চন্দ্রবিলাসীনি পর্ব ৭

0
364

#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৭

রৌদ্রূপ সন্ধ্যাবেলায় ছাঁদে গেল। তারা ছাঁদের রেলিং ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে। রৌদ্রূপ তারার দৃষ্টিকোনের দিকে তাকালো। তারার দৃষ্টি গিয়ে থেমেছে ওই সুবিশাল চাঁদের দিকে। রৌদ্রূপ জোড়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো। কিছুটা আক্ষেপের স্বরে বললো,
–তুমি যেভাবে ওই নীল আকাশ আর চাঁদকে আপন করেছো।সেভাবে,যদি আমায় একটু আপন করতে!”

রৌদ্রূপ হেসে তারার দিকে এগিয়ে গেল। মুখে হাসির রেখা টেনে পেছন থেকে বললো,
–তারা!”

তারা পেছন ফিরে রৌদ্রূপের দিকে চমকে তাকালো। রৌদ্রূপের এত সুন্দর হাসি উপেক্ষা করতে না পেরে নিজেও হেসে ফেললো। রৌদ্রূপ আস্তে আস্তে তারার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
–আমি ভেবেছিলাম আজকেও আবার আমাকে দেখে লাফ দেবে রেলিং থেকে। তোমাকে নিচে খুঁজে না পেয়েই আমি দৌড়ে ওপরে চলে এসেছি। এই দেখো আমার হাত, পা এখনও কাঁপছে! ”

তারা শব্দ করে হেসে ফেললো। হেসে বললো,
–ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়।”

রৌদ্রূপ তারার দিকে মুচকি হেসে তাকালো। রৌদ্রূপ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তারাকে বললো,
–কী ভাবছিলে এতক্ষন? আমি ওপরে আসলাম একবার টেরও পেলে না।”

তারা মলিন হাসলো। রৌদ্রূপের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
–আমার মতো একটা মেয়ে আর কী ভাববে বলুন। পুরনো দিনের কথাই ভাবছিলাম।”

তারার নেত্র যুগল মুহুর্তেই চিকচিক করে উঠলো। জলে টাইটুম্বুর অবস্থা। এখনই হয়তো নিচে গড়িয়ে পরবে কয়েক ফোঁটা জল। তারা রৌদ্রূপের সামনে মাথা নিচু করে বললো,
–আমি ভেঙে পরেছি রৌদ্রূপ আমি ভেঙে পরেছি। ”

রৌদ্রূপ একটু একটু করে তারার সন্নিকটে এসে দাঁড়ালো। তারার দু’গালে হাত রেখে নিবিড় দৃষ্টিতে বললো,
–একটা মানুষের জীবনে অনেক কিছুই হবে। অনেক কিছু হারাতে হবে আবার অনেক কিছু তুমি পাবেও। কিন্তু কখনো ভেঙে পড়ো না জীবনে। তুমি যদি ভেঙে পড়ো তাহলে তোমার সফলতা ও ভেঙে পড়বে। ”

তারা রৌদ্রূপের হাত দুটো ধরে বললো,
–আমি পারছি না রৌদ্রূপ! বারবার ভেঙে পরছি আমি! নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার মতো সাহস কিংবা শক্তিও নেই আমার। যতবার নিজেকে গড়ার চেষ্টা করি ততবার ভেঙে পড়ি।”

রৌদ্রূপ স্থির দৃষ্টিতে তারার দিকে তাকিয়ে বললো,
–কেউ তোমাকে একবার ভাঙার আগেই নিজেকে দশবার গড়ে নাও! নিজের দুর্বলতাকে নিজের শক্তি হিসেবে জমিয়ে রাখো। তোমাকে কখনো কেউ ভাঙতে পারবে না তারা। মনে রাখবে, তোমার প্রতিদন্ডী শুধুই তুমি। কেউ তোমাকে হারাতে পারবে না। কেউ না!”

তারার চোখ থেকে নিভৃতে অশ্রুকনা গড়িয়ে পরলো। মানসিক ভাবে এতটা সাহস কেউ আগে তাঁকে দেয়নি। মনের গহীনে থাকা আরেকটি সাহসী সত্তা জেগে উঠলো তারার। চোখ মুছে নিজের ভেতরের সাহসী সত্তাটাকে স্বাগতম জানালো তারা। সত্যিই! মানুষ চাইলে কী না পারে!

