চন্দ্রবিলাসীনি পর্ব ৮

0
300

#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৮

টেবিলের ওপরে মেহেদীর টিউবটা দেখে কিঞ্চিৎ বিষ্মিত হলো তারা। রৌদ্রূপকে বিস্ময়মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
–এই মেহেদীটা আপনি এনেছেন?”

রৌদ্রূপ তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললো,
–হ্যাঁ, কেন তোমার মেহেদী পছন্দ না?”

তারা মুখটা খানিকটা গম্ভীর করে বললো,
–মেহেদী আমার খুব পছন্দ তবে আমি জানি না কীভাবে মেহেদী পরতে হয়। আপনি পারেন?”

রৌদ্রূপ মাথা চুলকে উত্তর দিলো,
–ইয়ে আসলে না। আমি কখনো মেহেদী দিয়ে দেইনি কাউকে। আমার খুব হাত কাঁপে।”

তারা নিচু স্বরে শুধু বললো,
–ওহ!”

রৌদ্রূপ তারার মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ হতাশ হলো। এত সুন্দর মুখটা সবসময় হাসিতে পরিপূর্ণ থাকবে। কেন যে সবসময় গুরুগম্ভীর বেশে থাকে তারা! রৌদ্রূপ মাথা খাটিয়ে একটা বুদ্ধি বের করলো। মেহেদীর টিউব আর একটা কলম হাতে নিয়ে ঘরের দরজায় নক করলো। তারা দ্রুত উঠে রৌদ্রূপকে ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দিলো। রৌদ্রূপ ঘরে ঢুকেই তারার হাতের ওপরে কলম দিয়ে একটা ফুল আকঁলো। তাঁর ওপরে পাতা দিয়ে গোল গোল করে আরো ডিজাইন করলো। তারা রৌদ্রূপের কান্ড দেখে হতবিহ্বলের ন্যায় রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে ছিল। কলম দিয়ে হাতে কী করছে এগুলো?

দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর রৌদ্রূপ তারার হাতে একটা ডিজাইন করলো। এরপর মেহেদীর টিউবটা তারার হাতে দিয়ে বললো,
–আমার কলম দিয়ে আঁকা ডিজাইনটার ওপরে তুমি শুধু মেহেদী বসিয়ে দাও। আর কিছু করা লাগবে না। দেখবে এতেই হয়ে যাবে।”

তারা হতবাক হয়ে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। এত বুদ্ধি মাথায়! রৌদ্রূপ তারার এহেন নির্বাক দৃষ্টিতে তাকানো দেখে হেসে ফেললো। স্বাভাবিক কন্ঠে তারাকে বললো,
–চেষ্টা করলে সবকিছুই নিজের আয়ত্তে আনা সম্ভব। সবসময় সব কিছু পারতে হবে জানতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বুদ্ধি দিয়ে মাথা খাটিয়ে কীভাবে কাজটা উশুল করবে এটাই হচ্ছে বড় কথা।”

রৌদ্রূপের কথা অনুযায়ী একটু একটু করে কলম দিয়ে আঁকা ডিজাইনের ওপরে মেহেদীর টিউব দিয়ে মেহেদী বসালো তারা। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, কেউ দেখলে বুঝতেই পারবে না।এটা আসলে কলমের আঁকার ওপরে মেহেদী বসানো।

মেহেদী শুকিয়ে গিয়ে লাল বর্ন ধারন করেছে। তারা দৌড়ে গিয়ে রৌদ্রূপের কাছে গেল। হাতের এপিঠ ওপিঠ ঘুরিয়ে মেহেদী রাঙা হাতটা রৌদ্রূপের নিকট তুলে ধরলো। রৌদ্রূপ গ্লানিমাখা দৃষ্টিতে তারার দিকে তাকালো। এত সুন্দর নিষ্পাপ নিরীহ একটা মেয়ে। কিন্তু তাঁর জীবনটা?বিষের চেয়েও বিষাক্ত আর ধারালো!

