য কানিজ।”

কানিজ গম্ভীর হয়ে বললো, “বাজে কথা বলো না,এসব ফাতরামি করার বয়স নেই তোমার এখন।”

তালুকদার বিছানার এক পাশে বসে বললো, “ফাতরামি করছি না কানিজ,করলে তো বহু আগেই করতাম।সেই যেদিন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তুমি আমাকে ছেড়ে সরকারি চাকরিজীবী পাত্রর গলায় মালা পরালে, অথচ আমাকে চিঠিতে লিখলে যে আমি যাতে আগের দিন ঢাকায় চলে যাই।তুমি বিয়ের দিন পালিয়ে আসবা।

আমিও বোকার মতো তোমার কথা বিশ্বাস করলাম কানিজ। অথচ বুঝতে পারি নি আমি গ্রামে থাকলে ঝামেলা করতে পারি ভেবে তুমি চালাকি করে আমাকে গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছ।”

কানিজের মুখে মেঘের ছায়া নেমে এলো।এসব কথা তার শুনতে ইচ্ছে করছে না।

মুখ ভোঁতা করে বললো, “সুখে থাকার অধিকার সবার আছে তালুকদার, আমার ও আছে।তুমি ছিলে তখন ছন্নছাড়া মানুষ। কি ছিলো তোমার বলো তো?
চালচুলোহীন একটা মানুষের হাত আমি ধরবো কোন ভরসায়?”

শাহজাহান তালুকদারের দুই চোখে বিষাদের ছোঁয়া। গলা ভারী হয়ে এসেছে। মুচকি হেসে বললো, “সুখে থাকার অধিকার তোমার আছে কানিজ,তাই বলে আমাকে স্বপ্ন দেখিয়ে সেই স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে কেনো তোমাকে সুখী হতে হলো?
আমাকে বলেই দিতে না হয় আমাকে ভালোবাসো না।আমাকে কেনো ভালোবাসার আশ্বাস দিয়েছিলে?
আমি তো অপেক্ষায় ছিলাম।দুই দিন রেলস্টেশনে ঠাঁয় বসে ছিলাম।শুধু যেকোনো সময় তুমি চলে আসবে ভেবে।সস্তায় এক রুমের একটা বাসা ঠিক করে রেখেছিলাম।ছোট ছোট দুটো পাতিল কিনে রেখেছিলাম।একটা বালিশ একটা তোশক। সব তোমার পছন্দ মতো করে রেখেছিলাম যাতে আমাদের ছোট্ট সংসারে এসে তুমি অবাক হও আগেই সব রেডি দেখে।

শুধু বিলাসিতা, উচ্চবিত্ত স্বামী চেয়েছিলে তুমি, আমার ভালোবাসা চাইলে না!
তো এখন,স্বামী, বিলাসিতা নিয়ে খুব সুখে আছো নিশ্চয়?
স্বামীর ভালোবাসা পেয়েছ কি?”

কানিজ জবাব দিলো না। কি বলবে সে!
কিভাবে বলবে সেদিন পালাতে গিয়ে আব্বার হাতে ধরা পড়ে যায় কানিজ।বড় ভাইজান আর আব্বার ধমকের সামনে কানিজের কিছু করার ছিলো না। কাদের ভাইজান নিজেই তো তাকে শাসিয়েছে যদি পালানোর চিন্তা করে থাকে তবে আব্বা আম্মা বি//ষ খাবে বলে ঠিক করেছে।এখন সিদ্ধান্ত কানিজের হাতে।
কানিজ পারে নি নিজের ভালোবাসার মানুষের হাত ধরতে।আব্বার সম্মানের কথা ভেবে কানিজ পারে নি।

শাহজাহান তালুকদার উঠে দাঁড়ালো। তারপর ম্লান সুরে বললো, “তোমাকে কতো বছর পরে দেখলাম কানিজ জানো?খুব ইচ্ছে ছিলো তোমার সাথে একবার দেখা করে জিজ্ঞেস করার আমার দোষ কোথায় ছিলো। তোমার উত্তর আমি জানতে চাই না।তোমাকে পাই নি,তুমি আমাকে ঠকিয়েছো এই আক্ষেপ আমার আছে কানিজ। আমার সারাজীবন এই আক্ষেপ থেকে যাবে নিজেকে উজাড় করে ভালোবেসে ও আমি তোমাকে পাই নি।তুমি ঠান্ডা মাথায় আমার সব স্বপ্ন খু//ন করেছো।
সংসার আমার ও হয়েছে, সন্তান হয়েছে। নিজে চেয়ারম্যান হয়েছি।কেনো হয়েছি চেয়ারম্যান কানিজ জানো?
শুধু তোমার আব্বা আর ভাইকে দেখানোর জন্য। যেদিন আমি তোমার আমার ভালোবাসার কথা তোমার আব্বাকে জানিয়েছিলাম,তোমার আব্বা বলেছিলো তুমি চেয়ারম্যানের মেয়ে,আমি তোমার লেভেলের মানুষ না।তোমার আব্বার অহংকার ভেঙে দিতে আমি চেয়ারম্যান হয়েছি।
যতবার ইলেকশন আসে,ততবারই আমার মনে পড়ে যায় তোমার আব্বার অহংকারী সেই কথাগুলো। তুমি আমাকে ঠকিয়েছ সেই কষ্ট আমার আছে। তবে তারচেয়ে বেশী মনে সুখ আছে আমার একজন স্ত্রী আছে। যে আমাকে ঠিক আমার মতো করে বুঝে।
বিয়ের পর প্রথম প্রথম মাঝরাতে আমার ছটফটানি দেখে সে কখনো রাগ করে বলে নি প্রাক্তন প্রেমিকার কথা মনে করে কষ্ট পাচ্ছি কেনো!
সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সবসময় আমাকে স্বান্তনা দিয়ে বলেছে সব ঠিক হয়ে যাবে,আমার ভালোবাসা, যত্ন দিয়ে আপনার মনের সব ক্ষত মুছে দিবো।