রৌদ্রূপ ছাঁদ থেকে নিচে নেমে রুমে গিয়ে রং তুলি নিয়ে বসলো। চাকরি-বাকরিসহ সাংসারিক ঝামেলায় আঁকাআকির ব্যাপারটা মাথা থেকে পুরো বিগড়ে গেছে। অনেকদিন এই রঙ তুলি নিয়ে বসা হয় না। রৌদ্রূপ তুলিতে একটু রঙ নিয়ে কাগজে ছোঁয়ালো। তারা ছাঁদ থেকে নেমে সেই মুহুর্তে ঘরে প্রবেশ করলো। রৌদ্রূপকে রঙ তুলি নিয়ে বসতে দেখে রৌদ্রূপের সামনে এগিয়ে গিয়ে বসলো। হাতের মধ্যে থুতনি ঠেকিয়ে রৌদ্রূপকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–কী করছেন?”

রৌদ্রূপ রঙের তুলিটা পানি ভেজাতে ভেজাতে নির্লিপ্ত গলায় বললো,
— ছবি আঁকছি। ”

তারা রৌদ্রূপকে আর কোনো প্রশ্ন করলো না। কিছুক্ষন মন দিয়ে রৌদ্রূপের ছবি আঁকা দেখলো। রৌদ্রূপের দেখাদেখি তারা একটা রঙের তুলি পানিতে ভিজিয়ে, রঙ নিয়ে সাদা একটা কাগজে আঁকতে শুরু করলো। আঁকা বলা যায় না ঠিক সেটাকে। তারা শুধু কাগজের ওপর আলতোভাবে রঙ ছোঁয়াচ্ছে। তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মিটমিট করে হাসতে শুরু করলো। রৌদ্রূপ ছবি আঁকায় ব্যস্ত। তাই, তারার হাসি কিংবা তারার কর্মকান্ড কিছুই খেয়াল করলো না।

বেশ কিছুক্ষন কাগজের ওপর তুলি ঘুরিয়ে কাগজটা মুড়িয়ে নিচে ফেলে দিলো তারা। এসব ছবি-টবি আঁকা তাঁর দ্বারা সম্ভব নয়। তারা সবকটা রঙের কৌটা থেকে একটু একটু করে রঙ নিলো। আঙুলসহ হাতের তালুতে সবকটা রঙ একটু একটু করে লাগালো। রৌদ্রূপের খাতা থেকে আলতোভাবে আরেকটা কাগজ ছিঁড়ে নিলো। এরপর, কাগজটা সোজাভাবে রেখে জোড়ে হাতটা কাগজের ওপরে রেখে একটা চাপ দিলো। কাগজটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে তারা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কয়েক রঙের সংমিশ্রণে হাতের তালুর ছাপ বসে গেছে কাগজটায়। কী সুন্দর! রৌদ্রূপ অন্য একটা রঙের তুলি নিতে পাশ ফিরতেই তারার দিকে চোখ গেল।তারা কী যেন একটা নিয়ে খুব ব্যস্ত। রৌদ্রূপ নিজের কাজ শেষ না করেই সেখান থেকে উঠে দাঁড়ালো।

তারার দিকে অগ্রসর হতেই খেয়াল করলো তারার কর্মকান্ড। সাদা কাগজের মধ্যে কয়েকটা রঙের মিশ্রন করে হাতের ছাপ বসিয়েছে তারা। রৌদ্রূপ তারার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হেসে উঠলো।তারা পিলে চমকে উঠে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। রৌদ্রূপ তারার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো। নিজেও হাতে বেশ কয়েকটা রঙ একটু একটু করে মাখিয়ে সেই কাগজে হাতের ছাপ বসালো। তারা এতক্ষন কৌতুহলী দৃষ্টিতে রৌদ্রূপের দিকে তাকালেও, শেষের ঘটনাটুকুতে হেসে ফেললো। রৌদ্রূপ হঠাৎ তারার সামনে থেকে উঠে দাঁড়ালো। রঙ ভর্তি হাত নিয়ে ঘরের দিকে ছুটলো। তারা তাকিয়ে রৌদ্রূপকে একবার দেখলো। পরক্ষনে চোখ ফিরিয়ে রঙ মাখা দুটো হাতের ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো।

রৌদ্রূপ হাতে একটা কলম নিয়ে ফিরে এলো। টেবিলের সামনে দু’পা ভেঙ্গে বসলো। তারার সামনে থেকে কাগজটা সরিয়ে নিজের দিকে ঘোরালো। রঙমাখা হাতের ছবিটার ঠিক নিচের দিকে লিখলো,

” রৌদ্রূপ আহসান এবং তারা ইমতিয়াজা”

তারা বিস্মিত নয়নে রৌদ্রূপের লিখা দেখলো। এক ফোঁটা জল যেন নিচে গড়িয়ে পরলো। একটা হাতের ছাপের মুল্যও এত!