রৌদ্রূপ টেবিলে খাবার খেতে খেতে তারাকে জিজ্ঞেস করলো,
–তুমি তো H.S.C দিয়েছিলে আমি যতদূর জানি। এতদিনে তো রেজাল্টও দিয়ে দিয়েছে। তোমার রেজাল্ট কী ছিল?”

তারা ব্যস্ত কন্ঠে উত্তর দিলো,
–A+”

মূর্হুতেই রৌদ্রূপের গলায় যেন খাবার আঁটকে গেল। নির্বাক হয়ে তারাকে বললো,
–এত ভালো স্টুডেন্ট তুমি! আমি তো A+ এর ধারে কাছেও ছিলাম না!”

তারা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে রৌদ্রূপকে বললো,
–আপনি তো জানেনই আমার জীবনটা আসলে কেমন। তেমন বন্ধু-বান্ধব ছিল না আমার। ক্লাস শেষ করে সোজা বাড়ি চলে আসতাম। বাড়িতেও তেমন সঙ্গীসাথী ছিল না। একা একা থাকলেই ট্রমায় চলে যেতাম। তাই নিজেকে এক প্রকার ব্যস্ত রাখার জন্যই পড়াশোনা করতাম।”

রৌদ্রূপ খাবার মুখে দিতে দিতে বললো,
–হুম খুব ভালো;খুব ভালো। আমার স্যার বলতেন পড়াশোনা করা হচ্ছে এক ধরনের নিরব প্রতিশোধ। তখন ছোট ছিলাম। এই কথার সারমর্ম বুঝতে পারিনি। বড় হয়ে বুঝতে পারলাম। যখন বুঝলাম তখনই পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ বাড়িয়ে দিলাম। জীবনে সফল হতে গেলে পড়াশোনা করতেই হবে। যাইহোক এবার কাজের কথায় আসি। তোমার অতীতে কী হয়েছে না হয়েছে সেটা ভুলে যাও তারা। তোমার রেজাল্ট দিয়েছে। সামনে এডমিশন টেষ্ট। বাসায় ভালো স্যার রাখবো। ভালো করে পড়াশোনা করবে। ভালো ভার্সিটিতে চান্স পাওয়াবোই আমি তোমাকে।”

তারা স্যার রাখার কথা শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেল। কিছুটা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
–স্যার বাসায় রাখতে হবে কেন? এখানে আশেপাশে কোথাও ভালো কোচিং নেই? আমাকে কোচিংয়ে ভর্তি করে দিন। বাসায় স্যার রেখে ঝামেলা করার কী দরকার?”

রৌদ্রূপ তারার কথায় প্রথমে দ্বিমত করার কথা ভেবেছিল। তবে, একবার তারার পরিস্থিতির দিকটা খেয়াল করলো। এমন বাজে একটা পরিস্থিতিতে বড় হওয়ার পর বাইরের পুরুষকে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই রৌদ্রূপ তারার সিদ্ধান্তটাই গ্রহন করলো। কাল অফিস ছুটি হলে ভালো কোচিংয়ের সন্ধান করবে।

রাতে ঘুমের ঘোরে রৌদ্রূপ কারো গোঙানির আওয়াজ পেয়ে উঠে বসলো। কিছুটা বিচলিত হয়ে তারার দিকে তাকালো। তারা ঘুমের ঘোরে মুখ দিয়ে আওয়াজ করছে। আর,হাত ও পা প্রচন্ড নাড়াচাড়া করছে। রৌদ্রূপ বুঝতে পারলো তারা হয়তো কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে। রৌদ্রূপ আলতোভাবে তারার হাত ধরে; ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে তাঁকে; ঘুম থেকে উঠানোর চেষ্টা করলো।

তারা দ্রুত ঘুম থেকে উঠে বসলো। রৌদ্রূপের উৎকন্ঠা যুক্ত চাহনি দেখে চুপ হয়ে গেল তারা। রৌদ্রূপ বিমর্ষ হয়ে তারাকে বললো,
–কী হয়েছে তারা?”

