গোপনে
৩
#রিমা_বিশ্বাস
কফি শপে প্রায় আধ ঘন্টা হল এসে বসে অরিত্র।ওলির পাত্তা নেই।ঘুরে ফিরে ঘড়ি দেখে দেখে সময় কাটছে।দু কাপ কফিও শেষ হয়েছে।এখন মনে হচ্ছে মেয়েটা সেদিনের রিভেঞ্জ নিচ্ছে না তো?একবার ফোন করবে কিনা ভেবেও করতে মন সায় দিল না।কেন যেন মনে হল আরেকটু দেখা যাক..খালি সময়টা কাটানো সব চাইতে বিরক্তির আর একঘেয়ে। নিজেকে মানুষ সব চাইতে ভালবাসে অথচ নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে গেলে মনে হয় সময় বুঝি থেমেই গেল।এখন কফি শপের বাকি লোকজনের মুখ দেখা ছাড়া বা তাদের লক্ষ্য করা ছাড়া আর তো কিছু করার নেই।মোবাইল বের করে ফেসবুক অবশ্য ঘাটাই যায়।এই ফাঁকে রিমা বিশ্বাসের একটা গল্প পড়া যায়।তবে ওর গল্পে রিভেঞ্জ ব্যাপারটা থাকে না।এইটেই বিরক্তিকর। তার চাইতে একটা মুভি দেখলে কেমন হয় ইউটিউবে?
অরিত্র ফেসবুক থেকে ইউটিউবে যেতে গিয়ে থামল।ফেসবুকের সার্চে দিল শ্রুতি আগরওয়াল।সারি সারি ছবির একেবারে গোড়ায় জ্বলজ্বল করছে গত সন্ধের মেয়েটা।প্রোফাইলে অরিত্র ঢুকতে যাবে তখনই গলা খাঁকারির আওয়াজে অরিত্র সামান্য চমকাল।চোখ তুলে তাকাতে সামনের উজ্জ্বল মুখটা বুকে জোর ধাক্কা দিল।অরিত্র উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল সেই কারণে অন্যমনস্কতায় হাত থেকে ফোনটা খসে পড়ল।
গোলাপি সালোয়ার কামিজ পরা ওলি ঝুঁকে ফোনটা কুড়িয়ে হাতে দিল অরিত্রর….”সরি!আমার দেরি হল আসতে।আপনি অনেকক্ষণ ওয়েট করছেন?”
মাথা নেড়ে অরিত্র বলল…. “একটা ভুল হল!”
…”কি বলুন তো?”
…”দ্বিতীয় বার!”
…”সরি…”
…”কাল রাত্রে কিন্তু কথা হয়েছিল আপনি আজ্ঞে বাবু আর দেবী বর্জিত হবে!”
এবার খিলখিল করে হেসে ফেলল ওলি।অরিত্রর কানে আবার গত রাত্রের সারেঙ্গী বেজে উঠল।কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ওর দিকে।
ওলি চেয়ার টেনে বসে পড়ে বলল…”তুমি মনে হয় কথা বলতে বেশ পটু!”
…”ইশিকাদি কিন্তু অন্য কথা বলে!”
…”কি বলে?”
…”সেটা নয় নাই বললাম! “অরিত্র চিলতে হাসল।
…”তবে কি বলবে শুনি?”
…”আপাতত যেটা শোনার ইচ্ছেয় আছি সেটা হল তোমার গান!”
ওলির মুখটা রাঙা হল।তাচ্ছিল্যতায় বলল…”দূর এমন কিছু ভালো নয়।ঐ ভালোলাগা আর কি!”
…”ভালোলাগাকে লক্ষে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ কিন্তু খুব কম লোকের মেলে!”
…”বলতে পার।তোমার কিছু কি তেমন শখ আছে?”
…”নাহ।একেবারে নিরেট এ ব্যাপারে! বলতে গেলে একমুখী ভাবে এগিয়েছি।শুধু পড়াশোনা আর ক্যরিয়ার!”
…”আর প্রেম?”
প্রশ্নটায় সামান্য টাল খেল অরিত্র। সেটা বুঝতে পেরে ওলি বলল…”একটু বেশি পারসোনাল হয়ে গেলাম কি?”