ক্ষত সে মুছে দিয়েছে কানিজ।শুধু আক্ষেপ হলো কেনো আমি তোমার মতো ভুল মানুষকে ভালোবাসলাম?
কেনো আমি অপাত্রে নিজের ভালোবাসা দান করলাম।
এই যে আজকে আমি এসেছি এখানে,তোমার সাথে কথা বলছি তা আমার স্ত্রীর জন্য। সে-ই আমাকে পাঠালো একটা বার তোমার সাথে কথা বলতে। মনে যেসব প্রশ্ন আছে সব জিজ্ঞেস করে নিজেকে হালকা করতে।

তোমার সাথে কথা বলতে বসে আমার মনে পড়লো এখানে না এসে আমি আমার স্ত্রীর সাথে, সন্তানদের নিয়ে সন্ধ্যায় চা,বিস্কিটের আড্ডায় বসলে মনে হয় বেশি শান্তি পেতাম।তোমার সাথে কথা বলতে বসে আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে।
আসছি কানিজ।”

শাহজাহান তালুকদার বের হয়ে গেলো রুম থেকে।বাহিরে এসে দেখে শর্মী একটা সোফায় বসে আছে। চন্দ্রকে দেখতে পেলো না।কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো শাহজাহান তালুকদারের। মেয়েটা কোথায় গেলো!
শর্মীকে জিজ্ঞেস করতেই শর্মী বললো, “আপাকে তো আমি ও দেখছি না আব্বা।”

পকেট থেকে ফোন বের করে চন্দ্রকে কল দিলেন তিনি। পর মুহুর্তে চন্দ্র ছুটে এলো। দুই মেয়ের হাত ধরে শাহজাহান তালুকদার বের হয়ে এলেন।
কানিজের বিয়ের পর থেকেই কাদের খাঁনের সাথে শাহজাহান তালুকদারের বন্ধুত্ব ছিন্ন হয়ে যায়। একে অন্যের শত্রু হয়ে যায় দুজনেই।

তালুকদার চলে যেতেই কানিজ বালিশে হেলান দিয়ে বসলো।
সুখে কি কানিজ থাকতে পেরেছে আজও কোনো দিন!
চাকরি করা স্বামী পেয়েছে সবাই জানে,কিন্তু মাতাল স্বামী পেয়েছে তা কয় জন জানে?
বউকে টাকা পয়সা সোনা দিয়ে ভরিয়ে রাখে সবাই জানে,অথচ বিয়ের পর থেকে বিভিন্ন মেয়েদের সাথে মেলামেশা করে এটা কয়জন জানে!
জানে না,কেউ জানে না।অভিমান করে কানিজ আব্বা,ভাইদের জানায় নি এসব।কি হবে জানিয়ে, সবশেষে তারা না হয় তাকে নিয়ে যাবে,তাতে কি যাকে হারিয়েছে কানিজ তাকে ফিরে পাবে?
কানিজ নিজেকে নিজে শাস্তি দিতে চেয়েছে। শেষ দিকে আব্বা ভাইজান জানতে পেরে যখন শত চেষ্টা করেও কানিজকে ওই বাড়ি থেকে আনতে না পেরে কষ্টে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছিলো।আব্বা চিঠি পাঠিয়ে, লোক পাঠিয়ে ও খালি হাতে ফিরে আসতো।
কানিজ তখন শান্তি পেতো।আব্বা বুঝুক,ভালো করে বুঝুক। কষ্ট পাক আব্বা।যেই কষ্ট আব্বা কানিজকে দিয়েছে তার ছিঁটেফোঁটা আব্বাকে ফেরত দিতে পেরে কানিজ খুশি হতো। বিয়ের পর কানিজ আর আসে নি বাপের বাড়িতে। আব্বা মারা যাবার দুই দিন আগে এসেছিলো।
তালুকদার কি কখনো জানতে পারবে এসব!
না জানাই ভালো। তালুকদার স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সুখে আছে সুখে থাকুক।
আল্লাহ তাকে স্বামী দিয়ে ও সুখ দেয় নি,সন্তান দিয়ে ও না।এই ভালো করেছে আল্লাহ।সব কষ্ট দিক তাকে।
নিজেকে নিজে কষ্ট পেতে দেখলে আনন্দিত হয় কানিজ।

চন্দ্র অনেক খুঁজে ও টগরকে খুঁজে পেলো না।এমন কাউকে পেলো ও না যাকে জিজ্ঞেস করতে পারে টগরের কথা।
তিনজনই বাড়ির দিকে যাচ্ছে। অথচ তিন জনের মনেই তিন রকমের চিন্তা।

চলবে…..
রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here