চন্দ্রবিলাসীনি পর্ব ১৫

0
265

#চন্দ্রবিলাসীনি
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১৫

সকালের ক্লাসটা শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আজ বেশ দেরি হয়ে গেল তারার। দুপুরবেলা স্নান সেরে জামাকাপড়গুলোকে ছাঁদে শুকাতে দিতে গেল সে। হাতে ছোট্ট একটা বালতি। তাতেই টুপলি করে রাখা ভেজা জামাকাপড়।

ছাঁদের দু’ধারে বাঁশ দিয়ে আঁটকে রাখা রশিগুলোতে কাপড় মেলে দিলো তারা। রোজ রোজ সব কাজ রৌদ্রূপের আশায় ফেলে রাখাটা অনুচিত। সারাদিন কাজকর্ম করে বাড়ি ফিরে কারোরই এসব করতে ভালো লাগে না।

জামাকাপড়গুলো ছাঁদে ঠিকঠাক ভাবে শুকাতে দিয়ে।শুন্য বালতি হাতে তারা ছাঁদের সিঁড়ি যখনই পা দিলো;তখনই শুনতে পেল, নিচতলার ফ্ল্যাটের কয়েকজন কী কী যেন বলাবলি করছে। তারা একবার সিদ্ধান্ত নিলো তাদের সঙ্গে গিয়ে একটু আলাপ জমাবে। দু’পা এগিয়েও গেল। কিন্তু পরমুহূর্তেই কেন যেন আর কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে পরলো। ভালো লাগে না এখন আর মানুষের কোলাহলে যেতে। একা একা থাকাই শ্রেয়। একাকিত্ব আর যাই করুক;কখনো মানুষের মতো কষ্ট দেয় না।

দুপুরে খেয়ে দেয়ে তারা রেডি হলো। ব্যাগ গুছিয়ে বের হলো। রৌদ্রূপ নিতে এসেছে তাঁকে। নতুন কোচিংয়ে নিয়ে যাবে আজকে। বাড়ির নিচেই রৌদ্রূপ দাঁড়িয়ে আছে। তারাকে বের হতে দেখে রৌদ্রূপ এগিয়ে এলো। তারার সন্নিকটে এসে তারার কাঁধ থেকে শক্ত ব্যাগটা খুলে নিয়ে নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো। তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। ভাবুক কন্ঠে বললো,
— আগে কেমন ছিলেন তা জানি না। কিন্তু, বিয়ের পর থেকে দেখে আসছি। আপনি খুব অফিস কামাই দিচ্ছেন। নাহলে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই বাড়ি চলে আসছেন। এটা কিন্তু মোটেও ঠিক না। আমাকে ঠিকানা বলে দিলেই পারতেন। আমি একা একাই চলে যেতাম।”

রৌদ্রূপ শীতল কণ্ঠে বললো,
— আমি অফিস কামাই নিজের জন্য দেইনি।তোমার জন্যই দিয়েছি। আজ অবশ্য অফিস কামাই দেইনি।”

তারা উৎকন্ঠা মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
— তাহলে?”

রৌদ্রূপ হেয়ালি দৃষ্টিতে তারার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আমার দুপুরে ব্রেকটাইম থাকে। তখন সবাই লাঞ্চ করি আরকি। আজ ব্রেক টাইমে আমি বের হইনি। অফিসের কাজেই ব্যস্ত ছিলাম। তাই, এই বিকালে আমার ব্রেক টাইম!”

তারা আশ্চর্য হয়ে বললো,
— ব্রেকটাইমের কথা বলে যে, বাইরে বের হলেন। খেয়েছেন কিছু? না কি বের হয়ে সোজা এখানে চলে এসেছেন?”

রৌদ্রূপ হেসে বললো,
— না না! সেরকম না। আমি খেয়েছি হোটেলে।”

তারা রৌদ্রূপের কথা শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এখন যদি রৌদ্রূপ বলতো সে কিছু খায়নি। তবে, তাঁর খুবই কষ্ট হতো। শুধু শুধু তাঁর জন্য মানুষটার কত কষ্ট!

