#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ৩
রৌদ্রূপের সেদিনও আর অফিস যাওয়া হলো না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে খুব দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাই বলা যায়, রৌদ্রূপের আরেকটা দিনও অফিস কামাই গেল। সেদিন বাইরে থেকে নিজের জন্য আর তারার জন্য খাবার এনেছিল রৌদ্রূপ। সেটাতেই দুজনের বেশ হয়ে গেছে। আলাদা করে আর রান্নাবান্নার ঝামেলা পোহাতে হইনি।
রৌদ্রূপ সকালে ঘুম থেকে উঠলো এলার্মের শব্দে। রৌদ্রূপ ঘুম থেকে ওঠার কিছুক্ষন পরে তারারও ঘুম ভেঙে গেল। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বিছানা থেকে উঠলো তারা। তারা ঝাপসা চোখে খেয়াল করলো রৌদ্রূপ ড্রেসিং টেবিলের সামনে রেডি হচ্ছে। তারা চুলের খোঁপা বেঁধেই ওয়াশরুমে চলে গেল।
তারা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছলো। রৌদ্রূপ হাত ঘড়ি পরতে পরতে তারাকে বললো,
–রান্না করতে পারো?
তারা কাচুমাচু হয়ে বললো,
–জি না।
রৌদ্রূপ হালকা হেসে বললো,
–আমি শিখিয়ে দেবো তোমাকে। আমার থেকে রান্না শেখার পর তোমাকেই কিন্তু রান্না করতে হবে। তখন আবার আলসেমি করতে পারবে না।
তারা নিশ্চুপ ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। রৌদ্রূপ তারার দিকে একবার তাকালো। এরপর নিজের কাজে আবার মন দিলো।
তারা ব্যাগ থেকে নিজের জিনিস-পত্র বের করতে শুরু করলো। নিজের হাতে একটা শাড়ি নিয়ে রৌদ্রূপকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— আজকেও কী আমাকে শাড়ি পরতে হবে?
রৌদ্রূপ তারার কথা শুনে অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললো,
–তোমাকে শাড়ি পরতে কে বলেছে?
তারা নিজের হাতে থাকা শাড়িটাতে হালকা-ভাবে হাত বুলিয়ে বললো,
–বিয়ের সময় আত্নীয় স্বজনরা বলেছিলেন যে, বিয়ের পর বেশ কিছুদিন না কি শাড়ি পরতে হয়। সেজন্যই আপনাকে বললাম।
রৌদ্রূপ তারার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললো,
–নিজের ইচ্ছেটাকেও একটু প্রাধান্য দিতে শেখো। তুমি তোমার ইচ্ছেকে সম্মান না দিলে আর কে দেবে বলো?
তারা নির্বিকার ভঙ্গিতে রৌদ্রূপের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। রৌদ্রূপের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে, নিজের হাতে থাকা শাড়িটা সেখানেই রেখে দিলো। ব্যাগ থেকে একটা সেলোয়ার-কামিজ বের করে হাতে গুঁজে নিলো। এরপর টাওয়ালটা নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।
রৌদ্রূপ বাসার গেটটা হালকা করে লাগিয়ে দিয়ে বাইরে বের হলো। তারার জন্য দুপুরের খাবার কিনে আবার বাড়িতে ফেরত এলো। খাবারটা টেবিলে রেখে আবার রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমের সামনে গিয়ে রুমের দরজায় হাত উল্টো পিঠর নখ দিয়ে করাঘাত করলো। তারা শব্দ করে বললো,
–জি আসুন!
রৌদ্রূপ রুমে ঢুকেই তারাকে বললো,
–টেবিলে তোমার দুপুরের খাবার রাখা আছে। সময়মতো খেয়ে নিও। নিজের খেয়াল রেখো। আমি বের হচ্ছি এখন। নাস্তাও রাখা আছে টেবিলে খেয়ে নিও। এখন গেটটা লাগিয়ে দাও।
রৌদ্রূপ তারাকে কথাগুলো বলে,এবার সামনের দিকে সোজা হাঁটা শুরু করলো। তারাও রৌদ্রূপের পিছু পিছু হাঁটছিল। রৌদ্রূপ বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতেই নাস্তার টেবিলে বসে নাস্তা করলো তারা। ফ্ল্যাটের প্রতিটা কোনা ঘুরে ঘুরে দেখলো। পুরো বাসা ভর্তি দেয়ালে ফ্রেম করা ছবি টানানো। খুব নিখুঁতভাবে প্রতিটা ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যেন একেবারে স্বচ্ছ একেবারে জীবন্ত!
সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ রৌদ্রূপ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এলো। কলিংবেলার শব্দ পেতেই তারা গেট খুলে দিলো। রৌদ্রূপ দু’হাত ভর্তি বাজারের ব্যাগ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। বাজারের ব্যাগগুলো রান্নাঘরে রেখে রৌদ্রূপ রুমে ঢুকলো। তারা আড়চোখে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। রৌদ্রূপ শার্টটা খুলে গায়ে টিশার্ট জড়ালো। রৌদ্রূপের উত্তপ্ত শরীরে যেন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। রৌদ্রূপ টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো। ওয়াশরুমে ঢুকে ঝর্নাটা অন করে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো রৌদ্রূপ। শরীরটা এবার একটু ঠান্ডা লাগছে। টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো রৌদ্রূপ। তারা রৌদ্রূপকে দেখে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রৌদ্রূপ টাওয়ালটা বারান্দায় শুকাতে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে অগ্রোসর হলো। তারা রৌদ্রূপের পিছু পিছু ছুটলো।
ছুরি দিয়ে লেবু কাটলো রৌদ্রূপ। এরপর কড়কড়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে লেবুর সরবত বানালো। সরবত দুটো গ্লাসে ঢেলে তারার দিকে একটা গ্লাস বাড়িয়ে দিলো। তারা হাত বাড়িয়ে রৌদ্রূপের হাত থেকে সরবতের গ্লাসটা নিলো। রৌদ্রূপ এবার নিজের গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তারা লেবুর সরবতের গ্লাসে ছোট একটা চুমুক দিলো। চুমুক দিয়েই চোখ বন্ধ করলো তারা। এমন তীব্র গরমেের দিনে ঠান্ডা সরবত পেয়ে শুকরিয়া আদায় করলো তারা।
রৌদ্রূপ বাজারের ব্যাগ থেকে এক-এক করে সব বাজার বের করলো। একা হাতে সব সবজি কুটাবাছা করে রান্না করে বসালো। তারা নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ছেলে মানুষও এত সুন্দর করে রান্না করতে পারে? অতি উত্তেজনায় তারা রৌদ্রূপকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–এত সুন্দর করে রান্না কার কাছ থেকে শিখেছেন?
রৌদ্রূপ হালকা হেসে বললো,
— নিজ ইচ্ছায় শিখিনি। প্রয়োজনের খাতিরে সবই করতে হয়। রান্নাটাও সেভাবেই শেখা হয়েছে। এখানে তো আমি একাই থাকতাম। রান্নাবান্না করে দেওয়ার মতো কোনো মানুষ ছিল না। বাধ্য হয়ে নিজেই একটু একটু করে শিখেছি।
তারা রৌদ্রূপের কথা শুনে মুখে কিছু বললো না। আবারও রৌদ্রূপের রান্না দেখার দিকে মনোযোগ দিলো।
মাঝরাতে বিছানায় নিজেকে একা আবিষ্কার করলো রৌদ্রূপ। তারা কোথায় গেল? রৌদ্রূপ আতংকিত দৃষ্টিতে চারপাশে তাকালো। এক লাফে বিছানা থেকে নেমে তারাকে খুঁজতে শুরু করলো। কিন্তু, তারা কোথাও নেই! পাশের রুমে বারান্দার দরজাটা হালকা করে খোলা। রৌদ্রূপ ধীর পায়ে বারান্দার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
তারা জানালার গ্রিলের মাথা ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে বিরবির করে কী যেন বলছে!রৌদ্রূপ দরজায় জোরে একটা আওয়াজ করলো। আওয়াজ পেয়ে তারা চমকে উঠলো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছলো। রৌদ্রূপ উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তারার দিকে তাকালো। রৌদ্রূপ বড় বড় পা ফেলে বারান্দায় প্রবেশ করলো। আকাশে বিশাল একটা চাঁদ ভেসে রয়েছে। রৌদ্রূপ বারান্দায় প্রবেশ করেই তারাকে বললো,
এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে আছো? ঘুমাবে না?