তারা একবার নিজের শরীরের দিকে তাকালো। শরীর ঘেমে একাকার। মনে হচ্ছে আগুন জ্বলছে শরীরে। তারা রৌদ্রূপের প্রশ্নের কোনো প্রতুত্তর করলো না। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
–পানি! পানি! আমি পানি খাবো।”

রৌদ্রূপ দ্রুত বিছানা থেকে রান্নাঘর থেকে তারার জন্য পানি আনতে গেল। পানি নিয়ে ফিরে আসতেই তারা ভয়ে ভয়ে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। রৌদ্রূপ আরেক এক পা এগোতেই তারা চিৎকার করে উঠলো। বেডের পাশের টি-টেবিলটার ওপর থেকে একটা কাঁচের শোপিস ছুঁড়ে মারলো রৌদ্রূপের দিকে। রৌদ্রূপ একটা দূরে থাকায় রৌদ্রূপের গায়ে না লাগলেও। পা বরাবর পৌঁছালো।

তারা চিৎকার করে রৌদ্রূপকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–তুই সামনে আসবি না আমার! তুই কেন আমাকে ভালোবাসলি না?মরে যা তুই! আমার সামনে আসবি না আর!”

রৌদ্রূপের কাছে এবার বিষয়টা সম্পূর্নভাবে পরিস্কার হলো। রৌদ্রূপ দ্রুত হেঁটে পাশের ঘরে চলে এলো। রৌদ্রূপ চিন্তিত হয়ে বেডে শক্ত হয়ে বসলো। তারার স্মৃতি এখনও ওই দৃশ্যগুলোর মাঝেই আঁটকে রয়েছে। তাই স্বপ্ন, কল্পনা বাস্তব সবকিছুতে ওসবই ভেসে বেড়াচ্ছে। যেভাবেই হোক ওই বিষাক্ত স্মৃতিগুলোকে তারার মন, স্বপ্ন, কল্পনা সবকিছু থেকে মুছে ফেলতে হবে। রৌদ্রূপ খানিকবাদে তারার কাছে গেল। ফ্লোরে হাত, পা গুটিয়ে ঘুমিয়ে পরেছে তারা। রৌদ্রূপ আর টু শব্দও করলো না। নিঃশব্দে সেই ঘর থেকে প্রস্থান করলো। রান্নাঘরে গিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে তাতে অধর ছুঁইয়ে চুমুক দিলো। মনে মনে হাজারো চিন্তামালার ছাপ। মনে উত্তর বিহীন হাজারো ধাঁধার সমীকরণ মেলানোর তাগিদ। ক্ষ্যান্ত হয়ে রৌদ্রূপ বড় বড় শ্বাস ফেললো। ভয়ে ভয়ে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন করলো রৌদ্রূপ। সেই সিদ্ধান্তের মোড়ে ছিল আপনজনকে বাঁচানোর দৃঢ় প্রচেষ্টা ও সংকল্প।

ভোরবেলা অফিসের ম্যানেজারকে ফোন করে আজ ছুটি নিলো রৌদ্রূপ। ম্যানেজার প্রথমে ছুটি দিতে অস্বীকার করেছিল। পরমুহূর্তেই রৌদ্রূপের আকুতির কাছে হার মেনে গেল।
রৌদ্রূপ স্থির চিত্তে বারবার ভাবনার জগতে হারিয়ে যাচ্ছিলো। তারা ঘুম থেকে ওঠা অবধি তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে। তারা নিজের এমন বিধ্বস্ত রূপ দেখলে আরো ভেঙে পরবে। সেকারণ-বসতই রৌদ্রূপ অফিসে ছুটির আবেদন করেছে। তাতে যদি মাইনে থেকে টাকা কাটে তবে কাটুক। একটি মানুষের জীবনের মুল্য সকল কিছুর উর্ধে। টাকা, অর্থ, সম্পদ এক্ষেত্রে মুল্যহীন।