রৌদ্রূপ তারার দিকে তাকিয়ে বললো,
— এই কয়েক মাস পরেই শুনেছি একটা প্রমোশন হওয়ার কথা। তখন হয়তো আরো তাড়াতাড়ি ছুটে হয়ে যাবে। এই আনুমানিক বিকাল সাড়ে পাঁচটা ছয়টায়!”

তারার চোখেমুখে কিছুটা খুশির ঝলকানি দেখা দিলো। হাসোজ্জল ভঙ্গিতে বললো,
— হুহ! আপনার তো প্রমোশন আর প্রমোশন! সরকারি চাকরি বলে কথা!”

রৌদ্রূপ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
— দেরি আছে সেসবের। খুব বেশিদিন হয়নি আমি জয়েন করেছি। আমার থেকে অনেক সিনিয়র স্যাররা আছেন। কোথায় আমি আর কোথায় ওনারা! সারাদিন টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে। ওনাদের তো খুব শান্তি! ”

তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে অপ্রসন্ন গলায় বললো,
— একটা গাছ একেবারে গাছ হয়ে যায় না। ছোট্ট চারা থেকে বৃষ্টি পেতে পেতে তারপর গাছ হয়। আপনি তো এখনও জুনিয়র। শ্রম কখনো বৃথা যায় না। প্রমোশন পেতে পেতে একসময় আপনিও সিনিয়রদের তালিকাতে পরবেন। হুট করে কী কেউ বড় হয়ে যায়? যায় না তো! ছোট থেকেই তো একটা মানুষ বড় হয়।”

রৌদ্রূপ পরিস্ফুট দৃষ্টিতে তারার দিকে তাকালো। কী সুন্দর শান্তনার ভাষা! বিষ্ময়পূর্বক কন্ঠে রৌদ্রূপ বললো,
— তুমিও তো বড় হয়ে যাচ্ছো দিন দিন! জ্ঞানী মানুষ! আমার পারিবারিক মোটিভেশনাল টিচার!”

তারা রৌদ্রূপের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
— জ্ঞানী মানুষের সঙ্গে থেকে জ্ঞানী না হয়ে উপায় কী? আপনার সঙ্গে থেকে থেকে তবুও মগজে একটুখানি বুদ্ধির উদয় হয়েছে। নাহলে, আমি তো পুরো ক্যাবলাকান্তী দাস!”

কোচিং থেকে বের হয়েই তারা ক্লান্ত দৃষ্টিতে হাঁটা ধরলো। বাড়ি ফেরার শর্টকার্ট রাস্তা রৌদ্রূপ চিনিয়ে দিয়েছে। তারা রৌদ্রূপের কথা অনুযায়ী হাঁটা ধরলো। মাঝপথে হঠাৎ তারা দেখলো একটি বাচ্চা তাঁর বাবা মায়ের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। তারার চক্ষুযুগলে অতর্কিতভাবে অশ্রু বিন্দু হানা দিলো। ঝাপসা দৃষ্টিতে তারা দূরপানে তাকিয়ে বাচ্চার সাথে বাবা মায়ের খুনসুটির মূহুর্তগুলো পর্যবেক্ষন করলো। কাঁপা কাঁপা পায়ে আবারও পথ চলতে শুরু করলো। ভারাক্রান্ত মনে তারা নিজেকে প্রশ্ন করলো।তাঁর জীবনে এমন সুখানুভূতি এলো না কেন? বাবা মায়ের আঙুল ধরে হাঁটার তীব্র আকাঙ্খায় তারা বহুবার অপেক্ষা করেছে। কিন্তু, কেউ যে আসেনি! কেউ না! নিজের শুন্য হাতগুলো একবার নিজেই ছুঁয়ে দেখলো সে। বুকটা এত খালি খালি লাগছে কেন? তাঁর হৃদয়ের একপাশে একটা গভীর খাঁদ রয়েছে! সেখানে রয়েছে শুধু শুন্যতা। আর না পাওয়া কিছু আকাঙ্খার অভিব্যক্তি।

