#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৯
রৌদ্রূপ তারার অজান্তেই তারার জন্য সংরক্ষিত একটি সাধারণ জীবনের রুটিন তৈরি করলো। তারা নিজের মতোই চলবে। তবে, তারাকে পরিচালনা করবে রৌদ্রূপ। তারার জীবন যাপন একেবারে খাপছাড়া। ঠিক সময়ে খাবার-দাবার খায় না। রাতে বেশিরভাগ সময় বিশ্রাম না নিয়ে জেগে থাকে। সাধারণ কোনো মানুষ যদি রাতে না ঘুমিয়ে দিনে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। তাহলে তাঁর এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। রাতের অংশটুকু আমাদের মস্তিষ্কের অলস সময়। এই সময়টুকুতে আমাদের মস্তিষ্ক বিশ্রাম নেয়। একটি মানুষের মস্তিষ্ক যদি বিরামহীন ভাবে অবিশ্রামহীনতায় ভোগে তবে হ্যালুসিলেশন হবেই! যেকোনো জিনিস কিংবা বস্তুরই একটি স্বাভাবিক নিয়মনীতি থাকে। আমরা সেটি অনুসরণ না করলে হিতে বিপরীত তো হবেই।
রৌদ্রূপ টেবিলে খাবার সাজালো। তারার সন্নিকটে এসে বললো,
— তারা খাবে চলো। সকাল থেকে খাওয়া হয়নি তোমার কিছু।
তারা লাল আভাযুক্ত চক্ষুদ্বয় নাড়িয়ে বললো,
— আমি খাবো না রৌদ্রূপ। আমার খুদা লাগেনি। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমাকে একটু একা থাকতে দিন রৌদ্রূপ।”
রৌদ্রূপ দুটো লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। আকুলতা মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
— ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করলে শরীর মন দুটোই ভালো লাগে তারা। শোনো, একটা প্রবাদ আছে। চিত্তে শান্তি থাকলে দুনিয়া শান্তির। শরীর আর মনে যদি শান্তি থাকে তাহলে সারা দুনিয়াই তোমার জন্য শান্তির লাগবে। আর যদি শরীর আর মনে শান্তি না থাকে তাহলে এই দুনিয়ার যত সুখ আছে তা যদি কেউ তোমার পায়ের কাছে ফেলে দেয় তাও তোমার কাছে ওটাতেও শান্তি লাগবে না।”
তারা শান্ত দৃষ্টিতে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। এই মূহুর্তে তারার মধ্যে এক বিন্দু শান্তি পাওয়ার লোভ জাগ্রত হয়েছে। এই জীবনে শান্তির বড্ড অভাব যে তাঁর! হয়তো রৌদ্রূপের কথা শুনলে মনে বিন্দু পরিমাণ শান্তির আভা আসলেও আসতে পারে। তারা হেঁটে গেল টেবিলের দিকে।
বিকেলে হালকা টলমল বাতাসের আমেজ। তারা বারান্দায় দৌড়ে গেল। বাতাসে বারবার তারার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে বারি খাচ্ছে এদিক ওদিক। রৌদ্রূপ তারার দিকে মগ্ন হয়ে তাকিয়ে রইলো। ভীষণ খামখেয়ালী একটা মেয়ের সঙ্গে আছে রৌদ্রূপ। কোনো দিকে কোনো খেয়াল নেই। রৌদ্রূপ মৃদু হেসে বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারা অস্পষ্ট চোখে ভারী ভারী পলক ফেলছে।বাতাসে চোখ দু’খানি বুঁজে আসছে বারবার।রৌদ্রূপ ক্ষীন হেসে বললো,
— ইউ আর দ্যা কুইন অফ মাই হার্ট!
রৌদ্রূপ এটুকু বলেই নিজের বুকে একটা হাত দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়ালো। তারা ঠোঁটে অল্প প্রবাহের হাসির রেখা দেখা দিলো। চুল ঠিক করতে করতে বললো,
— কুইন হতে গেলে আলাদা রাজ্য,সৈন্য সদস্যসহ আরো অনেক ক্ষমতার অধিকারী হতে হয়। আমার মধ্যে সেসবের ছিটেফোঁটাও নেই। আমি হলাম রূপকথার গল্পের সেই ঘুঁটেকুড়ানি। যাঁর নেই কোনো রাজত্ব। যাঁর নেই কোনো অসাধারণত্ব।
রৌদ্রূপ তারার কথা শুনে তাচ্ছিল্য পূর্বক হাসলো। দৃষ্টিতে বেশ খানিকটা স্থিরতা বজায় রেখে বললো,
— দ্যা কুইন ইজ অলওয়েজ দ্যা কুইন।
তুমি যদি মনে করো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, সাহসী মেয়েটি তুমি তাহলে সেটাই তুমি। তুমি যদি মনে করো তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভিতু, কুৎসিত মেয়ে। তাহলে তোমার কাছে তুমি সেটাই। এসব আসলে তোমার মনের ওপর নির্ভর করে। তুমি আসলে নিজেকে কীভাবে দেখছো বা দেখতে চাও।”
তারা প্রচ্ছন্নে মৃদু হাসলো। হেসে বলো,
— আমার কথা বাদ দিলাম। আপনি আমাকে কীভাবে দেখেন রৌদ্রূপ।?”