…”না না একেবারেই নয়।আমার জীবনে প্রেম….নাহ.. আসেনি।তবে..”অরিত্র থামল।
ওলি ওর দিকে খানিক্ষন চেয়ে থেকে বলল…”আমি বলি?”
একটু ইতস্ততায় অরিত্র থেমে থেমে বলল…”হ্যাঁ.. ব লো..”
…”আমি কিন্তু সদ্য একটা রিলেশন থেকে বেরিয়ে এসেছি।জানি না ভুলতে পারব কি না বাট স্টিল আম ট্রাইং টু ফরগেট অল বিটার এক্সপেরিয়েন্সস অ্যান্ড পেনফুল মেমরিজ…”
….”তবে তো আমার মনে হয় সে প্রসঙ্গ একেবারে ভুলে যাওয়াই ভালো! “
…”ভোলা যায় না জান।বারবার ঘুরে ফিরে চলে আসে!ইনফ্যাক্ট আমার মনে হয় ও বিষয়ে কথা বললে হয়তো মনটা হালকা লাগতে পারে!”
…”তবে বলব বল।গোড়ার থেকে! “
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওলি বলতে শুরু করল।অরিত্র শুনে গেছে।
এখন অরিত্র জানলার দিকে চেয়ে বসে। কফি শপ থেকে ফিরেছে প্রায় দু ঘন্টা হল।মা বারবার তাড়া দিচ্ছে স্নানে যাওয়ার জন্য। মনে করিয়ে দিচ্ছে আজ বিকেলে যাওয়ার কথা।অরিত্রর কিছুই ভালো লাগছিল না।বলতে গেলে মনটা চোট খেয়ে গুটিয়ে পাকিয়ে গেছে।কেমন যেন মনে হচ্ছে প্রেম রোম্যান্স একে অপরের প্রতি মোহ সব সার্থের বা বলা যায় শুধুই চাহিদার।এর বাইরে কিছু নেই।বা কিছু হয় না।যা হয় সবই অলীক….
ওলি বলল ওর যার সঙ্গে রিলেশন ছিল সে ওলির কাছ থেকে শুধু টাকা আর কানেকশনের জন্য প্রেমের অভিনয় করে গেছে।ছেলেটি একই কলেজে পড়ত।তারও গানের শখ। গানটাকে পেশা হিসেবেই নিতে চায় কিন্তু সে রকম প্রতিভা না থাকায় ভালো জায়গায় প্রশিক্ষণ নিতে ঢুকতে পারছিল না।ওলির প্রতিভা আছে তাছাড়া ওর বাবা প্রফেসর হওয়ায় মিউজিকের প্রফেসারদেরর সঙ্গে ভালো চেনা জানা। ছেলেটি একরকম ওলির উপর জোর দিতে শুরু করে ওর বাবার থ্রুতে যাতে ছেলেটি একটা প্লেস পেয়ে যায়।ওলির বাবা এ ব্যাপারে সৎ।তিনি মেয়ের ব্যাপারেই কাউকে কিছু বলবেন না সেখানে এমন একজনের বলার প্রশ্নই আসে না যার যোগ্যতা নেই।ছেলেটি ওলিকে টাকার জন্যও যখন তখন জোর করত।যদিও সে ভঙ্গিতে তীব্রতার চাইতে বিনিতভাবটাই বেশি থাকত।মুখ শুকনো করে হয়তো বলত….”হাতে একদম টাকা নেই।বাবার কাছে কত চাইব বল?এদিকে একটা কম্পিটিশনের জন্য বলছে পাঁচ হাজার ডিপোজিট করতে।এখানে চান্স পেলে আমার লাক বদলাতে পারত!”