তারা এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে বললো,
–জি, এখনি যাচ্ছি।
তারা চলে যেতে চাইলে রৌদ্রূপ পেছন থেকে তারার হাত ধরে ফেললো। তারা আতংকিত ভাবে রৌদ্রূপের দিকে তাকালো। রৌদ্রূপ শান্ত দৃষ্টিতে বললো,
–বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে? রেখে আসবো তোমাকে তোমার বাড়িতে কয়দিনের জন্য?
তারা রৌদ্রূপের কথা শুনে পিলে চমকে উঠলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
–নাহ! আমার কিছু হয়নি! আমি কোথাও যাবো না।
রৌদ্রূপের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে চলে গেল তারা। রৌদ্রূপ হতভম্ব হয়ে তারাকে দেখলো। এক একসময় একেক রকম আচরন মেয়েটার! এত অদ্ভুত কেন মেয়েটা?
সকালে রৌদ্রূপ অফিসের জন্য বের হওয়ার সময় তারাকে ঘুম থেকে জাগালো। তারা ঘুম থেকে উঠে গেট লাগিয়ে এসে গোসল সেরে নিলো। তারা ধীর পায়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মুখখানা রক্তরাঙা! চোখ মনি স্থীর! তারা আয়নার সামনে গিয়ে নিরব কন্ঠে বললো,
–এই দাগ কী কখনো মুছবে না?
আয়না একটি জড় বস্তু। তাই,আয়নার কাছে তারার প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। তারা আয়নার কাছে তার প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে, বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। বড় একটা কাঠের চেয়াল নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল তারা। বিছানার ওপরে কাঠের চেয়ারটা রেখে,চেয়ারের ওপরে উঠে ফ্যানের মধ্যে একটা রশি বাঁধলো তারা। রশির ভেতরে নিজের গলাটাকে খুব সাবধানে ঢুকিয়ে দিলো। আলতো ভাবে চেয়ারটাকে ফেলে দিলো। তারার মুহুর্তেই দম বন্ধ হয়ে এলো। বাঁচার জন্য ছটফট করতে শুরু করলো তারা। অনেকক্ষন ধস্তাধস্তির পর নিচে আছরে পরলো সে। নাহ! এবারও প্রানে বেঁচে গেছে তারা। কিছু হয়নি তাঁর!
সন্ধ্যাবেলা রৌদ্রূপ অফিস থেকে ফিরেই আড়চোখে তারার গলার দিকটা খেয়াল করলো। লাল হয়ে আছে গলার পাশটা। মনে হচ্ছে কেউ ফাঁস দিয়ে ধরেছে। রৌদ্রূপ তারার গলায় হাত দিয়ে বললো,
–কী হয়েছে এখানে? জায়গাটা এত লাল হয়ে আছে যে?
তারা ইতস্তত ভাবে বললো,
— গলায় ওরনা জড়িয়ে বিকেলে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। তাই হয়তো এমনটা হয়েছে।
রৌদ্রূপের তারার কথা বিন্দুমাত্র বিশ্বাস হলো না। ওরনার দাগ আর রশির দাগ সম্পূর্ণ আলাদা। গলায় ফাঁস দিয়ে কেউ মারা গেলে এভাবেই দাগ বসে যায় রৌদ্রূপ তারাকে মুখে কিছু বললো না। তবে মনের দিক থেকে সন্দেহের প্রথম তালিকায় তারাকে রাখলো। তারার কাজকর্ম কথাবার্তা সবটাই কেমন যেন অস্বাভাবিক। প্রথম প্রথম রৌদ্রূপের মনে হতো। হয়তো, তারা সবকিছু মানিয়ে গুছিয়ে নিতে পারছে না।তাই, এমন আচরণ করছে। কিন্তু,এখন ঘটনার মোড় অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে। কী হচ্ছে আসলে? কেমন একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে রৌদ্রূপ।
চলবে…