রৌদ্রূপ কিছু সময়ের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেল। খানিকক্ষণ পর নিরবতা কাটিয়ে বললো,
— চাঁদের সৌন্দর্যের বর্ননা দেওয়ার মতো শক্তি কিংবা সামর্থ্য আমার নেই।”
রৌদ্রূপ এটুকু বলেই তারার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তারা অনতিপূর্বেই রৌদ্রূপের পিছু ছুটলো। সে কী আসলেই চাঁদ? না কি রৌদ্রূপ মিথ্যে বললো?
তারা সন্ধ্যায় আবার আরেকবার স্নান করলো। ভালো লাগছে না কিছু। মাথা ঝিমঝিম করছে বারবার। তারা টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। রৌদ্রূপ রঙ তুলি নিয়ে টেবিলে পসরা সাজিয়ে বসেছে। তারা হাত থেকে টাওয়ালটা ফেলে কৌতুহলী দৃষ্টিতে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। রৌদ্রূপের ছোট্ট টেবিলটার সামনে থুঁতনি ঠেকিয়ে রৌদ্রূপের রঙ তুলিতে হাত বোলালো।রৌদ্রূপ হস্তে এক কুন্ডলী রঙ মাখিয়ে সবে মাত্র আঁকিবুঁকি শুরু করেছিল। তারার এহেন আদুরে আচরণ দেখে স্নেহার্দ সূলভ ভঙ্গিতে দৃষ্টিপাত করলো। মেয়েটা খুব অদ্ভুত। কিছুটা পাঁচ মিশালি আচারের মতো। কখনো টক কখনো মিষ্টি টাইপ। রৌদ্রূপ রঙে তুলি ডুবিয়ে তারার নাকে একটু করে ছুঁইয়ে দিলো। নিজের নাকে তরল কোনো পদার্থের স্পর্শ পেয়ে;তারা ট্যারা ভাবে নিজের নাকের দিকে তাকালো। ইস! রঙ লেগে গিয়েছে!
রৌদ্রূপ তারার কান্ড দেখে হেসে ফেললো। তারা হাতে এক থাবলা রঙ মাখিয়ে রৌদ্রূপের গালে লাগিয়ে দিলো। রৌদ্রূপ রঙে রাঙানো বদনখানি এলিয়ে ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো। তারা রৌদ্রূপের আঁকা ছবিটার দিকে তাকালো। একি! রৌদ্রূপ নিজেরই ছবি আঁকছে! তারা চক্ষুযুগল কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম। তারা অদ্ভুত দৃষ্টিতে একবার রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। আরেকবার ওই ছবিটার দিকে তাকালো। বিষ্ময়ের রেশ না কাটিয়েই বলে ফেললো,
— কেউ নিজের ছবি আঁকে? আমি এটা আজ প্রথমবারের মতো দেখলাম!
রৌদ্রূপ স্লান হাসলো। রঙ মাখা মুখে হাত বুলিয়ে বললো,
— কেন? কেউ যদি নিজেকে ভালোবাসতে পারে। তাহলে নিজের ছবি আঁকা যাবে না কেন?”