রৌদ্রূপ কাগজটা নিয়েই আবার উঠে দাঁড়ালো। তারা চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হয়ে বসলো। রৌদ্রূপ কাগজটা নিয়েই যেন কোথায় মিলিয়ে গেল। কে জানে কোথায় হারিয়েছে!

তারা সংগোপনে বারান্দায় গিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। এই চাঁদকে কখনোই সে ভুলবে না। সুখ দুঃখের একমাত্র সঙ্গী এই চাঁদ। কে আছে আর? পৃথিবীতে এত মানুষ! কিন্তু সুখ দুঃখের গল্প করার মতো মানুষের খুব অভাব। অবশ্য এখানেও মানুষেরই দোষ। একটা মানুষ তাঁর প্রিয় কিংবা খুব আপন কারো সঙ্গ ছাড়া সুখ দুঃখের কথা বলে না। মানবজাতিই কেমন যেন! খুব অদ্ভুত! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব বলেই হয়তো মানুষ এতটা অদ্ভুত আর রহস্যময়।

তারা পাহাড়সম ভারী চোখ-দুটো একবার বন্ধ করলো। তারপর আবার পিটপিট করে তাকালো।চোখ বন্ধ করলে এখন আর ছোটবেলার মতো রঙিন জল্পনা-কল্পনা গুলো আর চোখে ভাসে না। শুধু ভাসে কারো গভীর রাতের আত্নচিৎকার। কারো পৈশাচিক আচরন মন্ডলী।

বারান্দার দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে তারা কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো। আলতো গলায় বলে উঠলো,
–আসুন!”

রৌদ্রূপ চায়ের ট্রে নিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করলো। এই নিশুতি রাতে চা খাওয়ার একটা সঙ্গী হলে মন্দ হয় না। তারা ঝাপসা চোখে চায়ের কাপগুলো দেখলো।চোখ মুছে রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
–এত গভীর রাতে চা কে খাবে?”

রৌদ্রূপ তারার দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো,
— আমি!”

তারা বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে বললো,
–আর আরেক কাপ? ”

রৌদ্রূপ কোনো দিকে তোয়াক্কা না করে বললো,
— আমিই!”

তারা রৌদ্রূপের অঙ্গভঙ্গি দেখে মৃদু হাসলো। রৌদ্রূপ মুচকি হেসে তারার দিকে চায়ের আরেকটা কাপ এগিয়ে দিলো। তারা নিবৃত্তে চায়ের কাপটা রৌদ্রূপের হাত থেকে নিলো। রৌদ্রূপ চায়ে চুমুক দিয়েই আহ! বলে একটা আওয়াজ করলো। চা জিনিসটা আসলেই শান্তির। শরীরের ক্লান্তি, ব্যাথা, বেদনা সব দূর করে।

তারা অসারতা এড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। তবে রৌদ্রূপের মতো আওয়াজ করলো না মুখ দিয়ে। চায়ে চুমুক দিতেই তারার চোখ থেকে নিভৃতেই জল গড়িয়ে পরলো। রৌদ্রূপ চায়ের কাপটা পাশে রেখে তারার সামনে এসে দাঁড়ালো। তারার নরম গালগুলোতে দু”হাত ছুঁইয়ে দিলো। তারা অচিরেই বলে উঠলো,
— রৌদ্রূপ, সৃষ্টিকর্তা কেন আমাকে এত দুঃখ দিলেন? খুব বেশি কী পাপ করে ফেলেছিলাম?”

রৌদ্রূপ তাচ্ছিল্যতার সূরে হাসলো। হেসে তারাকে বললো,
— সৃষ্টিকর্তা তোমার পরীক্ষা নিচ্ছেন। আর আমি এটাও জানি যে, খুব শীগ্রই খুব এই পরীক্ষাতে সফল হয়ে ফিরে আসবে।”

তারা বিড়বিড় করে বললো,
–পরীক্ষার আগেই যেন আমার মৃত্যু হয় রৌদ্রূপ। এই ধ্বংসাত্মক পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে থাকতে ক্লান্ত আমি!”

রৌদ্রূপ প্রগাঢ় অনুভূতি নিয়ে বললো,
–তুমি চেষ্টা করছো বা বলেই বারবার হেরে যাচ্ছো। সকল সম্মানের উর্ধে নারী জাতি। নারী জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে তুমি এত সহজেই হার মেনে নিচ্ছো? এভাবে হার মেনে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে বেড়ানো কী তোমাকে মানায় তারা? মনে রেখো তুমিই সকলের আগে। তোমার তুলনা একমাত্র তুমিই! তুমিই অনন্য;তুমিই সেরা!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here