তারা নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে। রৌদ্রূপ তারার মানসিক অবস্থার বিপর্যয় সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা করতে পারলো। সবকিছু তারার অগোচরে রাখলো। রাতে তারার করা আচরণগুলো হচ্ছে তাঁর অবচেতন মনের ভ্রম। বাস্তব ও কল্পনার খেই হারিয়ে ফেলার কারণেই এমনটা হচ্ছে। তারার কল্পনা ও ভাবনার পরিমাণ অতি সীমিত। মানুষ সারাদিন যেসব বিষয় কিংবা বস্তু নিয়ে বেশি ধ্যান বা চিন্তায় মগ্ন থাকে। তখন তাঁর স্বপ্ন কিংবা কল্পনার মূল বিষয়বস্তু হিসেবে সেটি বারংবার সন্নিকটে উপস্থিত হয়।

রৌদ্রূপ নিজের ঠোঁট দু’খানায় হাসি মাখিয়ে তারাকে পেছন থেকে বললো,
— তারা!”

তারা নিরব দৃষ্টিতে রৌদ্রূপের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করলো। এরপর চোখ নামিয়ে নিলো। ভেজা গলায় বললো,
— আমি কী আপনাকে খুব বেশি বিরক্ত করছি রৌদ্রূপ? কাল রাতের বেলা ঘটে যাওয়া ঘটনার ক্ষুদ্রাংশ আমারও খেয়ালে আঁটকে আছে। আমি কী করবো বুঝতে পারছি না রৌদ্রূপ! আমি ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছি রৌদ্রূপ। আমি কী করবো?এত মানুষের মৃত্যু হয়ে যাচ্ছে। আমাকে আল্লাহ জীবিত কেন রাখলেন? মে/রে ফেলতেন! আমি মরে গিয়েও বেঁচে যেতাম।”

রৌদ্রূপ তারার বলা কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো। এতে অবশ্য রৌদ্রূপের কিছুটা মনঃক্ষুন হলো। বারবার তারার বলা কথাগুলো শ্রবন ইন্দ্রিয়ের কাছে সম্মোচারিত হচ্ছে। রৌদ্রূপ প্রগাঢ় গলায় বললো,
— ডিপ্রেশনে কারা ভোগে জানো? যাঁরা নিজের ভাবনার বিষয়গুলোকে ছোট্ট ছোট্ট ঘটনাতে কিংবা অল্প কিছু বিষয়েই সীমাবদ্ধ রাখে। এবং, সারাদিন সেসব নিয়েই ভাবে। তুমি তোমার ভাবনা চিন্তার পরিধি বাড়াও। ডিপ্রেশন তোমাকে ছুঁতেও পারবে না। সারাদিন অতীত নিয়ে পরলে থাকলে তুমি কীভাবে সাধারণ জীবন পদার্পণ করবে তারা? আমি তোমাকে বলিনি তোমার অতীত জীবনের সবকিছু ভুলে যেতে। কখনো সেসব ভোলা সম্ভবও না। কিন্তু, তুমি সেসব মনে রাখার চেষ্টা করো বলেই তো বারবার মাথায় আসে। তুমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নাও। নিজের প্রতি খেয়াল রাখো। নিজেকে ভালোবাসো। দেখবে তোমার পৃথিবীটাই অন্যরকম।”

তারা রৌদ্রূপের বলা কথা শুনে কেঁদে ফেললো। এই বেদিশা জীবনের সমাপ্তি হবে কবে? কখনো কী সে আট-দশটা মানুষের মতো বাঁচতে পারবে না? বুক ভরে মুক্ত নিশ্বাস নিতে পারবে না?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here