ওলি একটাবার এ নিয়ে না ভেবে কোনও চিন্তা না করেই টাকা দিয়ে দিয়েছে।
কখনো সে বলেছে পনেরো হাজার ধার দিতে পারবি? টাকাটা পেলে মেঘ মল্লারে এডমিশন নেব।মেঘ মল্লার ওদের ওখানকার বিখ্যাত মিউজিক ইন্সটিটিউট। ওখান থেকে অনেকে চান্স পেয়েছে।টাকার পরিমাণ বেশি হলেও অনেক কষ্টে বাড়ির লোককে মিথ্যে বলে সে টাকা জোগাড় করেছে ওলি।শুধু সেই ছেলেটির কথা ভেবে যাকে ও ভালোবেসেছিল।অথচ নজরুল জয়ন্তীতে যখন ওলি পারফর্ম করতে উঠল ওদের ওখানকার একটা ক্লাবের অরগানাইজেশনে।শহরের নামি অডিটোরিয়ামে।যেখানে প্রায় শ খানেক লোকের সঙ্গে উপস্থিত ছিল শহরের নামি ডাক্তার কলেজের প্রফেসর ওলির বাবার বন্ধুরা।আরও নামি দামি অনেকে।ছিল ওলির আইডিয়াল বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী গীতশ্রী চক্রবর্তী। সেখানে ওলির পারফর্মেন্সের সময় হলের পিছন থেকে একদল চ্যাংড়া ছেলে সুর করে কুকুরের কান্নার আওয়াজ করে গেল।কেউ কেউ বলল… “থার্ড ক্লাস পারফর্মেন্স। এরা চান্স পায় কি করে?”
…”নেপোটিজম…”সুর করে বলল কেউ।
…”এ গাইছে না মরা কান্না কাঁদছে রে..”
ওদের কাউকে ধরা যায়নি।কিন্তু সে সময় ওলির আত্মবিশ্বাস লড়বড়ে হয়ের গিয়েছিল।স্টেজ ছেড়ে পালানোটাই মনে হয়েছিল সব চাইতে নিরাপদ।সেদিনটা মনে পড়ল ওলি আজও ঘেমে যায়।অথচ সে স্মৃতি একটা সময় হারানো আত্মবিশ্বাস ফেরাল যখন সত্য জানতে পারল ওলি।অথচ সেই সত্য ভেঙে খানখান করে দিল প্রেম ভালবাসার গোটা গোটা অনুভূতি গুলো..
ওলি যেদিন একটা চাকরির প্রস্তাব নিয়ে হুট করে হাজির হল তার বাড়ি।ভেবেছিল কতই না খুশি হবে সে।সব সময় টাকায় টানাটানির কথা বলত ছেলেটা বলত বাবার কাছে হাত পাততে লজ্জা করে কিন্তু ওলিকে এত কাছের মনে হয় যে ওলির কাছে হাত পাততে তার কোনও সঙ্কোচ নেই। ওলি একটা মিউজিক স্কুলে ছোট ছেলে মেয়েদের গান শেখানোর চাকরির অফারটা নিজে না নিয়ে ওকে দিতে চেয়েছিল।আর কি দেখল?
দেখল উগ্র প্রেমে উন্মত্ত সেই যুবক তার প্রেমিকাকে নিজের বাহুতে আবদ্ধ রেখে বলে চলেছে তার গর্বে ভরা সুকীর্তি।বলছে…”ভালো আমি তোকেই বাসি সুনন্দা।ঐ ভোতা মুখের মেয়েটাকে নয়।ওর বাপকে শিক্ষা দিতে ফায়দা লুটছি।লোকটা চাইলে আমাকে রেকমেন্ড করতেই পারে কিন্তু মাল নিজের মেয়ে ছাড়া কিছু বোঝে না।আমিও আচ্ছা করে শায়েস্তা করেছি।গাইতে উঠেছিল স্টেজে। ওর কাছ থেকে টাকা নিয়ে বস্তির ফেরেববাজ গুলোকে দিয়ে বলেছি হলের পিছনে বসে টিটকিরি মারবি।ওলির যা কনফিডেন্স এতে ও সব শুনে আর দ্বিতীয় দিন গান গাইতে পারবে না আর পারফর্ম করা তো দূরে থাক!”
ওর বাহুর বন্ধনে আবদ্ধ ওর প্রেমিকা সুনন্দা নামের মেয়েটা বলল….”বেশ করেছ।যারা নিজেদের ইনফ্লুয়েন্সে বাকিদের সর্বনাশ করে তাদের এর চেয়েও বড় শান্তি হওয়া উচিত। “
ওলি তখন শক্ত কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে। হাত পা হিম।ধীরে ধীরে যখন ওর দোতলার ঘরে আর না ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে তখন একতলার একটা ঘর থেকে শুধু শুনেছে এক বয়স্ক ভদ্রলোক আর মহিলার মাঝের টুকরো কথা…”ছেলে কি শুরু করেছে?নিত্য নতুন মেয়ে?”