তারা রৌদ্রূপের কথার জবাব দেওয়ার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেল না। কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। তারপর তুলতুলে আঙুলগুলোতে রঙ মাখিয়ে রৌদ্রূপের ছবিটাতে রৌদ্রূপের গাল বরাবর রঙ মাখিয়ে দিলো। বাস্তবে যেভাবে কিছুক্ষন আগে রৌদ্রূপের গালে রঙ লাগিয়ে ছিল। একেবারে সেভাবে!ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে রৌদ্রূপ সবেমাত্র রঙ দিয়ে হলি খেলে এসেছে। তারা দু’হাত ভর্তি রঙ নিয়ে ঝলমলিয়ে হেসে উঠলো। রৌদ্রূপ তারার হাসির শব্দ শুনে বিলম্ব করলো না। দৌড়ে তারার সন্নিকটে এসে দাঁড়ালো। ছবিখানা দেখে রৌদ্রূপও না হেসে থাকতে পারলো না। বাস্তবিক অর্থে আসলেই মনে হচ্ছে রৌদ্রূপ হলি খেলে এসেছে। রৌদ্রূপ ছবিটার দিকে দু’চোখ স্থির করে তাকালো। অতি প্রচ্ছন্নে আনমনে বিরবির করে বললো,
” এই রঙের ন্যায় রঙিন স্নিগ্ধময়ী হবে তোমার জীবন। অপেক্ষা শুধু সময়ের।”
রৌদ্রূপের বলা কোনো কথাই তারা শুনলো না। এখনও সে সেই ছবিতেই মত্ত্ব হয়ে পরে রয়েছে। রৌদ্রূপ মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো। যে যেটা নিয়ে থাকতে ভালোবাসে।তাঁকে সেটা নিয়েই থাকতে দেওয়া উচিত।
রৌদ্রূপ সবেমাত্র বিছানায় গা ছুঁইয়েছে। কৌতুহল মাখা চোখে আনমনে হঠাৎই তারার দিকে চোখ গেল তাঁর। চিন্তিত ভঙ্গিমার সুস্পষ্ট ছাঁপ তারার চাহনিতে। তারার চোখের দৃষ্টি দু”খানি গিয়ে ঠেকেছে স্বচ্ছ সাদা মেঝেতে। রৌদ্রূপ বিষ্ময় নিয়ে তারার দিকে তাকালো। তারার শরীরে নিজের হাতের ছোট্ট একখানা স্পর্শ দিতেই তারা চমকে উঠে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। রৌদ্রূপ কপালের মধ্যমালায় লম্বাটে ভাঁজ করে বললো,
— এত চিন্তা কীসের তোমার? ছোটখাটো একটা মেয়ে। এই বয়সেই এত চিন্তা। বুড়ো হলে তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজগুবি চিন্তা বাদ দিয়ে মাথা ঠান্ডা করে ঘুম দাও একটা।”
তারা তখনো আগের ন্যায় চুপচাপ,নিস্প্রান ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎই রৌদ্রূপকে অবাক করে দিয়ে বললো,
— দেহের এই অমসৃণ কলঙ্কের দাগ কী মুছবে না কখনো? না কি থেকে যাবে এভাবেই সারাজীবন? ”
রৌদ্রূপের হৃদয়ে উথাল-পাতাল ঢেউ খেলে গেল। বদনে কিছুটা স্নেহ আর মমতা মিশ্রিত করে রৌদ্রূপ বললো,
— চাঁদের গায়ে এক আকাশ পরিমাণ কলঙ্কের দাগ থাকলেও সে চাঁদ। চাঁদের গায়ে এত কলঙ্ক। তবুও সে সবচেয়ে সুন্দর। থাকুক না কিছু কলঙ্ক! থাকুক না কলঙ্ক মাখা চাঁদের সেই অপূর্ব সৌন্দর্য!”
তারা নেত্রযুগলে মায়ার অস্পষ্ট মোহজাল বিছিয়ে দিলো কেউ। দরদে অক্লান্ত হৃদয়ে তারা বললো,
” রৌদ্রূপ আমি নিজে থেকে তাঁদেরকে কোনো শাস্তি দিতে পারবো না। সেরকম শক্ত মনমানসিকতা আমার নেই। আজকাল একটা জিনিস খুব জানতে ইচ্ছে হয়। সৃষ্টিকর্তা তাঁদের জন্য কী শাস্তি বরাদ্দ রেখেছেন? পরকাল অবধি কী আমাকে অপেক্ষা করতে হবে? আমি নির্দোষ হয়েও ইহলোকে বিস্তৃত পরিমাণ শাস্তি ভোগ করলাম। তাঁরা কী এর এক বিন্দু পরিমাণও শাস্তি পাবে?
রৌদ্রূপ তারার গালে আঙুলের পরশ এঁকে দিলো। প্রলুদ্ধ গলায় বললো,
— পরলোকে সৃষ্টিকর্তা কী শান্তি বরাদ্দ রেখেছেন তা আমি জানি না। তবে, ইহলোকেও তাদের জন্য শাস্তি আছে। জীবনের অপ্রীতিকর এক পর্যায়ে এসে পরবে। নিজের কাছেই নিজে অপরাধী হয়ে যাবে। জানো তো তারা, একটা মানুষ যখন অন্যের কাছে অপরাধী হয়ে যায় তখনও তাঁর খুব একটা খারাপ লাগে না।কিন্তু একবার যদি কেউ নিজের কাছে অপরাধী হয়ে। তবে, তাঁর জীবনের সব শান্তিই হারাম হয়ে যায়। অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হতে হতে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যায়।”
তারা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। বুকে একরাশ চাপা কষ্ট নিয়ে বললো,
— কোনো দোষ না করেও আমি কষ্টের সাগরে পতিত হয়েছি রৌদ্রূপ।আমার জীবনটা নরকের আগুনে বিষিয়ে গিয়েছে। আঘাতে আঘাতে খন্ড বিখন্ড হয়েছে আমার মন। ”
রৌদ্রূপ তারাকে আর কোনো কথা বলতে দিলো না। তারার থুতনিতে হাত রেখে বললো,
— এসব বাদ দাও। ঘুম দাও একটা। তুমি তো আমার চাঁদ। তুমি ভেঙে পরলে চলবে? চাঁদ ভেঙে গেলে পৃথিবী টিকবে কী করে?”
চলবে….