নিদ্রায় যাওয়ার আগে,বারান্দায় এসে থেমে থেমে বয়ে যাওয়া বাতাসে গা ডোবালো রৌদ্রূপ। তারা অকস্মাৎ রৌদ্রূপের পাশ ঘেঁষে বসলো। রৌদ্রূপ নির্লিপ্ত চাহনিতে তারার দিকে তাকালো। তারার স্থির দৃষ্টি রৌদ্রূপকে প্রবলভাবে ব্যাথিত করলো। তারা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
— আমি আমার জীবনে আমার ছোট ছোট আঙুলগুলো ধরার জন্য একটা মানুষ পেলাম না কেন রৌদ্রূপ? আমায় কেন কেউ ভালোবাসলো না? আমি কী ভালোবাসার অযোগ্য? আমার কেউ নেই কেন? আমার মূল্য কারো কাছে নেই। কেউ ভালোবাসলো না আমায়! আমি একাই রয়ে গেলাম! বুকের মাঝখানটায় কেন যেন খুব খালি খালি লাগছে। শুন্যতা আমায় এভাবে গ্রাস করলো!”

তারার নিরাশ চাহনি রৌদ্রূপকে সেই মুহূর্তেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিলো। বিনয়ের দৃষ্টিতে রৌদ্রূপ তারার দিকে তাকিয়ে বললো,
— না ধরুক কেউ তোমার হাত! আমি তো আছি;আমি ধরবো! পুরো পৃথিবীর কাছে তোমার মূল্য কী সেটা আমি জানি না। তবে এটুকু মনে রেখো। আমার কাছে তুমি ধন-রত্নের ন্যায় অমূল্যসম্পদ। ”

রৌদ্রূপ তারার হাতটা শক্ত করে নিজের হাতের আওতায় নিয়ে গেল। হাতের আঙুলগুলো নরম পরশ এঁকে দিয়ে বললো,
— এই যে ধরলাম তোমার হাত। মৃত্যুর আগ অবধি আর ছাড়ছি না ”

তারা রৌদ্রূপের হাতটা শক্ত করে ধরলো। আকুলতা সম্ভাব্য কন্ঠে বললো,
— আমার প্রতি আপনার আস্থা, ভরসা কখনো যদি কমে যায়? তখন আমি কী করবো রৌদ্রূপ?”

রৌদ্রূপ তারার দিকে ব্যাকুল দৃষ্টিপাত করে বললো,
–তোমাকে আমি সম্মান করি দুইভাবে তারা। এক নারী হিসেবে। দুই আমার জীবনসঙ্গিনী হিসেবে। জীবনে যা কিছুই হোক না কেন। তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস, আস্থা, সম্মান এসব কখনোই কমবে না।”

তারা রৌদ্রূপের দিকে অনিমেষনেত্রে তাকিয়ে রইলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
— সত্যি রৌদ্রূপ? আপনি সত্যিই সবসময় আমার ওপরে এভাবে বিশ্বাস রাখবেন? এভাবেই সম্মান করবেন?”

রৌদ্রূপ তারার কথা শুনে প্রগাঢ় হাসলো। নিবিড় চাহনিতে মাদকতা ছড়িয়ে বললো,
— অতি কষ্টেও কেউ তোমার ন্যায় গুপ্তধনের সন্ধান পায় না। আমি অতি সহজে পেয়েছি বলে কী এর অমর্যাদা করবো?”

তারা চোখ থেকে জল উপচে পরলো। ফোঁটা ফোঁটা তপ্ত জলের আভাসে চোখজোড়া বহুমূল্যের হিরার ন্যায় চকচক করে উঠলো।তারা সর্বাঙ্গে অদ্ভুত সুখ অনুভব করলো। বিন্দু বিন্দু পানির কনা ছিল সেই সুখের প্রতীক মাত্র। রৌদ্রূপের বাহুডোরে নিজেকে দেখতে কেন যেন খুব ইচ্ছে করছে তারার। তারা রৌদ্রূপের অন্তঃস্থলে মাথা রাখলো। পৃথিবীর সর্বসুখ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাঁকে। তারা একবার মাথা উঁচু করে রৌদ্রূপের মুখপানে চাইলো। রৌদ্রূপের চোখদুটো বন্ধ। শুধু দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে তাঁর চাঁদকে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here