…”জানি না বাপু।তবে মেয়ে গুলোই বা কি?তোদের লজ্জা নেই সব কটা মিলে একজনকে ধরে ঝুলে পড়ছিস!মানছি, বাবু আমার দেখতে ভালো। ওমন পেটানো চেহারা অমন কৃষ্ণ ঠাকুরের মতন মুখ…”
…”স্বভাবটাও তাই কৃষ্ণ ঠাকুরের মতন কি বল?”
ওরা হাসাহাসি করছিল।… “এই এখন আবার একজন নেবে গেল।কে ছিল কে জানে!দাঁড়াও দেখি!”
ওদের আর দেখা না দিয়ে ওলি এক রকম ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরে এসেছে।ভেবে গেছে কথা গুলো। বারবার। ভেবেছে ওলি কি করল? দোষ কার?ওলির নির্বুদ্ধিতার না ওলির সরলতার? নাকি প্রেম মানেই ঠকা?
এরপরেও ছেলেটা নিরিহের মতন আবার যোগাযোগ করেছে।ফোনে না পেয়ে বাড়ি পর্যন্ত এসেছে।ওলি তখন ওর ফোন পেরলেই ঘাবড়ে যেত।নার্ভাসনেসে হাত পা কাঁপতে থাকত।মনে হত যে অকারণে মনে এমন বিদ্বেষ রাখতে পারে সে প্রকৃতপক্ষে কতটা হিংস্র?
কিন্তু আশ্চর্য এক ঐশ্বরিক বলে ওলি সামনা করেছিল ছেলেটার।যেদিন সে বাড়িতে এসেছিল ওলি ওর মুখের উপর চেয়ে বলেছিল…..”জানিস একটা প্রোগ্রাম করতে গিয়ে আমি কুকুরদের খুব ভালো করে চিনেছি তবে তাদের সঙ্গে শুয়োদের যে একটা তফাত আছে সেটাও বুঝতে শিখেছি। আসলে বিষ্ঠা উভয়ের খাদ্য ঠিকই কিন্তু প্রভু ভক্তের দিক দিয়ে কুকুর সেরা। এখন আমি ভাবছি তোর সঙ্গে মিলটা কার?”
ভুরু কুঁচকে সে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছে…”কি বলতে চাইছিস কি?”
…”বলতে চাইছিলাম মানুষ তো তুই নস।কুকুর বিশ্বস্ত।তাও নস।তিবে কি শুয়োর? “
…”ওলি..”বলে সে গর্জে উঠেছিল।
ওলি সতেজে বলেছে….”শুয়োররা কখন চেঁচায় জানিস?যখন লোহার গরম শিক ওদের গলায় ঢোকান হয়।ভুলে যাস না আমার বাবা এর আগে আমার হয়ে ইনফ্লুয়েন্স খাটায়নি বলে সত্যিই কখনো খাটাবে না।আর তা খাটালে তোকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।কিন্তু তবু আমি তোকে ছেড়ে দিলাম কিন্তু তুই আমাকে ভুলে যাওয়ার ভুল করিস না কোনও দিন!”
ওলি বুঝতেও পারে না ও কথা গুলো কি করে বলল!কে বলালো ওকে ওসব কথা।কারণ স্বভাবগতভাবেই ও শান্ত নিরিহ।আজ পর্যন্ত কাউকে মুখের উপর কিছু বলতে পারেনি।সেখানে এমন হুমকি দিল কি করে?
ওলির মুখের পরিবর্তন দেখে ছেলেটি সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছিল।একেবারে নিরিহ ভালো মানুষটির মতন মুখ নিচু করে চলে গেছে।
তার কয়েকদিন পর ওলি খবর পেয়েছে সুনন্দা নামের মেয়েটা সুইসাইড অ্যাটেম্পট করার চার্জে অ্যারেস্ট হয়েছে ওলির একদা অতি প্রিয় মানুষটি।
ওলি এই বিষাদের ঘোর রাত্রি থেকে যেন বেরিয়ে আসতেই পারছে না।এতে গানেরও ক্ষতি হচ্ছে।ক্যরিয়ার প্রভাবিত হচ্ছে।অথচ যার জন্য ওলির এত ক্ষতি এত কষ্ট দিনের শেষে সে কিন্তু কেউ নয়।সে শুধুই ওলির ভুল..আর এই ভুলের পিছনে ওলিকে সময় অপচয় করতে হচ্ছে।
এ কি মানা যায়?
সব শুনে অরিত্রর মেজাজটা হল ঠিক সেই রকম যেমনটা হয় রোদ ঝলমলে আকাশে উটকো কালো মেঘের আচমকা আগমন দেখলে।
ওলির মুখে একটু হাসি ফোটাতে অরিত্র টেবিলের উপর রাখা একটা টিস্যু পেপার টেনে নিয়ে ওয়েটারকে ডেকে একখান পেন চেয়ে নিয়ে বলেছে…”তোমার কথা শুনে বুঝলাম ছেলেটি তোমার যোগ্যতাকে যথেষ্ট ভয় পেত এবং নিজের অকর্মণ্যতাও জানত সেই থেকে তোমার উপর হিংসে আর তোমার ক্ষতির পরিকল্পনা। মোটের উপর এইটুকু বুঝছি তোমার যোগ্যতা আছে তার জন্য তোমার গান শোনার দরকার পড়বে না।কিন্তু একটা কাজ আগের থেকে সেরে রাখতে চাই।কে জানে পরে সুযোগ হবে কি না?”
ওলি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে….”কি বলত?”
…”অটোগ্রাফ প্লিজ ম্যাডাম…”
অরিত্রর চেষ্টা সফল হয়েছিল।আবার সেই সুরের ঝঙ্কারের হাসি।দু হাত নেড়ে ওলি বলছে…”ওরে বাবা।আমি মোটেই সেই লেবেলের লোক নই!”
…”আহা একটা তো মাত্র সই।দিয়েই দিন না ম্যাডাম…”
গোট গোট অক্ষরে ওলি ওর নাম লিখল..”ও লি..”
…”’ও’ কেন?আমি জানতাম বানানটা অলি!যার দুটো অর্থ এক ভ্রমর।যা তোমার চোখের সঙ্গে যায় আবার রক্ষক।কিন্তু ‘ও’ দিয়ে কি হয়?”
ওলি চোখ গোল করে বলল….”বাব্বা বাংলা ব্যাকারণ নিয়ে বেশ চর্চা আছে দেখছি?কিন্তু নামটা তো বিশেষ্য পদ।সেখানে কিন্তু বানানের অত কড়াকড়ি নেই।তবে উচ্চারণটা ঠিক থাকলেই হল।অনেকে আবার বলতে পারে তবে যেখানে ‘স’এর প্রয়োগ করা হয় সেখানে ‘ষ’এর প্রয়োগ করলে কেমন লাগবে?বা ‘র’ এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘ড়’ কি ‘ঢ়’!সেখানে বলব সামান্য আকার ইকার হস্যুকার দীর্ঘুকারের রদবদল করলে তা উচ্চারণের বদল হয় না কিন্তু বানানের বিকৃত রূপ তা বলে কখনই গ্রহণযোগ্য হয় না!”
অরিত্র মাথা নেড়ে বলেছে…”মানে অলি তবে কি গান শিখে ওলি হয়ে গেছে?”
কথাটায় আবার খিলখিল করে হেসেছে ওলি।
যাক শেষে যে মেয়েটা হাসল এটাই ভাললাগছে অরিত্রর।হেসেছে ও এর আগেও।কিন্তু তখন অরিত্র ওর মনের ভিতরের এই অন্ধকার দিকটা সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞাত ছিল।সে হাসি কতটা সৌজন্যতার কতটা ওর স্বভাবের আর কতটা শুধুই কষ্টকে চাপা দেওয়ার তা জানত না অরিত্র।তবে সব কিছু অরিত্রকে বলার পর ও যখন প্রাণ খুলে হাসল তখন অরিত্রর মনে হচ্ছিল শ্রাবণের আকাশের মেঘ ঠেলে চিকমিক করছে রোদ্দুর।
এখন এও বুঝতে পারছে কেন ইশিকাদি এত জোর করছিল ওলির সঙ্গে অরিত্রর দেখা করাতে।কারণ হয়তো ইশিকাদি বুঝতে পারছিল ওলির এমন একজনকে দরকার যার সঙ্গে বিনা দ্বিধায় নিজের মনের কথা খুলে বলতে পারে মেয়েটা।যাকে বিশ্বাস করা যায় আবার পূর্বপরিচিতর কারণে ইমেজ নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও হ্যাপাও পোহাতে না হয়।
আজকের ব্যতিক্রমী সকালটার চিন্তা আপাতত স্থগিত রেখে অরিত্র বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। এখন পৌঁছে গেছে মানিকতলার এফ বাই ১২২ ব্লকের শ্রীতমা অ্যাপার্টমেন্টে। সঙ্গে মা আছেন।অরিত্রর বুকটা দুরুদুরু করছে।একতলাটা দোকান। দোতলায় ওরা থাকেন।একতলার প্রথম ল্যান্ডিংটা পেরতেই অজস্র লোকের ক্যাচর ম্যাচরে বুকের ভিতরটা আরও জোরে জোরে বাজনা বাজাচ্ছে।এত লোক কোথায়?অরিত্র সম্বন্ধ দেখতে এসেছে না বিয়ে করতে?
ফ্ল্যাটে ঢোকার মুখে দরজার দু পাশে ছাড়া জুত আর লেডিজ স্যান্ডেলের স্তূপ।দরজা খোলা।দরজার উপর ডেকরেটেড ঝালর ঝোলানো। পর্দা দু পাশে রোল করা।সামনে দেখা যাচ্ছে শ্বেত পাথরের মেঝে আর কাঠের আসবাব। বার্নিশ চকচক করছে।অরিত্ররা দরজার কাছে এসে দাঁড়াতে এক লম্বা চওড়া মাঝ বয়সী ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন।উচ্চ কন্ঠে হাসছেন।হাসিটা কানে লাগছে অরিত্রর।চওড়া ভারী হাতটা অরিত্র কাঁধে রেখে দু বার চাপড়ালেন…”এই তো! এই তোরা কোথায়?অরিত্র আর ওর মা এসে গেছেন!”
অরিত্র চমকাল।মানে ইনি ওকে চেনেন।চেনেন কারণ ওর ছবি দেখেছে বলে।আর অরিত্র যে এই কদিনের ঝামেলায় ভুলেই গেছে মেয়ের ছবি দেখতে। এখন এত গুলো লোকের মাঝে কে আসল পাত্রী অরিত্র বুঝবে কি করে?এরা যদি আলাদা করে পরিচয় করিয়ে না দিয়ে সকালের সঙ্গে মিলে মিশে কথা শুরু করে দেয়?এদের রকম দেখে যেন কেমন কেমন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে না এরা খুব একটা সৌজন্যতা বা পোশাকী আদব কায়দার ধার ধারবে বলে!হুট করেই হয়তো কথা শুরু করল…অরিত্রর এখন কদিন আগের কনফিউশানটার কথা মনে পড়ছে।মনে পড়ছে শ্রুতি আগরওয়ালের কথা।
আজও কি তাই হবে?
ভদ্রলোক এক সঙ্গে অনেক গুলো নাম ডাকলেন….তরু মৌ টুশকি টুম্পা কই রে সব..
অরিত্রর ঘাম হচ্ছে।জল তেষ্টাও পাচ্ছে।
ড্র্যয়িং কাম ডাইনিং হলের সোফায় বসেছে মা আর অরিত্র। ভিতরের ঘর থেকে চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে।সামনে চেয়ার নিয়ে বসে দু জন হৃষ্টপুষ্ট চেহারার মাঝ বয়সী ভদ্রলোক। এক জনের মাথায় টাক অপর জনের মাথায় কাঁচা পাকা চুল।অরিত্র দিকে তাকাচ্ছে মিটিমিটি হাসছে আবার পা নাচাচ্ছে।অরিত্র এদের কার সঙ্গে কি সম্পর্ক কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।পাশে বসা মায়ের দিকে চেয়ে ভাবল এখন তো ছবি দেখার আর চান্স নেই।কারণ ওরা বারবার বলেছে ছবি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাবে না। হাতে হাতে দেখতে হবে তাই ঘটক মারফত ফোটো পাঠিয়েছিল।অরিত্র দেখেনি।
এখন?
না ছবি নয় নাই দেখল।কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতি হবে তাও তো বোঝেনি।এবার কি করবে?গলা যে শুকিয়ে কাঠ।
তবে কি জল চাইবে?
©রিমা বিশ্বাস
চলবে….